দুঃখবোধ

দুঃখবোধ

সকলের মাঝে বিস্ময়। শংকা, আবেগ উৎকণ্ঠা। আশা, চেতনা, উৎসুক দৃষ্টি। লোকজন একটা বিষয় নিয়ে সব জায়গায় আলোচনা করছিলো।

সেটা হলো ফারাও চিওপসের মনে এখন কি হতে যাচ্ছে। সম্রাট খুব মনমরা হয়ে আছেন। অতীতে তার একবার কি দু বার এমন হয়েছে যে বড় কোনো অনুষ্ঠানের পরও তার মনের ভেতর কেমন একটা দুঃখবোধ কিংবা বিষণ্ণভাব থাকতো।

কিন্তু এখন শুধু তিনি বিষণ্নই নন, মনে হচ্ছে তার মনের দুঃখটা সাহারা মরুভূমির চেয়েও বড়। আর সেই দুঃখের মরুভূমির প্রতিটি বালিকণা তাকে কষ্ট দিচ্ছে।

একটা দীর্ঘ সময় তিনি বোঝার ভান করলেন যে, প্রকৃতই তার রাষ্ট্রে কোনো কিছুই ঘটে নি। তবে শেষ পর্যন্ত তার ভাবনাটা আর স্থির থাকলো না। তিনি বুঝতে পারলেন এই পিরামিডই তার মনোকষ্টের একমাত্র কারণ।

এখন এই পিরামিডটা শেষ হয়েছে। আর এটা তাকে আকর্ষণও করছে। তিনি অনুভব করতে পারছেন এর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।

এক রাতে তিনি ঘর্মাক্ত অবস্থায় ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। চিৎকার করতে লাগলেন, ‘পালাও! পালাও! কিন্তু তিনি কোথায় পালাবেন, কোথায় যাবেন। পিরামিডটা মতো উঁচু আর মতো লম্বা যে তাকে সব জায়গা থেকেই এটা ডাকতে থাকবে আর বলতে থাকবে, ‘হেই চিওপস, তুমি কোথায় যাওয়ার চিন্তা করছো? ফিরে এসো।’

তিনি অনেক লোককে পিরামিড তৈরিতে দেরি হওয়ার কারণে শাস্তি দিয়েছিলেন। আবার অনেককে ঠিক উল্টো কারণে পিরামিড তৈরির কাজ খুব দ্রুত করার কারণে মৃত্যু দণ্ড দিয়েছেন। তারপর আবার দ্রুত কাজ করার কারণে শাস্তি দিয়েছেন। কখনো কখনো কোনো কারণ ছাড়াই শায়েস্তা করেছেন।

যেদিন তার লোকেরা পিরামিড তৈরি সম্পন্ন হওয়ার ঘোষণা দিতে এলো সেদিন তিনি এতো অবাক হয়েছিলেন যে, কথা বলার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তার এই অবাক করা নিশ্চুপ ভাব থেকে বার্তাবাহকরা বুঝতে পারছিলো না যে তারা এখন কী করবে।

তারা ভালো একটা কথা, কিংবা একটু উচ্ছ্বাস, অথবা কম করে হলেও বাদশার কাছ থেকে একটু ধন্যবাদের বাণী আশা করছিলো।

কিন্তু চিওপস একটা কথাও বললেন না। তার ঠোঁট দুটো বন্ধ করে মূর্তির মতো বসে রইলেন। তার চোখ দুটো ছিলো নিষ্পলক। তার বরফের মতো ঠাণ্ডা মনোভাব দেখে বার্তাবাহকরা এতোই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো যে, মনে হয় তারা মৃত্যুকূপের সামনে ঝুলে আছে।

কেউ সাহস করলো না ফারাওকে বলতে যে, তিনি পিরামিডটা দেখতে যাবেন কি না। তার মনের কথাটি কী?

এভাবেই একটু একটু করে প্রাসাদে রাতের পরে সকাল হলো। কিন্তু মনে হলো প্রাসাদে মৃত্যুর শোক বিরাজ করছে। কেউ আর দ্বিতীয় বার ফারাও এর সামনে পিরামিডের বিষয়ে কিছু বলার সাহস করলো না।

পিরামিডকে নিয়ে ফারাও চিওপসের বিপরীত সব অনুভূতি ম্লান হতে থাকলো। কখনো তিনি পিরামিডটার প্রতি অনেক ভালোবাসা আর আকর্ষণ অনুভব করতেন আবার কখনো তিনি ঘৃণা অনুভব করতেন। কখনো পিরামিডের জন্য তার প্রাসাদটাকে অসহ্য মনে হতো আবার কখনো পিরামিডটা অসহ্য মনে হতো।

মাঝে মাঝে তার কিছু দিন এমন হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতে যেতো যে তার মনে হতো পিরামিডটা ক্ষণে ক্ষণে তাকে ডাকছে। তিনি অনেকবার তার ঘুমানোর জায়গা পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু তিনি যেখানেই যান না কেন এ ডাক থেকে মুক্তি পাচ্ছিলেন না। কেবল তাকে গ্রাস করছিলো।

এক জোছনা মাখা রাতে তিনি পর পর কয়েকটা রাত প্রধান রাজ যাদুকর ডেজডির সাথে কাটালেন। জড়ানো গলায় ডেজডি ফারাওকে প্রশান্ত করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। এছাড়া আর কী করা যায় তাও ভাবছিলেন।

তিনি ফারাওকে মানুষের দ্বৈতসত্ত্বার কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন যে, প্রতিটি মানুষেরই দুটো সত্ত্বা আছে। তার ছায়া সেই দ্বিতীয় স্বত্ত্বারই একটি অংশ।

চিওপস আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো ডেজডির প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে। কিন্তু তার মন শুধু ঘুড়ে বেড়াচ্ছিলো। হঠাৎ করেই কথার মাঝখানে সে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘আমি নিজ হাতে আমার ধ্বংসের প্রস্তুতি করেছি।’

ফারাও-এর এই বক্তব্যে যাদুকর ডিজডিকে তেমন বিচলিত বলে মনে হলো না।

তিনি বললেন, ‘আমি মনে করি আমরা এই যে বেঁচে আছি এটা কেবল মারা যাওয়ারই প্রস্তুতি মাত্র। আমরা মূলত যতো তাড়াহুড়ো করবো বেঁচে থাকার জন্য ততো দ্রুত আমরা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবো। আপনি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমাধি ক্ষেত্রটা বানিয়ে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে যে এই পৃথিবীতে আপনার নামটা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। পৃথিবীর আর কোনো সমাধিক্ষেত্র আপনার জন্য উপযুক্ত না।’

‘কিন্তু আমি খুব মনোকষ্টের মাঝে আছি।’ চিওপস বললো।

যাদুকর খুব দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলো। তারপর সে নিজের মনের ভেতরের গোপন দুঃখের কথাগুলো স্বীকার করে বলতে থাকলো।

‘দেখুন এই আমি, আমি কিন্তু আমার জীবনের কোনো কিছুই ভুলি নি। এমন কি আমি এখনো আমার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়ে যে অন্ধকারে ছিলাম তার কথা মনে করতে পারি। আমার দুঃখ একমাত্র আমিই বুঝি। এই বিষয়ে আমি কাউকেই বিশ্বাস করি না। তোমার দুঃখ সেটা আরেক ভুবনের। সেটা এক নক্ষত্রের কষ্ট।’

‘আর কোনো দুখের বিষয়ে আমার জানতে ইচ্ছে হয় না।’ ফারাও কথার মাঝখানে বাঁধা দিয়ে বললো। ‘আমি এখন নক্ষত্রকেও ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছি।’

‘ঠিক আছে, সেটা খুবই ভালো কথা।’ যাদুকর বললো, ‘এখন তুমি মুক্ত যা ইচ্ছে তুমি করতে পারো।’

চিওপস বিরক্তিতে তার হাতের আঙুলের গিটগুলো একবার মটকালো।

আবার কথা বলা শুরু করলো। কিন্তু কী বিষয়ে কথা বলছিলো সেটা মোটেও পরিষ্কার ছিলো না। অস্থিরভাবে হাঁটাহাঁটি করতে করতে হঠাৎ করেই সে খুব ভয়ঙ্কর একটা প্রশ্ন করে বসলো।

‘আচ্ছা আমরা কি পিরামিডের ভেতর অন্য কারো শবদেহ রেখে এটার সাথে প্রতারণা করতে পারি না?’

তার প্রশ্ন শুনে ভয়ে প্রধান যাদুকর ডিজডির মুখ সাদা হয়ে গেলো। সে তার চোখ দুটি আরো বড় করে ফারাও-এর দিকে তাকালো।

কিন্তু ফারাও তার অবস্থানে শান্ত ছিলো। সে অনেক ভেবে-চিন্তে এ প্রশ্নটা করেছে। তিনি একটার সম্ভাবনার কথা ভাবছিলেন। সেটা হলো তার শত্রুরা কি কখনো পিরামিডের ভেতর থেকে তার মৃত দেহটা সরিয়ে সেখানে অন্য কারো মৃত দেহ রাখতে পারে?

ফারাও প্রশ্নটা করে এমন শান্ত মেঘ চোখে ডিজডির দিকে তাকিয়ে থাকলো যে ডিজডির মনে হচ্ছে এখনই তাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে।

ফারাও ভবিষ্যতে মমি করা মৃতদেহটা পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কিনা সেই বিষয়টা নিশ্চিত হতে চাইছিলো। সে জন্য সে বারবার প্রশ্ন করছিলো যে পিরামিডের সাথে কোনোভাবে প্রতারণা করা যায় কি না। এ কাজটা কেউ করতে পারবে কি না।

কিন্তু ফারাও যতোবারই এই প্রশ্ন করছে ততোবারই যাদুকর ডেজডি ভাবছে যে সম্রাট হয়তো পরিকল্পনা করছে পিরামিডের ভেতর সম্রাটের নিজের শবদেহের পরিবর্তে অন্য কারো মৃত দেহ রাখার। এ জন্য বারবার তিনি এই এক বিষয়ই জিজ্ঞেস করছেন।

যাদুকর এক দৃষ্টিতে চিওপসের দিকে তাকিয়ে নিজের উদ্বেগটুকু লুকানোর চেষ্টা করছিলেন। তারপর গভীর একটা শ্বাস টেনে বললেন, ‘মাননীয় সম্রাট পিরামিড নিয়ে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমাদের হাতে এখনো অনেক সময় আছে। আমরা অপেক্ষা করতে পারি।’

ফারাও তার কপালটাকে একটু ঝাকালো। কপাল বেয়ে ঠাণ্ডা ঘাম ঝরে পড়লো। তিনি চিন্তা সাগরে সাঁতার কাটছেন।

তারপর সে বললো, ‘না। আমার প্রিয় যাদুকর অপেক্ষা করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। ‘

শেষ পর্যন্ত ফারাও-এর মানসিক অস্থিরতা আর দৈন্যতার বিষয়টা গোপন রাখা হলো। মাঝে মাঝে তার অবস্থা এমন খারাপ হয় যে তিনি সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। আবার কখনো কখনো কোনো রাতগুলোতে ফারাও তার স্মৃতি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন। তিনি সব কিছু ভুলে যান। বিশেষ করে যে রাতগুলোতে তিনি যাদুকর ও পণ্ডিত ব্যক্তি ডেজডির সাথে অতিবাহিত করেন।

চিওপস ঘোষণা করলো যে, সে বেঁচে থাকতেই পিরামিড দেখে আসতে চায়। এর ভেতরটা দেখতে চায়।

সুপণ্ডিত ডেজডি আপ্রাণ চেষ্টা করলেন চিওপসকে বোঝাতে তিনি যেনো পিরামিডের ভেতর না যান। কাজটা খুব সহজ ছিলো না সম্রাটকে বোঝানো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। এক রাতে মাত্র একজন দেহরক্ষী নিয়ে যাদুকর পণ্ডিত ডেজডি ফারাও কে সাথে নিয়ে পিরামিড দেখতে গেলেন। সেই সাথে তিনি উদ্বিগ্নও ছিলেন।

রাতটা ছিলো খুব নীরব। পিরামিডের ঢাল বেয়ে চাঁদের আলো দুধের স্রোতের মতো উপর থেকে নিচে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো। চাঁদের সেই আলোতে সমস্ত মরুভূমি জুড়ে বিচিত্র এক দৃশ্য তৈরি হয়েছে।

চিওপস ঠাণ্ডা মেঘের মতো নিষ্প্রাণ চোখে চুপচাপ পিরামিডের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকলো। তারপর এক সময় বিড়বিড় করে যাদুকরকে বললো, ‘আমার মনে হচ্ছে সে আমাকে চায়।’

পরবর্তী দিনগুলো চিওপসের জন্য আরো খারাপ গেলো। সে আরো গভীর উৎকণ্ঠা আর বিভ্রান্তিতে সময় কাটাতে থাকলো। মাঝে মাঝে সে তার মাথার উপর দিয়ে হাতটা এমন ভাবে নাড়াতো যে মনে হতো সে নিজেই নিজের সাথে কোনো একটা কিছুর হিসাব মেলাচ্ছে। নিজেকে জিজ্ঞেস করছে কেনো সে কিছুই করতে পারে নি।

তার আশপাশে যারা থাকতো তারা কিছুতেই ফারাও-এর কথা-বার্তার কোনো কিছুই বুঝতে পারতো না। কেবল শুনতো আর শুনতো।

ফারাও মারা গেলো পিরামিড তৈরি শেষ হওয়ার ঠিক তিন বছর পর।

সে মারা যাওয়ার ষাট দিন পর যখন অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান শেষ হলো তখন তার মমিকৃত শরীরটাকে একটা পাথরের খাটিয়াতে বহন করে বের করে নিয়ে আসা হলো। প্রাসাদের বাইরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ অপেক্ষা করছিলো ফারাও এর দেহটাকে পিরামিডের ভেতর রাখার সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতাটুকু দেখার জন্য।

পিরামিডটা এখন মমিকৃত শবদেহটা গ্রহণ করলো। তার সমস্ত অর্জন আর চাহিদা এখন সম্পূর্ণ হলো। অনেক দুর্ভাগ্যের জীবন, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা, অনেক ধৈর্যে আর শ্রমের পর এটা এখন আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বিজয়, উদ্ধত বেশে। সূর্যের আলোতে এর চূড়াটা চক চক করছে। ঝলমলে আলো তার রশ্মি ছড়াচ্ছে।

জনতার বিশাল একটা অংশ পিরামিডের গোড়ায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে এর দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে মুখে অনেক দুঃখ বেদনা হতাশার স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত। বিশেষ করে সেই সমস্ত পরিবারের লোকজন যাদের পরিবার থেকে একজন একজন করে পিরামিড তৈরির কাজে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। এ সমস্ত পরিবারের লোকজন আজ পিরামিডের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সেই সময়কার দুঃখ-ভারাক্রান্ত স্মৃতির কথা মনে করার চেষ্টা করছে যখন তাদেরকে পরিবার থেকে বলপূর্বক পিরামিড তৈরির কাজে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো কিংবা অমান্যকারীকে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো নির্বাসনে। তারা আরো ভাবছিলো যে, নির্বাসনে পাঠিয়ে কী পরিমাণ অত্যাচার আর নির্যাতন করা হয়েছিলো তাদের উপর। আজ পিরামিডটা কতো উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পিরামিডটা যতো উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে তাদের স্মৃতিগুলো ততো দূরে সরে যাচ্ছে। তারা এখন অনেক দূরে হয়তো কোনো নাম না জানা মরুভূমিতে পড়ে আছে বালির নিচে যেখান থেকে তারা আর কখনো ফিরে আসবে না।

এক শীতের সকালে নতুন ফারাও ডিডোফরি তার নিকটের মন্ত্রিপরিষদ আর পরমার্শক সভার কাছে নিজের জন্য নতুন আরেকটি পিরামিড তৈরির সংকল্প ব্যাক্ত করলো। সেখানে চিওপসের আরেক ছেলে ছেফরান এবং তার একমাত্র মেয়ে হেনসেনও উপস্থিত ছিলো যে দীর্ঘ দিন তার মন্দ স্বভাবের কারণে প্রাসাদের ভেতর পা রাখার অনুমতি পায় নি। এটাই ছিলো তার বড় অপরাধ।

সকলেই বেশ দুঃশ্চিন্তার সাথে নতুন ফারাও এর এই ঘোষণাটা শুনলো। সম্রাট অবশ্য পিরামিডটার উচ্চতা, দৈর্ঘ্য, ঢালু কেমন হবে কী রকম হওয়া উচিৎ, তিনি কেমনটা চান এই বিষয়ে তেমন কিছুই উল্লেখ করেন নি। উপস্থিত সভাসদবর্গ বুঝতে পারছিলেন না ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না কি মন্দ হচ্ছে।

সেই আলোচনায় ফারাও এর একমাত্র মেয়ে হেন্টছেন অন্যান্য সবার আচরণে তার বিরক্তির ভাবটুকু গোপন করতে পারলেন না। পরে অবশ্য লোকজন বলাবলি করতে লাগল যে হেন্টছেন তার বাবার মতো নিজের জন্য একটা পিরামিড তৈরি করতে চায়। বাজারে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো যে হেন্টছেন তার প্রেমিকদের কাছে পিরামিড তৈরির জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পাথর দাবী করছিলো। লোকজন তখন এই ভেবে অবাক হচ্ছিলো যে পিরামিড তৈরিতে কী পরিমাণ পাথর দরকার আর রাজকুমারীর কতো সংখ্যক প্রেমিক রয়েছে। তারা যোগ বিয়োগ করতে উঠেপড়ে লাগলো।

মানুষের মুখে মুখে এ নিয়ে আরো নানা ধরনের কথা চালু ছিলো। তারা এ পিরামিডটাকে বলতো স্ত্রী পিরামিড। কেউ কেউ বলতো হেন্টছেনের ছায়ামূর্তি। হেন্টছেন অবশ্য এ সমস্ত মন্তব্য কানে তুলতো না। সে হাত দিয়ে বাতাস তাড়াবার মতো এই সমস্ত কথা-বার্তা উড়িয়ে দিতো। তাদের কথা বার্তায় সে তেমন বিরক্ত হতো না। বরং উল্টো তার একটা মন্তব্যে সে পুরো মিশর জুড়ে আরো খ্যাতি পেয়ে গেলো।

সে বলেছিলো, “মিশরের মেয়েরা যখন কামশীতলতায় ভুগছে তখন আমার ভালোবাসা তাদের প্রতি। হতে পারে এ পিরামিড প্রমাণ করবে যে আমি মিথ্যা দম্ভ করছি না।

নতুন ফারাও যখন তার বক্তৃতা প্রায় শেষ করে আনছিলো তখন তার ছোট ভাই ছেফরান ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় জ্বলছিলো। সে মনে মনে বলছিলো, আহ! আমার সময়টা আসতে দাও। একবার আসতে দাও, দেখ আমি কি করি।’

তারপর একদিন সেও যখন ফারাও পদে অধিষ্ঠিত হলো তখন সেই দিনের ভাবনাটা তার মনের ভেতর কেমন এক ধরনের বিষণ্ণ ভাব তৈরি করলো। কেন জানি তার চোখ ভিজে উঠলো। যেদিন তার নিজের পিরামিড তৈরি করা শেষ হলো তখন লোকজন দেখলো কী এক আচানক বস্তু সে তৈরি করেছে। আর সে পিরামিডের ভেতর আবিষ্কার করলো এক অদ্ভুত চুলের স্ফিংস বা সিংহ মূর্তি। সে মূর্তিটাকে ভক্তি করে পুজো করলো। তার মাথার অদ্ভুত দর্শনের চুল দেখে বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলো তুমি এই রকম চুল কেন রেখেছো?

সে বন্ধুদের কথা শুনে রহস্যময় ভাবে মুচকি হাসি দিলো।

পরবর্তীতে সে নিজেও পিরামিডের মূল ভূমিতে সামনে বিশাল এক মূর্তি স্থাপন করলো যার মুখ মণ্ডলটা সিংহের মতো। অবিকল সিংহের অবয়ব।

পরিব্রাজকরা এর সামনে এসে জিজ্ঞেস করতো, ‘তুমি কি সেফরান?’ ‘তুমি কীভাবে ফারাও হলে?’ ‘ডিজেফুর সাথে তুমি কী করেছিলে?’

কিন্তু আমরা তো জানি এই সিংহ মূর্তিটা কখনোই কোনো উত্তর দিবে না।

সে উত্তর দিতে পারে না।

তার উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

সে কেবলই পাথর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *