নির্মাণের ধারাবাহিকতা
পঞ্চম ধাপ, একশো সাতানব্বই থেকে একশো নব্বই পাথর,
নিয়ন্ত্রক জেনারেল ইসেসি
আসওয়ান এলাকা থেকে এসেছে একশো সাতানব্বইটি পাথর।
রিপোর্ট করার মতো বিশেষ কিছু নেই।
সিংহ মূর্তির মাথা উত্তোলন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বিষয়টা স্বাভাবিক। সৈন্য অবস্থা। রাজনৈতিক কোনো গুরুত্ব নেই। চিহ্নিত করার মতো বিশেষ কিছুই নেই।
একশো ছিয়ানব্বই পাথর এসেছে কারনাক এলাকার পাথরখাদ থেকে। পাথরগুলো উপরে ওঠানো বেশ কঠিন আর জটিল।
পাথরগুলোতে কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরিত চিহ্নের নির্দেশ। রিপোর্ট করার মতো আর কিছু নেই।
পাথর শ্রমিক সেবু বিশাল পাথর আর কাঠের চাঁইয়ের ভেতর যে আর্তনাদ শুনেছিলো তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নি।
একশো পঁচানব্বই পাথর আনা হলো এলবেরিশার পাথর খাদ থেকে। পাথরগুলো দেরি করে উত্তোলন করায় রহস্যময়ভাবে আত্মহত্যা করলো প্রধান পাথর শ্রমিক হাপিডজেফা। তার মৃত্যুতে অন্যান্য পাথরশ্রমিকদের কৌশল ছিলো বলে মনে করা হয়।
এলবেরিশার পাথর খাদ থেকে পাথর আনার সময় মরুভূমিতে খুবই দুবোর্ধ্য আর রহস্যময় অবস্থায় মারা গেলো চারজন। মতো কিছুর পরও পাথর ওঠা-নামার কাজ ঠিকই চলছিলো। তবে সবশেষে একজন শ্রমিকের হাত কাটা পড়লো। এতে অবশ্য তার অসাবধানতাই দায়ী ছিলো।
একশো তিরানব্বই নাম্বার পাথর আনা হলো কারনাক এলাকা থেকে।
একশো বিরানব্বই পাথর এলো অসওয়ান অঞ্চল থেকে। কোনো বিশেষ চিহ্ন না থাকায় এগুলো কাঠের দোলনা দিয়ে উপরে তোলা বেশ কঠিন ছিলো।
থেবস এলাকা থেকে এসেছে একশো একানব্বইটি পাথর। একটা পাথরে ফুটকি চিহ্ন থাকায় বিশেষ নির্দেশে সেটাকে পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তবে পাথরের রক্ষণাবেক্ষণে যে ছিলো সে দাবী করলো পিরামিড তৈরিতে পাথর উত্তোলণের সময় এ দাগগুলো হয়েছিলো। ফলে এগুলোর পরিবর্তে পুনরায় একশো একানব্বইতম পাথর আনা হলো ইলহান অঞ্চলের পাথরখাদ থেকে। এ পাথরগুলো কিছুটা লালাভ থাকার কারণে এগুলোকে উপাধি দেওয়া হয়েছিলো ‘রাডি’ নামে। এ বিষয়ে আর খুব বেশি রিপোর্ট করার মতো কিছু নেই।
একশো নব্বইতম পাথর আনা হলো এবিউজির পাথরখাদ থেকে। বিশেষ কিছু উল্লেখ করার মতো এখানে নেই। এগুলো সাধারণ, স্বাভাবিক এবং পরিচিত।
নির্মাণের ধারাবাহিকতা :
তৃতীয় ধাপ, সাতচল্লিশ থেকে চুয়াল্লিশ পর্যন্ত। নিরাপত্তাকর্মীদের রিপোর্ট। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সিবিপিপি’র পার্শ্বনোট।
সাতচল্লিশতম পাথর। আসওয়ান অঞ্চলের পাথর খাদ থেকে আগত। সর্বশেষ নির্দেশ অনুযায়ী বহনের সময় ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার নির্দেশ। পাথর বহনের সময় অনেকেই দিব্যি কেটে অভিশাপ দিচ্ছিল পাথরগুলোকে।
‘আমার বুক যেভাবে ফেটে যাচ্ছে সেভাবে তুমিও বিদীর্ণ হবে।’
তুই টুকরো টুকরো হয়ে যা। নরকের অতল তলে ভূপাতিত হ।’
কাউকে কাউকে আবার আশীর্বাদ করতে শোনা গেলো।
‘অদৃষ্টকে ধন্যবাদ যে শেষ পর্যন্ত তুমি ঐ চুড়ায় বসতে যাচ্ছো।’ ‘হে পাথর তুমি দীর্ঘজীবী হও।’
পাথরগুলো উত্তোলনের সময় তেমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নি।
ছিচল্লিশতম পাথর এসেছে কারনাক এলাকা থেকে। এখানেও সমানভাবে পাথরগুলোকে কেউ অভিশাপ দিয়েছে আবার কেউ আশীর্বাদ করেছে। একজন পাথর বহনের সময় তার সন্তান মারা গিয়েছিলো সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেছে, ‘আমি আমার সন্তানকে পিরামিডের জন্য আনন্দের সাথেই উৎসর্গ করলাম।’
পয়তাল্লিশতম পাথরও আনা হলো কারনাক এলাকার পাথরখাদ থেকে। এ পাথরগুলো নিয়েও একই রকম অভিশাপ আর আশীর্বাদের কথা শোনা গেলো।
তবে একজন ক্ষ্যাপা লোক এই পাথরগুলো নিয়ে বেশ চেঁচামেচি করলো। তার এই শোরগোল তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলো না।
(‘পার্শ্ব নোট : এই শোরগোল যদিও তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলো না। কিন্তু ঐ মূর্খ লোকটা তার চেচামেচির সময় যেনো শব্দগুলো উচ্চারণ করেছিলো তার বেশ কিছু দু মুখো অর্থ আছে। যেমন : ‘হে পাথর তুমি খুব ভাগ্যবান যে অতো উপরে তোমাকে বসানো হচ্ছে।, ‘তোমার মা আর বাবা কোথায় ঘুমুচ্ছে এখন।’ ‘নিচে নেমে আয়। একদম নিচে।’
‘একটু নড়াচড়া করো লক্ষ্মী সোনা। তুমি কি ধরে অতো উপরে বসে আছো। তুমি কি মনে করো যে তুমিই পিরামিড হবা।’ সারা দিন এ সব চেঁচামেচি করে সে অবশ্য তার কথার কোনো ব্যাখ্যা দেয় নি।)
চুয়াল্লিশতম পাথর আনা হলো এলবারেসার পাথর খাদ থেকে। এখান থেকে একমাত্র চারটা পাথর বহনের সময় নীল নদে পড়ে গিয়েছিলো। পরে সেগুলো উদ্ধার করা হয়। যার ফলে পাথরগুলোর নাম রাখা হয় ‘ড্রাউনি’। পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এগুলোকে সীলগালা করা হয়। উত্তোলনের সময় তেমন কোনো সমস্যা হয় নি।
নির্মাণের ধারাবাহিকতা:
চুড়ান্ত ধাপ, নবম পাথর থেকে পঞ্চম পাথর।
সূত্র সিবিপিপি থেকে।
নবম পাথর। লিবিয়া এবং মিশরের সীমান্তবর্তী এলাকা আবুগারব থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সিলযুক্ত করার কথা ছিলো, কিন্তু কর্তৃপক্ষ থেকে সন্দেহজনক অভিযোগ এসেছে। ধারণা করা হয়েছে যে, পাথর উত্তোলনের সময় যে পাথর খাদ থেকে পাথর সংগ্রহ করার কথা ছিলো সে পাথরখাদের পরিবর্তে অন্য পাথর দিয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। হতে পারে সেটা পুরাতন কোনো পিরামিডের পাথর। তদন্ত কমিশন তাদের তদন্তে যদিও বলেছে বিষয়টার কোনো ভিত্তি নেই। অষ্টম পাথরটাও আনা হয়েছে একই জায়গা থেকে। এই পাথরগুলো ছিলো একেবারে নিখুঁত।
সপ্তম পাথর উত্তোলন করা হয়েছে আবুগাব থেকে। এই পাথরগুলো একই জায়গা থেকে এলেও এগুলো একটু ব্যতিক্রম ছিলো। বিভিন্ন ধরনের উপনামে এগুলোকে ডাকা হতো। যেমন : ‘বড় পাথর, চওড়া পাথর, কালো পাথর, বাদাউন।’ পাথরগুলো স্থাপনের সময় পিছল খেয়ে পড়ে যাওয়ার কারণে এরকম আরো অনেকগুলো উপনাম এগুলোকে দেওয়া হয়েছিলো। কেনো পাথরটা পড়ে গিয়েছিলো তার কারণ স্পষ্ট করা হয় নি। পাথরটা প্রথম যখন একটু নড়ে ওঠে সামনে স্থাপিত সিংহ মূর্তির সাথে আটকে গেলো তখন সবাই ভেবেছিলো পাথরটা হয়তো নিচে পড়বে না। কিন্তু সবার ধারণাকে মিথ্যা বানিয়ে পাথরটা নবম স্তরে চলে গেলো। তারপর দ্রুত নিচে নামতে থাকলো। এগারোতম ধাপের পাথরগুলোকে চূর্ণ করে এটা নেমে গেলো চৌদ্দতম ধাপে। তারপর মনে হচ্ছিলো যেনো এটা পাগল হয়ে গেছে। পিরামিডের পুরো উত্তর পাশটা খুব বাজে ভাবে ঝাকুনি দিয়ে উঠলো। একশো চব্বিশতম ধাপে পাথরটা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। একটা অংশ ডান পাশে পড়ে গেলো আর একটা অংশ নিচে নেমে গেলো।
এ দুর্ঘটনায় বিরানব্বই জন মারা গেলো। আহত হলো অনেকে। অগণিত ক্ষতি হয়ে গেলো। পিরামিডের দুঃখের দিন ছিলো এটা।
ষষ্ঠ পাথরটা আনা হলো সাকারা অঞ্চল থেকে। এ পাথরটাও উত্তোলনের সময় দু জন মারা গেলো। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি হলো আগেরটার তুলনায় অনেক কম। ফলে এটাকে শুভ পাথর বলে উপাধি দেওয়া হলো।
পঞ্চম পাথরটাও সাকারা থেকে আনা হলো। তবে এখানে রিপোর্ট করার মতো তেমন কিছু ছিলো না। আগের মতো এটার বিশেষত বলে তেমন কিছু চোখে পড়লো না।
পরিশিষ্ট : সপ্তম স্তরের পাথর।
ফারাও এর বিশেষ দূতের কাছ থেকে লাল কালিতে লেখা ‘সর্বাধিক গোপনীয়’।
সপ্তম স্তরের পাথরের ভেঙে পড়ার কারণ অনুসন্ধানের বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। মূল কারণটা বের করতে গিয়ে বেশ কিছু অমিল পাওয়া গেলো যা সন্দেহের উদ্রেক করে। তদন্ত দলটি কয়েকটি বিষয়ের উপর সতর্ক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রথমত পাথরটি পিছল খেয়ে পড়ে যাওয়ার কারণ। দ্বিতীয়ত পাথর পড়ার সময় লোকজনের প্রতিক্রিয়া যেমন কেউ কেউ আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে আবার কেউ অহেতুক সাহসিকতা দেখিয়েছে। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু সন্দেহপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়।
তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট :
সপ্তম স্তরের পাথরের নড়নটা একেবারে আস্তে হয়েছিলো যে সেটা প্রথমে কেউ বুঝতেই পারে নি। শ্রমিকরা এর দিকে ঝুকে পড়েছিলো কিন্তু তারপরেও এর সরে যাওয়ার শুরুটা টের পায় নি। প্রধান পাথরমিস্ত্রী শাম কিছুটা বুঝতে পেরে মন্তব্য করেছিলো, ‘হেই কী হতে যাচ্ছে? মনে হয় পাথরটা জায়গা পরিবর্তন করছে?’
তার কথা শুনে অন্যরা ভাবলো সে ঠাট্টা করছে। কেউ কেউ তাকে তিরস্কার করে বললো, ‘তুমি নিশ্চই পাথরটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়েছো।’ আরেকজন বললো, “আসলে পাথরটা না তুমিই মনে হচ্ছে সরে যাচ্ছো।’ এ ধরনের আরো নানা ধরনের কথা-বার্তা তার সহকর্মীরা তাকে উদ্দেশ্য করে বলাবলি করতে লাগলো।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই তারা বুঝতে পারলো যে, পাথরটা নড়তে শুরু করেছে। তারা খোলা হাতেই পাথরটাকে আটকাতে চেষ্টা করলো। প্রধান পাথর শ্রমিক শাম একটা ঠেকা দিয়ে আটকাতে চাইলো। সকলেই তাড়াহুড়ো করছিলো কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাথরটা আঁকা-বাঁকা পথে উপর থেকে গড়াতে শুরু করলো।
এগারো নাম্বার ধাপে এসে এটা তার তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো। তেরো নাম্বার স্তরে পাথরটা গড়িয়ে আসার পর প্রধান তত্ত্বাবধায়ক মিস্ত্রী থিওট পাথরটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, ‘ফারাও দীর্ঘজীবী হোক।’ কিন্তু পাথরের চাপে মুহূর্তেই সে দলা পাকিয়ে মণ্ড হয়ে গেলো। তার হাত পা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো।
চৌদ্দতম ধাপে এসে এটা পুরোপুরি বেগে নিচে নামতে লাগলো। ঠিক এ সময় পাথরশ্রমিকরা চিৎকার করে বলতে থাকলো, ‘পিরামিডটা ধসে পড়ছে।’
তার কথা শুনে সবাই তখন দিক-বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ভূমিকম্পের সময় যেভাবে সবাই ছোটাছুটি করে সেভাবে দৌড়াতে লাগলো। পাথরটা কোনোদিক দিয়ে ছুটে আসছিলো সেদিকে কেউ লক্ষ্য করলো না। ফলে অনেকেই পাথরের নিচে চাপা পড়ে গেলো। পাথরটা যখন বিশতম ধাপে এসে পৌছলো তখন চারদিকে রক্ত আর মৃতদেহের ছড়াছড়ি। দূর থেকে সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। বিষয়টা মতো দ্রুত তাল রেখে ঘটলো যে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। হয়তো এখানে অন্ধকার রাজনীতির কোনো হাত আছে।
তদন্ত চলতে থাকলো।
মূল ঘটনা জানার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠলো। যা তারা আশা করে নি তা কেন ঘটলো। ভাবনার সাগরে ডুবে গেলো তারা।
ভাবতে লাগলো নিরন্তর।