একটি ছলচাতুরি, একটি অপকৌশল

একটি ছলচাতুরি, একটি অপকৌশল

প্রত্যেকটি ঝড় প্রতিটি কাল তার নিজের প্রজন্মকে নিজের মতো করেই স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে সুবিন্যস্ত করে সাজাতে চেষ্টা করে। তবে বাইরের একজন দর্শনার্থীর কাছে বিষয়টা অন্য রকম হতে পারে। তার দৃষ্টিতে সে সব কিছুই দেখবে অন্য রকম।

যেমন বলা হয় মিশরের সেই ফারাও প্রজন্মটি একটার থেকে আরেকটা মোটেও পৃথক কিছু ছিলো না। যেমন মরুভূমির বালিগুলো একে অপরের সাথে জড়িয়ে থাকে।তাদের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না।

পিরামিডের অপরিবর্তনীয় নেতৃত্বের ভেতর দিয়ে কতো নেতৃত্ব এলো আর চলে গেলো। পিরামিডের এ সমস্ত ধারক বাহকরা যেনো সমস্ত উপকথা আর কাহিনী তাদের অবদান রেখে গিয়েছিলো সেটাই ছিলো মানুষের জন্য একটা সম্পদ স্বরূপ।

আর পিরামিডকে নিয়ে মানুষের এ আবেগ চক্রাকারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাড়তে থাকে। ঘুরতে থাকে। যদিও ফারাও চিওপসের পিরামিডের পর অনেক তর্ক-বিতর্ক অনেক নিন্দা প্রশংসার ঘটনা ঘটেছে। পিরামিড তৈরি নিয়ে আরো নানা রকম পরিকল্পনা হয়েছে। কতো কৌশল আর অপচেষ্টার দানা বেঁদেছে।

কিন্তু এই পিরামিড নিয়ে একদিন ঘটে গেলো একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা।

সময় ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। শীর্ণবস্ত্র পরিহিত অবস্থায় উসকো খুসকো চুলের এক লোক মরুভূমিতে ঘুরতে লাগল অনেক দিন ধরে।

পিরামিডগুলোর চারপাশে তার কৌতূহলী দৃষ্টি দিয়ে সে কী যেনো খুঁজতে থাকলো।

পিরামিড নিয়ে যে সমস্ত রাজ ঐতিহাসিকরা নানা রকম তথ্য এবং ইতিহাস লিখছিলো, বিভিন্ন ধরনের তদন্ত করছিলো তারা কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না এ রহস্যময় লোকটা আসলে কে ছিলো। তার আসল চেহারা কী?

সে কি ঐ সমস্ত ভবঘুরেদের মতো কেউ ছিলো যারা শুধু শুধুই মরুভূমিতে পাগলের মতো ঘুড়ে বেড়ায় নাকি তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলো। নাকি সে কোনো আশ্রম থেকে উঠে আসা ক্ষেপাটে কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাকি গণিতবিদ।

এ রহস্যময় লোকটা পিরামিডের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছিলো আর কি যেনো খোঁজার চেষ্টা করছিলো। মাঝে মাঝে পাথরের স্তরগুলোকে খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে বালির উপর বসে বালিতে কী যেনো জ্যামিতিক সব আঁকিবুকি করতো। অংক করতো। কিছু একটা হিসেব নিকেশ করে কী যেনো বের করার চেষ্টা করছিলো সে। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে উচ্চ স্বরে হাসতো। সে হাসিতে রহস্য আর প্রশ্ন শোভা পেতো।

কেউ তার কাজকর্মের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলো না। মাঝে সে পিরামিডের চারপাশে মরুভূমির বালুগুলো হাতে নিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিতো।

তার বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ আনা হলো যে, সে এই পিরামিডগুলোকে ধ্বংস করার ফন্দি আঁটছে, তখন সে এই অভিযোগ এক বাক্যে অস্বীকার করলো। সে প্রতিউত্তরে বললো যে, এই পিরামিডগুলো ধ্বংস করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। সে শুধু চায় পিরামিডগুলোকে কবর দেওয়া হোক। এটি যেনো এভাবে না থাকে।

কারণ এইগুলোকে এখন কবর দেওয়ার সময় হয়ে গেছে।

‘তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো না এরা কেমন জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। এরা এখন মৃত। শবদেহের মতোই এখন এদের অবস্থা।

সব মৃতদেহের মতোই এগুলোকেও এখন কবর দিতে হবে।’

পিরামিডকে কবর দেয়ার জন্য সে পাগলের মতো এর চারপাশে পরীখা খননের জন্য বিভিন্ন রকম দৈর্ঘ্য প্রস্থের মাপ নিতে থাকলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে এর পেছনে কাজ করতো।

তাকে যখনই এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হতো তখনই সে এক কথার বেশি কোনো উত্তর দিতো না। সংক্ষেপেই সে সব কিছু বলে দিতো। সে মৃত পিরামিড বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছিলো সেই বিষয়টাও কিছুতে ব্যাখ্যা করলো না। তার সব কাজ কর্মই ছিলো হাস্যকর আর রহস্যময়।

‘এই আমাকে দেখে তোমরা হাসছো কেন? তোমাদের হাসি বন্ধ করো।’

যদিও তার দিকে তাকিয়ে কেউ কোনো হাসাহাসি করছিলো না। কিন্তু সে তার কথা বলেই যেতে থাকলো।

‘দেখ তোমরা অনেক দূর থেকে এর দিকে তাকিয়ে দেখো। দেখ এর জীবনী শক্তি শেষ হয়ে গেছে। তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো না?’

তাকে যখন বন্দি করা হলো তখন সে জেলখানার দেয়ালে তার নানা ধরনের অংকের হিসেব-নিকেশ করতে থাকলো।

তার অংকগুলো ছিলো আগের চেয়েও জটিল। সে দেখাচ্ছিলো বাতাসের প্রভাবে আর বাইরের আবহাওয়ার ক্ষণে ক্ষণে তাপমাত্রার ওঠা-নামার কারণে কীভাবে নানা অনুপাতে পিরামিডের বিভিন্ন দিকের বিভিন্ন অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে সময়ের সাথে সাথে একদিন হয়তো পিরামিডের কিছুই থাকবে না। একেবারে অস্তিত্বহীনও বিলীন হয়ে যাবে।

তার কথা কেউ বিশ্বাস করছিলো না।

‘সময়! মহাকাল!” সে কারাগারে হাঁটতে হাঁটতে বিড় বিড় করে বলছিলো, সময় নিজেই তোমাকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দেবে।’

তবে সত্যিকার অর্থেই পিরামিডের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হচ্ছিলো।

তার এই পরিবর্তন খালি চোখে ধরা বা বোঝার কোনো উপায় ছিলো না।

পিরামিডের শ্বেত শুভ্র রংটা আস্তে আস্তে কেমন ফিকে হয়ে আসছিলো। এর পাথরগুলো বিবর্ণ হয়ে পড়ছিলো।

প্রায় আটশো বছর পর সর্বপ্রথম এটার মধ্যে একটা ভাঁজ বা কুঞ্চনের দৃশ্য সবার চোখে পড়লো। সবাই এ বিস্ময়কর জিনিসটি প্রতক্ষ করলো।

এক ডিসেম্বরে অপরাহ্নের পর উত্তর দিকের একটা পাথর একটু ফাটল ধরে ভেঙে নিচে নেমে গেলো। তার সাথে সাথে আরো কয়েকটা পাথর নড়ে চড়ে উঠলো।

সবার চোখের সামনে পিরামিডের এই ক্ষয় চিহ্নের আগে পিরামিড তৈরির প্রায় দুইশো সত্তর বছর পর পিরামিডের উত্তর পশ্চিমের দিকে প্রথম চৌদ্দটা পাথররের রং ধুসর বর্ণ ধারণ করলো।

তারো একশো বিশ বছর পর পিরামিডের দক্ষিণ দিকে আরো কিছু পাথরের ভাঙন আর ক্ষয় শুরু হলো। ঠিক ওঠার ন্যায়।

পিরামিডের ক্ষয়ের এই চিহ্ন আরো প্রকট আকার ধারণ করলো এক হাজার পঞ্চাশ বছর পর। এ যেনো আগের ঘটনায়।

কেবল উত্তর দিকেরই নয় বরং পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকেও পাথরগুলোর ক্ষয়ের চিহ্নও সবার চোখে পড়তে থাকলো। নানা রকম ধ্বংসের চিহ্ন যেমন, বিভিন্ন জায়গায় গর্ত হয়ে যাওয়া, ভেঙে পড়া, ক্ষয়ে যাওয়া, রং নষ্ট হয়ে যাওয়াসহ আরো বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন দেখা যেতে লাগলো।

বিষয়টা রাজপ্রাসাদের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনা হলো। সে সময়ের ফারাও বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নিয়ে তিনি এর প্রতিকার করতে চাইলেন।

তিনি চাইলেন পিরামিডকে রক্ষা করতে। কিন্তু তখন তার এই কাজে বাঁধা দিলো রাজপ্রাসাদের একমাত্র এবং সেই প্রধান পুরোহিত। সে বললো, ‘পিরামিড একটি অতি পবিত্র বিষয়। এতে হস্তক্ষেপ করলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।’

সে আরো বললো যে, পিরামিড হলো প্রকৃতির সম্পদ। একে প্রকৃতির নিয়ম আর ইচ্ছের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। এছাড়া অন্য কারো হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না।

আর তাই তারা তখন পিরামিডকে প্রকৃতির কোলেই ছেড়ে দিতে রাজি হলো। কিন্তু এর উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য রাত দিন এর পাশে এক দল পাহারাদার নিযুক্ত করা হলো। কিন্তু সময় যতো এগুতে লাগলো ততোই পিরামিডের চেহারা বিবর্ণ হতে থাকলো। দিন দিন তা কেবলই বৃদ্ধি পেলো।

পিরামিডের এ বিস্ময়কর বুড়ো হয়ে যাওয়া অবস্থা নিয়ে জনগণও বেশ সজাগ ছিলো। কিন্তু গ্রিক থেকে একদল লোক সর্বপ্রথম এ স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে এসে তারা মন্তব্য করলো, ‘উফ! পিরামিডটা আসলেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।’

এটা বলা কষ্ট কর ছিলো যে তারা পিরামিডকে নিয়ে এই ধরনের মন্তব্য না কি ঠাট্টা করে করেছিলো না কি এর অমঙ্গল কামনা করেছিলো। এ বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো না। আর বোঝার কোনো উপায়ও ছিলো না।

লোকজনও কেবলই দেখতে পেলো পিরামিড আর আগের অবস্থায় নেই। এর চারকোণার সাদা অংশগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। এর বাইরের আবরণে কেমন এবড়ো খেবড়ো একটা ভাব ফুটে উঠেছে। কেমন যেনো বেসুরো কাজ।

কিন্তু এ সবই ছিলো খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল একটা অনুভূতি।

পিরামিড তার নিজের জায়গায় কতো ঝড় ঝাপ্টার পরেও নিজের ক্ষমতা আর শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। যেনো সে একজন তীব্র জীবনীশক্তির অধিকারী মেয়ে মানুষের মতো যে তার শেষ জীবনে এসেও গর্ভ ধারণ করে সন্তান প্রসব করে তার জীবনী শক্তির প্রমাণ রেখেছে।

একইভাবে পিরামিডও চার হাজার বছর অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পরেও দূর দূরান্তে নিজেকে আবার পুনর্জন্ম দিয়ে চলছে।

পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত চলছে এর খ্যাতি আর পরিচিতি।

তীব্র দ্যুতিময় আলো ছড়িয়ে পড়ছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

লোকজন যখন পিরামিড নিয়ে তাদের স্বপ্নকে আবার পুনরাবৃত্তি করে তখন তাদের চোখের সামনে পিরামিডের প্রথম ছায়াটাই ভেসে উঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *