পিরামিড : আকাশের দিকে মাথা
এটাই প্রতীয়মান হলো যে, যতোটুকু আশা করা হয়েছিলো নির্মাণের কাজ শেষ হতে তার চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছিলো। যেখানে পিপীলিকার মতো সারি বেঁধে লোকজন পিরামিডের কাজ করছিলো সেখানে তার উপরে আকাশে ধুলির মেঘ জমে গিয়েছিলো। ধুলির এ আস্তরণের বিস্তার হবে আট থেকে দশ মাইল জুড়ে।
অনেক দূরে গ্রামের লোকেরা যারা কোনো কিছু না ভেবেই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এই ধুলির মেঘের দিকে তাকায় তাদেরকে যদি বলা হয় যে, পিরামিড নির্মাণের কাজটা আসলে আকাশে হচ্ছে তারা হয়তো এতেও অবাক হবে না।
পিরামিড অতীতেও তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু তার কোনো ক্লান্তিকর অনুভূতি বা স্মৃতি কোথাও ছিলো না। এর পরেও কোথায় যেনো একটা সুপ্ত আতঙ্ক বিরাজ করছিলো। দুর্বল একটা মরা বাতাস নির্মাণের জায়গার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো। সব কিছুই কেমন যেনো বিপদগ্রস্ত মনে হচ্ছিলো। লোকজন বলাবলি করতো যে মিশরের উপর অভিশাপ নেমে আসছে।
এর চেয়ে বেশি আর কী হতো যেখানে পিরামিড মানবতাকে আরো উন্নত খ্যাতির দিকে নিয়ে যাবে সেখানে তার পরিবর্তে গভীর এক অজানা উৎকণ্ঠায় ইতোপূর্বে যেমনটা তারা কখনোই ছিলো না।
তবে সর্বশেষ পিরামিড তৈরিতে এর উচ্চতার বিষয়টা ছিলো স্থির। কিন্তু তারপরেও যারা এর নির্মাণের সাথে জড়িত ছিলো তাদের অনেকেরই ধারণা ছিলো এটা সকল দুর্ভাগ্যের শেকড়। এর কাছে প্রাপ্তির চেয়ে প্রদানটা বড় হয়ে দেখা যাবে।
পিরামিডের উচ্চতাটা সত্যিকার অর্থেই ছিলো অবিশ্বাস্য আর ভীতিপ্রদ। অতীতে নির্মিত সকল পিরামিড থেকে এর উচ্চতা ছিলো তিনগুণ বেশি। এমন কি এর অর্ধেকটা যখন তৈরি হলো তখন মানুষ পিরামিডের আধা উচ্চতার দিকে মাথা তুলে তাকালে তাদের মাথা ঝিম ঝিম করতো। তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়তো।
চিন্তা করো পরবর্তীতে মানুষগুলো একে নিয়ে কি ভাবনাচিন্তা করেছিলো। সর্বশেষ পিরামিড যখন তার মূল উচ্চতায় পৌঁছে যাবে তখন তুমি ভাববে কি একটা কাণ্ড ঘটে গেলো।
গির্জাগুলোতে ধর্মীয় যাজকেরা লোকদের উত্তেজনাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলো।
‘পিরামিড আমাদেরকে আরো শক্তিশালী আর সুখী করবে। এটা পৃথিবী এবং বেহেশতের মাঝে আমাদের সম্পর্কে বুঝতে আরো সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’
পররাষ্ট্র বিষয়ক দলটি পিরামিড তৈরির অবস্থা দেখতে আসলো। তারা যখন গাড়ি থেকে নেমে এলো সকলেই তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লো। কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। সারা পৃথিবীর চোখ মিশরের উপর। কারণ এ দেশটা পৃথিবীর সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টা অর্জন করতে যাচ্ছে।
গ্রিক থেকে আগত একটা দল যারা তখন সভ্যতায় শিক্ষায় অনগ্রসর ছিলো তারা কেবল এই সমাধি সৌধের নির্মাণের বিষয়ে কোনো ধারণা বা সুস্পষ্ট মতামত দিতে পারলো না।
আগমনের পর প্রথম দর্শনেই তারা এই অসম্পূর্ণ নির্মাণ শৈলী দেখে হতবাক হলো। তাদের মস্তিষ্ক অক্ষম ছিলো এটা বুঝতে যে, একটা সমাধি সৌধ এতো লম্বা আর দীর্ঘ হয় কীভাবে।
পরবর্তীতে একদল মিশরীয় প্রতিনিধিকে তারা ডেকে পাঠিয়ে পিরামিডের বিষয়ে তাদের অজ্ঞ ধারণাটুকু দিয়ে দিলো যে, ‘এই পিরামিডটা তেমন একটা সুশৃঙ্খল নির্মাণ সৌধ না। এর মাঝে অনেক গলদ রয়েছে।’
যা হোক, কিছু রাষ্ট্রদূতকে যারা মূলত পরিচিত ছিলো পিরামিডের প্রতি তাদের দুর্বলতা আর ভালোবাসার বিষয়ে তাদেরকে ধর্মীয় উপাসনালয়ে ডাকা হলো পিরামিড বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য।
তাদের বক্তৃতায় তারা দেশের সমৃদ্ধি, উন্নতি কামনা করে দেশের গুণকীর্তন করে পিরামিডের সুসামঞ্জস্য নির্মাণের বিষয়ে ভুয়সী প্রশংসা করলো। মিশর যদি এ মুহূর্তে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো পরিদর্শন করে তাহলে এতে করে আরো শান্তি, সমৃদ্ধি পারস্পরিক সৌহার্দ্যতা বজায় থাকবে।
যদিও পাশের দেশগুলোর আবহাওয়া তখন ছিলো বেপরোয়া, অস্থিতিশীল আর প্রকৃতির খুব বিরূপ। সেখানে ঠাণ্ডা ছিলো। লোকজন ছিলো দুঃখী আর সেখানে বৃষ্টি একেবারে বন্ধ ছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো স্বর্গ আর পৃথিবীর মাঝে খুব একটা সুসম্পর্ক ছিলো না। এতো প্রচণ্ড কুয়াশা ছিলো যে প্রতিটি সকালে ঘুম থেকে উঠলে তোমার মনে হবে এটাই তোমার জীবনের শেষ সময়। এরপর জীবনের ইতি ঘটবে।
লোকজন ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে হাসিমুখে মনের মধ্যে প্রশান্তি নিয়ে বের হলো। তারা ভাবলো যে কী সৌভাগ্যবান তারা। তাদের একটি মহান পিরামিড আছে। যা অন্য কারো নেই। নয়তো অশুভ শয়তানই জানে এই দেশটার কী হতো। হয়তো আকাশ থেকে আগুনে এসে সব ধ্বংস করে দিতো। নয়তো এ দেশটাকে সাদা কুয়াশা দিয়ে আচ্ছাদিত করে দিতো।
বিদেশীদের এই তোষামোদি ও প্রশংসার বন্যায় কূটনীতিকদের গোপন রিপোর্টে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন করতে পারলো না। বিষয়টা যদিও দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই এটা একদিন প্রকাশ হয়ে পড়লো যখন সুমেরীয়ান রাষ্ট্রদূতদের কিছু রিপোর্ট পথিমধ্যে ধরা পড়েছে। এগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গোপনীয়।
মিশরীয় গোপন নিরাপত্তারক্ষীরা রাস্তার মধ্যে গর্ত করে ফাঁদ পেতে রেখেছিলো। সুমেরীয়ন কূটনীতিকদের বার্তাবাহী বোঝাই দুটি গাড়ি সেই ফাঁদে পড়ে ধরা পড়ে যায়। সুমেরীয়ন কূটনীতিকরা অনেক চেষ্টা করেছিলো তাদের সংবাদগুলো যে প্রস্তর ফলকে লিখেছিলো সেটাকে পাতলা করতে যাতে ওজন অনেক হালকা হয় এবং বহন করতে সুবিধা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা এর ওজন হ্রাস করতে সক্ষম হয় নি। তবে তাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিলো না।
দুর্ঘটনায় কবলিত গাড়ির বাহকদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রস্তর ফলকগুলো চুরি হয়ে যাওয়ায় সেটা তাদের জন্য আরেকটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। সুমেরীয়নদের বিষ যে কতো তীব্র এ ঘটনা থেকে সেটা বেশ ভালোভাবেই বোঝা গেলো।
গুপ্ত ষড়যন্ত্র উদ্ধারের এক সপ্তাহ পর একটি অফিসিয়াল নৈশভোজে সম্রাট চিওপস তার বিজয় উদযাপন ভাষণ দিলেন। চমকিত সে ভাষণ।
তিনি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘আমাদের শত্রুরা পিরামিড তৈরির ধারণায় বেশ ক্রুদ্ধ আর ইর্ষান্বিত ছিলো। কিন্তু তাদের সেই শত্রুতা ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। আমরা পিরামিডকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবো। একেবারে স্বর্গের কাছাকাছি।’
অবশ্য ফারাও মনে মনে বেশ ক্রুদ্ধ ছিলো।
লোকেরা বলতো যে, নতুন একটা ষড়যন্ত্র উন্মোচন করা হলো। যদিও এই ষড়যন্ত্রের কোনো সার সংক্ষেপ বাইরে কিংবা জনসমক্ষে কোথাও প্রকাশ করা হলো না।
পুরো সপ্তাহ জুড়ে লোকজন আশা করাছিলো যে স্থাপত্যবিদদের মূল দলটি গ্রেফতার হবে।
অবশেষে তাদের সাথে কোনো নিরাপত্তাকর্মীদের পরিবর্তে প্রাসাদের বার্তাবাহি দূত এসে দেখা করলো এ বলে যে, তারা যেনো সম্রাটের সাথে পিরামিডের মডেলটা নিয়ে দেখা করে।
স্থপতি দলের প্রধান রাহোটেপ সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে তার মুখ সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়ে সব কিছুতে সে একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে চোখটা নিচে নামিয়ে ফেললো। দেখে মনে হলো যে, সে মাটির নিচে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার হাতের ছড়িটা সে শক্ত করে ধরলো। যাতে করে সেটা না পড়ে যায়।
‘আমাকে সমাহিত করা হবে এর ঠিক গভীর জায়গায়।’ স্থাপত্য প্ৰধান হঠাৎ তার হাতের লাঠিটা পিরামিডের ছোট্ট প্রতিকৃতির একটা নির্দিষ্ট অদৃশ্য বিন্দুতে স্থাপন করে বোকার মতো কথাগুলো বললো।
ভীতসন্ত্রস্ত প্রকৌশলীর কথা-বার্তা প্রথমে বোঝাই যাচ্ছিলো না যে আসলে সে কী বলতে চায়। অবশেষে বোধগম্য হলো। সে আসলে সমাধি স্তরের কথা বলছে। পিরামিডের যে স্তরে সম্রাটকে সমাধি করা হবে সে স্তরের বর্ণনা সে দিচ্ছে। তবে তার কথায় জড়তা আর ভয় বিরাজ করছে।
তারা পিরামিডের গুরুত্বপূর্ণ এ অংশটা নিয়ে যেখানে সম্রাটকে সমাহিত করা হবে অনেক আলোচনা করেছিলো। ব্যাপারটা নিয়ে তারা যদিও খুব ভীত ছিলো কিন্তু তারপরেও পিরামিডের জনক স্থাপত্যবিদ ও প্রকৌশলী ইমহোটেপ যে সমস্ত নোট আর দলিলপত্র রেখে গিয়েছিলেন সেগুলো থেকে এর চেয়ে ভালো সমাধান আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না।
‘আমাকে গাধার মতো পিরামিডের নির্মাণ শৈলীর সমস্যাগুলো বর্ণনা করার কোনো প্রয়োজন নেই। এতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।’ চিওপস বললো! ‘আমি এর ওজন, পাথরের জঞ্জাল এর কোনোটার বিষয়েই জানতে চাই না। আমি চাই পিরামিড আরো উঁচুতে উঠুক। আরো উঁচু। বুঝতে পেরেছো?’ তার চোখে কেবল উচ্চতর সমুজ্জল বিস্ময়।
‘অবশ্যই, মহামান্য সম্রাট। প্রকৌশলী প্রধান যেনো কবরের ভেতর থেকে মৃত স্বরে উত্তর দিলো।
স্থাপত্যবিদরা সবাই চুপচাপ তাদের পিরামিডের মডেলটা নিয়ে চলে গেলো। তাদের কর্মক্ষেত্রে পৌঁছে তারা দীর্ঘক্ষণ ঠিক যেনো বোবা হয়ে বসে থাকলো। তাদের মন আর শরীর যেনো অসাড় হয়ে পড়েছে। এটাকে তুমি পাগল হয়ে যাওয়ার শুরু বলতে পারো।
তারা ধারণা করেছিলো যে সমাধিকক্ষটি হবে পিরামিডের মূল পথ যেটা দিয়ে পিরামিডের সাথে মাটির অনেক গভীরে সম্পর্ক রাখা যাবে।
এটা হলো পিরামিডের মূল। এর মাধ্যমে পিরামিডের চূড়া থেকে মাটির মধ্যে খিল আটার মতো সম্পর্ক রাখা যাবে।
আর এখন সম্রাট তাদের কাছে চাচ্ছেন অন্য কিছু। তিনি পিরামিডের মূল এ পথটাকে পরিত্যাগ করতে চাচ্ছেন। তিনি চান সমাধিঘরটা যেনো আরো উঁচুতে ওঠানো হয়। অথচ এটাকে যদি উচু করে দুটো দেয়ালের মাঝে আনা হয় তখন এটা অনেক বিপদজনক হয়ে যাবে। এমন কি পাথরের চাপে কেবল একটা ডিমের খোসার মতো সমাধি ঘরটা ভেঙে যাবে। আর এর সাথে সাথে সংরক্ষিত মৃতদেহটাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
স্থাপত্যবিদরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলো। প্রধান কৌশলী রাহোটেপ মনে মনে ভাবলো আসলে সে নিজে মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। সে কাজের স্তুপের মধ্যে বসে দিনরাত এক মনে ভাবতে থাকলো। কী হবে অবশেষে যদি সে কাজটা না করতে পারে। সে প্রবলভাবে তার অক্ষমতার ফলস্বরূপ শাস্তির কথা ভাবতে লাগলো। সব কিছু কি ভয়াবহ পরিণামই না বয়ে নিয়ে আসবে। পাথরের এ চাপের মধ্যে কীভাবে সমাধিঘরটা স্থাপন করা যায়।
অন্যান্য স্থাপত্যবিদরা সবাই ধরে নিলো যে রাহোটেপ হয়তো পাগল হয়ে গেছে। তার অশালীন আর অসার আচরণ তাই প্রমাণ করে।
একদিন রাহোটেপ একগাদা স্থাপত্য চিত্র নিয়ে তাদের কাছে এলো। তারা ভান করলো যে, মনোযোগ দিয়ে তারা রাহোটেপের কথা শুনছে। রাহোটেপ যা বলছে তারা সেটা শুনতে থাকলো যেভাবে বয়স্ক লোকেরা একটু অবজ্ঞা আর স্নেহের দৃষ্টিতে বাচ্চাদের কথা শোনে, ঠিক সেভাবে। কারণ তাদের ধারণা, রাহোটেপ চিন্তায় চিন্তায় ইতোমধ্যে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই রাহোটেপের কথার মাঝে তারা আবিষ্কার করলো রাহোটেপ খুব অদ্ভুত একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। তারা শুনলো রাহোটেপ বলছে যে সমাধিঘরের উপর পিরামিডের পাথরের চাপ কমাবার জন্য তোমরা আরেকটা দেয়ালের স্তর তৈরি করতে পারো। ফলে পাথরের চাপ পড়বে দেয়ালের উপর। আর এভাবে পিরামিডের চুড়া আর সমাধিঘরের মাঝে দূরত্বের ব্যবধানটা আরো কমানো যাবে। আর তা হবে সত্যিকারে পিরামিড। টেকসই আর উপযুক্ত পিরামিড।
অন্যান্য প্রকৌশলীরা নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এটা সত্যিকার অর্থেই খুব বাস্তব সম্মত আর মেধা সম্পন্ন একটা পরিকল্পনা।
আড়ালে তারা নিজেদেরকে তিরস্কার করতে থাকলো যে এমন একটা পরিকল্পনা তারা কেন আবিষ্কার করতে পারলো না।
পরদিনই তারা ফারাও এর সাথে একটা বৈঠকের ব্যবস্থা করলো। বৈঠকে সম্রাট আবেগহীন চোখে তাদের কথা শুনছিলো। তার অপলক দৃষ্টি তাদের হরণ করছিলো প্রতিটা ক্ষণে।
‘মহামান্য সম্রাট আপনি এখন ঠিক এই জায়গাটায় সমাহিত হবেন।’ রাহোটেপ পিরামিডের মডেলের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ইঙ্গিত করে সমাধিঘরটা কোথায় হবে সেটা বললো।
তাদের কথা শুনে সম্রাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এমন আচরণ ফারাও সাধারণত করেন না।
‘আরো উঁচু!” সম্রাট শ্বাসরুদ্ধ গলায় বললো। ‘আমি এখনো অনেক নিচুতে আছি।’
‘আমি বুঝতে পেরেছি মহামান্য সম্রাট।’ প্রধান স্থাপত্যবিদ বললেন। ‘আমি এই পিরামিডের ঠিক মধ্যখানটায় থাকতে চাই।’ সম্রাট ঘোষণা করলেন।
‘আমি বুঝতে পেরেছি মহামান্য সম্রাট।’
সম্রাট চিওপসের চোখে কেমন আতঙ্ক আর বিরক্তির ক্ষুদ্র একটা ভাঁজ দেখা গেলো।
.
পিরামিডের একটা দুটো স্তর করে আস্তে আস্তে সেটা আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিলো। তারা যখন আস্তে আস্তে স্তর বৃদ্ধি করতে করতে আরো উঁচুতে গেলো তখন তাদের মধ্যে কেমন একটা ভয় চেপে গেলো। ভয়টা যারা সেখানে স্থায়ীভাবে দীর্ঘদিন কাজ করছিলো শুধু তাদের মাঝেই ছড়িয়ে গেলো না বরং সেটা মাসখানেক হয় যারা কাজ করতে এসেছে তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়লো। তারা পিরামিডের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এটা কি! আর কিইবা হতে যাচ্ছে এখানে। নিশ্চই আমাদের কোনো স্বপ্নভ্রম হচ্ছে। আমরা কি ভুল দেখছি?
শ্রমিকেরা যখন কাজ শেষ করে তাদের ব্যারাকে ফিরে যাচ্ছিলো তখন তাদের পেছনে কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টিতে ছিলো প্রশংসা আর ভয়। যেনো তারা বলছে দেখো এ লোকগুলো এরাই আসলে সত্যিকার বীর। এরা স্বৰ্গ থেকে নেমে এসেছে। এরা স্বর্গদূত। হতে পারে স্বর্গ দেবতা।
কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টি ক্রমশই পিরামিডকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। এখন শুধু পিরামিডের কাজটা শেষ করা বাকি। সবাই পিরামিডের চুড়াকে কেন্দ্র করে আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে। কেউ বলছে সত্য খুব শিগগির প্রকাশিত হবে।
কেউ কেউ ভয় পাচ্ছিলো পিরামিডের চুড়া হয়তো আকাশকে স্পর্শ করবে কিংবা বিদীর্ণ করে ফেলবে। তারা তখন বলছিলো, “তখন তোমরা দেখবে কি ঘটতে যাচ্ছে। তখন সেই মুহূর্তে আমরা কোথায় পালাবো?
এ কথায় কেউ কেউ বলছে, ‘আমাদেরতো কোনো দায়িত্ব নেই। আমরা শুধু নির্দেশ পালন করেছি মাত্র। এখানে কোনো ভুল হলে যারা নির্দেশ দিয়েছে এটা তাদের দায়িত্ব।
‘কিন্তু আমরা হয়তো সবাই দোষী।’ অন্য আরেকজন বললো। ‘কেননা আমরা কোনো না কোনোভাবে এ পিরামিড তৈরির সাথে সম্পৃক্ত।
এ সমস্ত কথা বলে তারা তাদের চোখকে আকাশের দিকে তুলে তাকালো।
এটা যেনো পিরামিড নয় তাদের শরীর। আর তাদের ভাগ্য। তাদের ললাটের নির্ধারিত অনাগত ভবিষ্যত।