প্রসঙ্গ পিরামিড

প্রসঙ্গ পিরামিড

প্রাচীন পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্য স্থাপনার মধ্যে গিজার বৃহৎ পিরামিড অন্যতম। ঐতিহাসিক ও আর্কিওলজিস্টদের মতে, প্রায় দুই মিলিয়ন পাথর খণ্ড ব্যবহার করা হয়েছিলো এই পিরামিডটি তৈরি করার সময়। পাথরগুলোর গড় ওজন ছিলো ২.৫ টন। যখন এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় তখন এই ৪৮১ ফুট উঁচু পিরামিডই ছিলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনা।

এই বৃহৎ পিরামিডটি তৈরি করেছিলেন ফারাও চিওপস। ইতিহাসে তিনি ফারাও খুফু নামে পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৪৭ থেকে ২৫২৪ পর্যন্ত সময়ে মিশরের শাসক ফারাও খুফু তার নিজের দীর্ঘ এই সমাধি স্তম্ভটি তৈরি করেছিলেন।

গিজার পিরামিড বলতে যে ছবি আমাদের চোখের সামনে ভাসে, তা খুবই অপূর্ণাঙ্গ। মূলত একেকটা পিরামিড মতো বড় যে, না তাকে সীমাবদ্ধ করা যায় ক্যামেরার ফ্রেমে, না তার বর্ণনা সম্ভব স্বল্প পরিসরে।

পাশাপাশি তিনটি পিরামিড গিজায়-ফারাও খুফু, খাপড়ে ও মেনকাউড়ে। পাশে আরো কয়েকটা ছোট, ছোট পিরামিড আছে যার গায়ে ধ্বংস ভর করেছে। এই বিশাল চত্বরের সামনে সদাজাগ্রত প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে স্ফিংস, অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহের আকৃতির দেবতা। পিরামিডের চেয়ে অধিক বিস্ময়কর এই স্ফিংস। কারণ এতো বড় অ্যালাবেস্টর পাথর মিসরে দুষ্প্রাপ্য এবং বিদেশ থেকে নিয়ে এসে তাকে কীভাবে বসানো সম্ভব, যার ওজন এক লাখ পঁচিশ হাজার টন? এ জন্যই বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং কিছু কিছু মিশরীয় মতবাদে বিশ্বাসীদের ধারণা, স্ফিংস ও পিরামিড কোনো মানুষের গড়া ভাস্কর্য নয়। তাদের মতে, এসব ভিন গ্রহের কেউ বানিয়েছে। না হলে স্ফিংসের মুখ এতো কিম্ভুত কেন?

স্ফিংসের মুখ আসলেই বিচিত্র। এক দিক থেকে তা নারীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, অন্যদিকে পুরুষের। এসব দেখে নেপোলিয়নের এক গবেষক প্ৰশ্ন তুলেছিলেন, ‘মোনালিসা কি স্ফিংসের প্রেরণায় আঁকা?’

পিরামিডের গঠনশৈলী আমরা যেভাবে আলোকচিত্রে দেখি, মোটেই সে রকম নয়। আলোকচিত্রে পিরামিডগুলো মতো ছোট হয়ে যায়, মনে হয় মাটির উপর দাঁড়ানো ছোট ছোট ত্রিভুজ। কিন্তু পিরামিড গড়া হয়েছে চৌকা পাথরের অসংখ্য টুকরো সাজিয়ে। প্রথম তাকের ওপর দ্বিতীয় তাক বসানো হয়েছে একটু ভেতরে চেপে। ফলে ওপরের আয়তন ছোট হয়েছে। এভাবে ছোট হতে হতে শীর্ষে গিয়ে তা শেষ হয়েছে। একটি মাত্র খণ্ডে। বহু দূর থেকে তোলা ছবিতে এসবের কিছুই আসে না। অথচ এসব পাথর খণ্ডের সবচেয়ে ছোটটির ওজনই আড়াই টন।

পিরামিডের রহস্য কিন্তু এতেই শেষ হয়ে যায় নি।

পিরামিডের বহিরাঙ্গের থেকে ভেতরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্দর বিবেচনা করলে আসলে এ এক তাজমহল। মানে কবরখানা। পিরামিডের অভ্যন্তরে আছে অসাধারণ সুন্দর, কিন্তু ভয়ানক রহস্যময় পথ। প্রতিটি পথেই ফাঁদ পাতা, যা বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সব ফারাওয়ের কবরের মতো পিরামিডেরও রয়েছে ভ্রান্ত গলি। স্বাভাবিক বুদ্ধি যেখানে বিভ্রান্ত হয়। এরই চরম দৃষ্টান্ত আছে মেনকাউর পিরামিডে। মেনকাউরের নিচ পর্যন্ত পানি নিয়ে আসার জন্য নীল নদ পর্যন্ত যে রাস্তা আবিষ্কৃত হয়েছে, তা বিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়েছে। গত তিন হাজার বছরে অন্তত ষোলোটি মারাত্মক ভূমিকম্পকে হেলায় অবজ্ঞা করে এ জন্যই টিকে আছে পিরামিড।

পিরামিডের সবচেয়ে বড় বিস্ময় এর ত্রিকোণোমিতিক হিসাব এবং আনুভূমিক গঠনে। পিরামিডের প্রতিটি কৌণিক রেখার সাথে মেলানো হয়েছে মহাকাশের নক্ষত্ররাজিকে। দক্ষিণ কোণ থেকে শীর্ষে তাকালে দেখা যায় ধ্রুবতারা। উত্তর থেকে দক্ষিণে তাকালে বৃশ্চিকের কেন্দ্রবিন্দু। সেও শুধু একটি মাত্র দিনে, যে দিন সম্রাট খুফু মারা গিয়েছিলেন, অর্থাৎ দশই ডিসেম্বর। পরম আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিলো সম্রাট খুফুর মৃত্যুর তিন বছর আগে। কি অসম্ভব ছিলো সেই প্রকৌশলীদের নক্ষত্রবিদ্যা, যা তার মৃত্যুকে নিশ্চিত করেছিলো আসল মৃত্যুর তিন যুগ আগেই।

একই ভাবে পশ্চিম দিক দিয়ে তাকালে শীর্ষে দেখা যাবে আদম সুরাতের মাথার তিনটি তারা, এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যা মিসরের বসন্তকাল। দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে তাকালে দেখা যাবে সপ্তর্ষিমণ্ডলের লুব্ধক, জুনের পনেরো তারিখ যেদিন সম্রাটের জন্ম। বহু বৈজ্ঞানিক ধারণা করেন যে, পুরো স্থলমণ্ডলের কেন্দ্র খুফুর পিরামিডের সরাসরি নিচে।

সম্রাট নেপোলিয়নের সাথে আসা গবেষকরা এ সত্যও প্রমাণ করেছেন যে, গিজার তিনটি পিরামিডে মোট যে পরিমাণ পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তা দিয়ে ফ্রান্সের সীমানা ছয় ফুট উঁচু দেয়ালে ঘিরে দেওয়া সম্ভব, যার ওপর হেসে-খেলে দৌড়াতে পারবে তিন তিন জন ঘোড়সওয়ার।

পৃথিবীর আশ্চর্যতম এই পিরামিড নিয়ে আজো মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের এই জয়জয়কার যুগে এসেও বিশাল আকৃতির এই পিরামিডগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছিলো তা নিয়েও বিতর্কের কোনো কূল-কিনারা হয় নি। গ্রিক ইতিহাসবিদ হিরোডোটাসের উত্থাপিত তত্ত্বই এ যাবতকালের সর্বপ্রাচীন দলিল। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ সময়ে মিশর সফর করেন। তখন পিরামিড মোটামুটি ২ হাজার বছরের পুরনো ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, পাথরের টুকরোগুলো ওপরে ওঠানোর জন্য যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিলো। আর এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিলো সঙ্কীর্ণ আকারের ক্রেন। ৩০০ বছর পর সিসিলির ডিডোরাস লেখেন, নির্মাণ কাজের জন্য মাটির স্তুপ তৈরি করা হয়েছিলো। এটা অনেকটা র‍্যাম্পের মতো যা ব্যবহার করে সিঁড়ি ছাড়াই এক তলা থেকে অন্য তলায় যাওয়া সম্ভব।

আজ অবশ্য অন্য গ্রহের সাহায্য থিওরিও আছে। আদিকালের মিশরীয়রা নিজেদের দক্ষতা ব্যবহার করে এ বিপুলায়তানের স্থাপনা তৈরি করতে পারে না। নিশ্চয়ই ভিন গ্রহ থেকে প্রাণীরা এসেই তাদের সাহায্য করেছে। আধুনিক বিশেষজ্ঞরা প্রথম দুটি থিওরিতেই তাদের সম্মতি দিয়েছেন। তবে তারা মনের গভীর থেকে হয়তো বিশ্বাস করতেন যে, এ দুটি ধারণার কোনোটিই হয়তো সঠিক নয়। হয়তো এখানে রহস্যময় আরো অন্য থিওরি আছে।

ফ্রেঞ্চ আর্কিটেক্ট জঁ পিয়ের হুঁদি সম্পূর্ণ নতুন একটি আইডিয়ার কথা জানিয়েছেন সম্প্রতি। তিনি গত সাত বছর ব্যস্ত ছিলেন কম্পিউটারে পিরামিডের নানা মডেল তৈরির কাজে। থ্রী ডি সফটওয়্যার ব্যবহার করে তিনি দেখিয়েছেন পাথর ওপরে তোলার কাজে র‍্যাম্প ব্যবহার করা হয়েছিলো। আর এ র‍্যাম্প এখনো আছে পিরামিডের ভেতরে।

রহস্যময় আশ্চর্য এই পিরামিডের গঠনশৈলী নিয়ে আজো নানারকম গবেষণা আর চিন্তা-ভাবনা চলছে। একদিন হয়তো ফারাও খুফুর প্রধান স্থাপত্যবিদ হেমিউনি যে রহস্যময় তত্ত্ব আর পরিকল্পনা নিয়ে এই অত্যাশ্চর্য সমাধিস্থল পিরামিড তৈরি করেছিলেন তার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *