কাজের সূচনা
প্রস্তুতি : সকল স্থাপত্য নির্মাণ থেকে স্বতন্ত্র
পিরামিড তৈরির সংবাদটি অকল্পনীয় ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়লো।
দুটো ব্যাখ্যা এ ব্যাপারে দাঁড় করানো হলো। প্রথমত এমন একটা সংবাদের জন্য জনগণের আনন্দ দীর্ঘদিন অপেক্ষা করছিলো। অথবা এর বিপরীতে এমন একটা দুর্ভাগ্যজনক আতঙ্ক আর শঙ্কা যেটা জনগণ কখনোই আশা করে নি যে এটা ঘটুক। আর সেই বিষয়টাই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে দিগন্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যাচ্ছে।
মানুষের মুখে মুখে এই রাজ ঘোষণাটি আটত্রিশটি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের সম্রাটদের কাছে ছড়িয়ে পড়লো। যেভাবে ঝড়ো বাতাসে বালির স্তুপ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
‘আমাদের মহামতি সূর্য ফারাও চিওপস সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মিশরের জনগণকে এক পুতপবিত্র উপহার দেবেন। তিনি সবচেয়ে সুমহান এক অট্টালিকা, সব কিছুর চেয়ে পবিত্রতার পিরামিড তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাদ্যের তাল এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এমন কি রাজঘোষকদের গলার স্বর বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই প্রদেশের হোমড়া চোমড়া কর্তা ব্যক্তিরা তাদের সবগুলো মাথা একত্রিত করে রাজধানী থেকে তাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আসার আগেই কি করা যায় সে বিষয়ে খুব সাবধানে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলো। তারা যখন বাড়ি ফিরছে তখন খুশিতে তাদের চোখমুখ চিক চিক করছিলো।
তারা বলাবলি করছিলো “অবশেষে ভাগ্য ফিরলো। মহান সেই সৌভাগ্যের দিনটি চলে এসেছে। সেদিন থেকেই তাদের হাঁটা-চলা, ইশারা- ইঙ্গিতের মধ্যে একটা নতুন কিছু ছিলো। এক ধরনের গোপন আনন্দ তাদের মাংসপেশিকে সংকুচিত করছিলো আর হাতের মুষ্ঠিকে করছিলো সুদৃঢ়।”
এমন ক্ষিপ্রগতিতে পিরামিড তাদের অস্তিত্বের ভেতর ঢুকে গিয়েছিলো যে কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা বলাবলি করছিলো, ‘ইবলিশ ছাড়া কীভাবে আমরা এর থেকে পরিত্রাণ পাবো।’
যা হোক, মূল কেন্দ্র থেকে কোনো নির্দেশনা আসার অপেক্ষা না করেই তারা পিরামিড নিয়ে তাদের পূর্বসুরীদের মতো আচরণ করা শুরু করলো।
অন্যদিকে হাজার হাজার মানুষ এ খবর শুনে আনন্দিত হওয়ার বিপরীতে হতাশা আর আতঙ্কে আর্তনাদ করছিলো।
“উফ! আবারো শুরু হচ্ছে সেই খেলা।”
তাদের মধ্যে একটা ক্ৰোধ জেগে উঠছিলো।
“তুমি কি মনে করো তুমি এর সাথে সাথে মুক্তি পেতে যাচ্ছো। তুমি কি বিশ্বাস করো যে সব কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে আর কোনো নতুন পিরামিড তৈরি হবে না। আর তুমি তোমার মতো করেই বেঁচে থাকতে পারবে?
ঠিক আছে এখন তুমি লক্ষ্য করো কীভাবে সব কিছু হয়। সুতরাং তোমার মাথা নিচু করো এবং তোমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে অনুভব করো।”
রাজধানীতে পরিস্থিতিটা ছিলো বেশ চাপা উত্তেজনায় ভরপুর। শুধু কর্তাব্যক্তিদের চেহারাই নয় বরং অট্টালিকাগুলোকেও খুব বেশি মলিন আর কঠিন দেখাচ্ছিলো। ঘোড়ার গাড়িগুলো সবচেয়ে চমৎকার প্রাসাদ হোয়াইট হাউস আর ফারাও এর রাজপ্রাসাদের মাঝে থেমে গেলো। এমন কি মরুভূমির দিকে অজানা পথে যাত্রা করা গাড়িগুলোও থেমে পড়লো।
হেমিউনি কর্তৃক পরিচালিত একদল স্থপতি রাতদিন কাজ করছে। পরিকল্পনাটা তাদের কাছে খুব জটিল মনে হচ্ছিলো। প্রত্যেকেই ভাবছিলো যে যখন সে পুরো ব্যাপারটা মাথায় নিয়ে নিবে তখন তার মস্তিষ্ক অধিক চাপে বিস্ফোরিত হয়ে পড়বে।
উচ্চতায় এবং মূলভূমিতে যদি ছোট্ট কোনো সংশোধনও আনা হয় তাহলেও সেটা পুরো ব্যাপারটায় অসীম সংখ্যক পরিবর্তন বয়ে আনবে।
প্রত্যেকটি বিষয় দৃশ্যতই পুরো পরিকল্পনায় একটু ব্যতিক্রম ছিলো। ফাঁদ, গ্যালারি, বায়ু নির্গমনের পথ, ফাটল দরজা, গোপন প্রবেশ পথ যেটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে শূন্য কোনো জায়গায় নিয়ে যাবে, বের হওয়ার ভুয়া পথ, ধাপে ধাপে সিঁড়ির পরিমাপ, অতল গহ্বর, পাথরের সংখ্যা, মূল ভৌতিক কেন্দ্র, এ সব কিছুর কোনোটাই আলাদা করার মতো ছিলো না। পিরামিডের জনক ইমহোটেপের একটা বাণী আছে, ‘পিরামিড হলো এক এবং একক। (হেমিউনি প্রথম সভায় সকলকে এই কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো)
কথাটা তাদের মনের ভেতর পেরেকের মতো গেঁথে আছে।
যতোবারই তারা বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে প্রতিবারই ইমহোটেপের ঘোষণাটি তাদের কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছে। কিন্তু তাদের মনে কোনো সুখ ছিলো না। বরং ছিলো এক ধরনের যাতনা আর হতাশাবোধ। এটাও সত্য ছিলো যে, নগ্নভাবে দিনকে দিন এটা নিজেকে প্রকাশ করছিলো। আর পিরামিডের এই স্পষ্ট অস্তিত্ব যেনো তাদের উপরে একটা অভিশাপ হিসেবে পতিত হচ্ছিলো। পিরামিডটা যেমন ছিলো এটাকে সম্পূর্ণভাবে ঠিক তেমনই হতে হবে। এটার কোনো একটা অংশ বা কোণা যদি অসম্পূর্ণ থাকে তাহলে এটাতে ফাটল ধরবে কিংবা অন্য কোনো অংশ দেবে যাবে। সুতরাং তোমার আনন্দ কিংবা কষ্ট যাই হোক না কেন এর সম্পূর্ণতা নিয়েই তোমাকে কাজ করতে হবে।
এখন তারা উপলব্ধি করছে যে পিরামিডটা তাদের সকল চিন্তা-ভাবনা অংক কষা, পরিকল্পনা সব কিছুকে ভেস্তে দিয়েছে। তাদের কাছে প্রথম যখন পিরামিডটা স্বর্গীয় কিছু বলে বর্ণনা করা হলো তখন তারা বুঝতে পারছিলো যে এর মধ্যে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। এখন তারা বেশ উদ্বিগ্ন যে হয়তো সেই রহস্যটা রয়েছে এর কেন্দ্রবিন্দুতে। এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো। তাদের উপরিভাগে যদিও বিষণ্নতার একটা খোলস ছিলো কিন্তু তাদের অন্তরের অন্তস্থলে ছিলো তাদেরকে নিয়ে ভাগ্যের যে জটিল খেলা তা নিয়ে এক ধরনের গর্ব। যদিও পিরামিডটা এখন শুধু দলিলের পাতায় নকশার কাগজে প্যাপিরাসেই মুদ্রিত আছে এবং পিরামিডের জন্য এখন পর্যন্ত একটা পাথরও কাটা হয় নি তারপরেও থিবজ নগরীর প্রধান কারখানাগুলো রাষ্ট্রীয় কোনো নির্দেশনা ছাড়াই তাদের উৎপাদনের দর দ্বিগুণ করে ফেলেছে।
মেমফিসের কারখানার ফটকে রাজদরবার থেকে চাবুক বোঝাই রথ এসে থামলো। লোকজন আশা করছিলো যে কারখানার মালিককে আতঙ্ক ছড়ানোর অপরাধে শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু অল্প কিছু পরেই লোকজন জানতে পারলো যে কারখানার মালিককে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সময় উপযোগী প্রয়োজনটা বুঝতে পারার কারণে কারখানার মালিককে অভিবাদন জানিয়েছে।
মূল দলে থাকা স্থপতিরা হঠাৎ করে মনমরা হয়ে গেলো। কারণ পিরামিডের পরিকল্পনাটা তাদের ধারণার বাইরে করা হয়েছিলো। এমন কি মূল চিত্র আঁকা শেষ করার আগেই এর ধারণাটা ছিলো খুব ভয়ঙ্কর।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন পররাষ্ট্রদূতরা যদিও তারা ব্যাপারটা নিয়ে একটু উদাসীনতার ভান করছিলো, তারা এই খবরটা তাদের রাজধানী শহরে নিজ নিজ পন্থায় ছড়িয়ে দিয়েছিলো। তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের গুপ্ত কথা আর চিহ্ন পরিবর্তন করছিলো। ফলে দাপ্তরিক দায়িত্বে নিয়োজিত গোয়েন্দাদের এর মর্মকথা উদ্ধার করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো।
তবে শুধু একজন রাষ্ট্রদূত সে হলো কেনান দেশের সে প্রচলিত পথেই পাথরে খোদাই করে তার খবরাখবর আদান-প্রদান করছিলো। আর অন্যেরা বিশেষ করে লিবিয়া ও ট্রয় নগরীর দূত খুবই ষড়যন্ত্র পন্থায় এই খবরটা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। গ্রিক থেকে আগত বিশেষ বার্তাবাহক এবং ইলিয়ান অধিবাসিরা উড়ো উড়ো খবরটা নিয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছিলো। বিষয়টা তাদের মাথা ব্যথা আর ঘন ঘন শ্বাস ফেলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে জানে কোনো দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছে।
গোপন নিরাপত্তা বাহিনীদের কাছে সবচেয়ে অপছন্দের লোক ছিলো সুমিরিয়ানের রাষ্ট্রদূত সুপিলিউলিমা। খুব বেশি দিন হয় নি তার দেশে অশুভ কতোগুলো চিহ্ন আবিষ্কার করা হয়েছে। তারা সেগুলোকে বলে লিখন পদ্ধতি। কতোগুলো অস্পষ্ট ফোটার আঁকিবুকি দেখতে কাকের পায়ের চিহ্নের মতো। এই চিহ্নগুলোর নাকি অনেক ক্ষমতা যে এটা দিয়ে মানুষের চিন্তাকে স্থবির করে দেওয়া যায়, মৃত পচনশীল শরীরকে সজীব রাখা যায়। শুধু এতোটুকুই যথেষ্ট ছিলো না বরং মাটির ঢেলায় খোদিত এ চিহ্নগুলো চুলোর আগুনে সেকে শক্ত করে তারপর তারা এই দিয়ে বার্তা আদান-প্রদান করতো।
তুমি কল্পনাও করতে পারবে না যে রাজধানীতে কী ঘটতে যাচ্ছে। মিশরের রাষ্ট্রদূত যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছিলো তখন তার মধ্যে একটা গোপন আত্মতৃপ্তি ছিলো। সমস্ত দিন রথগুলো এ পাথরে লেখা সংবাদ নিয়ে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যাতায়াত করছিলো। একটা কিংবা দুটো রথে থাকতো পাথরের একটা খোদাই করা সংবাদ। রাস্তার পাশে অপেক্ষা রত কুলিরা রথ থামার সাথে সাথে সেটাকে খালি করতো। যদি দৈবাত হাত ফসকে কোনো খোদাই পাথর ভেঙে যেতো তাহলে সেখানে তুলকালাম কাণ্ড লেগে যেতো। আর সাথে সাথেই কেউ একজন ছুটে যেতো বিষয়টা মন্ত্রণালয়ের অফিসে জানানোর জন্য। এভাবে দিনের অর্ধেক সময় পিরামিড নিয়ে নানা ধরনের খবরাখবর চালাচালিতে সবাই ব্যস্ত থাকলো।
তবে পররাষ্ট্র দফতর থেকে উড়োউড়ো খবরটা শোনা গেলো যে সম্রাট চিওপস তার সভাসদদেরকে বেশ তিরস্কার করেছেন।
তবে ঘটনা যা হোক এটা সত্য ছিলো যে, পিরামিড তৈরির খবরটা শুধু মিশরের ভেতরেই নয় বাইরের রাষ্ট্রগুলোতেও আশাতীতভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সারা বিশ্ব থেকেই ঘটনাটাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছিলো। মিশরের প্রধান রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদে বোঝা যাচ্ছিলো যে পিরামিডের খবর সব জায়গায়ই বেশ উত্তেজনা তৈরি করেছে। চিওপস নিজে এ সমস্ত খবর খুব মনোযোগ দিয়ে একাধিকবার পড়েছেন। তাকে যেটা সবচেয়ে অবাক করেছে তা হলো তার শত্রুদেশগুলোও তাকে এই কাজে সম্মতি দিয়েছে এবং সমর্থন করেছে। এখন সম্রাটের কাছে পিরামিডের বিষয়ে হেমিউনি আর তান্ত্রিক ডেজদির ব্যাখ্যা খুব যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে।
অন্যদিকে তান্ত্রিক ডেজদির আরেকটি মতামত হলো পররাষ্ট্র দপ্তরের বুড়ো বুড়ো কর্মকর্তাদের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরিবর্তে সম্রাট চিওপসের উচিৎ হবে মেসোপটেমিয়ার খালটার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।
কারণ পানির এই উৎসটি মিশরের শক্ত পাথর যেমন আবশ্যকীয়, এটাও তেমনি আবশ্যকীয়। একে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।
আরেকটা সংবাদ প্রকাশিত হলো যে মিশরের সর্বত্রই সবাই কেবল পিরামিড নিয়েই আলোচনা করছে। প্রত্যেকটি ঘটনা যেনো এই বিশাল কাজটার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে।
তবে কোনো কোনো মেয়েলোক এ বিষয়টাকে স্রেফ একটা গুজব মনে করলো। এবং তারা বিশ্বাস করলো যে তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তবে ব্যাপারটা ঘুরে যাবে যখন এক শুভ সকালে তারা আবিষ্কার করবে, তাদের স্বামী, তাদের প্রেমিক পুরুষ, তাদের স্কুলগামী সন্তানকে যেতে হচ্ছে এই অশুভ কাজের জন্য। আর তখন তুমি হয়তো কান্না কিংবা আনন্দের চিৎকার শুনতে পাবে।
এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলো যে পিরামিড তৈরি করার সময় শুধু এর চারপাশে সংলগ্ন রাস্তা-ঘাট তৈরি করতেই দশ বছর লেগে যাবে। প্রবেশ-রাস্তা তৈরির সাথে সাথে পিরামিড তৈরির মূল কাজও জড়িত ছিলো, আর সাথে ছিলো মহান সেই কর্মযজ্ঞের জন্য মানুষদেরকে তাদের সব অনিশ্চিয়তা দূর করে প্রস্তুত করা।
বিশাল এ কাজের জন্য মানুষের মাঝে অবসন্নতা আর অস্থিরতা দূর করে তাদের মাঝে কাজের স্পৃহা তৈরি করাটাও ছিলো খুব কঠিন কাজ।
এখন সবাই এটা স্বীকার করে নিয়েছে যে যদিও অট্টালিকা নির্মাণ কাজে স্বাভাবিক যে ধুলোবালি দেখা যায় পিরামিড তৈরিতে তার ছিটেফোঁটা বালির চিহ্নও এখনো দেখা যায় নি। তারপরও এর শক্ত ভিত্তিমূলটা সবার মাঝে এর মধ্যেই গেঁথে গেছে।
একটা ভূত কিংবা অপচ্ছায়ার মতো পিরামিড সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন অনেকেই আছে যারা অসহিষ্ণু হয়ে অপেক্ষা করছে কবে পিরামিড তৈরির কাজ শুরু হবে আর তারা এই দুঃস্বপ্ন থেকে পরিত্রাণ পাবে।
স্থাপত্যবিদদের মূল দলটি এখন জানতো, যে জনগণ যাদের মাঝে অধিকাংশই জীবনে কখনো একটা কালির আঁচড়ও একে দেখে নি তারা এখন পিরামিড তৈরির ভাবনায় নিজেদের মতো করে ডুবে আছে। এক রাতের ভোজে স্থাপত্যবিদরা কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে খেতে বসে খুব একটা আনন্দিত বোধ করছিলো না। যদিও তারা সবার দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো।
‘আপনি পিরামিডের স্থাপত্যশৈলী নিয়ে কেমন চাপে আছেন? এক চিত্রশিল্পী যুবক একদিন এক স্থপতিকে জন্মদিনের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করে বসলো।
‘তুমি চিন্তা করতে পারবে না কী ধরনের চাপ আমি আমার পাকস্থলিতে অনুভব করছি। এটা অন্য সময়ের চেয়ে হাজার গুণ বেশি।’
.
ফারাও চিওপস সামগ্রিক কাজের অগ্রগতির উপর খুব কাছ থেকে নজর রাখছিলো। একদিন প্রাসাদের বিশেষ কোনো ঘরটি প্রধান স্থপতিদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো, সেই ঘরে চিওপস এসে হাজির হলো। দেয়ালে বেশ কিছু সংখ্যক পেপেরি দলিলের মধ্যে দুর্বোধ্য সব চিহ্ন আঁকিবুকি হয়ে রয়েছে। নানা রকমের গাণিতিক চিহ্ন, দিক-নির্দেশনা। হেমিউনি সম্রাট চিওপসকে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন আর ফিস ফিস করে সব কিছুর ব্যাখ্যা করছিলেন। ফারাও একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। সবাই বুঝতে পারলো ফারাও খুব দ্রুত চলে যেতে চাচ্ছে।
তবে পিরামিডের মডেলটা যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম প্রকাশ করা হলো সেদিন তিনি বেশ কিছু সময় সেখানে অবস্থান করেছিলেন।
তার চোখে বেশ শান্ত আর ধীরস্থির একটা ভাব ছিলো। মসৃণ নরম পাথরের পিরামিডের মডেলটি দাঁড়িয়ে আছে।
সম্রাট চিওপস একটা বিষয় নিয়ে বেশ দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। তার মনের মধ্যে কি জানি একটা বিষয় বার বার উঁকি মেরে আবার পিছল খেয়ে কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি পিরামিডের সাথে সাদা মসৃণ মোটা মোটা চুনাপাথরগুলোর সম্পর্কটা ধরতে পারছিলেন না। বিশেষ করে তৃতীয় এই পিরামিডের সাথে যেটা এখনো তৈরি হয় নি আর যেটা রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের মনে এখনো স্থির হয়ে আছে।
হেমিউনি সম্রাটের কাছে আসল তার সাথে কথা বলার জন্য। সে সম্রাটকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে কেন সে পয়তাল্লিশ ডিগ্রির পরিবর্তে বায়ান্ন ডিগ্রি কোণা কুণিকে পছন্দ করেছে। সে পিরামিড তৈরির কিংবদন্তি ইমহোটেপের কথা স্মরণ করলো যে প্রথম পিরামিডের ডিজাইন এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিলো। সে নক্ষত্রের নিখুঁত অবস্থান ধরে পিরামিড তৈরির সময়কাল বিষয়ে সম্রাটকে আরো নানা রকম তথ্য দিলো। কিন্তু সম্রাটের মনোযোগ ছিলো তখন অন্য কোথাও। তিনি নিজের মনেই একটা বিষয় বোঝার চেষ্টা করছিলেন যখন প্রধান পুরোহিত একটা কাঠের টুকরো নিয়ে বর্ণনা করছিলেন যে কীভাবে বড় বড় পাথরগুলো উপরে ওঠানো হবে।
‘ঠিক এই বিষয়টাই আমি জানতে চাচ্ছিলাম কীভাবে এমন উঁচুতে পাথরগুলো ওঠানো হবে।’ ফারাও চিওপস বললো।
‘মহামান্য! কোনো সমস্যা নেই। প্ৰধান স্থপতি বললো। ‘আপনি নিশ্চই কাঠের তৈরি এই মাচানটি দেখতে পাচ্ছেন। আমরা এরকম আরো চারটি মাচান তৈরি করেছি বড় বড় এই পাথরগুলো রশি দিয়ে এই মাচানের সাহায্যে আমরা স্থাপন করব। মহামান্য আপনি দেখেন কীভাবে মাচনগুলো পিরামিডের দিকে ঝুকে আছে।
চিওপস তার মাথা নাড়লো, যার অর্থ হচ্ছে ‘হ্যা’ তিনি বুঝতে পারছেন। ‘পিরামিডটাকে এখন কেমন একটা ধূমকেতুর মতো মনে হচ্ছে।’ ফারাও চিওপস বললো। এ প্রথমবারের মতো তার ঠোঁটে একটু হাসির রেখা দেখা গেলো।
হেমিউনি হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেললো।
‘এই তীর নির্দেশনার চিহ্নটা কী?’ ফারাও জিজ্ঞেস করলো।
প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্ত বিরতিতে হেমিউনির গলার স্বর আবার নেমে গেলো।
‘মহামান্য সম্রাট! এ গ্যালারিটা মরদেহ যে চেম্বারে রাখা হবে সেখানে নিয়ে যাবে।’
হেমিউনি সম্রাটের চোখের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিলো।
ফারাও একটা ছরির দণ্ড দিয়ে চিহ্নটি স্পর্শ করে বললো, “আর মরদেহ রাখার ঘরটি কোথায় থাকবে?
‘মাননীয় এ ঘরটি পিরামিডের মূল মডেলের মাঝে নেই। কারণ ঘরটা পিরামিডের মধ্যে থাকবে না। এটা থাকবে পিরামিডের বাইরে। মাটির নিচে এটাকে স্থাপন করা হবে। একশো ফিট কিংবা তার চেয়েও আরো অনেক গভীরে। এমন একটা অবস্থানে যেখানে পিরামিডের ওজন এক বিন্দুও অনুভূত হবে না।
চিওপসের চোখ দুটি যেখানে তার মরদেহটা রাখা হবে সেই মাটির অতল তলের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো। কিছু দিন আগে সে একটা স্বপ্ন দেখেছিলো। তার এখন সেই স্বপ্নটার কথা মনে পড়ছে। সে দেখেছিলো তার নিজের শবদেহটা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেভাবে একটা শরীর পানিতে তলিয়ে যায়।
‘যেভাবে আপনার পিতা সেনেফিরুর শবদেহ রাখা হয়েছিলো ঠিক সে ভাবে। বেশ নিচু স্বরে হেমিউনি কথাগুলো বললো।
চিওপস কিছুই বললো না। তার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো। কিন্তু সে বাইরে সেটা প্রকাশ করলো না। তার হাতের ছড়িটা শুধু একটু কেঁপে উঠলো।
‘তোমাদের কাজটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।’ শেষ কথা বলে সম্রাট তার পা ঘুরালো বের হওয়ার জন্য। যেতে যেতে তার শেষ শব্দটি ছিলো, ‘তোমাদের কাজ শুরু করো।
মাথা ঘুরিয়ে চলে যাবার সময় সম্রাটের কথাগুলো যেনো বাতাসে ভেসে ভেসে আস্তে আস্তে স্থপতিদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছিলো।
‘তো-মা-দে-র- কা-আ-আ-জ-জ-জ -শু-উ-উ-রু-উ- ক-অ-রো-অ।
কয়েকটা মুহূর্ত সম্রাটের কথাগুলো তাদের পেছনে রয়ে গেলো, যেভাবে একজন দরবেশের পেছনে তার ভক্তকুল ঘুরে বেড়ায়।
শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে সম্মতি গৃহীত হলো।
পিরামিডের যে প্রতিকৃতি যেটা মাত্র গতকাল হস্তান্তর করা হয়েছে সেটা আজ অস্পৃশ্য আর দুর্মূল্য হয়ে পড়লো। সাদা মসৃণ চুনা পাথরের তৈরি পিরামিডের ছোট্ট এই প্রতিকৃতির আলোকছটা শুধু তাদের চোখগুলোকে ঝলসে দিচ্ছিলো না বরং সেটা সারা পৃথিবীকে চমকে দিচ্ছিলো।
পিরামিডের দিকে প্রবেশের রাস্তাটা তৈরি করা হচ্ছিলো রাজ্যের বিভিন্ন দিক থেকে একটা সমীকরণ হিসাবের মাধ্যমে। আগের পিরামিডের সবগুলো রাস্তার যাবতীয় চিহ্ন মুছে গিয়েছিলো অনেক আগেই। এখানে সেখানে যদিও এখনো ভাঙা অবশিষ্ট কিছু অংশ খুঁজে পাওয়া যায়। বেশ কয়েক বছর আগে সেগুলোকে মেরামতও করা হয়েছিলো। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোনো কিছুই পাওয়ার সুযোগ নেই। এমন কি পুরাতন জরাজীর্ণ সেই রাস্তাগুলোকে যদি ঠিক করাও হয় তাহলেও সে রাস্তা দিয়ে নতুন পিরামিডে প্রবেশ করার কোনো উপায় ছিলো না। কারণ প্রত্যেকটা পিরামিডেরই নিজস্ব একটা মূল রাস্তা ছিলো যেটা দিয়ে পাথরখাদ থেকে পিরামিড তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আনা নেওয়া করা হতো।
তবে পিরামিড তৈরির অন্যান্য উপাদান যেমন ধাতুর স্তম্ভ, কাঠ, মাটি, পাথর এগুলো মাঝে মাঝে জরুরি বিষয়গুলো পরিবহনের জন্য নতুন রাস্তা ব্যবহার করা হতো। আর এ সব কিছুই নির্ভর করতো কাচামালগুলো কতো দূরে তৈরি হচ্ছে কোথায় তৈরি হচ্ছে তার উপর।
এ সব কাজ যদিও বিশাল এই প্রকল্পেরই অংশ ছিলো নিঃসন্দেহে কিন্তু তারপরেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা ছিলো পিরামিড তৈরির পাথরগুলো নিয়ে।
কয়েক ডজন অফিসের কর্মকর্তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো পাথরগুলো আনা নেওয়া এবং এর পরিবহন কাজের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে।
কী পরিমাণ পাথর উত্তোলন করতে হবে, সংগ্রহ করতে হবে এবং কতো ঘণ্টা কাজ করতে হবে এ সমস্ত নানা ধরনের পরিকল্পনাও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিলো।
পাথরগুলো পরিবহনের জন্য নীলনদের ব্যবহার ছিলো অপরিহার্য। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে লোকজন নীলনদ ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকার চিন্তা করছিলো। আবার নীল নদ যদি ব্যবহার না করা হয় তাহলে পিরামিড তৈরিতে মতো বেশি সময় লাগবে যে ফারাও চিওপস হয়তো তার পিরামিডটা দেখে যেতে পারবেন না।
এ অবস্থায় নীল নদ ব্যবহার না করে অন্য কিছুরও ব্যবস্থা ছিলো না। আবার অন্যদিকে এই মৌসুমে কিংবা অন্য মৌসুমে পাথর এবং গ্রানাইট বোঝাই মালামাল আনয়নের জন্য কী পরিমাণ ভেলা লাগতে পারে সে বিষয়ে সমস্ত সম্ভাবনার বিষয়টা ভাবনা-চিন্তা করা উচিৎ ছিলো আগে থেকেই।
যা হোক উচ্চ অফিসিয়াল কর্মকর্তাসহ সবাই পুরো বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবে অঙ্ক কষছিলো।
কতোটুকু আনুভূমিক রেখায় এটা দাঁড়াবে এ নিয়ে স্থাপত্যবিদরা ভাবছে আবার পিরামিডের আভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা কেমন হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করছিলো আরেকটি দল।
তবে পিরামিড নিয়ে সবচেয়ে রহস্যময় বিষয়টা ঘটছিলো প্রধান যাদুকর মোরহেবকে কেন্দ্র করে। তিনি তার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দলটি নিয়ে নক্ষত্রের অবস্থান আর এর ভবিষ্যৎ সব কিছু নিয়ে গভীর চিন্তার মাঝে ডুবে গিয়েছিলেন। কেউ যখন এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতো তখন তাদের কাছ থেকে তেমন ভালো উত্তর পাওয়া যেতো না।
পিরামিডের এতোটুকু কাজ এগুনো অবস্থায়ই গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে পিরামিড হয়তো তৈরি হবে না।
হয়তো পিরামিডের বীজটুকুই মাটিতে রোপন করা হয়েছে কিন্তু এর অঙ্কুর হয়তো আর পৃথিবীর মুখ দেখবে না।