সম্রাটদের জঞ্জাল

সম্রাটদের জঞ্জাল

আকাশের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।

অনেকে হত বিহ্বল।

ভীত-সন্ত্রস্ত।

আকাশ ধুলিতে ছেয়ে আছে।

চিওপস প্রাসাদের উঁচু তলায় চিন্তিত মুখে এদিকে ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিলেন।

তিনি চেষ্টা করছিলেন কোনো দিকেই তার মাথাকে না ঘোরাতে। কিন্তু পারছিলেন না। তিনি কিছুতেই সম্রাটদের পশ্চিম দিক থেকে অন্ধকার করে ধুলির যে ঝড় আসছিলো তার থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে নিতে পারছিলেন না। পশ্চিম দিকের ধুলির ঘুর্ণিঝড়টা এতোই অন্ধকার করে এগিয়ে আসছিলো যে এমনটা ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায় নি। এটাকে মনে হচ্ছিলো দুপুরের পরে কোনো সামুদ্রিক ঝড়। এ ঝড়ে পিরামিডের বালুকণা সর্বত্রই পাওয়া যাবে। ফারাও চিওপস উপলব্ধি করছিলেন যে পিরামিডের উঁচুতে তার সমাধিস্থ কবরটা এ বাতাসে দ্রুত ছুটে বেড়ানো অশ্বের মতো হারিয়ে যাবে।

তিনি নিজেকে শান্ত্বনা দিচ্ছিলেন এ বলে যে, এটাই তার ভাগ্য। আর এ নিয়ে কারো কাছে অভিযোগ করারও কিছু নেই। এই চিন্তাটা তাকে আরো বেশি দুঃখী আর বিষণ্ণ করে তুলছে।

দুই প্রস্তর তথ্য প্রমাণিদের কাগজপত্র একটা পাথরের টেবিলের উপর রাখা ছিলো। একটা ছিলো বেশ পুরু আর ভারি। সেখানে লেখা আছে তার বাবা সেনেফিরুর জীবনী। কিছু দিন আগে একদল ঐতিহাসিক এ কাজটা সমাপ্ত করেছেন। অত্যন্ত দক্ষতা আর সুচতুরতার সাথে এটা সমাপ্ত করা হয়েছে।

চিওপসকে অনুরোধ করা হয়েছে তার বাবার জীবনীর উপর চোখ বুলাতে। যাতে করে তিনি তার নিজের জীবনী লেখার ধরণটা পছন্দ করতে পারেন। তার জীবনী লেখার কাজ খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে।

টেবিলের উপর ছড়ানো অন্যান্য দলিল-দস্তাবেজের মধ্যে রাষ্ট্রের সমসাময়িক সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ধরনের বিষয় অন্তর্ভূক্ত আছে।

তার বাবার জীবনী পড়ার আগে তিনি আরো একটা দিন অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। আজকে তার মন আর আত্মা দুটোই বেশ বিক্ষিপ্ত।

তার বাবার জীবনী সম্বলিত পাণ্ডুলিপিটি দুটো স্তরে বিভক্ত। দুটো বিষয় আলাদা।

প্রথম অংশটা লাল চামড়ার মলাটে ঢাকা। যেখানে তার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সময়ের ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ আছে।

আর দ্বিতীয় অংশটা ছিলো রঙিন চামড়ার মলাটে ঢাকা। যেখানে তার বাবার পরকালীন জীবন সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করা আছে।

তিনি ভাবলেন যে, তিনি তো জানেন প্রথম পাণ্ডুলিপিটিতে কী লেখা আছে। সেখানে আছে তার বাবার যৌবনকাল, ফারাও হিসেবে তার অভিষেক, সৈন্য-সামন্ত নিয়ে প্রথম অভিযান, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুভাবাপন্ন সন্ধি, তাকে নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের রহস্য প্রকাশ, যুদ্ধ, তাকে নিয়ে কবিদের বিভিন্ন প্রশংসা গীতি

তবে পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় অংশটা নিয়ে তার কিছু কৌতূহল রয়েছে। ফারাও চিওপস আস্তে আস্তে দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা খুললেন :

“সেনেফিরুর দিন, দিন শেষে, সেনেফিরুর রাত, তারপর আবার সেনেফিরুর দিন, আবার রাত, আবার সেই দিন, আবার দিনের পর সেনেফিরুর রাত, তারপর রাত শেষে আবার সেনেফিরুর আরেকটা দিন। এই দিন শেষে আবার রাত।’

‘কল্যাণময় ঈশ্বর!’ ফারাও চিওপস আর্তনাদ করে উঠলেন। তিনি নিজেকে কল্পনা করছিলেন তার শবদেহ থাকার জায়গাটিতে তিনি সম্পূর্ণ একা।

তিনি তার নামটি বাবার নামের জায়গায় বসালেন।

‘চিওপসের দিন, চিওপসের রাত…. বিষয়টা তিনি খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন যে তার ভেতরের ক্রোধটুকু একেবারে দমে গেলো। তিনি শান্ত হয়ে গেলেন।

তাহলে তার মৃত্যু পরবর্তী জীবনীটা কেমন হবে।

প্রথম পাণ্ডুলিপিটার শিরোনাম ছিলো, ‘প্রথম তিনশো বছর’

প্রথম তিনশো বছরের বর্ণনাই যদি এমন একঘেঁয়ে হয় তাহলে বাকি শতাব্দীগুলোতে এর পরিবর্তন আশা করা বৃথা।

তিনি আবার পাণ্ডুলিপিটা উল্টালেন। সেই একই রকম শব্দ আর বাক্যের দেখা তিনি পেলেন। তিনি পুনরায় তার নামটা বাবার নাম দিয়ে পাল্টিয়ে দেখলেন কী হয়। নিমীলিত নয়নে ভাবলেশহীন শান্তভাবে ভাবলেন।

‘চিওপসের দিন, চিওপসের রাত, চিওপসের রাতের পর আবার চিওপসের দিন, চিওপসের আরেকটা রাত…’

‘নির্বোধ কতোগুলো।’ তিনি নিজের মনে রাগে গরগর করলেন। পাণ্ডুলিপি লেখকরা প্রথম তিন বছরের গড় পরতা একটা হিসাব ধরে সব’ কিছু বর্ণনা করেছে। ঠিক ধারাবাহিকভাবে।

তিনি পাণ্ডুলিপির বড় স্তুপটা বুকের মধ্যে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেনো কোনো রমণীকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দিতে চাচ্ছেন। তারপর তিনি সেটাকে মেঝেতে নিক্ষেপ করলেন। পাণ্ডুলিপির একটা অংশ ছিঁড়ে ফেলে তিনি অনুভব করলেন খুব শান্ত লাগছে। রাগটা মনে হয় হঠাৎ করেই কমে গেছে। কি মনে করে তিনি পাণ্ডুলিপির একটা অংশে তীব্র কৌতূহল নিয়ে আবার ঝুকে পড়লেন।

‘সকালে রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিটি উপস্থিত হলেন। তারপর প্রধান পুরোহিত একে একে মন্ত্রিসভার সকল সদস্য এবং সকল রানীরা ফারাওকে তাদের অভিবাদন জানালেন। অনুষ্ঠান শেষে ফারাও বিশ্রামে গেলেন। অতঃপর ফারাও-এর দ্বিপ্রহর, তারপর ফারাও-এর দ্বিপ্রহরের পর ফারাও-এর রাত, অতঃপর ফারাও-এর দিন…

…এরপর শুরু হবে চিওপসের দিন…

কেবল বর্ণনা। ধারাবাহিক বর্ণনা। চলছে অবিরাম। চলমান।

তিনি পাগলের মতো পাণ্ডুলিপির এখানে সেখানে হাতড়ে বেড়াতে লাগলেন। একটা জায়গায় এসে তার চোখ আটকে গেলো। তিনি জানেন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো খুব কমই চোখে পড়ে। সেগুলো অসংখ্য নক্ষত্রের ভিড়ে থাকলেও। তিনি পড়তে থাকলেন ফারাও-এর রাজ্যাভিষেকের ঘটনা। শুধু তাই না তার নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠান, কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান। যেখানে হিসাব করে বলা হচ্ছে তার মৃত্যুর পরবর্তী পরকালীন জীবনটা কেমন সুখী হবে। কেমন সুখে থাকবে সে স্বর্গে। আহ! স্বৰ্গ I

তিনি মনে মনে একটু বিরক্তির সাথে ফিসফিস করে উঠলেন।

মিশরে এখন এমন একটা কাজ হতে যাচ্ছে যা সারা পৃথিবীকে বিমূঢ় করে দিবে। পৃথক করে দিবে মিশর থেকে। রাষ্ট্রদূতরা এমনই কিছু তথ্য তাকে দিয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও তাকে বেশ গর্বের সাথে এ সমস্ত তথ্যের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য মন্ত্রী মহোদয়েরা বলছে যে সারা বিশ্বে মিশরের নিজস্ব একটা প্রভাব ক্রমশ বেড়েই চলছে।

পিরামিড নিয়ে মৃত্যু পরবর্তী ধারণা এবং পরবর্তী জীবন সম্পর্কিত দর্শন মানুষকে বেশ অবাক করছে। বিশেষ করে ক্রিট অঞ্চলে যেখানে মানুষ সদ্য বসবাস শুরু করছে তারা মিশরীয়দের কাছ থেকে মাত্র জানতে পারলো যে তাদের এ জীবন ছাড়াও আরো একটা জীবন আছে। তারা বলাবলি করছে যে তারা এতোদিন ছিলো মুর্খ, তারা ভাবতো জীবন কতো ছোট, অথচ আজ তারা জানে জীবন কতো অসীম। রাষ্ট্রদূতরা তাকে জানালো যে ক্রিট অঞ্চলের লোকেরা মিশরের কাছ থেকে এ বিষয়টা জেনে খুব সন্তুষ্ট। মিশরের মৃত্যুপরবর্তী মানুষের জীবন সম্পর্কিত এ ধারণা হয়তো পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে দিবে।

সম্রাট চিওপস চুপ করে শুধু মন্ত্রীদের কথা শুনছিলেন। শুরু থেকে তারা কী বলছিলো সেটা তিনি বোঝার চেষ্টা করছিলেন না। মন্ত্রিপরিষদ যখন চলে গেলো তখন চিওপস আবার উঠে ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণের জন্য তিনি যেনো স্থানে পিরামিডটা তৈরি হচ্ছিলো সেদিকের নির্মাণের ধুলির মেঘের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।

তিনি আজ অন্যান্য দিনের চেয়েও আরো ঠাণ্ডা মাথায় ভাবছিলেন যে মিশর যদি তার সমাধিসৌধের ধারণাটা অবশিষ্ট পৃথিবীর কাছে না পৌঁছাতো তাহলে তাকে পিরামিড তৈরি করতে হতো না। আর যদি পিরামিড তৈরি না হতো তিনি বারবার ভাবছিলেন তাহলে পিরামিডের এ ভয়ঙ্কর ধুলির মেঘ তার জীবনটাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে পারতো না।

পেছনের অনেকগুলো বছর তাকে ভেতর থেকে কেউ একজন বলে আসছিলো যে, তিনি যেনো পিরামিড তৈরি না করেন। কিন্তু তার মন্ত্রীরা শেষ পর্যন্ত তাকে নির্বিঘ্নে সম্মত করালো। এখন তিনি ইচ্ছে করলেও পিরামিড থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবেন না। আর তা হবারও নয়।

‘আমি এটা তোমার জন্য তৈরি করেছি। আমি নিজেকে তোমার জন্য উৎসর্গ করেছি।’ ফারাও চিওপস নিজের সাথেই চিৎকার করে কথাগুলো বললেন।

এখন সবাই তাকে এ পিরামিডের ভেতর একা ফেলে চলে যাবে। হ্যাঁ, . তিনি একা হয়ে পড়বেন। এই সমাধি আর তিনি বড্ড একা।

দীর্ঘক্ষণ তিনি কোনো কিছুই না ভেবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর তিনি আবার তার সামনে চামড়া দিয়ে বাঁধানো পাণ্ডুলিপিগুলোর দিকে মনোযোগ দিলেন যেখানে পূর্ববর্তী ফারাওদের সম্পর্কে লেখা আছে অনেক তথ্য। তিনি ভাবছিলেন আকাশের ঐ অনন্ত নীল এ মুহূর্তে তার মনের দুঃখবোধটাকে তাড়িয়ে দিবে। কিন্তু সেটা হচ্ছিলো না। বরং অস্বস্তির এই পাণ্ডুলিপিটাই বার বার তাকে আকৃষ্ট করছিলো।

তিনি জানেন এ কাগজগুলোর ভেতর কী লেখা আছে। কিন্তু তারপরেও তিনি চামড়া দিয়ে বাঁধানো এ খাতাটা আবার খুলে বসলেন।

‘রাজকীয় বিভিন্ন কার্যাবলির বর্ণনা, প্রাসাদের মেয়েদের শিক্ষা পদ্ধতিসহ আরো নানা বিষয় সেখানে উল্লেখ ছিলো। তারপর আবার এলো পূর্ববর্তী ফারাওদের সমাধি নির্মাণের প্রসঙ্গ।

পিরামিড নিয়ে সেখানে সাধারণ মানুষের আবেগ অনুভূতি। সাধারণ মানুষ কিছুতেই পিরামিডটাকে কল্যাণকর বলে মনে করতে পারছিলো না। তারা উপলব্ধি করছিলো যে পিরামিডটা শুধু তাদের প্রাত্যহিক জীবনটাকেই ধ্বংস করছে না এটা বরং পুরো মিশরকেই শেষ করে দিচ্ছে।’

চিওপস এ সমস্ত বিষয় পড়তে পড়তে আরো অস্থির হয়ে পড়ছিলেন। তার চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য তিনি কোনো অনুভূতিই পাচ্ছিলেন না তার সারা শরীরে। তিনি বুঝতে পারছিলেন লোকজন এই পিরামিডটাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে।

তিনি নিজেও পিরামিডটার প্রতি এক রকম ঘৃণা আর অবজ্ঞা টের পাচ্ছিলেন। এখন তিনি বুঝতে পারছিলেন কোনো বিষয়টা তাকে পছন্দ করতে হবে আর কোনোটা তাকে ঘৃণা করতে হবে।

তিনি আর তার কুৎসিৎ অনুসারী চামচাগুলো এক সাথে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।

চিওপস চোখ তুলে তাকালেন। আকাশের দিকে তিনি তাকিয়ে দেখতে পেলেন ধুলির মেঘেরা ছড়িয়ে পড়ছে। আহ! এগুলো কী।

এগুলো তো সম্রাটদের জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ লোকগুলো ঘৃণা নিয়ে তার জন্য পিরামিড তৈরি করছে। সমাধি তৈরি করছে। পিরামিডের প্রতি তাদের কোনো ভালোবাসা নেই।

‘তারা তোমাকে পছন্দ করে না।’ চিওপস মনে মনে বারবার কথাগুলো বললেন। তিনি যেনো বিড়বিড় করলেন।

‘কিন্তু আমি তাদের দেখে নিব। …‘নাহ! তোমাকে পছন্দ করার জন্য তাদের কোনো প্রয়োজন নেই।’

তিনিতো পিরামিডকে ভালোবাসার জন্য তাদেরকে চাপ দিতে পারেন না। যদিও এ কাজটা করা তার জন্য খুব একটা কষ্ট হবে না। তিনি ইচ্ছে করলেই এ মানুষগুলোকে পোকা-মাকড়ের মতো পিষে মেরে ফেলতে পারেন।

চিওপস বুঝতে পারছিলেন তিনি যেনো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছেন। তিনি পাগলের মতো বিড় বিড় করে ঘরের ভেতর ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। ক্রোধে তার হাঁটু কাঁপছে। চিওপস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন।

তিনি আবার যখন মার্বেল পাথরের টেবিলটার কাছে চলে আসলেন তখন সিদ্ধান্ত নিলেন তার পিতা আর পূর্বপুরুষের জীবনী পড়ে তিনি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করবেন।

পাণ্ডুলিপিটা পড়তে পড়তে তিনি এক জায়গায় দেখতে পেলেন যে, তখন তার বয়স মাত্র তেরো। একদিন প্রধান পুরোহিত হেমিউনি তার বাবার সামনে একটা বিশাল রূপার থালা ভর্তি করে কতোগুলো কাটা জিহ্বা নিয়ে এসে হাজির হয়েছে।

তার বাবা তাকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বললেন যে, এগুলো হলো সেই সমস্ত লোকেদের জিহ্বা যারা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রাধিকারীর বিরুদ্ধে অহেতুক দুর্বল কথা এবং অপপ্রচার চালাচ্ছে। একদিন তোমাকেও এরূপ করতে হবে। পিতা সেনেফেরু চিওপসকে বললেন। তুমি যদি এটা না করো তাহলে এই জিভগুলো তোমার দিকে তাদের বিষ ছুড়ে মারবে।’

চিওপস ভাবলেন। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কয়েক হাজার রূপার থালা ভর্তি কাটা জিভ দিয়েও এখন কিছু করা যাবে না। পানি বহুদূর গড়িয়েছে।

চিওপস তীক্ষ্ণ বেদনাহত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর পাথরের শেলফের দিকে এগিয়ে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে প্রধান যাদুকরকে আসার নির্দেশ দিলেন।

যাদুকর উপস্থিত হলে চিওপস তার দিকে না ঘুরেই জিজ্ঞেস করলেন যে, তিনি সাম্প্রতিক সময়ে পিরামিড নিয়ে যে গুজব শুনছেন সেটা সত্য কিনা।

‘হ্যা জ্বি হুজুর, কিছুটা সত্যি। আপনার পিরামিডের পর একটা অতি আধুনিক পিরামিডের যুগ আসছে এমন কিছু কথা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এগুলো খুবই বাজে কথা। আমি প্রধান নিরাপত্তা রক্ষীদের বিষয়টা সতর্কতার সাথে দেখতে বলেছি।

‘আমি সেটা জানি।’ চিওপস বললো। কিন্তু আমরা যদি অসফল হই তাহলে সত্যিই কি কোনো অতি আধুনিক পিরামিডের যুগ আসছে?’

‘হুঁ। মহামান্য আমি বুঝতে পারছি না কী বলবো এ বিষয় নিয়ে।

সম্রাট চিওপস যাদুকরকে বিশ বছর আগের একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। যখন যাদুকর বলেছিলো পিরামিড হলো মিশরের মূল ভিত্তি, রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো।

চিওপস ভাবলেন আহ! সময় কতো দ্রুত পার হয়ে যায়।

‘তাহলে তখন কী ঘটবে… আমি বলতে চাচ্ছি যখন পিরামিড উত্তর সময়ের যুগ আসবে?’

‘হু! মহামান্য আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে একটা কথা বলি। পিরামিডের উত্তর সময়ের যুগ কখনোই আসবে না। এখন যে পিরামিডটা আছে সেটাই আজীবন থেকে যাবে।’

চিওপস আকস্মিকভাবে জাদুকরের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

‘ডেজডি তুমি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবে না। ঠিক এ মুহূর্তে যখন পিরামিড নির্মাণ শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন এই ধরনের গুজব কাম্য নয়।’

‘মহামান্য সম্রাট! একটা পিরামিড নির্মাণ কখনোই শেষ হবে না। জাদুকর উত্তর দিলো।

‘তুমি কী বলতে চাও?’ সম্রাট চিৎকার করে বললেন।

‘তাহলে আমাকে কি আরো একটা পিরামিড তৈরি করতে হবে যেভাবে আমার বাবা তৈরি করেছিলেন? বাকি অসম্পূর্ণ এ পিরামিডটা ধ্বংস করে আবার পুনঃনির্মাণ করতে হবে?’

‘না, মহামতি চিওপস। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি এ পিরামিডটার কোনো শেষ নেই। আমি সব সময় আপনার বিষয়টা নিয়েই ভাবছি। আমি জানি এই পিরামিডের সমকক্ষ আর কিছু নেই। দ্বিতীয়বার এটা তৈরিরও কোনো প্রয়োজন নেই। একই সাথে এটা প্রায় শেষের পথে।’

প্রধান যাদুকর দিগন্তের দিকে তাকালেন যেখানে ধুলির মেঘগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

‘পিরামিডের অভ্যন্তরে হয়তো এ শরীরটা নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু তার আত্মাটা চির জাগরুক, চিরঞ্জীব। প্রধান যাদুকর বলতে থাকলেন।

তার কথা শেষ হলে সম্রাট চিওপস একটু উষ্ণ স্বরে বললেন, “আর কতোগুলো ধাপ রয়েছে পিরামিডের চুড়ায় পৌছাতে?’

‘পাঁচটা ধাপ মহামান্য।’ প্রধান যাদুকর প্রতিউত্তরে বললো।

‘পিরামিড সংক্রান্ত মন্ত্রী আমাকে ব্যাখ্যা করে জানিয়েছে আর দুই শতো পঞ্চাশটা পাথর লাগবে এটা শেষ হতে। কিংবা তার চেয়ে কম।’

‘মাত্র দুই শতো পঞ্চাশ! তাহলেতো এটা প্রায় শেষের পথে।’

সম্রাট উত্তর করলেন। তার কথায় একটু আনন্দের আভাস পাওয়া গেলো। সম্রাট হাসির চেষ্টা করলেন সত্যি কিন্তু হাসিটা তার ঠোঁটে ঝুলে রইলো।

‘আরো প্রায় দুশো পাথর খণ্ড। আহ! কবে শেষ হবে? আকাশে বালির ঘুর্ণিগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। একটা মরুঝড় আসছে।’ চিওপস বললো।

প্রাসাদের ভেতর বাতাসের শিসের শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিলো না। কেউ একজন যদি ব্যালকনি থেকে চিওপসের পাণ্ডুলিপিগুলো সরিয়ে না নিতো তাহলে সেগুলো হয়তো বাতাসে ভেসে যেতো।

আসলে চিওপসও ভাবছিলো পাণ্ডুলিপিগুলো জাহান্নামে যাক।

‘বালু আর তার উড়ে চলার শব্দ এই নিয়েই তোমার মিশর।’ চিওপসের বাবা মারা যাওয়ার আগে তাকে এ কথাগুলো বলে গিয়েছিলো।

‘যদি তুমি এ বালিগুলোকে শাসন করতে পারো তাহলে তুমি পুরো রাষ্ট্রটিকে শাসন করতে পারবে।’

যখনই এ ধরনের কোনো ঝড় মরুভূমিতে আছড়ে পড়ে তখনই চিওপস তার বাবার এ কথাগুলো শুনতে পান। তিনি অন্যমনস্ক হয়ে বাতাসের চিৎকারগুলো শোনার চেষ্টা করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন এই ঝড় তাকে অভিশাপ দিচ্ছে। তিনি নিজেও চিৎকার করে নিজেকে বলতে চাচ্ছেন, ‘মৃত্যু তোমার সাথেই আছে। কি এক শয়তান তোমার উপর ভর করেছে। আহ! আমার উন্মাদ রাজত্ব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *