পিরামিড এখন মমি চায়
যখন পিরামিড নির্মাণের সমাপ্তির ঘোষণাটা ছড়িয়ে পড়লো তখন পিরামিডের আশপাশে বসবাসকারি লোকজন এ খবর শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লো। অধিকাংশ লোক তাদের হাতকে কানের উপর রাখলো।
‘তুমি বলতে চাইছো তদন্ত তাহলে শেষ হয়েছে?
‘বুড়ো গাধা আমি তদন্তের কথা বলছি না, বলছি পিরামিড তৈরি শেষ হয়েছে।’
‘ওহ! সেই পিরামিড!’
যদিও পিরামিডের মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা নির্মাণ কাজের ভষ্মগুলো এখনো তাদের পেছনে পড়ে আছে। তাদের কানের ভেতর পিরামিডকে নিয়ে তীব্র জিজ্ঞাসাবাদের শব্দগুলো এখনো হই চই করে বেড়াচ্ছে।
কোনো রকম ঝাকি বা প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পিরামিড নির্মাণের কাজটা যেনো স্বপ্নের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো।
সজ্জিত পাথরের খণ্ডগুলো পিরামিডের উত্তরের ঢালু জায়গার শীর্ষে স্থাপন করা হয়েছিলো। চারকোণা বাকি ঢালুগুলো ব্যাখ্যাতীতভাবে ফেলে রাখা হলো। আর সব শেষে এই শবদেহের স্মৃতিসৌধে পিরামিডের সর্বশেষ পাথরটিকে স্থাপন করা হলো।
সর্বশেষ এ পাথরটি ছিলো সকল পিরামিডের সকল পাথরের রাজা। মূল পাথর। এটাকে সাজানো হয়েছিলো স্বর্ণের পাতা দিয়ে। পাথরটা নতুন চাঁদের মতো ঝক মক করছিলো। যেনো আলোর বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছিলো এর ভেতর থেকে।
পরদিন সকালে নতুন শিশুর নাড়ি কাটার মতো শ্রমিকেরা কাঠের যে দোলনা দিয়ে সর্বশেষ সজ্জিত পাথরটিকে পিরামিডের উপর স্থাপন করেছিলো সেই দোলনাটা পিরামিডের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। এভাবে মাটির সাথে পিরামিডের সর্বশেষ যন্ত্রপাতির সংযোগটা খুলে আনা হলো।
পিরামিডের অনেক ভেতরে যদিও বাইরের চেয়ে অনেক বেশি রহস্যময় আর ব্যাপক বিস্তৃতি কাজ হয়েছে কিন্তু তার পরেও কৌতূহলী লোকজন বাইরের দিকে চেয়ে থাকলো কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা দেখার আশায়।
কালো গ্রানাইট পাথরের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। যাতে কেউ এর ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।
ভুয়ো গমন পথ যেটা বাইরের লোকজন মনে করবে আসলেই সত্যিকারের পথ সেটাকেও সিল গালা করে দেওয়া হয়েছিলো। এই ভুয়ো গমন পথ দিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকলে সে সোজা চলে যাবে মৃত্যুকূপে।
পিরামিডের ভেতরে যারা কাজ করছিলো তাদেরকে ডাকা হতো মৃতলোক বলে। ভেতরে কাজ করতে করতে তাদের ঘাড়ের পেশি কুঁচকে গিয়েছিলো। তারা অবশ্য সব সময় ভান করতো যে ভুয়ো গমন পথের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। কিন্তু এই ভুয়োপথটাই আসল পথ। কিন্তু এভাবে বিশ্বাস করতে করতে এক সময় তারা সত্য আর মিথ্যার ভেতর তালগোল পাকিয়ে ফেললো। তাদের বিচার বোধ শক্তি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। তারা অপলকে চেয়ে রইলো।
তারপর এক সময় তারা মুখে ধুলো বালি কাদা পানি মেখে তাদের কাজের সর্বশেষ দিনে পিরামিডের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। বের হয়ে তারা দেখতে পেলো বাইরে সৈন্যরা হাতে কুঠার আর অস্ত্র নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তারা বুঝতে পারলো এখন তারা কী অসহায়। পিরামিডের ভেতরের কার্যক্রম নিয়ে শত পরিকল্পনা, শত চিন্তা-ভাবনা সব কিছুই আসলে ভুয়া। এগুলোর আসলে কোনো মূল্য নেই।
তারা আরো বুঝতে পারলো বিশ বছর আগেই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়ে গিয়েছিলো, যখন প্রধান স্থপতি ও পিরামিডের নকশাকার এক সন্ধ্যায় একটি প্যাপিরাসের উপর পিরামিডের আকৃতি আঁকছিলো। পিরামিডের দৈর্ঘ্য, এর আনুভূমিক অংশ, পাথরের পরিমাণ, ওজন, অবস্থান, ভেতরের নিরাপত্তা, কারুকাজ, গোপন কুঠুরি, এ সব কিছুই নিয়ে যখন পরিকল্পনা চলছিলো তখনই এই শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়ে গিয়েছিলো। কারণ তখন সব কিছুর সাথে একটা চিহ্ন বার বার ব্যবহার করা হয়েছিলো। আর সেটা হলো মৃত্যু চিহ্ন।
এখন তাদের মৃত্যু ছাড়া পিরামিডের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, রহস্যময়তার গোপনীয়তা, নানা রকম কার্যক্রম এ সব কিছুই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পিরামিড তৈরির প্রথম পরিকল্পনার সময়ই তাদের মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছিলো।
তারা অন্তত এতোটুকু আশা করছিলো যে, জল্লাদের কুড়োলের সামনে মাথা পেতে বসার আগে কমপক্ষে তারা আবার সেই গোপন কুঠুরিটিতে যদি একবার ঢুকতে পারত যেখানে কোনো এক সময় ফারাও-এর মৃতদেহ রাখা হবে।
প্রধান স্থপতি তার হাতের নির্দেশে কিছুক্ষণ মৃত্যু দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখলেন। তিনি এগারো জনের পুরো দলটিকে একটা সারিতে দাঁড় করালেন।
আহ! বেচে থাকার সকল আশা শেষ হয়ে গেলো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রিয়তমার কথা স্মরণ করে কোনো একটা বার্তা পাঠাবার চেষ্টা করলো, অধিকাংশই চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘ফারাও দীর্ঘজীবী হোক।’ তবে তাদের মধ্যে শুধু দু জন বললো, ‘মৃত্যু একদিন ফারাওকেও গ্রাস করবে।
খুব সকালে বন্দি দলটিকে নিয়ে কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত একটি গাড়ি অজানার উদ্দেশে বের হয়ে গেলো। দিনটি ছিলো খুব দীর্ঘ। যেনো কাটতেই চাচ্ছিলো না। তারা বসে বসে গান করার চেষ্টা করতে লাগলো। কেউ কেউ ভাবলো তারা হয়তো আসলেই গান গাইছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুরের বদলে তাদের কণ্ঠ দিয়ে বের হয়ে আসছিলো এক দুঃখী কান্নার স্বর। এ দুঃখ অনেক ভারী। অনেক বেদনার।
পিরামিডের উদ্বোধনী উপলক্ষে কোনো অফিসিয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো না। তবে রাজধানীর অধিকাংশ বাসিন্দা আর অভিবাসীরা নতুন এই পিরামিডটা দেখতে এলো। বিদেশীরা পিরামিডের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের নানা রকম শব্দ করলো। স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের কাঁধ ঝাঁকালো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখ পিট্ পিট্ করলো। তাদের দৃষ্টিতে কেবল বিস্ময়।
সত্যি কথা বলতে কি, আগের পিরামিডগুলোর তুলনায় তারা এখন যে পিরামিডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এর তুলনাটা ছিলো বিস্ময়কর। এর দীর্ঘ আঙিনা, এক কোণা থেকে আরেক কোণার বিস্তৃত দৈর্ঘ্য, এর অতি উচ্চতা, পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হবে যে একটা মোমের পুতুল দাঁড়িয়ে আছে, সব কিছুই ছিলো বিস্ময়ে অবাক করে দেওয়ার মতো। মনে হতো যেনো এর ভেতরে কোনো রহস্য আর অপদেবতার শক্তি লুকিয়ে আছে।
তারা নতুন পিরামিডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডগুলো দেখে বুঝতে পারছিলো না যে কোনটি আসল পিরামিড আর কোনটা আসল পিরামিডের অপছায়া। তারা এটাও বোধগম্য করতে পারছিলো না যে কোনটা থেকে কোনটা উৎপন্ন হয়েছে। এক কথায়, এর আসল কোনটা?
যদিও অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করে যে, নতুন যেটা তৈরি হয়েছে সেটাই আসল পিরামিড। তবে তারা যখন পুনরায় পিরামিডগুলোর দিকে তাকায় তখন তাদের চোখে পানি চলে আসে। কারণ আসলে সবগুলোই ছিলো জমজ সন্তানের মতো দেখতে। এদের মধ্যে যদি একটাও অদৃশ্য হয়ে যায় তাহলে বাকিগুলো থাকলেও ঠিক বোঝা যাবে না কোনটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
তবে সাধারণ জনগণের মাঝে যার সৌভাগ্য হয়েছিলো শুধু একবার পিরামিডের নমুনাটা দেখার। সেই আসল পিরামিডটাকে দেখে হতবাক হয়ে গেছে। তাদের কাছে মনে হয়েছে এ বস্তুটা আসলে কী? এর সাথে কি কোনো অশুভ যাদু বা শয়তানের শক্তি আছে। প্রথমে একে দেখা গিয়েছিলো এক রকম, এখন অন্যরকম, একবার মনে হয়েছিলো ধুলির মেঘ, আবার মনে হয়েছিলো ধোঁয়ার প্রাসাদ, আর এখন। উফ! বিশ্বাসই হচ্ছে না পিরামিডটা যে এমন হতে পারে। কে জানে ভবিষ্যতে এ পিরামিডটা আবার কোনো আকৃতি লাভ করে।