নরমুণ্ডের স্তুপ
একটি প্রতিবিম্ব ছবির মতোই দীর্ঘকাল পর ঠিক ভিন্ন একটা সময়ে যেখানে পিরামিডটা রয়েছে তার কাছ থেকে হাজার মাইল দূরে পিরামিডের একটি অশুভ ছায়া আবির্ভূত হলো। এশিয়ার ঠিক মধ্যাঞ্চলে ইস্পাহানের দুর্গম মরুভূমিতে একজন নৃপতির আগমন ঘটলো। ইতিহাসে সে পরিচিত তৈমুর নামে। সে ইস্ফাহানের মরুভূমিতে ফারাও চিওপসের মতো একটি পিরামিড তৈরি করলো। তার পিরামিডটা ফারাও চিওপসের পিরামিড থেকে একটু ভিন্ন ছিলো। ফারাও চিওপসের পিরামিড ছিলো পাথরের পর পাথর দিয়ে তৈরি আর তৈমুর তার পিরামিড বানালেন মানুষের কাটা মাথা দিয়ে। নরমুণ্ডের স্তুপ দিয়ে পিরামিডটা তৈরি হলেও ফারাও-এর পিরামিড আর তৈমুরের পিরামিডের মাঝে আসলে আদর্শগত কোনো পার্থক্য ছিলো না। এই দুটোই যেনো একটা খোলসে দুটো মটর দানার মতো ছিলো। মিশরীয় পূর্ব পুরুষদের মতোই তৈমুর একটা পরিকল্পনা মাফিক তার এই নরমুণ্ডের পিরামিড তৈরি করলো। মিশরীয়দের পিরামিড তৈরিতে যে পরিমাণ পাথর লেগেছিলো ঠিক সেই পরিমাণে সেই সংখ্যার কাটা মুন্ডু দিয়ে সে পিরামিড তৈরি করলো।
তার এই পিরামিড তৈরি করতে গিয়ে সে সত্তর হাজার কাটামাথা ব্যবহার করলো। আর এ মাথাগুলো সে কোনো এক অভিযান কিংবা একটা যুদ্ধ অথবা কোনো ভয়াবহ আক্রমণ যেখানে স্বাভাবিক হত্যা সংঘটিত হয় সে রকম কোনো অভিযান থেকে সংগ্রহ করে নি। বরং সে বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের যুদ্ধ বিগ্রহ যেমন তাচ কুরগানের যুদ্ধ, কারা তুরগাজের যুদ্ধ, আকসারাযের গণহত্যা ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে সে এ মাথাগুলো সংগ্রহ করেছিলো। পরবর্তীতে কৌতূহলী লোকজন পরীক্ষা করে দেখেছে এই মুন্ডুগুলো ছিলো আসলে কেবল সব পুরুষ মানুষদের। অবশ্য কারো কারো মতে, এখানে মেয়ে মানুষের মাথাও ছিলো। তবে সেটা বোঝার উপায় ছিলো না। কেননা মাথাগুলো জড়ো করার সময় অনেকে মেয়ে মানুষের মাথাগুলো থেকে লম্বা চুলগুলো চেছে পরিষ্কার করে তাদের মুখে কাদা মেখে দিয়েছিলো যাতে তাদের চেহারা বোঝার কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া না যায়।
নরমুণ্ডের স্তুপের এ পিরামিডটা তৈরি করার সময় এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যদিও চুন বালি মিশ্রিত করে রং ব্যবহার করা হয়েছিলো। কিন্তু তারপরেও এ পিরামিডের প্রধান স্থপতি কারাহুলেগ এর নিরাপত্তা আর স্থায়িত্বের বিষয়ে মোটেও নিশ্চিত ছিলেন না। তার ভয় হচ্ছিলো পিরামিডটা শীতকালীন আবহাওয়া, তুষারপাত এবং বন্যজন্তুদের দিয়ে আক্রান্ত হয়ে অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সে এই পিরামিডের প্রত্যেকটি অংশকে একটার সাথে আরেকটাকে বেঁধে দিলো। একটা মুন্ডের সাথে আরেকটা মুন্ডকে এমনভাবে সংযোগ করা হলো যাতে সেটা কোনো ক্রমে ভেঙে না পড়ে।
মানুষের কর্তিত মাথা দিয়ে এ পিরামিড তৈরির সময় এর প্রধান স্থপতি কারাহুলেগ প্রকৃত পিরামিডের জনক ইমহোটেপ এর কলা-কৌশল অনুসরণ করেছিলো। যখন পিরামিড প্রায় তৈরি শেষ হয়ে গেলো তখন পিরামিডের মাথার উপর একটা বড় আকৃতির মানুষের মাথার খুলি বসানোর প্রয়োজন হয়ে পড়লো। কারণ আসল পিরামিডেও এর সর্বোচ্চ চূড়ার উপর সবচেয়ে বড় পাথরটা বসানো হয়েছিলো।
তাই তারা এমন একজনের মাথা খুঁজতে লাগল যেটা আকৃতিতে একটু ব্যতিক্রম। কিন্তু তেমন কাউকে তারা খুঁজে পেলো না। তখন নিজেদের দলের মাঝেই মংকা নামের একজন নির্বোধকে পাওয়া গেলো যার শরীরের আকৃতি আর মাথার আকৃতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বড়।
সৈন্যবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে বললো, ‘তোমাকে আমরা এখন রাজা বানাবো। তুমি হবে পিরামিডের প্রধান।’
তখন তার মুন্ডুটা কেটে তখন পিরামিডের একেবারে চূড়ায় বসিয়ে তাদের কাজ শেষ করলো।
তৈমুরের সেনাবাহিনী যখন ভীতিকর লৌমহর্ষক এই মাথার স্তুপের পিরামিডটি রেখে ইস্পাহান ত্যাগ করলো তখন সমস্ত মরুভূমিসহ পুরো
এলাকাটায় একটা ভীতিকর নারকীয় পরিবেশ বিরাজ করছিলো।
কাক আর দাঁড়কাকগুলো দল বেঁধে এসে মানুষের কাটা মাথার এই স্তুপের উপর বসে মানুষের চোখগুলো ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগলো।
সে বছর শীত খুব দ্রুত চলে এলো। দীর্ঘ দিন ধরে বৃষ্টিপাত পিরামিডের মাথাগুলোর উপর থেকে রক্ত আর ক্লেদ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিলো। শীতকালীন ঝড়ে এর মধ্যে তেমন একটা পরিবর্তন দেখা গেলো না। তবে পিরামিডের মাথায় নির্বোধ মংকার মুন্ডুটা একটু বিবর্ণ হয়ে গেলো।
পিরামিডটা দু দুবার বরফে আচ্ছাদিত হয়ে গেলো। এক বসন্তকালে দেখা গেলো পিরামিডটা একটু কালচে হয়ে গেছে। কাটা মাথাগুলোর চুলগুলো বরফগলে যাওয়ার পর আবার দেখা যেতে লাগলো।
কেমন জানি মনে হলো। বিস্ময়ে সবাই এসব দেখতে লাগলো।
পর্যটক আর তীর্থযাত্রীরা যখন মধ্য এশিয়ার এ অঞ্চলটায় আসতো তখন তারা ভয়াবহ পিরামিডের এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কে অস্থির হয়ে যেতো।
যা হোক, মরুভূমির হিংস্র পশুগুলো রাতের পর রাত এবং দিনের পর দিন মানুষের খুলি দিয়ে তৈরি স্তুপাকৃত পিরামিডের চারপাশে ঘুর ঘুর করতো। তাদের তীক্ষ্ণ দাঁত আর নাক দিয়ে কাটা মুন্ডুর স্তুপের ভেতর খাবার খুঁজে বেড়াতো। তারা দল বেঁধে কখনো কখনো তুর্কমিনিস্তানের বিশাল উপত্যকায় বাতাসের সাথে সাথে গা শির শির করা চিৎকারে পুরো উপত্যকা প্রকম্পিত করে ঘুরে বেড়াতো।
কখনো তারা কান্দাহারের বালুচড়ে আবার কখনো মঙ্গোলিয়ানদের সীমাহিন উপত্যকায় বাতাসের বেগে ছুটে বেড়াত। কেবল ছুটতো দুরন্ত গতিতে।
তৈমুর তার যুদ্ধ কিংবা অভিযান শেষ করে যখনই কোথাও তাঁবু স্থাপন করেছে সেখানেই সে মানুষের কাটা খুলি দিয়ে স্তুপ করে পিরামিড তৈরি করেছে। সে ফারাওদের মতো তার সন্তান-সন্ততি এবং বংশধরদেরকেও একই রকমভাবে তাদের নিজ নিজ পিরামিড তৈরির ক্ষমতা দিয়েছিলো। শুধু তাই নয় সে তার নিজের সেনাবাহিনীর জেনারেলদেরকেও এ অধিকার দিয়েছিলো। যার ফলে নানা জায়গায় কতো শত পিরামিড তৈরি হলো। আর তাদের এই কার্যক্রম ভয়াবহ আতঙ্ক, উন্মাদনা আর দুঃস্বপ্ন নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হলো। যখনই তৈমুরের সেনাবাহিনী কোথাও অভিযানে যেতো তখনই তাদের এ কার্যক্রমের জন্য সবাই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়তো। তারা বিচলিত বোধ করতো।
সেনাবাহিনীর অযুত-নিযুত ক্যাম্পে এবং বিভিন্ন শহরে রাষ্ট্রে তৈমুরের এই পিরামিড তৈরির কাজ আতঙ্কিত মানুষের মুখে মুখে ঘুরছিলো। তারা ইস্পাহানের তৈরি সবচেয়ে বড় পিরামিড নিয়ে ভীত সন্ত্রভাবে আলোচনা করতো। ঘুরে ফিরে তাদের কেবল এ আলোচনাই ছিলো।
তৈমুরের এ পিরামিড বজ্রের মতো মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিলো। প্রতিটি মানুষ কেমন যেনো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।
একবার এক দীর্ঘ অভিযানের মাঝপথে তৈমুরের মনে হলো যে ইস্পাহান তার খুব নিকটেই আছে। তাই সে নিজের তৈরি পিরামিডটা দেখার সিদ্ধান্ত নিলো।
পিরামিডটা স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গিয়েছিলো। হিংস্র পশুরা নানা জায়গা দিয়ে খুবলে খুবলে খেয়ে ফেলেছে। তবে মানুষের কাটা খুলি দিয়ে তৈরি পিরামিডের খুলির চোয়ালগুলো একটার সাথে আরেকটা বেশ ভালোভাবেই জোড়া লেগেছিলো। তৈমুর তার ক্ষয়ে যাওয়া পিরামিডের সামনে বিষণ্ন চোখে দাঁড়িয়ে থাকলো।
তাকে যখন বলা হলো যে, এই পিরামিডটা খুব বেশি হলে আর চার কি পাঁচ বছর টিকে থাকবে তখন সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ভাবলো কীভাবে দীর্ঘকাল তাহলে মিশরের পাথরের স্তুপের পিরামিডটা দাঁড়িয়ে আছে।
সে মিশরের দিকে তার চিন্তাটা ঘুরিয়ে খুব আস্তে ধীরে ভাবতে লাগলো এক দিন নিশ্চই সে মিশর আক্রমণ করবে। তারপর পৃথিবীর বুক থেকে মিশরকে তার পাথরের স্তুপসহ ধ্বংস করে দিবে। বিশেষ করে ফারাও চিওপসের সবচেয়ে উঁচু পাথরের স্তুপের যে পিরামিডটা রয়েছে তার নিশানাও সে পৃথিবীতে রাখবে না। তার পরিবর্তে সে মানুষের খুলি দিয়ে তৈরি পিরামিড বানিয়ে সারা বিশ্বকে প্রমাণ করে দেবে সত্যিকারের পিরামিড কোন্টা।
কিন্তু সে মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সুযোগ পেলো না। কারণ তাকে তখন মনোযোগ দিতে হয়েছিলো চীন অভিযানের দিকে। সে বছরেই শীত আবার খুব দ্রুত চলে এলো। চারদিকে কেবল শীত আর শীত।
সে শীতের এ সময়টাকে মোটেই পছন্দ করে না। যদিও তখন তার মাথায় অসম্ভব সব পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
যেমন সাইবেরিয়ায় অভিযান। এ কঠিন অভিযানে দুর্গম সময়গুলোতে তখন তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছিলো এমন একজন যাদুকর যার যাদুর প্রার্থনায় সূর্য অস্ত যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সূর্যও যেনো ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
লোকজন এ সময়টাকে উত্তরের আলো বলে ডাকতো।
উত্তরের এ অভিযানের সময় তৈমুর জ্বরে আক্রান্ত হলো। কোনো সন্দেহ নেই সে বুঝতে পেরেছিলো এ জ্বরেই মৃত্যু তার জন্য অপেক্ষা করছে।
এ জ্বর মৃত্যুর মুখোশ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সে মৃত্যুকে সব কিছুর চেয়ে বেশি ঘৃণা করতো। ভয়ও পেতো।
একমাত্র মৃত্যুই তাকে তার সাম্রাজ্যের শেষ সীমানায় নিয়ে যাবে। তাকে নিয়ে যাবে জনাকীর্ণ এমন এক ভূমিতে যেখানে সরু নলখাগড়াগুলো মঙ্গোলিয়ানদের মঠগুলোর মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তারা স্থির, অনড়।