সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে সাহিত্যকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানোর একটা চেষ্টা এখন সাম্প্রদায়িক মহলে আড়ম্বরের সাথে শুরু হয়েছে। এ প্রচেষ্টা এবং আড়ম্বরের সাথে সাহিত্য অথবা সংস্কৃতি চর্চার যে কোন সম্পর্ক নেই একথা পরিষ্কারভাবে বোঝা দরকার।
প্রত্যেক সংস্কৃতি ও সাহিত্যেরই একটা সামাজিক বুনিয়াদ থাকে যাকে অস্বীকার করে সংস্কৃতি বা সাহিত্য চর্চা করা অথবা তার সম্পর্কে কোন ধারণায় উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। সাধারণভাবে স্বীকৃত হলেও কথাটি বর্তমান আলোচনা প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন। দ্বিতীয়তঃ স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে সাহিত্য সংস্কৃতির বৃত্তের অন্তর্গত, তারই একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
২
সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রথম বক্তব্য এই যে বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র প্রমুখ ‘হিন্দু’ লেখকেরা বাঙলা সাহিত্যের এক একজন দিকপাল এবং সেই হিসাবে তারই ঐতিহ্যবাহী এবং তাঁদেরকে বাদ দিয়ে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত উপরোক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য যথার্থ। কারণ বাঙলা সাহিত্য সম্পর্কে যাদের কিছুমাত্র ধারণা আছে তারাই জানে সে ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের স্থান কোথায়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখনই যখন বলা হয় যে উপর্যুক্ত সাহিত্যিকেরা বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী হলেও ‘আমাদের’ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের, সংস্কৃতির সাথে তাঁদের কোন রকম ঐতিহ্যিক বন্ধন নেই। কেউ একথা বললে প্রথমেই সেটাকে ক্ষিপ্তচিত্ততার লক্ষণ মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাবে যে এক্ষেত্রে পাগলামীটা নিতান্তই পরিকল্পিত।
৩
প্রত্যেক সাহিত্য এবং সংস্কৃতিরই একটা ঐতিহাসিক চরিত্র থাকে। এজন্যেই শাশ্বত সাহিত্য অথবা সংস্কৃতি বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। সাহিত্যের ইতিহাসে তাই দেখা যায় যে এক এক যুগে বিশেষ বিশেষ দেশের সাহিত্যে কতকগুলি বিশেষ অবস্থা এবং সমস্যার উপর গুরুত্ব পড়ে। সেগুলিকে অবলম্বন করেই গড়ে ওঠে সেই সব যুগের সাহিত্য। আমাদের দেশও সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকেই বাঙলা সাহিত্যের আধুনিক পর্ব শুরু। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এ সাহিত্যের উপজীব্য কী সে হিসাব নিলে দেখা যাবে যে তার মধ্যে আশ্চর্য রকম পার্থক্য আছে। বিদ্যাসাগর যে সব বিষয় অবলম্বনে সাহিত্য রচনা করেছেন সেগুলি মোটামুটিভাবে হিন্দু সমাজ, হিন্দু ধর্ম, পুরাণ, মহাভারত ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত অথবা তাদের থেকেই উদ্ভূত। তিনি যে অন্য কিছু লেখেন নি তা নয়। কিন্তু তাঁর রচনার এগুলিই হলো প্রধান উপজীব্য। তবে এক্ষেত্রে তাঁর বিশেষত্ব এই যে বিষয়বস্তুর এই পরিচয় সত্ত্বেও বক্তব্যের গুণে তিনি সেগুলির আধুনিকতার ছাপ এমন সুস্পষ্ট এবং দৃঢ়ভাবে করেছিলেন যেটা অনেক অত্যাধুনিক সাহিত্যিকের পক্ষেও পরবর্তীযুগে সম্ভব হয় নি। এদিক থেকে মাইকেল মধুসূদনের সাথে তাঁর অনেকখানি মিল এবং সাদৃশ্য। এরপর বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর ক্ষেত্রে সহজেই লক্ষ্য করা যায় বিষয়ের প্রকারভেদ। সমগ্র বঙ্কিম সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে সামন্ততান্ত্রিক সমাজচিত্র অঙ্কনেই তিনি অধিকতর ব্যাপৃত। নবোত্থিত ঊনিশ শতকীয় মধ্যবিত্তকে তিনি তাঁর লেখায় অগ্রাহ্য করেন নি কিন্তু তারা তাঁর সাহিত্যের মূল অবলম্বন নয়। অবশ্য সামন্ত সমাজ এবং মূল্যবোধকে বিশেষভাবে অবলম্বন করলেও ক্ষেত্রবিশেষে আধুনিকতার ছাপ তাঁর লেখাতেও সুস্পষ্ট। তার অন্যতম প্রধান কারণ একদিকে বঙ্কিমের নোতুন ঐতিহ্য চেতনা এবং অন্যদিকে ইউরোপীয় সাহিত্যের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয়। এর ফলেই তিনি বাঙলা সাহিত্যে জন্ম দিতে পেরেছিলেন ঐতিহাসিক এবং আধুনিক উপন্যাসের। কিন্তু সাহিত্যে উপন্যাসের রূপটি আধুনিক হলেও বাঙালী মধ্যবিত্তের নোতুন চিন্তাভাবনা তাঁর উপন্যাসে বিশেষভাবে প্রাধান্য পায় নি বরং সেই নোতুন চিন্তাভাবনার যে প্রতিক্রিয়া হিন্দু সমাজের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিলো তিনি ছিলেন সেই প্রতিক্রিয়ারই সাহিত্যিক ও দার্শনিক মুখপাত্র।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য একটি বিচিত্র মহাদেশ। বিষয়বৈচিত্র্য এবং ব্যাপ্তির দিক থেকে তার তুলনা নেই। তাঁর হাতে আমাদের সাহিত্য যে ঐশ্বর্যে ভূষিত হয়েছে তার সঠিক হিসাব নির্ধারণও সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই আমাদের সাহিত্যের প্রথম বিশ্বপরিচয়। তাঁর সৃষ্টিকর্মই হলো বহু বিদেশী সভ্যতার সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির যোগসাধনার শ্রেষ্ঠতম ফসল। আমাদের দেশের এক যুগ সন্ধিক্ষণে তিনি জন্মলাভ করেছিলেন, বহু বিচিত্র পথ একের পর এক উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং সবকিছুই হয়েছিলো তাঁর অন্তরে মুদ্রিত এবং সাহিত্যে প্রতিফলিত। এজন্যেই তাঁর সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য কী এ আলোচনা অত্যন্ত দুরূহ তাঁর বিশাল প্রতিভা, বিপুল অভিজ্ঞতা এবং অপূর্ব রচনা শৈলী তাঁর ঐতিহাসিক যাত্রাপথে নব নব দিগন্ত রচনা করেছে। তবু রবীন্দ্রযুগকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্র শিল্প সাহিত্যের কোন মূল্যায়নই সম্ভব নয়। সেদিক থেকে তাঁর সমস্তকর্মেরই একটা ঐতিহাসিক চরিত্র আছে।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাস বাঙলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম নিয়ে এলো মধ্যবিত্তের একটা ঘরোয়া আবহাওয়া। এখানেই শরৎসহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মধ্যবিত্তকে বাদ দিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্ম অচন্তনীয়। মহেশের মতো গল্প তিনি লিখেছেন। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সেটি নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম। যে যুগে তিনি সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন সে যুগে মধ্যবিত্তেরই প্রাধান্য এবং সেই প্রাধান্যের চিহ্ন তাঁর সাহিত্যের সর্বত্র। কিন্তু মধ্যবিত্ত জীবনকে বিশেষভাবে অবলম্বন করলেও বিশ শতকীয় বাঙালী মধ্যবিত্তের প্রগতিশীল চিন্তাধারার সাথেও তিনি আবার সম্পূর্ণ একাত্মবোধ করেন নি। এজন্যে সামন্ততান্ত্রিক মূল্যের প্রভাব তাঁর চিন্তার মধ্যেও সহজেই প্রত্যক্ষ।
এর পর এলো বাঙলাদেশ এবং সমগ্র ভারতবর্ষের এক নোতুন যুগ এবং সেই নোতুন যুগে আবির্ভূত হলো নোতুন শিল্পী। রবীন্দ্রনাথ যে কবির পদধ্বনি শুনেছিলেন সেই পদক্ষেপেই বাঙলা সাহিত্যে নজরুল ইসলাম, সুকান্তের আবির্ভাব। এই শতকের বিশের থেকে চল্লিশে বাঙলাদেশে চাষী মজুরেরা ধীরে ধীরে মাথা তুললো, নিজেদের দাবী দাওয়ার ক্ষেত্রে হলো ক্রমশঃ সচেতন ও সতর্ক। কবি নজরুল এবং বিশেষ করে সুকান্ত মুখ্যতঃ তাদেরই কবি, তাঁরা তাদেরই প্রতিনিধি। এর মধ্যেই তাঁদের পরিচয়ের মুখ্যরূপ।
বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করলে বোঝা যাবে যে আমাদের দেশের আর্থিক ও সামাজিক পরিবর্তন এবং অগ্রগতিকে বাদ দিয়ে সাহিত্য সম্পর্কে কোন সুষ্ঠু ধারণা সম্ভব নয়। একথা শুধু বাঙলা সাহিত্য নয়, যে কোন সাহিত্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সীতার বনবাস অথবা মীর মশাররফ হোসেন বিষাদ সিন্ধু কেন লিখেছিলেন এবং শরৎচন্দ্রের দেনা পাওনা গৃহদাহ নজরুলের অগ্নিবীণা, তারাশঙ্করের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা কেমন করে সম্ভব হলো এর জবাব তাদের সমসাময়িক সামাজিক ও আর্থিক জীবন থেকেই পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয়। মধ্যবিত্ত চরিত্রের মধ্যেও যে পরিবর্তন এসেছে সেটাও আমাদের সাহিত্যে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। এজন্যে শরৎচন্দ্রের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তুপুষ্ট মধ্যবিত্ত এবং তারাশঙ্কর, বুদ্ধদেব ও বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের মধ্যবিত্ত এক নয়। তাদের মধ্যে যে পার্থক্য সেটা বাঙলাদেশের এক যুগের সাথে অন্য যুগের।
বাঙলা সাহিত্যের দিকপালদের সাহিত্যের উপজীব্য সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার উদ্দেশ্য সমাজের সাথে সাহিত্যের গভীর সম্পর্কের কথা স্মরণ করা। আমাদের চিন্তাভাবনা, শিল্প সাধনা সবকিছুই যে বিশেষ সামাজিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এই সত্যকে যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করা।
এক্ষেত্রে দেখা যাবে যে শুধু সাহিত্যেরই নয়, আমাদের সমগ্র সংস্কৃতিরই উৎসমূল আমাদের সামাজিক জীবনভূমি। সেদিক থেকে সাহিত্য এবং সংস্কৃতি একই সূত্রে গ্রথিত এবং এই সূত্রকে ছিন্ন করার কোনই উপায় নেই।
৪
জীবনচর্চারই অন্য নাম সংস্কৃতি। মানুষের জীবিকা, তার আহার বিহার চলাফেরা তার শোক তাপ আনন্দ বেদনার অভিব্যক্তি, তার শিক্ষা সাহিত্য ভাষা, তার দিনরাত্রির হাজারো কাজকর্ম, সবকিছুর মধ্যে তার সংস্কৃতির পরিচয়। এজন্যে তার সামগ্রিক সংস্কৃতিও অসংখ্য শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এগুলির মধ্যে কিসের প্রভাব বেশী কিসের প্রভাব কম সেটা নির্ভর করে বিভিন্ন জিনিসের উপর মানুষের নির্ভরশীলতার তারতম্যের উপর। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে আর্থিক অবস্থার গুরুত্বই মানুষের জীবনে সব থেকে বেশী এবং তার দ্বারাই সংস্কৃতি সব থেকে বেশী প্রভাবিত। এর অর্থ এই নয় যে অর্থগৃধু, সকলেই অর্থ রোজগারের মোহে আচ্ছন্ন। এর সরল অর্থ এই যেমানুষের আর্থিক জীবনকে কেন্দ্র করে তার কতকগুলো স্বার্থ, বিবেচনা এবং ধ্যানধারণা গড়ে ওঠে যেগুলিকে সাধারণত অস্বীকার করা চলে না। শুধু তাই নয়। সেগুলি সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে মানুষের অন্তরের গভীর দেশে প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে ব্যক্তি মানস লাভ করে তার বিশেষ চরিত্র।
বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগে যুগে বিভিন্ন সাহিত্যিকের চিন্তা ও সাধনার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছি সে পরিবর্তন এসেছে সামাজিক পরিবর্তনের ফলে। ইংরেজ আমলের বাঙলাদেশের আর্থিক জীবনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং তার পরবর্তী ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে আমাদের আর্থিক ও সামাজিক জীবনে পরিবর্তন এনেছিল এবং সে পরিবর্তনের ফলে যে নোতুন নোতুন সমস্যাবলী দেখা দিয়েছিলো সেগুলিই সমসাময়িক সাহিত্যের মধ্যে হয়েছিলো প্রতিফলিত। এজন্যেই দেখা যায় ঈশ্বরচন্দ্র মাইকেল মধুসূদন রামায়ণ, পুরাণ, মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে সাহিত্য সৃষ্টি করলেও তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র নেই। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য আবার সাম্প্রদায়িকতা দোষে অনেকখানি দূষিত। তাঁর সাহিত্যের গৌরবও সে কারণে বহুলাংশে ক্ষুণ্ন। তবে শুধু বঙ্কিমই নয়, তাঁর পরবর্তী হিন্দু মুসলমান মধ্যবিত্ত লেখকদের অধিকাংশের মধ্যেই অল্পবিস্তর সাম্প্রদায়িক প্রভাব বর্তমান। সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার মুখ্য কারণ বাঙলাদেশের সমাজদেহে তার উত্থান এবং প্রতিষ্ঠা। সমাজের মধ্যে সংস্কৃতির মধ্যে যা বর্তমান ছিলো সাহিত্যের মধ্যে সেটাই হয়েছিলো প্রতিফলিত। সেই দূষিত প্রভাবকে উত্তীর্ণ হওয়ার মতো ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথ নজরুল ইসলামের মতো কারো কারো থাকলেও সকলের সে ক্ষমতা ও মানবচেতনা ছিলো না।
ঊনিশ শতকের শেষার্ধ এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ব্যাপক হওয়ার কারণ আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে সাম্প্রদায়িকতার ক্রমাগত প্রভাব বৃদ্ধি। কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক প্রভাব সত্ত্বেও তার বাইরে বাঙলাদেশের মানুষের কোন চিন্তা-ভাবনা, বিচার বিবেচনা, শিল্প সাধনা ছিলো না এমন নয়। তাছাড়া সাম্প্রদায়িকতা সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক প্রভাব ছিলো অপ্রতিরোধ্য এবং ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে সে সাহিত্যশিল্পের ক্ষেত্রে অধিকাংশ লেখক ও শিল্পীর অধিকাংশ সৃষ্টিকর্মই সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত।
৫
শুধু আধুনিককালেই নয় পুরাতন আমলেও বাঙলা সাহিত্যের মধ্যে বিবিধ আন্দোলন সত্ত্বেও তার অখণ্ডতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। শ্রীচৈতন্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত সাহিত্যকেই আমরা একটা উদাহারণ হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। চৈতন্যদেব যে ধর্ম প্রচার করলেন এবং তার থেকে প্রেরণা লাভ করে যে বৈষ্ণব সাহিত্য সৃষ্টি হলো তাকে ‘হিন্দু’ অথবা মুসলিম’ আখ্যা দেওয়া চলে না। কারণ এই ধর্মসাহিত্যের মধ্যে ভারতীয় এবং ইসলাম ধর্মীয় প্রভাব অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত। বৈষ্ণব সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা হিন্দু সাহিত্য আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল প্রেরণা ইসলাম ধর্মের ভ্রাতৃত্ব ও মানবতা থেকে উদ্ভূত। হিন্দু সমাজের কাঠামোর মধ্যে এমন কিছু ছিলো যার থেকে সরাসরিভাবে বৈষ্ণব ধর্ম ও সাহিত্যের উদ্ভব হতে পারতো। এ ধর্মসাহিত্য ইসলামের সাথে হিন্দুধর্মের সমন্বয়েরই সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এজন্য বৈষ্ণব সাহিত্য এবং কীর্তন বাঙলার হিন্দুদের যতখানি আপন মুসলমানদেরও ঠিক ততখানি!
কাজেই কেউ যদি বলেন যে বৈষ্ণব সাহিত্য অথবা কীর্তন মুসলমানদের পক্ষে বিজাতীয় তাহলে শুধু যে সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞানতাই প্রমাণিত হবে তাই নয়, বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসও তার দ্বারা হবে বিকৃত। বৈষ্ণব সাহিত্যে হিন্দু ধর্মীয় এবং ইসলামী চিন্তার যে সমন্বয় সাধিত হয়েছিলো সেটা কিছুতেই সম্ভব হতো না যদি সে সমন্বয় সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সাধিত না হতো। কাজেই সাহিত্যের এ সমন্বয়কে স্বীকার করলে সাংস্কৃতিক সমন্বয়কেও স্বীকার না করে উপায় নেই। শুধু এখানেই শেষ নয়। বাঙলাদেশেই সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক সমন্বয় সম্ভব হয়েছিলো কারণ বাঙালী জীবনের মধ্যে তার প্রয়োজন হয়েছিলো অনুভূত। এ সমন্বয় একটি বিশেষ ধর্মীয় আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করলেও তাই তাকে সমগ্র বাঙালী জীবন থেকে আলাদাভাবে বিচার করা চলে না।
বাঙালী সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মধ্যে একই ঐতিহ্যের ধারা কিভাবে প্রবাহিত তার অন্য একটি বিশিষ্ট উদাহরণ নজরুল ইসলামের সঙ্গীত সাধনা। তাঁরই সাধনার মধ্যে সমগ্র বাঙালী সাহিত্য সংস্কৃতির এক অপূর্ব বিকাশ সাধিত হয়েছিলো। তিনি অনেক ইসলামী গান রচনা করেছিলেন কিন্তু তাঁর সে গানগুলিও যে ঐতিহ্য বহন করে তাকে সমগ্র বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। এই প্রসঙ্গে ‘তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে’— নজরুল ইসলামের এই বিখ্যাত গানটি উল্লেখ করা যেতে পারে। সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা এই গানটিকে নজরুল মানসের ইসলামী চরিত্রের প্রমাণ হিসাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে গানটিতে হজরত আমেনার কোলে রসুল মহম্মদের আবির্ভাব এবং সেই আবির্ভাবের মহিমা বর্ণনা করলেও সমগ্র গানটিতে বৈষ্ণব কবিতার প্রভাব সুস্পষ্ট। বৈষ্ণব কবিরা মা যশোদার কোলে শ্রীকৃষ্ণকে যেভাবে কল্পনা করেছেন, যেভাবে সেই আবির্ভাবের মহিমা কীর্তন করেছেন নজরুল ইসলাম উপরোক্ত গানটিতে হজরত মহম্মদের আবির্ভাবের মহিমা সেই একইভাবে কীর্তন করেছেন। সেজন্য এই তথাকথিত ইসলামী গানটিকে ইসলামী তত্ত্বের দিক থেকে ‘ইসলামী’ আখ্যা দেওয়া চলে না। মাতৃরূপের এই বন্দনা ইসলামী তত্ত্বের পক্ষে সম্পূর্ণ বিজাতীয়। কাজেই গানটিতে হজরত মহম্মদ এবং হজরত আমেনার কথা আছে বলেই সেটি যে মুসলিম সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী একথা সত্য নয়। এ গানটি যে ঐতিহ্য বহন করে তার নাম হিন্দু অথবা মুসলিম নয়–তার নাম বাঙালী ঐতিহ্য–যার মধ্যে হিন্দুধর্ম, ইসলাম, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এবং অন্যান্য অনেক কিছুরই অবাধ সমন্বয়ে।[১]
[১. গানটির এই দিকটি সম্পর্কে অধ্যাপক মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম আমার কাছে প্রথম উল্লেখ করেন।]
শুধু এই একটি গানই নয়, সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকে স্বার্থমুক্ত ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে যে বিভাগপূর্ব কাল পর্যন্ত বাঙালী সংস্কৃতি অবিভাজ্য ও অখণ্ড। দেশ বিভাগের পর আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবন তফাৎ হওয়ার ফলে দুই বাঙলার সংস্কৃতির মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই কিছু পার্থক্য দেখা দেবে কিন্তু তাই বলে কোন সুবুদ্ধিসম্পন্ন যোগ্য মানুষই নিজের অতীতকে, অতীত সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে পারে না। পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের বর্তমান সংস্কৃতিকে পিতৃমাতৃপরিচয়হীন মনে করার কোন কারণ নেই। এ সংস্কৃতি ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট পর্যন্ত হাজার বছরের যে বাঙালী সংস্কৃতি তারই ঐতিহ্যবাহী, তার মধ্যেই আমাদের বর্তমান সংস্কৃতির অনস্বীকার্য জন্ম পরিচয়।
কোন ভাষা এবং সাহিত্য যখন যুগ যুগ ধরে গঠিত হতে থাকে তখন অসংখ্য ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সেই গঠনকার্য সম্ভব হয়। দৈনন্দিন জীবনযাপন ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানুষের মনে যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং উপলব্ধি সঞ্চার হয় ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে সেটাই হতে থাকে ক্রমাগত প্রতিফলিত। এজন্যেই ভাষা ও সাহিত্য যে কোন সমাজের সাংস্কৃতিক মান নির্ণয়ের অন্যতম মানদণ্ড। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যেমন ভাষার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি। হাজারো মানুষের সমবেত সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা গড়ে ওঠার ফলে সমগ্ৰ সংস্কৃতি, সাহিত্য, অথবা ভাষাকে ‘আমার’ অথবা ‘তোমার’ বলে চিহ্নিত করার উপায় নেই। এ সৃষ্টি কার্যে সকলেই শরীক এবং এ সৃষ্টি যৌথভাবে সকলেরই। একটি কারখানা, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অথবা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনা করলে তার মধ্যে অল্পবিস্তর বহু লোকের পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা থাকে। কিন্তু কারখানা, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অথবা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে প্রতিষ্ঠাতা অথবা পরিচালনাকারীদের মধ্যে কেউই একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি বলে দাবি করতে পারেন না। এগুলি সম্পর্কে যে কথা সত্য ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সে কথাই আরো হাজার গুণে বেশী সত্য।
রবীন্দ্রনাথ বাঙলা ভাষায় সব থেকে বেশী নোতুন শব্দ সংযোজন করে বাঙলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি করেছেন, তাঁর সাহিত্য চর্চার দ্বারা বাঙলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতিকে করেছেন অতীব ঐশ্বর্যশালী। বস্তুতঃপক্ষে আজ আমরা যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাও বহুলাংশে রবীন্দ্রনাথেরই সৃষ্টি। কিন্তু তাই বলে এ ভাষা ও সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের একক সৃষ্টি নয়। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন মৌল বস্তু যেমন অন্যবস্তুর সাথে মিলিত হয়ে তা চাপ এবং অন্যান্য অবস্থার গুণে জন্ম দেয় এক নোতুন সত্তার, সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটিই ঘটে থাকে। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে সত্তার অবিভাজ্যতা আরও কঠিনতর সত্য। কারণ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বস্তু নোতুন সত্তা সৃষ্টি করলেও রাসায়নিক বিশ্লেষণের দ্বারা বস্তুগুলি আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের পূর্বাবস্থা প্রাপ্ত হতে পারে কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সে কাজ আর কিছুতেই সম্ভব নয়। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা ব্যক্তি বিশেষের কিন্তু তার ফল সমগ্র সমাজের, সর্বসাধারণের। কাজেই সৃষ্টির পর ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রণ সেই সৃষ্টির উপর আর অবশিষ্ট থাকে না। স্রষ্টাকে মানুষ বিস্মৃত হয় কিন্তু তার সৃষ্টির ব্যবহারকে বিস্মৃত হয় না। উপরন্তু তাকেই অবলম্বন করে সমাজ ও সভ্যতাকে করে অগ্রবর্তী।
কাজেই কোন ব্যক্তিবিশেষ অথবা গোষ্ঠী যেই হোক না কেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার যতই অবদান থাক না কেন, সেই ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত দানের ভিত্তিতে সাহিত্য সংস্কৃতির অখণ্ডতাকে সে খর্ব করতে পারে না। বিভিন্ন আন্দোলনের ফলে সেই অখণ্ড সত্তার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব হয়তো বাড়ে অথবা কমে কিন্তু সেই প্রভাবের গুরুত্ব বিচার সেই সাহিত্য সংস্কৃতির অখণ্ডতাকে খর্ব করে সম্ভব নয়। সে চেষ্টা যে করবে সে সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নতি সাধানের পরিবর্তে তার ধ্বংস সাধনেই প্রবৃত্ত হবে।
সাহিত্য সংস্কৃতির চরিত্র অনেকটা সমুদ্রের মতো। ছোট বড়ো অসংখ্য ধারা ক্রমাগত তার মধ্যে প্রবাহিত হয়ে তাকে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ করে কিন্তু সাগর তার নিজস্ব মহিমায় থাকে মহিমান্বিত। এ মহিমা অগণিত অসংখ্য ধারার মধ্যে কোন বিশেষ একটির দ্বারা সৃষ্টি নয়। এ মহিমা যৌথ সৃষ্টি এবং সমুদ্রের একান্ত নিজস্ব।
আমাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একথা সত্য। জীবনচর্চাকালে আমরা যে হাজারো শব্দ ব্যবহার করে হাজারো নিত্য নোতুন ভাব ও ধারণার জন্ম দিচ্ছি সে শব্দগুলি কোনটি ঈশ্বরচন্দ্র, কোনটি মাইকেল বঙ্কিম, কোনটি দীনবন্ধু, মোশাররফ হোসেন, কোনটি রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত অথবা নজরুল ইসলামের দান। প্রত্যেক ভাষা ও সাহিত্য কর্মীই নিজ নিজ প্রতিভা অনুসারে আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন কিন্তু আজ আমরা তার নিখুঁত হিসাব রাখি না, সে হিসাব চর্চার প্রয়োজনও তেমন নেই এবং সে কাজ তেমনভাবে সম্ভবও আর নয়।
সেজন্য আজ যে কোন বাঙালী, সে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান যে ধর্মেরই হোক, বাঙলা ভাষায় কিছু লিখতে গেলে যে শব্দগুলি ব্যবহার করবে, যে ভঙ্গিতে নিজের ভাব ব্যক্ত করবে এবং যে ভাবকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে চাইবে তাদের সবকিছুই তার এক অখণ্ড ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত, তাঁর থেকে অবিচ্ছিন্ন। কোন ব্যক্তি যদি এখন মনে করেন যে বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র নজরুল ইসলাম প্রমুখের সংযোজিত শব্দ বাদ দিয়ে অথবা তাঁদের প্রভাবকে বীরবিক্রমে অতিক্রম করে বাঙলা সাহিত্যে এক অদৃষ্টপূর্ব বিপ্লব সাধন করবেন তাহলে তাঁর সে প্রচেষ্টা হয় সম্পূর্ণভাবে মূঢ়তাব্যঞ্জক নয়তো প্রতারণামূলক।
ঊনিশ শতকেই বাঙলা সাহিত্য তার আধুনিক রূপ লাভ করে। আধুনিক বাঙলা গদ্যরীতিও মোটামুটিভাবে এই সময় গঠিত হয়। বাঙলা সংবাদপত্রেরও ইতিহাস সেই থেকেই শুরু। বাঙলা সাহিত্যের এই পর্যায়ে হিন্দু মুসলমান ব্রাহ্ম খৃষ্টান এসব প্রশ্ন অনেকাংশে ছিলো অবান্তর। এজন্যেই দেখা যায় রামমোহন একদিকে বহু ধর্ম চর্চা করছেন, ফারসী সংবাদপত্র সম্পাদনা করছেন এবং অন্যদিকে বাঙলা ভাষায় সৃষ্টি করছেন নিজের ধর্ম সাহিত্য। বিদ্যাসাগর পুরাণ রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে যে গদ্য সাহিত্য সৃষ্টি করছেন সেই গদ্যরীতিই সমগ্রভাবে বাঙালীর দ্বারা স্বীকৃত, অনুসৃত এবং নব নব রূপে রূপান্তরিত। এজন্যেই ১৮৩১ সালে বাঙলা ভাষায় মুসলমান পরিচালিত প্রথম সাময়িক পত্রের নাম আরবী ফারসীতে না হয়ে হলো সমাচার সভারাজেন্দ্র। এ নাম যে আরবী ফারসীতে হতে পারতো না তা নয়। কিন্তু সাময়িকপত্রটির নাম যে আরবী ফারসীতে হতেই হবে এমন কথা সেকালে ছিলো না। সাময়িকপত্রটির নাম যে সমাচার সভারাজেন্দ্র হলো এ নিয়ে কোন বিতর্কের সূত্রপাত হয়নি। কিন্তু ঊনিশ শতকের শেষ অথবা বিশের প্রথমার্ধে মুসলমান পরিচালিত যে সমস্ত সংবাদ ও সাময়িক পত্রের আবির্ভাব হলো তাদের নাম হলো আরবী ফারসীতে। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে আরবী ফারসী নামওয়ালা পত্রিকার সাথে সুধাকর, মিহির, হিতকরী, লহরী ইত্যাদি কতকগুলি বাঙলা নামধারী পত্রিকাও পাওয়া যায়। কিন্তু বিশ শতকের পত্র পত্রিকার বাঙলা নাম দেবার রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেলো। বাঙলার বদলে সেখানে কেবল আরবী ফারসীর ভীড়। তার থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে মুসলমানেরা এই সময়ে বাঙলা নামকরণের আর পক্ষপাতী ছিলেন না। তাদের চেতনার মধ্যে এই পরিবর্তনের কারণ সন্ধান করতে হলে আলোচিত সময়ের মধ্যে শুধু মুসলমান সমাজ নয়, সমগ্র বাঙালী সমাজে যে পরিবর্তন এসেছিলো তার হিসাব নিতেই হবে।
বাঙলা গদ্যের কথাতে ফিরে গেলে বলতে হয় যে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র যে রীতি প্রবর্তন করলেন সেটা হলো সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের নিজস্ব। শব্দ চয়নের দিক থেকেও একথা প্রযোজ্য। বিশ শতকের প্রথমার্ধে কিছু মুসলমান লেখক সংস্কৃত শব্দ যথাসম্ভব বাদ দিয়ে আরবী ফারসীর জিগীর যেভাবে তুলেছিলেন এবং তাঁদের পূর্ব পাকিস্তানী উত্তরসূরীরা এখন ঢাক ঢোল পিটিয়ে যেভাবে সেই জিগীরকে শতগুণে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন সে রকম কোন প্রচেষ্টা প্রথমদিকে ছিলো না। এ জন্যে সে সময় মুসলমান লেখকেরা গদ্যরীতি এবং শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে মুসলিম ঐতিহ্যের আওয়াজ তোলেননি। তথাকথিত মুসলিম ঐতিহ্যের বর্তমানে বর্ণিত ইতিহাসটি যদি সে আমলের কল্পিত কাহিনী না হয়ে হাজার বছরের হতো তাহলে সে আমলের মুসলমান লেখকেরাও সমানভাবে তারই জিগীর তুলতেন। কিন্তু বস্তুতঃ তাঁরা তা করেন নি। মীর মোশাররফ হোসেন যদি তৎকালীন মুসলিম সাহিত্যের প্রতিনিধি স্থানীয় হন তাহলে তাঁর গদ্যের নমুনাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। সে নমুনা মধ্যে আমরা কোন সাম্প্রদায়িক আস্ফালন অথবা ‘মুসলিম সাংস্কৃতি’ উদ্ভূত বাক্য-বিন্যাসের দেখা পাই না। সে গদ্য এবং শব্দ রীতি মীর মোশাররফেরও যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়েরও ঠিক তেমনি।
৭
ভাষা মানুষের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ একথা স্বীকার করতেই হবে। এ স্বীকৃতির কারণ ভাষার মাধ্যমে মানুষ শুধু সাহিত্যই সৃষ্টি করে না। ভাষা তার জীবিকা অর্জনেরও সর্ব প্রধান হাতিয়ার। এই ভাষা যদি হিন্দু মুসলমানদের যৌথ সৃষ্টি হয় তাহলে তার মাধ্যমে সমগ্র বাঙালী জীবনের যে ঐক্যসূত্র তাকে অস্বীকার করবে কে?
ঊনিশ শো বাহান্নো সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষার দাবীকে দমন করার জন্যে যারা ছাত্রজনতা হত্যা করেছিলো তাদেরও একথা ভালবাবেই জানা ছিলো যে ভাষা হলো মানুষের জীবনের অন্যতম প্রধান ঐক্যসূত্র। এ জন্যেই সে সূত্রকে ছিন্ন করার প্রচেষ্টায় তারা ছিলো উন্মত্তপ্রায়। সংস্কৃতিকে আঘাত করতে হলে ভাষা ও সাহিত্যকে আঘাত করাই যে প্রয়োজন এ উপলব্ধি তাদের বরাবরই ছিলো এবং সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের আজও আছে। এজন্যেই পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাদের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যবিরোধী আন্দোলন। সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে তারা বিচ্ছিন্ন করতে চায় কারণ তারা জানে যে সত্য অর্থে এ দুই একই ঐক্যসূত্রে গ্রথিত এবং সে ঐক্যসূত্র হলো পূর্ব পাকিস্তানের হাজার বছরের জীবনভূমি।
৮
বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথকে বাঙলা সাহিত্যের কর্ণধার এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে স্বীকার করা এবং তাঁদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির যোগকে অস্বীকার করা সম্পূর্ণ অজ্ঞ মানুষ অথবা বিকারগ্রস্ত মানসিক রোগীর পক্ষেই সম্ভব। এবং সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা তো মানসিক বিকারেরই এক নিশ্চিত অভিব্যক্তি।
কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটা সত্য অর্থে মানসিক বিকার হলেও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের কেন্দ্রস্থানীয় ব্যক্তিদের কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাঁদের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে তাঁদের জ্ঞান আছে, বুদ্ধি আছে এবং সেই জ্ঞানবুদ্ধির সাথে কিছু পাপও মিশ্রিত। জ্ঞান, বুদ্ধি এবং পাপের এই মিশ্রণের রাসায়নিক ফলকেই বাঙলা ভাষায় বলে জ্ঞানপাপী। উপরোক্ত কেন্দ্রস্থানীয় ব্যক্তিরা আসলে বিকারগ্রস্ত নন। তাঁরা হলেন জ্ঞান, বুদ্ধি ও পাপবিদ্ধ সিদ্ধপুরুষ!