সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা

সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা

ভারতবর্ষে বিপরীতধর্মী জাতির মোকাবেলায় মুসলমানের নিজস্ব তহজীব ও তমুদ্দন সম্পর্কে শঙ্কিত ও সচেতন থাকতে হোত। সামান্য পদঙ্খলন হলেই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে এ ভয় ছিল। প্রতিপক্ষের সাংস্কৃতিক আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার উপায় নিয়ে তাঁরা ছিলেন চিন্তিত। ছোটকালে ঢাকায় দেখেছি মসজিদের সামনে কোন বাজনা চলত না। হিন্দু পর্বের সময় এ নিয়ে দাঙ্গা হয়েছে পর্যন্ত। আকজাল মুসলমানেরাই সামাজিক আচার অনুষ্ঠান উপলক্ষে নির্বিবাদে রাস্তাঘাটে বাজনা বাজায়। নামাজের সময়ে পর্যন্ত এ বাজনার বিরতি ঘটে না। কিন্তু তা নিয়ে ধর্মীয় কারণে কেউ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে এ খবর শুনিনি। আমাদের জীবন এতে নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে; শহরে গোলমাল বেড়েছে। কিন্তু ধর্ম সম্বন্ধে ঢাকার মুসলমান সমাজের ঔদাসীন্যের প্রমাণ হিসাবে এই ঘটনা উল্লেখযোগ্য কিনা সন্দেহ। কথা এই যে, পূর্বে আপত্তি হতো বাদকদল হিন্দু ব’লে। তাদের হাতে ইসলাম অপমানিত হবে এটা কেউ বরদাশত করতে রাজী ছিল না। পাকিস্তানে এসেছে ইসলাম সম্পর্কিত একটা নিরাপত্তার ভাব। দু’একজন বাদক মসজিদের সামনে বাজনা বাজালেই ইসলাম বিপন্ন হ’বে একথা কেউ ভাবে না। [১]

[১. আমার সাম্প্রদয়িকতা নামক বইয়ের সমালোচনা প্রসঙ্গে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। পূর্বমেঘ সপ্তম বর্ষ, প্রথম-দ্বিতীয় সংখ্যা, বৈশাখ-আশ্বিন ১৩৭০। পৃষ্ঠা ৬৯-৭০]

উপরের উদ্ধৃতিটির মধ্যে যে মনোবৃত্তির পরিচয় মেলে তারই নাম সাম্প্রদায়িকতা। এখানে লেখকের বক্তব্যকে বিচার করলে দেখা যাবে যে তাতে সত্যিকার ধার্মিকতার কোন স্থান নেই। অর্থাৎ ধর্মের মর্যাদা রক্ষার প্রতি তাঁর কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু ধর্মকে ঐহিক স্বার্থের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার ব্যগ্রতা আছে। পাকিস্তানপূর্ব যুগে মসজিদের সামনে বাজনা বাজানোর ফলে যে দাঙ্গা হাঙ্গামা হতো তার প্রতি লেখকের অকুণ্ঠ সমর্থন কারণ সেই দাঙ্গা হাঙ্গামাকে সমর্থন না করলে সেটা পদস্খলনের সামিল এবং সামান্য পদস্খলন হলেই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে, উল্লিখিত ‘বিপদ’ যদি ধর্মসম্পৰ্কীয় হতো তাহলে আজকাল ‘নামাজের সময়ে পর্যন্ত বাজনার বিরতি না ঘটলে ‘ যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ ছিলো। কিন্তু উদ্ধৃত অংশটির লেখকের অন্তরে সে আশঙ্কাবোধ একেবারেই নেই। এর সরল অর্থ মসজিদের সামনে বাজনা বাজানোর মধ্যে আত্যন্তিকভাবে কোন দোষ নেই। অর্থাৎ তার ফরে ধর্মের প্রকৃত অবমাননা হয় না। অবমাননা হয় তখনই যখন সেই বাজনা বাজায় অমুসলমান। হিন্দু এ বাজনা বাজালে সেটা হয় সাংস্কৃতিক আক্রমণ কিন্তু মুসলমান সে কাজ করলে তার সাত খুন মাফ!

এ আক্রমণ তাহলে কি জাতীয় সাংস্কৃতিক আক্রমণ? এর চরিত্র বিচার করতে গিয়ে প্রথমেই দেখা যাবে যে এটা আর যাই হোক ধর্মীয় নয়। তা হলে বাদকদল হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান যাই হোক মসজিদের সামনে নামাজের সময় বাদ্যবাদনে আপত্তির কারণ থাকতো।

কিন্তু আক্রমণটি যদি ধর্মীয় না হয় তাহলে তা কোন্ প্রকৃতির ‘সাংস্কৃতিক আক্রমণ?’ এ প্রশ্ন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ যাঁরা এ ধরনের আক্রমণকে সাংস্কৃতিক আক্রমণ আখ্যা দেন তাঁদের সংস্কৃতির মূল ব্যাখ্যা বাহ্যতঃ ধর্মকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।

আলোচ্য উদ্ধৃতিটির লেখক ‘ধর্ম’ এবং ‘সংস্কৃতিকে’ প্রকৃতপক্ষে বিচ্ছিন্ন করেছেন এবং বিপরীত দাবী সত্ত্বেও এ বিচ্ছেদই সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম প্রধান চরিত্রলক্ষণ। অর্থাৎ যে মানুষ সাম্প্রদায়িক তাকে ধার্মিক হতেই হবে এমন কথা নেই। শুধু তাই নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কাছে ধর্মের তত্ত্ব এবং ব্যবহার নিতান্তই গুরুত্বহীন। এজন্যেই দেখা যায় যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষ, সে হিন্দুই হোক অথবা মুসলমান, কদাচিৎ ধর্মনিষ্ঠ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন শুধু যে ধর্মনিরপেক্ষ তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে ধর্মবিমুখ।

সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির এখানেই মূল বিরোধিতা। একদিকে তা চিন্তার কাঠামোকে জোরপূর্বক ধর্মের উপর স্থাপন করতে চায় আবার অন্যদিকে সংস্কৃতির নামে তা মানুষের চিন্তাকে চালনা করে ধর্মহীন ঐহিকতার দিকে। এ দুই প্রবৃত্তির মধ্যে দ্বিতীয়টিই সর্বাংশে প্রধান, কারণ এজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির তথাকথিত ধর্মানুগত্য ধর্মীয় আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। একথা অনস্বীকার্য যে, ধর্মকে তার প্রয়োজন। কিন্তু সে প্রয়োজনের চরিত্র স্বতন্ত্র। সাম্প্রদায়িকতাবাদীর কাছে ধর্ম তাই জীবনযাপনের পদ্ধতি নয়, তা হলো ক্ষুদ্র ঐহিক স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার।

এই সব কারণে দেখা যায় ধর্মের দোহাই দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা অনেক কিছু বললেও সংস্কৃতি বলতে আসলে যা বোঝাতে চান ধর্মের সাথে তা সম্পর্কহীন। তাঁদের সংস্কৃতিচর্চার লক্ষ্য ধর্মের গৌরববর্ধন নয় আসলে তা হলো ধর্মের প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য জ্ঞাপনকারী লোকদের শ্রেণীস্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে সহায়তার আয়োজন।

ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিসেবীদের মত তাঁরাও নিজেদের জীবনে ধর্মের প্রভুত্বকে অস্বীকার করেন কিন্তু প্রথমোক্তদের মতো তাঁরা সেটা সরাসরি এবং সততার সাথে কবুল করতে নারাজ। সাধারণ ধর্মনিষ্ঠ এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের সাথে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এখানেই প্রকৃত পার্থক্য। ধর্মনিষ্ঠ মানুষ সত্যি সত্যি ধর্মে বিশ্বাস করে এবং ব্যবহারিক জীবনেও ধর্মের কোন প্রভাব থাকে না। সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা এর কোনটাই নয়। তারা বোঝাতে চায় যে, তত্ত্বগতভাবে তারা ধর্মানুগত কিন্তু তাদের ব্যবহারিক জীবনে সে আনুগত্যের কোন দেখা মেলে না। এ কারণেই সত্যিকার ধর্মনিষ্ঠ এবং ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তির জীবনে সাধারণভাবে সততার একটা স্থান থাকলেও সাম্প্রদায়িকতাবাদীর জীবন অসৎ এবং মিথ্যাময় হতে বাধ্য।

ধর্মকে শোষণের কাজে ব্যবহার কোন নোতুন কথা নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সেটা হয়েছে। প্রত্যেক পর্যায়েই দেখা গেছে যে, অধিক সংখ্যক মানুষ ধর্মে সততার সাথে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং অল্প সংখ্যক লোকে সে বিশ্বাসকে ব্যবহার করেছে। এভাবেই ধর্ম পরিণত হয়েছে শোষণের হাতিয়ারে। ইতিহাসের এই অভিজ্ঞতাতে তাই দেখা যায় যে মানুষ ধর্মচর্চা করলেই সে খারাপ একথার কোন ভিত্তি নেই। পৃথিবীতে অগণিত শোষিত মানুষই আবহমানকাল থেকে ধর্মচর্চা করে আসছে এবং তারা খারাপ এবং অসৎ এ কথা বলা মূঢ়তা ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু তার অর্থ আবার এই নয় যে, ধর্মচর্চাকারী মানুষ সঠিক পথের অনুসারী। এর অর্থ এই যে, ধর্মচর্চা করা এবং ধর্মকে অন্য উদ্দেশে ব্যবহার করা এ দুই মনোবৃত্তির মধ্যে প্রভেদ আছে। এবং যে কোন যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তার ক্ষেত্রেই এ প্রভেদকে স্বীকার করা প্রয়োজন।

যারা ধর্মচর্চা করে তারা অধিকাংশই শোষিত এবং অশিক্ষিত। ধর্মচর্চা শোষণ ও অশিক্ষার মতোই তাদের জীবনের ভূষণ। তাই শোষণ ও অশিক্ষাকে যেমন তারা জীবন থেকে সহজে বাতিল করতে পারে না, ধর্মকেও তেমনি বর্জন করা তাদের সাধ্যাতীত। এগুলির অস্তিত্ব তাদের জীবনে প্রায় সমান্তরাল এবং সমকালস্থায়ী।

ধর্মনিষ্ঠা এবং সাম্প্রদায়িকতার এই পার্থক্যকে যথাযথভাবে নির্ণয় করা এজন্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মকে যারা শোষণের কাজে ব্যবহার করেছে অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠ মানুষদেরকে যারা চিরকাল শোষণ করে এসেছে সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা তাদেরই ঐতিহ্যবাহী, এদেশে তাদেরই তারা আধুনিক ও সমসাময়িক সংস্করণ।

শোষণকে উচ্ছেদের জন্যে এ সত্যকে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধির প্রয়োজন অপরিহার্য। এ উপলব্ধি যদি অন্তরে না আসে তাহলে ধর্মের দ্বারা সমগ্র সমাজ কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ধর্মকে কিভাবে অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের কাজে সাম্প্রদায়িকতাবাদী শোষকেরা ব্যবহার করছে তার সত্যিকার চরিত্রও সার্থকভাবে উদ্ঘাটিত হবে না।

ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা তার বর্তমান চরিত্র পরিগ্রহ করতে শুরু করে ঊনিশ শতকের সত্তরের দিকে, দেওবন্দ এবং আলীগড় মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পত্তনের পর থেকে। এই প্রতিষ্ঠান দুটির উদ্দেশ্য এক ছিলো না। দেওবন্দে শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিলো তার মধ্যে আধুনিকতার পরিবর্তে ছিল গতানুগতিকতা। বহু শতাব্দী পূর্বে প্রবর্তিত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানের, বিশেষতঃ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছিলো তার শিক্ষা কাঠামো। সেই অনুসারে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা, বিশেষতঃ ‘ফিকাহ-এর উপর গুরুত্ব দেওয়া হতো যথেষ্ট। বৃটিশ ভারতে যে নোতুন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিলো তার সাথে প্রকৃতপক্ষে দেওবন্দের কোন সম্পর্কই ছিলো না। এ সব দিক থেকে দেওবন্দ ছিলো পুরোপুরি একটি রক্ষণশীল ধর্মীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তত্ত্বগতভাবে এবং ব্যবহারিক জীবনে ধর্মচর্চাই ছিলো তার মুখ্য উদ্দেশ্য।

এই উদ্দেশ্যের সাথে আলীগড় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সামঞ্জস্য ছিলো না। আলীগড় কলেজের প্রতিষ্ঠার সাথে স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রভৃতি যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁরা প্রতিষ্ঠানটিকে আধুনিক শিক্ষার উপযোগী করে গঠন করতে চেয়েছিলেন। কাজেই বৃটিশ ভারতে উনিশ শতকে নোতুন আর্থিক ও সামাজিক প্রয়োজনে যে নোতুন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো আলীগড়ের প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন তারই দ্বারা অনুপ্রাণিত। সেজন্যেই এই শিক্ষায়তনে বিশুদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে বিজ্ঞান এবং আধুনিক জ্ঞানের অনুশীলনের প্রতি গুরুত্বই ছিলো বেশী।

দেওবন্দ এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথমটি সৃষ্টি হয়েছিলো নোতুন আর্থিক জীবনকে অনেকাংশে উপেক্ষা করে ধর্মীয় জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে এবং দ্বিতীয়টি সৃষ্টি হয়েছিলো ধর্মীয় জীবনকে অনেকাংশে উপেক্ষা করে নোতুন আর্থিক জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে। স্যার সৈয়দ আহমদের ব্যক্তিগত ধর্মনিষ্ঠা এবং ধর্মানুগত্য সত্ত্বেও দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটির ক্ষেত্রে এ কথা সত্য। তিনি মুসলমানদের ঐহিক জীবনে দুরবস্থার অবসান ঘটাতে যত্নবান হয়েছিলেন এবং তাঁর সমগ্র শিক্ষাচিন্তার সেটাই হলো মূলসূত্র।

স্যার সৈয়দ যখন আলীগড় কলেজের পত্তন করেছিলেন তখনও সাম্প্রদয়িকতা ভারতবর্ষের মাটিতে ভালভাবে মূল এবং শাখা বিস্তার করেনি। তাঁর নিজের চিন্তাও তখন ছিলো বহুলাংশে অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু নিজের চিন্তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সৈয়দ আহমদ খান বেশী দিন আর রক্ষা করতে সক্ষম হলেন না। অচিরেই ঊনিশশো আশির দিকে আর্থিক ও রাজনৈতিক তাগিদে তাঁর সে চিন্তা ভেঙ্গে পড়লো। তিনি দেখলেন যে, নব্যশিক্ষিত মুসলমানদের ব্যবসা বাণিজ্য চাকরী বাকরী ইত্যাদি ঐহিক স্বার্থ রক্ষার সংগ্রাম অনেকাংশে পরিণত হলো নব্যশিক্ষিত হিন্দুদের সাথে সংগ্রামে। আর্থিক জীবনে শুরু হলো হিন্দু-মুসলমানের ভাগ বাঁটোয়ারার মারামারি এবং তার থেকেই জন্মলাভ করলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।

দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের দৃষ্টি অন্যদিকে নিবন্ধ থাকার ফলে তাঁদের রাজনীতিও হলো ভিন্ন। সে প্রতিষ্ঠান থেকে যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতো তারা ইংরেজের অফিস আদালতে কোন চাকরী পেতো না। তাদের সে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার ফলে তারা ব্যবসা- বাণিজ্য-চাকরীতে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের আশাও করতো না। তারা চাকরী পেতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে অথবা উপার্জন করতো অন্যান্য ধর্মীয় কাজকর্মের দ্বারা। সেই হিসাবে হিন্দুদের সাথে তাদের আর্থিক জীবনে কোন প্রতিযোগিতা ছিলো না এবং প্রতিযোগিতার এই অভাব এবং ভাগ বাঁটোয়ারার মারামারির বাইরে থাকার ফলে তাদের রাজনীতির চরিত্রও হলো স্বতন্ত্র। সাম্প্রদায়িকতা থেকে সে রাজনীতি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত থাকলো মোটামুটিভাবে মুক্ত।

আলীগড়ে যে আধুনিক শিক্ষাগ্রহণ মুসলমানেরা শুরু করলো সে শিক্ষাই বাঙলাদেশ এবং অন্যান্য স্থানের মুসলমানেরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রহণ করতে শুরু করলো। তাদের এই নোতুন শিক্ষার তাগিদ সম্পূর্ণভাবে এলো আর্থিক ও সামাজিক জীবনকে গঠন করার তাগিদে। এই তাগিদের রাজনীতিই হলো সাম্প্রদায়িক এবং তার থেকেই হলো মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। যে প্রয়োজনে মুসলিম লীগের জন্ম সে প্রয়োজনের অভাবেই দেওবন্দে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা। তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ এ জন্যেই ছিলো অসাম্প্রদায়িক। এ জন্যেই তার সাথে ছিলো ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগ।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমেই মুসলিম সংস্কৃতি নামে কথিত সংস্কৃতি পরিণত হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীস্বার্থ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারে। এ মুসলিম সংস্কৃতি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেওবন্দের মুসলিম সংস্কৃতি নয়। এ এমন এক সংস্কৃতি যার সাথে ইসলামের তেমন কোন তত্ত্বগত যোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে এ সংস্কৃতি ইসলামে বিশ্বাসী বলে যারা দাবী করে তাদের হালুয়া রুটির যোগানদার।

মুসলিম সংস্কৃতির নাম করে মুসলমানদের যে সব সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয় সেগুলি অনেকক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে অথবা গায়ের জোরে সৃষ্ট। এদের অস্তিত্বও খুব বেশী দিনের নয়, এরা সাম্প্রদায়িকতার উত্থানযুগের প্রায় সমসাময়িক। অমুসলমানদের থেকে মুসলমানরা যে পৃথক এই কথা আর্থিক ও রাজনৈতিক কারণে প্রচার করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই বহুলাংশে হিন্দু-মুসলমান উভয় সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিরই জন্ম। এজন্যে মুসলমানেরা যা করতো হিন্দুরা চাইতো তার বিপরীতটি করতে এবং হিন্দুরা যা করতো মুসলমানেরা তার উল্টোটি করে বসতো। যে কোন সমাজ ও দেশের সংস্কৃতি যে তার আর্থিক জীবনের দ্বারা কতখানি নিয়ন্ত্রিত ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উন্মেষ তারই এক অনস্বীকার্য উদাহরণ। এ কারণেই ইসলাম ধর্মের মধ্যে তথাকথিত মুসলিম সংস্কৃতির মূলসূত্র অনুসন্ধান করলে অতি সহজেই বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ বিভ্রান্তিকে অতিক্রম করতে হলে তার সন্ধান করতে হবে এ দেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবনভূমিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *