অক্টোবর বিপ্লব ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

অক্টোবর বিপ্লব ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

১৯১৭ সালের অক্টোবরে রুশদেশে যে বিপ্লব ঘটে তার সাথে পূর্ববর্তী যে কোনো বিপ্লব, এমনকি ফরাসী বিপ্লবেরও, দুস্তর পার্থক্য। ফরাসী বিপ্লবের পর সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটলেও তার মাধ্যমে সমাজদেহে শোষণের উচ্ছেদ হয়নি। শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে যে পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়, ফরাসী বিপ্লব ছিল তারই পরিণতি। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং উৎপাদন-পদ্ধতিকে বাতিল করে ফরাসী দেশে এর পর শুরু হয় বুর্জোয়া শ্রেণীর জয়যাত্রা। এ যাত্রাপথে উৎপাদন ক্রমবর্ধিতভাবে সামাজিক রূপ পরিগ্রহ করলেও তার দ্বারা সমগ্র অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু তাই নয়। সে ব্যবস্থায় উৎপাদন এবং বণ্টনের মধ্যে একটা ব্যবধান প্রথম থেকেই ছিলো এবং সে ব্যবধান ক্রমশঃ হ্রাসপ্রাপ্ত না হয়ে বৃদ্ধিলাভ করতে থাকলো। এর ফলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন একটা দৃঢ় সামাজিক ভিত্তির উপর স্থাপিত হলেও বণ্টনের ক্ষেত্রে অসাম্য দূর হলো না। কাজেই শ্রমিকশ্রেণীভুক্ত লোকেরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে থাকলেও তারা আর্থিক এবং সামাজিক অধিকার থেকে নিদারুণভাবে বঞ্চিত হয়ে রইলো। অক্টোবর বিপ্লব বাস্তবপক্ষে সর্বপ্রথম ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎপাদন এবং বণ্টনের মধ্যেকার এই ব্যবধানকে নিশ্চিহ্ন করার পথনির্দেশ করে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে স্থাপন করলো এক সম্পূর্ণ নোতুন ভিত্তির উপর। এই নোতুন ভিত্তি রচনার মধ্যেই তাই অক্টোবর বিপ্লবের সত্যিকার তাৎপর্য নিহিত আছে। সমাজের সামগ্রিক জীবনকে শোষণমুক্ত করার জন্যে অনেক বাস্তব ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। সেগুলিকে কার্যকর করতে হলে বণ্টনক্ষেত্রে অসাম্য এবং শ্রেণী শোষণের উচ্ছেদ সাধন একান্ত অপরিহার্য। এ কাজ রাতারাতি রুশদেশে সম্ভব হয়নি এবং তা হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তবু একে সম্ভব করার জন্যে প্রথম থেকেই তারা সচেতন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতিক্ষেত্রে সঞ্চার করে এক অভূতপূর্ব জাগরণের। জনসাধারণের জীবনে এই সংস্কৃতিক বিপ্লবের সাফল্যের উপরই যে অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য প্রায় সর্বতোভাবে নির্ভরশীল এ সত্য লেনিন এবং অপরাপর নেতৃবৃন্দ সহজেই উপলব্ধি করেন এবং সেই পথ ধরে অগ্রবর্তী হন।

বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার সাংস্কৃতিক জীবন শোষণমূলক আর্থিক ব্যবস্থার দ্বারা পুরিপুষ্ট হতো। তার ফলে শুধু উচ্চশ্রেণীর শোষিত মানুষদের মনেও এমন সব ধ্যানধারণা ও সংস্কার রাজত্ব করতো, যেগুলি প্রচলিত শোষণব্যবস্থাকে কায়েম রাখার পক্ষে হতো যথেষ্ট সহায়ক। নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম রাখার জন্যে শোষকশ্রেণীর লোকেরা বহু মিথ্যার জন্ম দিতো এবং সেই সব মিথ্যাকে আশ্রয় করে সমাজের উচ্চ নীচ সকলেই নির্বাহ করতো জীবনযাত্রা। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের শুরুতে এই মিথ্যার মহিমাতেই পাদ্রী গ্যাপনের নেতৃত্বে অগণিত মানুষ শোষকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রার্থনা করেছিল জার নিকোলাসের কাছে। তাদের ধারণা ছিলো জারের অধীনস্থ লোকেরা অত্যাচারী হলেও জার নিজে একজন মহানুভব ব্যক্তি, তাঁর কাছে আবেদন-নিবেদন করলে অবিচারের একটা প্রতিকার হবেই। কাজেই গলায় ক্রশচিহ্ন ঝুলিয়ে, ধর্মভাবে আপ্লুত হয়ে, তারা ধর্মাবতার জার নিকোলাসের প্রাসাদের সামনে উপস্থিত হলো সামন্ততান্ত্রিক ও বুর্জোয়া শোষকশ্রেণীর মধ্যমণি নিকোলাসের হৃদয় প্রজাদের আবেদন নিবেদনে আর্দ্র হলো না। উপরন্তু জনতা ছত্রভঙ্গ করার জন্যে তাদের ওপর নির্দয়ভাবে গুলীবর্ষণের ফলে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং আহত হলো। আর্থিক জীবনের তাগিদে শোষণকে উচ্ছেদ করার প্রয়োজনে মানুষের মনে একটা সংগ্রামী চেতনা সঞ্চারিত হলেও সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রভাবে মানুষ যে নিজেকে কতখানি বিপন্ন করতে পারে ১৯০৫ সালের এই ঘটনাই সেকথা প্রমাণ করে। কিন্তু শুধু এটাই নয়, আরও অসংখ্য ধ্যান-ধারণা যুগ যুগ ধরে শোষিত মানুষের অন্তরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে থাকে, যেগুলির উচ্ছেদ বিপ্লবের সাফল্যের জন্যে অপরিহার্য এবং এখানেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গুরুত্ব।

সংস্কৃতির ধর্মচরিত্র, দেশচরিত্র ইত্যাদি নিয়ে আকাশ-পাতাল গবেষণা করলেও তার শ্রেণীচরিত্রের আলোচনা বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। তাঁরা যে বিশেষ এক শ্রেণীর প্রতিনিধি, একথা তাঁরা স্বীকার করতে চান না এবং এজন্যেই নিজেদের সংস্কৃতিকে সমগ্র সমাজের সংস্কৃতি বলে প্রচার করেন। এই প্রচারণার মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক ও বুর্জোয়া মূল্যবোধ, ভালমন্দের জ্ঞান, ইত্যাদিকে তাঁরা সমগ্র সমাজের পক্ষে কল্যাণকর বলে প্রমাণ করতে চান। এজাতীয় সংস্কারের ফলেই এদেশে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকেও বিধবা হিন্দু যুবতীরা অনেকে স্বর্গারোহণের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে স্বেচ্ছায় চিতায় আরোহণ করতো এবং এখনো শোষিত প্রজারা শোষক জমিদার মহাজনকে পিতামাতা জ্ঞান করে অনেক সময় স্বেচ্ছায় তাদের দাসত্ব করে এবং তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে সম্মত হয় না। এই প্রচারণার ফলেই হিন্দু শ্রমিক, মুসলমান শ্রমিক নিজেদের শ্রমিকচরিত্র বিস্মৃত হয়ে পরস্পরের প্রাণনাশ করতে দ্বিধাবোধ করে না। এর ফলেই বাঙালী, অবাঙালী শ্রমিকেরা প্রবৃত্ত হয় পরস্পরের সাথে দাঙ্গা করতে।

প্রত্যেকটি সংস্কারের যেমন একটি বাস্তব ভিত্তি থাকে অর্থাৎ বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে সেটি মানুষের মনে ধীরে ধীরে নিজের রাজত্ব কায়েম করে তেমনি এ কথাও সত্য যে সেই বাস্তব ভিত্তির অবসানের সাথেই সংস্কারগুলির রাজত্ব রাতারাতি বিলুপ্ত হয় না। তার জন্যে সময় লাগে এবং সে সময়কে সংক্ষেপ করার জন্যে প্রয়োজন হয় কিছুটা সজ্ঞান প্রচেষ্টার। এই প্রচেষ্টাকে জাগ্রত রাখার জন্যেই অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েট রাশিয়ায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং তার ফলেই সে দেশে সামন্ততান্ত্রিক ও বুর্জোয়া মূল্যবোধের অবসান ঘটিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত হয় সমাজতান্ত্রিক চেতনা এবং মূল্যবোধ। এজন্যেই লাল চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব তাদের সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখার জন্যে আজ অপরিহার্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *