সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার শ্রেণীগত ভূমিকা

সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার শ্রেণীগত ভূমিকা

ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত স্বার্থ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের সংঘর্ষ থেকেই হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির জন্ম এবং বিকাশ। এই সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক পরিচয় একটি বিশেষ পর্যায়ে প্রাধান্য লাভ করলেও সাংস্কৃতিক জীবনে এর প্রভাব অনক সুদূরপ্রসারী এবং অধিকতর মারাত্মক। কিন্তু মারাত্মক বললেই প্রশ্ন ওঠে এ প্রভাব কার পক্ষে মারাত্মক। এর সহজ উত্তর – জনগণের পক্ষে, কৃষক, মজুর, নিম্ন মধ্যবিত্তের পক্ষে

পাকিস্তান আন্দোলনকালে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাই ছিল মুসলিম লীগের নেতা ও কর্মীদের আদর্শিক হাতিয়ার। হিন্দুদের মধ্যেও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব খুব উল্লেখযোগ্য। ঊনিশ ও বিশ শতকের সাহিত্যে তার প্রমাণের অভাব নেই।

ঊনিশ শতকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতীয় রাজনীতি কিছুমাত্র সংগঠিত ছিলো না। তখন সংস্কৃতিক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার আবির্ভাব হয়েছিলো একদিকে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় আবিষ্কার এবং অন্যদিকে আর্থিক জীবনকে নোতুনভাবে গঠন করতে গিয়ে। ভারতীয় হিন্দুরা যখন নিজেদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চা শুরু করলেন তখন স্বভাবতঃই তার মধ্যে দেশীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রাধান্য পেলো। ইংরেজদের নোতুন রাজত্বে যখন আর্থিক জীবনকে নোতুনভাবে গঠন করার প্রয়োজন দেখা দিলো তখন হিন্দুরা সেই অবস্থার সাথে অসুবিধা সত্ত্বেও অনেক তাড়াতাড়ি খাপ খাইয়ে নিতে পারলেন কারণ তাঁদের মনে মোগল সাম্রাজ্য বা বাদশাহী আমলের প্রতি মুসলমান অভিজাতশ্রেণীসুলভ কোন সুদৃঢ় স্বার্থগত ও ধর্মীয় আনুগত্য ছিলো না। মুসলমানেরা হিন্দুদের এই নোতুন সংস্কৃতি ও আর্থিক জীবন চর্চাকে অস্বীকার করলো নিজেদের স্বার্থগত কারণে এবং ধর্মীয় সংস্কারের বশে। কাজেই হিন্দু মুসলমান সমস্ত পেশাদার শ্রেণীর মধ্যে একটা দারুণ রেষারেষি এবং শত্রুতার ভাব ঊনিশ শতকেই সৃষ্টি হলো। এ রেষারেষি এবং শত্রুতা সমাজের উপর তলাতেই ছিলো বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ। ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত রাজনীতি ঊনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে যখন সংগঠিত রূপ পরিগ্রহ করলো তখন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মধ্যবিত্তেরা নিজেদেরকে একত্রিত করে দাঁড়ালেন পরস্পরের মুখোমুখি।

কিন্তু এ ব্যাপারে মুসলমানদের সাথে হিন্দুদের একটা বড়ো তফাৎ ছিলো। সংখ্যাগুরু হওয়ার ফলে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা মুসলমানদের থেকে হিন্দুদের ক্ষেত্রে হলো অপেক্ষাকৃত কম। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আপেক্ষিকভাবে অধিকতর উন্নত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ হিসাবে অনুন্নত ও সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের থেকে আশাঙ্কা করার মতো তেমন কিছু তাদের ছিলো না। সেজন্যেই তাদের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেসের আদর্শ ছিলো বাহ্যতঃ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এবং সেই হিসাবে তাঁরা ছিলেন অখণ্ড ভারতের পক্ষপাতী। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে অখণ্ড ভারতের হিন্দুরা যে সুবিধা ভোগ করছিলেন সেই সুবিধার দাবীই ভারতীয় মুসলমানেরা করলেন পাকিস্তানের মাধ্যমে। হিন্দুদের মতো তাঁরাও এমন একটা এলাকায় প্রায় সর্বময় কর্তৃত্ব দাবী করলেন যেখানে সংখ্যাগুরুত্বের বলে মুসলমানরা তাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীস্বার্থকে সংরক্ষণ ও গঠন করতে পারে। কাজেই বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে পরিণামে মধ্যবিত্ত হিন্দুদের অখণ্ড ভারতের আন্দোলন এবং মধ্যবিত্ত মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যে তফাৎ বিশেষ নেই। ভাষা এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার কোন প্রচেষ্টা তাতে ছিলো না। তার মধ্যে ছিলো শুধু ধনতন্ত্রসুলভ বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার ব্যাপক আয়োজন। একথার সত্যতা স্বাধীনতা উত্তর ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাস থেকেই বিশেষভাবে প্রমাণিত হবে।

কিন্তু কংগ্রেস লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন যদি সত্যই উচ্চ মধ্যবিত্তের স্বার্থে পরিচালিত হয়ে থাকে তাহলে এদেশে অগণিত মানুষ, কৃষক শ্রমিক নিম্ন মধ্যবিত্ত সে আন্দোলনে শরীক হলো কেমন করে? এ প্রশ্নের উত্তর আলোচনাকালেই আমরা সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার চরিত্রের সাথে পরিচিত হবো।

তত্ত্বগতভাবে সংস্কৃতিকে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত মনে করাকেই সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার মূলসূত্র বলে ধরা যেতে পারে। কিন্তু এই তত্ত্ব নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বিশুদ্ধ সত্যানুসন্ধানের মধ্যে নেই। সে প্রয়োজনীয়তা তার আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবন থেকেই উদ্ভূত।

আর্থিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তত্ত্ব, মতবাদ ও আদর্শ নির্মাণ এবং সেগুলিকে বিবিধভাবে প্রচার করে জনসাধারণকে দলভুক্ত করার প্রচেষ্টা যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের পক্ষেই স্বাভাবিক। শুধু এদেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র এ চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সেদিক থেকে তার মধ্যে নোতুনত্ব অথবা দোষের কিছু নেই। কিন্তু এ প্রচেষ্টা দোষদুষ্ট হয় তখনই যখন তত্ত্ব হয় মিথ্যা এবং সেই মিথ্যা তত্ত্বকে শোষক শ্রেণীর অল্প সংখ্যক লোকের স্বার্থের কাজে ব্যবহার করা হয়। জার্মান দার্শনিক কান্ট বলেছেন যে শুভ সঙ্কল্প ছাড়া আত্যন্তিকভাবে শুভ বলে কিছু নেই। অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের বশবর্তী যা কিছু গুণাবলী বা দ্রব্যসামগ্রী সেগুলি সবই সঙ্কল্পের হাতিয়ার। সবগুলিই তার সঙ্কল্প সাধনের কাজে ব্যবহৃত হয়। কাজেই বিদ্যা, বুদ্ধি, দক্ষতা, দৈহিক ক্ষমতা, সৌন্দর্য ইত্যাদি কোন কিছুকেই সরাসরি ভালোমন্দ বলা চলে না। এগুলি সৎ সঙ্কল্প সাধনের কাজে ব্যবহৃত হলেই ভালো এবং অসৎ সঙ্কল্প সাধনের কাজে ব্যবহৃত হলেই মন্দ। অর্থাৎ এগুলির কোন নৈতিক চরিত্র নেই। সেদিক থেকে এরা নিরপেক্ষ যেমন নিরপেক্ষ একটি তলোয়ার, বন্দুক অথবা টাকাকড়ি। এগুলির দ্বারা যদি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হয় তাহলেই এরা ভালো অর্থাৎ এদের ব্যবহার ভালো। অন্যথায় এদের ব্যবহার মন্দ। কাজেই শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে ব্যবহারের উপরই এদের ভালো মন্দ নির্ভরশীল। এদের কোন আত্যন্তিক নৈতিক চরিত্র নেই।

সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের তত্ত্বনির্মাণ ও প্রচারণা সম্পর্কেও কান্টের এই বক্তব্য প্রযোজ্য। তাদের এই প্রচেষ্টা দোষদুষ্ট কারণ তা শোষণের মাধ্যমে সংকীর্ণ শ্রেণীস্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে নিয়োজিত।

পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় যে সংগঠিত শোষণ নিশ্চিতভাবে শ্রেণীভিত্তিক। মার্ক্স তাঁর শ্রেণীবিশ্লেষণের দ্বারা একথা প্রমাণ করেছেন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলনের পূর্ব পর্যন্ত যে কোন সমাজ প্রধানতঃ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত থাকে একটি শোষক এবং অন্যটি শোষিত। যে শ্রেণীটি শোষণ করে তারা সংখ্যায় অল্প। যারা শোষিত হয় তারাই অধিকাংশ। অর্থাৎ প্রত্যেক সমাজেই অল্পসংখ্যক লোক সংখ্যাগুরুকে শোষণ করে।

কিন্তু শাসন ব্যতীত শোষণ অসম্ভব। পৃথিবীতে তাই যেখানেই শোষণ সেখানেই শাসন। মানব সমাজে শাসনকে অবশ্য সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এ শাসন হলো অত্যাচারিতের উপর, শোষিতের উপর অত্যাচারী ও শোষকের শাসন। এর দুই রূপ একটি বাহ্যিক অপরটি মানসিক। বাহ্যিক শাসন কায়েম হয় দৈহিক ভয়ভীতির উপর ভিত্তি করে। তার জন্যে থাকে সৈন্যসামন্ত, পুলিশ, চৌকিদার এবং তাদের তলোয়ার লাঠি বন্দুক। এসব দেখা এবং দেখানোর দ্বারা এক শ্রেণী প্রভুত্ব করে অন্যে পরাভূত হয়। কিন্তু শুধু বাহ্যিক শাসনের দৌলতে কোন শাসনব্যবস্থাই টিকে থাকতে পারে না। তার মাধ্যমে শোষণকার্য শান্তির সাথে সম্পন্ন হয় না। শোষিতের সংখ্যাগুরুত্বই এর কারণ। পৃথিবীতে শোষণকে জারী রাখার জন্যে শুধুমাত্র বাহ্যিক শাসন ব্যতীত যদি অন্য কিছু না থাকতো তাহলে শোষক শ্রেণীর নিরাপত্তা তাতে অনেক বেশি বিপন্ন এবং শোষণকার্য অনেকাংশে সংযত ও ব্যাহত হতো। শোষণের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুর বিদ্রোহও হতো অনেক সহজ।

মানসিক শাসনের প্রয়োজনীয়তা এই উপলব্ধি থেকেই উদ্ভূত। শ্রেণী-সংগ্রামের শুরু থেকেই তাই দেখা যায় শোষিত সংখ্যাগুরুর চিত্তশাসনের বিবিধ ব্যবস্থা। এ কাজের জন্যে সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টাই উপযোগী কারণ সংস্কৃতির বাস্তব ভিত্তি যাই হোক পরিণতিতে তা মানসিক। কাজেই বাহ্যিক শাসনের জন্যে যেমন প্রয়োজন লোক লস্কর সেপাই পুলিশ, মানসিক শাসনের জন্যে তেমনি প্রয়োজন উপযুক্ত সাংস্কৃতিক হাতিয়ার।

ইতিহাসের আদিপর্বে মানুষের জীবন-ব্যবস্থা এতো জটিল এবং বিস্তৃত ছিলো না। কিন্তু শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উৎপত্তির সাথে সাথেই মানুষের মনকে শৃঙ্খলিত করার আয়োজন শুরু হলো। সেই আয়োজনকালে, প্রাকৃতিক শক্তির প্রতাপ ও মহিমায় মানুষ স্বভাবতঃই আচ্ছন্ন ছিলো। প্রকৃতি তার কাছে ছিলো এক মহা বিস্ময়, যার সব কিছুই তার অজানা। কিন্তু অজানা হলেও মানুষ নিজের প্রকৃতির গুণে তাকে জানার এবং বোঝার চেষ্টা করতো। এই প্রচেষ্টা থেকেই জন্ম নিলো অতিকথা ও দর্শন, জন্ম নিলো অতিপ্রাকৃত শক্তি। একদিকে তাই তার বাস্তব জীবন সংগ্রাম এবং অন্যদিকে প্রকৃতির প্রতি এই দৃষ্টি ভিত্তিস্থাপন করলো মানুষের সংস্কৃতির। শুরু হলো তার সংস্কৃতির আদিপর্ব।

এই আদিপর্ব থেকেই ধর্ম-সংস্কৃতি শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত। পরিবেশের সাথে ক্রমাগত সংঘাতের মধ্যে দিয়ে যে সংস্কৃতির জন্ম তাকে মোচড় দিয়ে, মুখোশ পরিয়ে ব্যবহার করা হলো সংখ্যাগুরুকে জব্দ করার কাজে। এই প্রচেষ্টার ফলেই সৃষ্টি হলো কতকগুলি ধর্ম-দার্শনিক ধারণা যেগুলির মধ্যে ভগবান, আত্মা ও পরকালই হলো সর্বপ্রধান। আত্মা এমন একটি সত্তা যা দেহের বন্ধনে আবদ্ধ নয়, জৈবিক নিয়মকানুন ও নয় তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দেহ জৈবিক, তার জন্ম বৃদ্ধি মৃত্যু আছে। কিন্তু আত্মার তা নেই। আত্মা দেশকাল এমনকি পাত্রেরও ঊর্ধ্বে। কাজেই সে জাতীয় কোন বন্ধনেই তা আবদ্ধ নয়। কিন্তু সে বন্ধন যদি না থাকে তাহলে মৃত্যুর পর আত্মার স্থান কোথায়? এবার হলো পরকালের আবির্ভাব। দৈহিক মৃত্যুর পর আত্মা বিনষ্ট হয় না, সে অব্যয় অক্ষয়। তাই তার পরকাল আছে, আছে পুনর্জন্ম।

এই আত্মা এবং পরকাল পৃথিবীতে সব ধর্মেরই ভিত্তি প্রস্তর। কিন্তু এটা শুধু ধর্মেরই ভিত্তিপ্রস্তর নয়, শোষণের হাতিয়ারও বটে। এজন্যে পরকালের সুখের জন্যে ইহকালকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং বিসর্জন দেওয়ার আহ্বান ধর্মীয় শিক্ষার পাতায় পাতায়–সে ধর্ম আদি অথবা আধুনিক যে পর্বেরই হোক। ধর্মের এই ক্রিয়াকাণ্ডে পুরোহিতকুলের ভূমিকা অতি উল্লেখযোগ্য। ধর্মকে সমগ্র শোষক সমাজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবহার করলেও এই পুরোহিত গোষ্ঠিই প্রত্যক্ষভাবে ধর্ম ব্যবসায়ী। এই ব্যবসার ভিত্তি সামাজিক শোষণের মধ্যে এমনভাবে প্রোথিত যে উপরোক্ত পুরোহিত গোষ্ঠীর আত্মিক উত্তরপুরুষেরা আজও সংস্কৃতি চর্চার অন্তরালে সেই ধর্ম ব্যবসাতেই লিপ্ত।

ধর্ম-সংস্কৃতিকে ব্যবসা ও শোষণের কাজে লাগাতে গিয়ে আত্মা ও পরকালের কথা সবাই বলেছে কিন্তু এ ব্যাপারে প্রাচীন গ্রীক এবং বিশেষতঃ ভারতীয় শোষক শ্রেণীর মতো এতো বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে অন্য কেউ সক্ষম হয় নি। এ ক্ষেত্রে তাঁদের আবিষ্কার সাত্যিই চমকপ্রদ। তাঁরা আবিষ্কার করলেন যে মানুষের শুধু পরকালই নেই, তার একটি পূর্বকালও ছিলো। অর্থাৎ শুধু আত্মা ও পরকালের উপর ভিত্তি করে নিজেদের ধর্মদর্শনকে দাঁড় না করিয়ে তাঁরা চেষ্টা করলেন তাকে ব্যাপকতর ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে। সেদিক থেকে তাঁদের চেষ্টা যুক্তিসম্মত। কারণ আত্মা যদি অমর হয় তাহলে এ জন্মকেই তার প্রথম জীবন মনে করার পেছনে কোন নিশ্চিত যুক্তি নেই। দেহকে উত্তীর্ণ হয়ে তার বারংবার জন্মান্তর সম্ভব। এভাবেই সূত্রপাত হলো জন্মন্তরের ধারণার, যার দার্শনিক পরিণতি কর্মবাদে। শোষণের ইতিহাসে মানুষের চিত্তশাসনের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসাবে কর্মবাদকে নিঃসন্দেহে চিহ্নিত করা চলে। কৌশলের দিক থেকে সত্যিই তা অতুলনীয়।

জন্মান্তরের ধারণা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার পর শোষণকে শান্তিপূর্ণ করা অনেক সহজ হলো। যে মানুষ দুঃখকষ্ট পেয়ে জীবনধারা পরিবর্তনের চিন্তা ও চেষ্টা করতো তাকে বলা হলো যে তার বর্তমান অবস্থার সাথে এ জীবনে যা কিছু ঘটছে তার কোন সম্পর্ক নেই। এ জীবন তার দুঃখময় কারণ বিগত জীবন তার ছিলো পাপপূর্ণ। বর্তমান জীবন পূর্ব জন্মের দ্বারাই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। কাজেই কারো কিছু করার নেই। যে অন্যায়ভাবে সুখে আছে তার সুখকে বিপর্যন্ত করা অথবা যে দুঃখকষ্টে জর্জরিত তার দুঃখকে দূর করা এ দুইই অসম্ভব।

এই দার্শনিক তত্ত্বের প্রয়োগ বহুলবিস্তৃত। সর্বপ্রকার শোষণের ব্যাখ্যাই এর দ্বারা সম্ভব। একজন ক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি যদি দুর্বলকে প্রহার করে তাহলে প্রহৃত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বলের বলার কিছু নেই। কারণ তার এই দুর্দশা তার গতজন্মের কৃতকার্যের ফল। বিগত জন্মে সে অন্যায়ভাবে কাউকে প্রহার করেছিলো কাজেই এ জন্মে তার প্রায়শ্চিত্ত। কেউ যদি কাউকে বেগার খাটায়, কারো জমি অপহরণ করে তাহলেও সেই একই যুক্তি। বেগার দেওয়া ব্যক্তিটি নিশ্চয়ই গতজন্মে কাউকে বেগার খাটিয়েছে। তেমনি এ জন্মে একজনের জমি অপহৃত হওয়ার কারণ পূর্ব জন্মে অন্যের উপর তার অনুরূপ অত্যাচার। কাজেই যারা শোষিত অত্যাচারিত তাদের বলার অথবা করার কিছু নেই। তাদের অবস্থার জন্যে সত্যি অর্থে ইহজন্মের শোষক অত্যাচারীরা দায়ী নয়, দায়ী তার পূর্বজন্ম!

কিন্তু এই কৌশলের সব থেকে আশ্চর্য এবং উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই যে, অত্যাচারিত ও শোষিত শ্রেণী এই তত্ত্বকে আত্মস্থ করার ফলে শোষকদেরকে বিশেষ বেগ পেতে হতো না। প্রচারণা ও আশৈশব শিক্ষার ফলে এ বিশ্বাস ছিলো শোষিত মানুষের ধর্মবিশ্বাসেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শুধু তাই নয়। তাদের এই বিশ্বাসকে উচ্ছেদের সাধ্য এবং সাহস কারো ছিলো না। লেনিন এ কারণেই ধর্মকে তুলনা করেছিলেন অহিফেনের সাথে। অহিফেনের ঘোরে মানুষ যেমন নির্জীব হয়ে থাকে, তার কর্মশক্তি রহিত হয়, বুদ্ধি হয় বিভ্রান্ত, ঠিক তেমনি এ জাতীয় ধর্ম দার্শনিক প্রচারণাতে মানুষের মনুষ্যত্ব হয় বিধ্বস্ত, তার চিন্তা কর্মশক্তি হয় লুপ্তপ্রায়।

উপরে আলোচনা থেকে একথাই বোঝা যায় যে একটা বিশ্বাস সার্বজনীনভাবে মানুষের অন্তরে খুঁটি গেড়ে থাকলেই যে সেটি তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। উপরন্তু বলা যেতে পারে যে মানুষের এমন কতকগুলি সার্বজনীন বিশ্বাস আছে যেগুলির হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভই মানুষের সত্যিকার আত্মিক উন্নতির পক্ষে অপরিহার্য। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় যে মানুষের জীবনে বিশ্বাসের একটা সুফলপ্রসূ ভূমিকা থাকলেও সর্বপ্রকার বিশ্বাসই সে দাবীর অধিকারী নয়।

মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জীবন বিপন্ন হওয়ার ফলে পাকিস্তান আন্দোলনের জন্ম এবং মুসলমানদের সেই পৃথক সাংস্কৃতিক জীবনকে রূপদানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, এই বিশ্বাসের উদ্ভব আর্থিক ও রাজনৈতিক কারণে। স্বাধীনতা আন্দোলনকালে মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা শ্রেণী স্বার্থে এই তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন এবং সংখ্যাগুরু কৃষক শ্রমিকদেরকে নিজেদের শ্রেণীগত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে প্রচারণার মাধ্যমে এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করেন। এ বিশ্বাসের যে কোন দৃঢ় বাস্তব ভিত্তি ছিলো না সেটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী অধ্যায়ে প্রমাণিত হয়েছে। কৃষক শ্রমিক নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনে, সে জীবন সাংস্কৃতিকই হোক বা আর্থিক, পাকিস্তান কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতি আনেনি। সে উন্নতি এসেছে মধ্যবিত্তের জীবনে যে মধ্যবিত্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে নিজেদের স্বার্থকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে করে চলেছে ক্রমাগত সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত।

হিন্দুদের থেকে এখন তাদের আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারা আজ মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। এজন্যে এই নোতুন মধ্যবিত্তের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত প্রভাব ক্রমশঃ বিনষ্ট হচ্ছে। তারা সব কিছুকে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে বিচার করতে চেষ্টা করছে এবং স্বদেশের সাথে স্থাপন করতে চাইছে নিজেদের অন্তরের নিরবচ্ছিন্ন যোগ। কাজেই পাকিস্তান আন্দোলনের সময় যে মুসলমান মধ্যবিত্তের মানসিক গঠন ছিলো পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক তাদেরই আজ মোহমুক্তি ঘটেছে, তারাই আজ ধীরে ধীরে স্বাদেশিকতার আহ্বানে নেতৃত্ব দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে। এ কাজ তারা করেছে কারণ দেশের বর্তমান অবস্থার সাম্প্রদায়িকতা তার উন্নতির পথে অনেকাংশে বিঘ্নস্বরূপ। রাজনীতি ক্ষেত্রেও সেজন্যে মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং তার থেকে আওয়ামী লীগে উত্তরণ।

কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা বর্তমান মুসলিম বাঙালী মধ্যবিত্ত যদি উপকৃত না হয় তা হলে পাকিস্তানোত্তর সাম্প্রদায়িকতায় উপকৃত হচ্ছে কারা? এ প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং এর আলোচনা এদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনকে বিশ্লেষণ ও চালনার পক্ষে অপরিহার্য।

প্রথমেই অবশ্য একথা মনে রাখতে হবে যে সাম্প্রদয়িকতায় বিশ্বাসী বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ নিজেরাই সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ও প্রচারণার দ্বারা প্রতারিত। সাম্প্রদায়িকতায় এ জাতীয় লোকের কোন মুনাফা নেই এদের অবস্থা অনেকাংশ আফিংখোরের মতো। আফিংএর নেশায় মানুষের চিন্তাশক্তি থেকে শুরু করে সব শক্তিই যেমন স্তিমিত হয়ে আসে এবং বহুলাংশে তার স্থান কাল পাত্রের অনুপাতজ্ঞান বিলুপ্ত হয় ঠিক তেমনি এই সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা কুশিক্ষা ও অসৎ প্রচারণার বশবর্তী হওয়ার ফলে তাদের সত্যদর্শনের ক্ষমতা লুপ্ত হয় এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে অবাস্তব কতকগুলি ধারণা তাদের সমস্ত চিন্তাকে বিকৃত করে! এই বিকৃত চিন্তার ফলে তাদের লাভ না হলে পরিশেষে ক্ষতিই হয় কারণ অন্যেরা সেই চিন্তার সুযোগ নিয়ে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তাদেরকে ব্যবহার করে। কিন্তু এসব সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করার কোন ক্ষমতা তাদের নেই। সাম্প্রদায়িক অহিফেনের মহিমায় তাদের স্বাধীন চিন্তা, কল্পনা ও কর্তব্যবুদ্ধি রহিত প্রায়।

সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা যারা উপকৃত তাদেরকে মোটামুটি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা চলে। প্রথমটি হলো পাকিস্তানের বৃহৎ বুর্জোয়া এবং দ্বিতীয়টি তাদের দালালগোষ্ঠী, যাদেরকে বলা চলে বৃহৎ বুর্জোয়ার সাংস্কৃতিক মুৎসুদ্দী।

পাকিস্তানী বৃহৎ বুর্জোয়াদের স্বার্থ হলো সামন্তশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের সাথে, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে আঁতাত স্থাপন করে শুধু যে এদেশের কৃষক শ্রমিক নিম্নমধ্যবিত্তকে শোষণ করা তাই নয়, এর মাধ্যমে তারা এদেশীয় অর্থনৈতিক অবস্থায় অপেক্ষাকৃত অল্প সামর্থ্যসম্পন্ন বুর্জোয়াদের বিকাশকেও বাধা দান করতে বদ্ধপরিকর। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বৃহৎ বুর্জোয়ার ভূমিকা স্পষ্টতর হবে।

পাকিস্তানের শিল্প বিকাশের প্রতি লক্ষ্যপাত করলে সহজেই দেখা যাবে যে বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রায় সব অংশটুকুই পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। এই অবস্থার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ দায়ী নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে দুই অংশে আর্থিক, সামরিক এবং চাকরি ও রাজনীতিগত ভারসাম্যের অভাব থেকেই এই পরিস্থিতির উদ্ভব। কিন্তু কারণ যাই হোক বর্তমানে এই বৃহৎ বুর্জোয়ারা পূর্ব পাকিস্তানে কিছু কিছু ব্যবসাবাণিজ্য করলেও তাদের প্রধান কর্মক্ষেত্র দেশের এই অংশে নয়। পণ্যশিল্প, বীমা, ব্যাংক ইত্যাদি সবকিছুর ক্ষেত্রেই একথা খাটে। যে গুটিকতক সংস্থা আজ পাকিস্তানের অর্থনীতিতে প্রায় একচেটিয়া প্রভাব ও প্রাধান্য বিস্তার করেছে তাদের সকলেরই প্রধান দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে।

এই বৃহৎ বুর্জোয়ারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে সমানে শোষণ করে চলেছে, এবং অধিকতর শোষণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু দুই অংশের এই শোষণ সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে এক বিশেষ অবস্থার উদ্ভব হয়েছে। এই অবস্থাকে এক কথায় বর্ণনা করতে গেলে বলা চলে যে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত বৃহৎ বুর্জোয়াদের ধনতান্ত্রিক আধিপত্যের ফলে পাকিস্তানের নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের একটা আধা- ঔপনিবেশিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।

ঔপনিবেশিক রাজত্বের ‘গৌরবময়’ অধ্যায়ে উপনিবেশগুলিকে শোষণ করার সাথে ‘পিতৃ ভূমি’তে ধনতন্ত্রের ক্রমাগত সমৃদ্ধি ও প্রসার হতো এবং উপনিবেশগুলির ধনতান্ত্রিক বিকাশ একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে হতো বাধাপ্রাপ্ত। ঔপনিবেশিক বাজারকে নিজেদের আয়ত্তগত রাখার প্রচেষ্টার ফলেই এটা ঘটতো! বাঙলাদেশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এই উদ্দেশ্যই সাধন করে।

সমগ্র পাকিস্তানের আর্থিক জীবন এবং এদেশে ধনতন্ত্রের বিকাশের প্রতি লক্ষ্য রাখলে দেখা যাবে যে পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমানে স্বাধীনতাপূর্ব ঔপনিবেশিক অবস্থাই বহুলাংশে বিরাজ করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে ধনতন্ত্রের বিকাশ এত শ্লথগতি কেন এর কারণ সন্ধান করলেই এই অবস্থার সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে।

বৃহৎ বুর্জোয়ারা শুধু যে কৃষক শ্রমিক নিম্নমধ্যবিত্তকেই শোষণ করেছে তাই নয়। তারা অপেক্ষাকৃত স্বল্পোন্নত বুর্জোয়াদের বিকাশকেও বাধাদান করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে যেহেতু বৃহৎ বুর্জোয়া বলতে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই সেজন্য পাকিস্তানী অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত (এদের অনেকেই ভারতের বোম্বাই, আহমোদাবাদ, গুজরাট প্রভৃতি এলাকা থেকে আগত) বৃহৎ বুর্জোয়ারা দেশের এই অংশে ধনতন্ত্রের উপযুক্ত বিকাশ এবং এদেশীয় বুর্জোয়াদের উন্নতিতে বাধা দান করতে বদ্ধপরিকর। তা ছাড়া তারা যে এদেশের আর্থিক জীবনকে বহুলভাবে নিয়ন্ত্রণের দ্বারা জনসাধারণকে অন্যান্য দেশীয় বৃহৎ বুর্জোয়াদের মতই শোষণ করছে এ কথাও তারা চাপা দিতে ব্যস্ত, এ ব্যাপারে তাদের যে কোন সমালোচনারই কণ্ঠরোধ করতে সচেষ্ট।

এইসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে কোন সাক্ষাৎ যোগাযোগ না থাকলেও তারা সাংস্কৃতিক প্রশ্ন সম্পর্কে উদাসীন তো থাকেই না উপরন্তু সাংস্কৃতিক জীবনকেও নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ ও বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

সাংস্কৃতিক জীবনকে বিভ্রান্ত করে সুস্থ চিন্তা বিতাড়নের জন্যে প্রয়োজন আফিং-গাজা- চরস- সিদ্ধি। এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক জীবনে আজ তারই বিপুল সংগঠিত আয়োজন সহজেই চোখে পড়ে। শোষক শ্রেণীর চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী ধর্মকে ক্ষুদ্র স্বার্থের কাজে ব্যবহারের উদ্যোগ তো অব্যাহত আছে উপরন্তু তারই উপর ভিত্তি করে অন্যান্য উপায়ও একের পর এক হচ্ছে উদ্ভূত ও ব্যবহৃত।

এগুলির মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনের চরিত্র সম্পর্কে প্রচারণাই হলো সর্বপ্রধান। একথা যাদের চোখ, কান ও চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা আছে তাদের কারো অবিদিত নেই যে ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এদেশে নানাভাবে যারা উপকৃত হয়েছে তারা মধ্যবিত্তের বিভিন্ন অংশ। শুধু এখানেই শেষ নয়। এই সময়ের মধ্যে মধ্যবিত্তের আয়তন অনেক সম্প্রসারিত এবং অন্যান্য নিম্নশ্রেণীর লোকদের জীবন আর্থিক ও অন্যান্য দুর্যোগে পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশী বিধ্বস্ত হয়েছে। তাছাড়া যে ইসলামী তমদ্দুনের প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধির জন্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বলে দাবী করা হচ্ছে তার কোন বিকাশই এই একুশ বছরে এদেশে আর সম্ভব হয়নি।

দেশের এই বর্তমান অবস্থাই পাকিস্তান আন্দোলনের যথার্থ চরিত্র ব্যাখ্যার পক্ষে সর্বাপেক্ষা সহায়ক। ফরাসী বিপ্লব বুর্জোয়া আন্দোলনের ফল, সেজন্যে তার মাধ্যমে ফরাসী দেশে বুর্জোয়া রাজত্ব কায়েম হয়েছিলো। রাশিয়া ও চীনের বিপ্লব আন্দোলন মার্কসবাদীদের নেতৃ ত্বে সংঘটিত হয়েছিলো, সেজন্যে বিপ্লবোত্তর রাশিয়া ও চীনে স্থাপিত হয়েছে সমাজতন্ত্র। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোরন মূলতঃ ছিলো বুর্জোয়া আন্দোলন, কাজেই ভারতে আজ বুর্জোয়া রাজের প্রতিষ্ঠা। পাকিস্তানে যদি সত্য অর্থে ধর্মীয় আন্দোলন হতো, তার সত্যিকার প্রাণশক্তি যদি ইসলামী সংস্কৃতির থেকে উদ্ভূত হতো তাহলে স্বাধীনতার পর এদেশেও ইসলামী সংস্কৃতি সামগ্রিকভাবে আর্থিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য এলাকাতেও প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করতো। কিন্তু বস্তুতঃ তা হয়নি। কারণ বাহ্য প্রভেদ সত্ত্বেও কংগ্রেসের স্বরাজ আন্দোলনের মতো মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনও মূলতঃ ছিলো বুর্জোয়া শ্রেণীর আন্দোলন। এ জন্যে স্বাধীনতার পর এদেশের ইসলামের রাজত্ব কায়েম না হয়ে স্থাপিত হয়েছে বুর্জোয়ার রাজত্ব। পাকিস্তান আন্দোলনের এই হলো সহজ পরিচয় ও পরিণতি। এ পরিচয়কে আজ অস্বীকার করবে কে?

কিন্তু যতো অসম্ভবই হোক না কেন একে অস্বীকার করার লোক আছে এবং তারাই শ্রেণীগতভাবে হলো পূর্ব পাকিস্তানের বৃহৎ বুর্জোয়ার সাংস্কৃতিক মুৎসুদ্দী। তাদের মতে সমগ্র পাকিস্তান আন্দোলন হলো হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুসলিম সংস্কৃতির জেহাদ এবং এই উদ্ভট মতবাদকে জবরদস্তিমূলকভাবে ঢোল পিটিয়ে তারা প্রচার করতে ব্যস্ত। এই মুৎসুদ্দীরাই হলো এদেশে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা ভোগী। বৃহৎ বুর্জোয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ উদ্ধারের কাজে পূর্ব পাকিস্তানে যারা ব্যাপৃত সংস্কৃতিক্ষেত্রে এরা তাদেরই সহযাত্রী।

মুৎসুদ্দীদের দ্বিতীয় প্রধান বক্তব্য হলো এদেশের সংস্কৃতি হয় হিন্দু নতুবা মুসলমান। অর্থাৎ সংস্কৃতি ধর্মের একটি অঙ্গ মাত্র। কাজেই এদেশের লোকেরা যখন ধর্মগতবাবে হিন্দু অথবা মুসলমান তখন তাদের সংস্কৃতিও সেই অনুসারে গঠিত। ধর্মের সাথে সংস্কৃতির এই সম্পর্ক স্থাপন যে কতখানি বিভ্রান্তিকর একথা সমাজ বিজ্ঞানে যার সামান্য জ্ঞানও আছে এবং যে নিজের বিদ্যাবুদ্ধিকে নির্লজ্জভাবে বিক্রি করতে প্রস্তুত নয় তার কাছেই ধরা পড়বে। কিন্তু তবু সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা সংস্কৃতির এই ব্যাখ্যাই দিয়ে থাকেন। এবং একাজ করতে গিয়ে তাঁরা বাঙালী সংস্কৃতি এলাকা থেকে হিন্দু শিল্পী সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদেরকে বিতাড়িত করতে ব্যস্ত। তাঁদের এ প্রচেষ্টার অন্যতম উদাহরণ আমরা তাঁদের রবীন্দ্রবিরোধিতার মধ্যে দেখেছি। সেক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে সরকার পক্ষ থেকে যখন বলা হলো যে, রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধের প্রস্তাব তাঁরা করেন নি এবং তাঁরা রেডিও টেলিভিশনে কিছু কিছু তা পরিবেশন করার পক্ষপাতী তখনও মুৎসুদ্দীর দল রবীন্দ্রবিরোধিতায় বিভোর ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ!

১০

সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা হলো বিশিষ্ট মুসলমান কবি সাহিত্যিকদেরকে তৌহিদবাদ এবং ইসলামী তমদ্দুনের ধারক ও বাহক বলে প্রচার করা। মাইকেল রবীন্দ্রনাথকে একদিকে যেমন তাঁরা ‘হিন্দু’ শিল্পী সাহিত্যিক আখ্যা দিয়ে বাঙলা সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করছেন অন্যদিকে তেমনি নজরুল ইসলামকে মুসলমানী পোশাক পরিয়ে তাঁর সাহিত্যকে বিকৃতভাবে উপস্থিত করতেও তাদের লজ্জা শরম নেই। নজরুল ইসলামকে যে কোন মতেই এই পোশাকে ভূষিত করা চলে না একথা আজ যাঁরা নজরুল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ তাঁরাও বিলক্ষণ জানেন। নজরুল যদি তাই হতেন তাহলে সাময়িক ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদী’ সমাজে তিনি অপাঙ্ক্তেয় থাকতেন না এবং হিন্দু সমাজে তার এত সমাদরও সম্ভব হতো না! নজরুল জীবনের ঘটনাবলীর সাথে যার কিছুমাত্র পরিচয় আছে তিনিই একথা স্বীকার করবেন। কিন্তু শুধু নজরুল ইসলামই নয়। যে কোন মুসলমান শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিককেই আজ তারা সাম্প্রদায়িক পোশাক পরাতে উদ্যত। তাদের এই উদ্যোগ থেকে মনে হয় হয়তো কিছুদিন পর সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা স্বয়ং কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আজাদকে নোতুন জন্মদানের জন্যে নিজেদের গর্ভে ধারণ করবেন!

১১

ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত মুসলমানরা একটি পৃথক আবাসভূমির দাবী করলেও সে দাবী সত্য অর্থে জাতীয়তার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো না। পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে ইংরেজ অধিকৃত ভারতে বুর্জোয়া শ্রেণীর অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যেই তার জন্ম। সাম্প্রদায়িক ভাগ বাটোয়ারার ক্ষেত্রে দরকষাকষি এবং মনকষাকষির থেকেই হিন্দু-মুসলমানের এক সাথে ঘর না করার সিদ্ধান্ত। পাকিস্তান আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা এই আর্থিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেরই সহচর। এছাড়া তার কোন নিজস্ব তাত্ত্বিক পরিচয় নেই। যে কোন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই একথা সত্য। কারণ নির্দিষ্ট আর্থিক ও সামাজিক ভিত্তি ব্যতীত কোন সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্ভব হয় না। এজন্যেই ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে নানা আন্দোলন যেভাবে গঠিত হয়েছে ঠিক সেইভাবে তাদের সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনও হয়েছে নিয়ন্ত্রিত।

সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা কিন্তু দাবী করেন যে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক গরমিল এবং বৈসাদৃশ্যের থেকেই মূলতঃ পাকিস্তান আন্দোলনের সূত্রপাত। সমাজতন্ত্রের যে কোন যোগ্য ছাত্রই এ দাবীকে গাঁজাখোরী বলে প্রতিপন্ন করবেন। কিন্তু এই গল্প গাঁজাখোরী হলেও আমাদের দেশের চিন্তায় তা এতো প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হলো কেমন করে? প্রশ্নটিকে উপেক্ষা না করে তার যথাযোগ্য বিচার প্রয়োজন।

১২

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আধুনিক ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমাদের বর্তমান অবস্থার আলোচনা অনেকখানি সহজ এবং অর্থপূর্ণ হবে। ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, স্প্যানিশ, রাশান, ইটালিয়ান ইত্যাদি আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাগুলির উত্থান সেখানে ধনতন্ত্রের উন্মেষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রেনেসাঁ, রিফরমেশন, শিল্পবিপ্লব অতিক্রম করে ইউরোপীয় জীবনে যে নোতুন জাগরণের সূত্রপাত হলো জাতীয়তাবোধ ছিলো তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। জাতীয় জাগরণ এবং ধনতন্ত্রের প্রয়োজনে নোতুন চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করার জন্যে ল্যাটিন কোনক্রমেই আর উপযুক্ত বিবেচিত হলো না। রোমক সাম্রাজ্যের প্রতাপের যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের উত্থান পর্যন্ত ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ল্যাটিনই ছিলো প্রচলিত।

সে সময় বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশগুলির কথ্য ভাষা ভিন্ন ভিন্ন হলেও উচ্চশ্রেণীর লোকেরা সে ভাষাগুলিতে কথা বলতেন না। লেখালেখির ক্ষেত্রে তাদের ব্যবহার তো ছিলো একেবারেই কল্পনাতীত। ইংরেজী ভাষার ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ফ্রান্সিস বেকনের পূর্বে কোন সম্ভ্রান্ত ইংরেজ লেখকই গদ্যরীতিতে মাতৃভাষায় বিশেষ কিছুই লেখেননি। বেকন নিজেও তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ল্যাটিনে। সে পর্যন্ত ইউরোপের অপরাপর দেশগুলির মতো ইংলন্ডেও ল্যাটিনের দোর্দণ্ড প্রতাপ অব্যাহত ছিলো।

ল্যাটিনের এই মর্যাদা ও প্রভাবের সব থেকে বড়ো কারণ ছিলো রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব ইউরোপে খ্রিষ্টান চার্চ বিভক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রোমের নেতৃত্বে রোমান ক্যাথলিক চার্চই ইউরোপের সর্বত্র রাজত্ব করতো। লুথারের সংস্কার আন্দোলন এবং পাল্টা চার্চ প্রতিষ্ঠার পর রোমানচার্চের আধিপত্য জার্মানী, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে অনেক কমে আসে। এই প্রভাবহানির ফলে ল্যাটিন ভাষার মর্যাদাও সেই সব দেশগুলিতে বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু শুধু ইংল্যান্ড জার্মানীতেই নয়। ফ্রান্স স্পেন প্রভৃতি দেশ যেখানে ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব তেমন বিনষ্ট হয়নি সেখানেও দেশীয় ভাষাসমূহের উত্থান ঘটলো। তার কারণ ল্যাটিন ছিলো অত্যন্ত প্রাচীন কালের ভাষা। তার কাঠামো যে সমাজের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিলো আধুনিক ইউরোপীয়েরা তার থেকে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে এ সময় পত্তন করেছিলো এক নোতুন সমাজের। কাজেই ক্যাথলিক ধর্মে এবং সামন্ত ব্যবস্থায় ল্যাটিনের কার্যকারিতা যাই থাক নোতুন অবস্থায় ইউরোপীয় দেশগুলির নোতুন প্রয়োজন মেটাতে তা অক্ষম হলো।

তা ছাড়া আরও একটি কারণ ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ল্যাটিন ছিলো ইউরোপীয় সমাজের উপরতলার ভাষা। সামন্ত যুগে ধর্মীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে রাজকীয় কার্যনির্বাহ পর্যন্ত সব কিছু করতো উপরতলার লোকে। ল্যাটিন চর্চা তাদের মধ্যেই ছিলো সীমাবদ্ধ। শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপে যে নোতুন জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর উৎপত্তি ও বিকাশ হলো তাদের সাথে সেই প্রাচীন ভাষার কোন সম্পর্কই ছিলো না। কাজেই সমাজে যেমনভাবে এই নোতুন শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলো তেমনিভাবে ক্রমশঃ তাদের ভাষাসমূহেরও উত্থান ঘটলো। এইভাবে ধীরে ধীরে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী প্রভৃতি দেশে ল্যাটিনের পরিবর্তে প্রবর্তিত হলো ইংরেজী ফরাসী এবং জার্মানের ব্যবহার।

জাতীয় ভাষার উত্থান ইউরোপীয় সমাজের মধ্যে কতকগুলি মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এলো যার মধ্যে সর্ব প্রধান হলো বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ। ল্যাটিন ভাষার বন্ধনে মানুষের চিন্তা ছিলো ধর্মের গণ্ডীতে আবদ্ধ। আধুনিক ভাষাসমূহকে অবলম্বন করে ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তার ঘটলো ধর্মমুক্তি। এই ভাষাগুলিতে যে ধর্মচর্চা হলো না তা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এগুলি নতুন প্রয়োজনের তাগিদে হলো নোতুন চিন্তার বাহন। এই নোতুন চিন্তাই ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলো আধুনিক ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় সংস্কৃতির।

কিন্তু ইউরোপের এই নোতুন চিন্তা এবং সংস্কৃতি আকাশ থেকে খসে পড়লো না। দেশের মাটিতে নোতুন আর্থিক ও সামাজিক জীবনের থেকেই সর্বাংশে তার উদ্ভব। ইউরোপে ধনতন্ত্রের বিকাশের সাথে এই সংস্কৃতির তাই মূলগত সম্পর্ক।

১৩

ধনতন্ত্রের সূত্রপাত ও বিকাশের মধ্যে দিয়ে ইউরোপ যেভাবে ধর্ম-সংস্কৃতির পর্যায় অতিক্রম করে সৃষ্টি করেছে এক ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক সংস্কৃতি, ঠিক তেমনিভাবে বর্তমানে ধনতন্ত্রের পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে এবং পৃথিবীর অন্যান্য বহু অনুন্নত দেশেও শুরু হয়েছে এক নোতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এ আন্দোলনও আকাশ থেকে খসে পড়েনি। এর মূলও বর্তমানের আর্থিক ও সামাজিক জীবনের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত।

বৃটিশ রাজত্বকালে ধনতন্ত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং এদেশে তার ক্রমশঃ বিকাশের ফলে ভারতবর্ষেও বিভিন্ন জাতীয় ভাষার উদ্ভব ঘটে। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সমস্ত ভাষা কথ্য ভাষার পর্যায়ে ছিলো অথবা যাদের লিখিত ব্যবহার থাকলেও সম্ভ্রান্ত লেখকেরা তাকে পরিহার করে চলতেন সেগুলির চর্চা ও উন্নতি শুরু হলো। এভাবেই ভারতবর্ষে ফারসী সংস্কৃতির পরিবর্তে আরম্ভ হলো বাঙলা, উর্দু, তেলেণ্ড, মলয়ালম, তামিল, গুজরাটি প্রভৃটির বিকাশ ও উৎকর্ষসাধন। এই ভাষাগুলিকে অবলম্বন করেই গঠিত হলো বিভিন্ন প্রদেশের বিশিষ্ট আধুনিক সংস্কৃতি।

ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক জটিলতার জন্যে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশকে অনেকখানি ব্যাহত করে। এই সময় সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে পরিণত হয় আর্থিক ও রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার শক্তিশালী হাতিয়ারে। এজন্যে সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা এক দিকে যেমন জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ব্যাহত হয় অন্যদিকে তার ধর্মমুক্তিও হয় বিলম্বিত। সাম্প্রদায়িকতার অবর্তমানে ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলন ইউরোপীয় জাতীয় আন্দোলনের মতো গঠিত হতে পারতো। সেক্ষেত্রে অখণ্ড ভারত অথবা পাকিস্তানের দাবীও হতো নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সে পথে না গিয়ে অন্য পথ নিলো এবং তার ফলে ভারতবর্ষে সত্যিকার জাতীয় আন্দোলনও স্থগিত থাকলো।

১৪

জাতীয়তার প্রশ্নকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকালে কংগ্রেস লীগ কোন দলই যথাযথভাবে বিচার করতে পারে নি। তার ফলে কংগ্রেস আওয়াজ তুললো অখণ্ড ভারতের এবং মুসলিম লীগ খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে প্রচার করলো দ্বিজাতি তত্ত্ব। এর ফলে স্বাধীনতা উত্তর ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয়তার প্রশ্ন শুধু জীবন্ত রইলো তাই নয়, নোতুন শক্তি সঞ্চয় করে তা হলো প্রতাপশালী। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সাংস্কৃতিক অধিকার ইত্যাদির দাবী আসলে তাই উত্থানমুখী জাতীয়তার দাবী। এ দাবী পাকিস্তানে শুধু বাঙালীদের নয় পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পাঠান, বেলুচ, সকল জাতিরই। কিন্তু বৃহৎ বুর্জোয়ারা নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থে আজ এ জাতীয়তার প্রবল বিরোধী।

১৫

পাকিস্তান আন্দোলনকালে বাঙালী কৃষকরা হিন্দু মহাজন জমিদারদের দ্বারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে শোষিত হতো। কিন্তু সাম্প্রদায়িক প্রচারণার প্রভাবে তারা তাদের শোষককে জমিদার মহাজন হিসাবে না দেখে হিন্দু হিসাবে দেখেছিলো। তাদেরকে বোঝানো হয়েছিলো যে হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা পেলে শোষণ বন্ধ হবে, কাজেই পাকিস্তানই তাদের একমাত্র পথ। পাকিস্তানের পর দেখা গেলো অত্যাচারীর শাসন-শোষণ বন্ধ নেই, উপরন্তু নোতুন উদ্যমে তার আধিপত্য। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের গণতান্ত্রিক ও সুস্থ চেতনাকে কীভাবে বিভ্রান্ত ও খর্ব করে এটাই হলো তার প্রামাণ্য উদাহরণ।

পাকিস্তানের বৃহৎ বুর্জোয়ারা এ উদাহরণ বিস্মৃত হয়নি। তাদের শোষণ কার্যকালে এখানে তারা ঐ একইভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগাতে চায়। পাকিস্তানপূর্ব অবস্থার সাথে পাকিস্তানোত্তর অবস্থার অবশ্য একটা গভীর প্রভেদ আছে। পূর্বে পাকিস্তান আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক চরিত্র সত্ত্বেও কংগ্রেসের স্বরাজ আন্দোলনের মতো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন হিসাবে তারও কিছুটা গণতান্ত্রিক চরিত্র ছিলো। কিন্তু বর্তমানের সাম্প্রদায়িক প্রচেষ্টা জাতীয়তা ও গণতন্ত্রের সহায়কও নয়, তার পরাক্রান্ত শত্ৰু।

জাতীয়তা ভারত ও পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় সংহতি ও নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক না হলেও বৃহৎ বুর্জোয়া এবং মুৎসুদ্দীরা ঠিক সেই কথাটিই বলতে চান। তাঁদের মতে একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যা কিছু বৈশিষ্ট্য তাকে সম্পূর্ণভাবে ধূলিসাৎ না করলে রাষ্ট্রে নিরাপত্তা নেই। একথা যে কত মিথ্যা তা যে কোন সৎ ব্যক্তিই অন্যান্য অনেক দেশের, বিশেষতঃ বিপ্লবোত্তর রাশিয়া ও চীনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে উপলব্ধি করবেন। এ সব রাষ্ট্রে জাতীয়তার কণ্ঠরোধ না করে বিভিন্ন জাতির যথাযথ বিকাশের উপরই স্থাপিত হয়েছে তাদের রাষ্ট্রীয় সংহতি ও নিরাপত্তার ভিত্তি।

কিন্তু বৃহৎ বুর্জোয়াদের দ্বারা এ ধরনের রাষ্ট্রীয় সংহতি স্থাপনের কোন সম্ভাবনা নেই। তার কারণ, এ কাজ করতে তাহলে শোষণ বন্ধ করতে হবে এবং তাতে তারা নিতান্তই নারাজ। আঞ্চলিক শোষণ বৃহৎ বুর্জোয়া স্বার্থের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এবং সে লক্ষ্যচ্যুতি তাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। এর ফলে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় সংহতি বিপন্ন করছে তারা এবং তাদের মুৎসুদ্দীর দল, অন্য পক্ষ নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *