নজরুল ইসলাম অহিফেন

নজরুল ইসলাম অহিফেন

নজরুল ইসলাম সাহিত্যিক হিসাবে প্রগতিশীল হলেও কোন নির্দিষ্ট জীবনদর্শনের গণ্ডীর মধ্যে তিনি ধরা দেন নি। অর্থাৎ তিনি তাঁর চিন্তার মধ্যে তেমন কোন শৃঙ্খলা কোনদিন আনতে পারেন নি অথবা তার চেষ্টাও করেন নি। কাজেই তাঁর সাহিত্যের একটা প্রগতিশীল ভূমিকা থাকলেও একথা বলা চলে না যে তিনি নির্ভেজাল সাম্যবাদের কবি অথবা বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদে বিশ্বাসী। কেউ সে কথা বললে সত্যের অপলাপই হবে। তিনি সাম্যবাদের উপর লিখেছেন, নিজে সাংবাদিকতার মাধ্যমে কৃষক মজুর মধ্যবিত্তের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন, মুজফফর আহমদ প্রমুখ সাম্যবাদীদের সহকর্মী হিসাবে অনেক সময় কাজ করেছেন কিন্তু তবু তাঁদের সকলের সাথে নজরুলের একটা সুনির্দিষ্ট ব্যবধান বজায় থেকেছে। তাঁরা কোন দিনই তাঁকে ষোলআনা পেতে পারেন নি। নজরুলের ব্যক্তিগত চারিত্রিক দুর্বলতা এবং বৈশিষ্ট্য সেজন্যে অনেকখানি দায়ী। শুধু মুজফফর আহমদের মতো সাম্যবাদীরা কেন নজরুল চরিত্রের অনেক দুর্বলতা লক্ষ্য করে মোহিতলাল পর্যন্ত তাঁর অভ্যাস সংশোধনের চেষ্টা করেছিলেন, যদিও সে প্রচেষ্টা ছিল ভ্রান্তিপূর্ণ ও বিবেচনাহীন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বলা চলে যে স্বভাবগতভাবে নজরুল ইসলাম একজন কবি এবং সেই হিসাবে দেশের মানুষের সাথে তিনি বোধ করতেন গভীর একাত্মতা। এই একাত্মতাবোধ থেকেই তাঁর স্বদেশপ্রেম ও প্রগতিশীলতার উৎপত্তি।

শুধু তাঁর স্বাদেশিকতা ও প্রগতিশীলতাই নয় তাঁর সমগ্র সাহিত্য ও কর্মজীবনই এই বোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এরই তাড়নায় তিনি যেমন অত্যাচার শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে লেখনি ধারণ করেছেন অন্যদিকে তেমনি তাঁর লেখনি সৃষ্টি করেছে এক ধর্ম সাহিত্য – যে সাহিত্যের হিন্দু-মুসলমান নেই, যা হিন্দুর যতখানি মুসলমানেও ঠিক ততখানি। এদিক থেকে বিচার করলে বলা চলে যে নজরুল ইসলামই একমাত্র সাহিত্যিক যিনি বাঙালী সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করেছিলেন সম্পূর্ণভাবে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সাথে তাঁর প্রতিভার তারতম্য থাকলেও এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম অতুলনীয়, অন্যন্যসাধারণ। বাঙালী হিসাবে তাই তাঁর ধর্ম ছিল না, থাকলে ততখানি পুরোপুরিভাবে বাঙালী হতে সক্ষম হতেন না। তবু কেউ যদি জোর করে কোন ধর্ম তাঁর ঘাড়ে চাপাতে চায়, তাহলে বলতে হবে যে আসলে তিনি দ্বিধর্মী – তিনি হিন্দু-মুসলমান। অর্থাৎ তিনি শুধু হিন্দু অথবা শুধু মুসলমান নন – তাঁর মধ্যে এ দুইয়ের অবাধ সমন্বয়। এই সমন্বয়ের মধ্যেই নজরুলের বৈশিষ্ট্য, এর মধ্যেই তাঁর বাঙালীত্বের সম্পূর্ণতা। এজন্যেই তিনি অবিভাজ্য।

নজরুল ইসলামের সাহিত্যকীর্তির সাথে যাঁরা পরিচিত তাঁদের অজানা নেই যে তিনি একদিকে যেমন হিন্দু ধর্মীয় সাহিত্যের প্রতিনিধি অন্যদিকে তেমনি ইসলামী সাহিত্যেরও প্রতিনিধি অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় সাহিত্যের যৌথ ধারা তাঁর মধ্যে প্রবাহিত। এ ধারার কোন একটি থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা নজরুল ইসলামকে, তাঁর স্বকীয়তাকে অস্বীকার করারই প্রচেষ্টা। তাঁর শ্যামা সঙ্গীতের কথা স্মরণ করে কেউ তাঁকে হিন্দু আখ্যা দিলে তিনি যেমন ভুল করবেন তেমনি তাঁর নাত্ ও হাম্দের স্মরণ করে কেউ তাঁকে মুসলমান আখ্যা দিলেও সেই একই ভুল করা হবে।

নজরুল ইসলামের এই দ্বিধর্মিতার যথার্থ চরিত্র উপলব্ধি করতে হলে ধর্মপ্রেরণার মধ্যে তার সন্ধান করলে চলবে না। তার সন্ধান করতে হবে জনসাধারণের সাথে তাঁর একাত্মতা এবং যোগ সাধনার মধ্যে। তাঁর জীবনী এবং রচনাসমূহের সতর্ক পর্যালোচনা করলে তাই দেখা যাবে যে ধার্মিকতা বলতে চলতি অর্থে যা বোঝায় তার সাথে তাঁর কোন সম্পর্কই কখনো থাকেনি। হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের বিভিন্ন দিক ও বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, কারণ এই ধর্মসাহিত্যের মাধ্যমেই তিনি যোগ স্থাপন করতে চেয়েছিরেন জনগণের সাথে, এর মাধ্যমেই তিনি অনেক সময় তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন অত্যাচারী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। তাঁর সমস্ত ধর্মবিষয়ক লেখা সম্পর্কে একথা প্রযোজ্য না হলেও মোটামুটিভাবে তা সত্য। তার কারণ ধর্মবিষয়ে তিনি যতই লিখুন তাঁর প্রতিভার প্রধান প্রবণতা ছিলো গণসাহিত্যের দিকে।

নজরুল ইসলামের সঙ্গীত সাধনার মধ্যে তাঁর প্রতিভা লাভ করেছিলো বিশাল বৈচিত্র্য। এখানেও তিনি একদিকে যেমন খড়গ ধারণ করেছেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে অন্যদিকে তেমনি রচনা করেছেন ধর্ম এবং প্রকৃতিবিষয়ক সঙ্গীত। কাজেই কবি হিসাবে তাঁর মুখ্য অথবা গৌণ প্রবণতা যেদিকেই থাক তিনি একাধারে গণসাহিত্য এবং ধর্মীয় ও প্রকৃতিবিষয়ক কবিতার স্রষ্টা।

অবশ্য একথাও সত্য যে তিনি যে সমস্ত গান ও কবিতা লিখেছেন তার মধ্যে অসংখ্য হলো ফরমায়েসী। এর অধিকাংশই আবার রেকর্ড কোম্পানী হিজ মাষ্টারস্ ভয়েসের ফরমাস অনুযায়ী লেখা। অনেক সময় দেখা গেছে যে তাদের ষ্টুডিওতে বসেই তিনি একের পর এক বহু গান লিখে সঙ্গে সঙ্গে সুর যোজনা করে রেকর্ড করে চলেছেন। এদের মধ্যে ধর্মীয় সঙ্গীতের সংখ্যা নগণ্য নয়। এবং সেগুলি নজরুলকে লিখতে হয়েছিলো ব্যবসাদারের তাগিদে, অর্থ উপার্জনের তাড়নায়।

নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চার তেমন কোন স্থান ছিলো না। ধর্মবিষয়ক সাহিত্য সৃষ্টি সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য। সেদিক থেকে বলা চলে যে গণসাহিত্য সৃষ্টির সাথে সাথে জনসাধারণকে রাজনীতিগতভাবে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনেকখানি সক্রিয়। অন্য সবকিছু বাদ দিলেও তাঁর সাংবাদিক জীবনই এর সব থেকে বড় উদাহরণ।

নজরুল ইসলাম ধর্মীয় সাহিত্য সৃষ্টি করলেও বাঙলাদেশের মুসলমানরা কোন দিনই তাঁকে ইসলামের খাদেম অথবা মুসলিম সাংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসাবে স্বীকার করেন নি। এ জন্যে কর্মজীবনে তিনি কোন দিনই বাঙলাদেশের মুসলমান সমাজে তেমন ভালভাবে ঠাঁই পান নি। বরং বিপুল অধিকাংশ স্বধর্মীদের দ্বারা তিনি বরাবর ধিকৃতই হয়েছিলেন তাঁর স্বাদেশিকতা, প্রগতিশীলতা এবং ‘হিন্দুপ্রীতির’ জন্যে। এ ঘটনা কারো অবিদিত নয় এবং এর তাৎপর্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

শ্যামাসঙ্গীত তিনি রচনা করেছিলেন সত্য কিন্তু সে কারণে তাঁকে কালীভক্ত হিন্দুসাধক মনে করার কোন কারণ থাকেনি এবং হিন্দুরা কোনদিন নজরুল চরিত্রের সে ব্যাখ্যাও দিতে চেষ্টা করেননি। কাজেই নজরুল ইসলামের সমগ্র সাহিত্য ও কর্মজীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে স্বাধীনতাপূর্ব বাঙলাদেশে তাঁকে এদেশের গণসাহিত্যের একজন প্রধান দিকপাল হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছিলো। সেই হিসাবে তিনি ছিলেন সহিত্য ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক জাতীয়তাবাদী যোদ্ধা। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অর্থও তাই তাঁর কাছে ছিলো এদেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন। তাঁর এই জাতীয়তাবাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা অথবা ধর্মীয় গোঁড়ামীর কোন স্থান ছিলো না। মুসলিম লীগ এবং তার আদর্শ থেকে তিনি নিজেকে তাই তফাৎ রেখেছিলেন সতর্কভাবে। নজরুল সাহিত্যের অন্যান্য অনেক গৌণ পরিচয় থাকলেও এই ছিলো তাঁর আদর্শিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর মুখ্য পরিচয়। এবং এ পরিচয়কে বাতিল করার মত কোন নোতুন তথ্য প্রমাণ আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি।

নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার উদ্দেশ্য আমাদের বর্তমান সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি জনসাধারণ এবং সংস্কৃতিকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। পূর্ব পাকিস্তানে আজ নজরুল সাহিত্য চর্চার হিড়িক পড়েছে। এতে সকলেরই উৎসাহ বোধ করার কথা। কিন্তু নজরুল সাহিত্য চর্চার নামে যে কীর্তিকলাপ এখন শুরু হয়েছে তাতে উৎসাহের থেকে আশঙ্কাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ এই সাহিত্য চর্চার নামে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণসাহিত্যের প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম আজ পরিণত হতে চলেছেন সাম্প্রদায়িক সাহিত্য এবং রাজনীতির হাতিয়ারে। সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের হাতে পড়ে নজরুল আজ ইসলাম ধর্মের সাধক, মুসলিম সংস্কৃতির বাহক এবং সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের অন্যতম প্রতিনিধি!

তথাকথিত নজরুল ভক্তদের নজরুল প্রীতি এবং নজরুল সাহিত্য চর্চার এই দিকটির প্রতি লক্ষ্য রাখলেই দেখা যাবে যে তাদের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বিরোধী আন্দোলন আজ নজরুলকেও গ্রাস করতে উদ্যত। বাঙলার বিরুদ্ধে তাদের উদ্যম যতই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ততই তার গতি হচ্ছে বিচিত্রমুখী। পূর্বে তাদের চেষ্টা ছিলো বাঙলা সাহিত্যের এলাকা থেকে অমুসলমানদেরক সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করে এক মুসলিম সাহিত্য সৃষ্টি করা। এই প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ করেই কথা প্রসঙ্গে একদিন খালেদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘যে সাহিত্য মুসলমানদের দ্বারা রচিত এবং কেবলমাত্র মুসলমানদের দ্বারা পঠিত সেই সাহিত্যকে মুসলিম সাহিত্য বলে।’

বাঙলা সাহিত্যকে এই সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ রেখে তার বিকাশ ও বৃদ্ধিকে রোধ করার চেষ্টা পূর্ব পাকিস্তানে নতুন নয়। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন যতই অগ্রসর হয়েছে ততই সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা নোতুন নোতুন উপায় ও পথ নির্ধারণ এবং অন্বেষণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়েই তাঁদের সাফল্য আসে নি, কিন্তু তবু উদ্যম তাঁদের অব্যাহত আছে।

সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এই নজরুল সাহিত্য চর্চা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তা সর্বতোভাবে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত। তাঁদের সংস্কৃতিকর্মের এই দিকটিকে জনসাধারণের সামনে ভালোভাবে উদ্‌ঘাটিত করার প্রয়োজন সে জন্যেই আজ অপরিহার্য।

মিথ্যার ব্যবসা অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়। এ প্রয়োজনের গুরুত্ব শুধু আজকেই উপলব্ধি বা আবিষ্কৃত হয় নি। এ উপলব্ধি এবং আবিষ্কার শোষণের ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। শক্তি প্রয়োগ ক্ষমতা শোষণের জন্যে অপরিহার্য হলেও শুধু তার দ্বারাই সংখ্যালঘু কখনো শান্তিপূর্ণভাবে সংখ্যাগুরুকে শোষণ করতে পারে না। তার জন্যে প্রয়োজন হয় তাদেরকে তাদের চিন্তাভাবনা অনুভূতিকে প্রচারণার দ্বারা এমনভাবে গঠন করা যাতে তারা শোষণকে শোষণ বলে নির্ণয় করতে বা চিনতে না পারে। কেবলমাত্র এখানেই শেষ নয়। তারা যেন শোষণের মধ্যে নিজেদের মঙ্গলই দেখতে পায়। এ কার্য সাধন করতে হলে সত্যকে পরিহার এবং মিথ্যাকে আশ্রয় করা ব্যতীত উপায় নেই। শোষণের সাথে মিথ্যার তাই সহজ অবস্থান।

শোষণের হাতিয়ার এই মিথ্যাকেই লেনিন আখ্যা দিয়েছিলেন অহিফেন। অহিফেন সেবনের দ্বারা মানুষের সুস্থ চেতনা যেমন আক্রান্ত হয়, অনুপাত জ্ঞান ও কার্যক্ষমতা লুপ্ত হয় এবং পৃথিবীর যাবতীয় সব কিছুকে মনে হয় অবাস্তব, ঠিক তেমনি এই মিথ্যারূপী অহিফেনও মানুষের চিন্তাশক্তি, আত্মবিশ্বাস ও কর্মক্ষমতাকে বিলুপ্ত করে তাকে পরিণত করে অন্যের দাসানুদাসে। পৃথিবীতে এ জাতীয় অহিফেনের সংখ্যার শেষ নেই। প্রয়োজনের তাগিদে তারা আবিষ্কৃত এবং ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন শেষে তাদের দেখা মেলে না। নতুন প্রয়োজনের তাগিদে আবার আবিষ্কৃত হয় নতুন মিথ্যা, অহিফেনের নতুন সংস্করণ।

আমাদের দেশেও শোষণ আছে এবং তার সাথে আছে মিথ্যার বেসাতি, অহিফেনের বিস্তৃত ব্যবস্থা। অশিক্ষিত জনসাধারণ, এমনকি শিক্ষিত লোকদেরকে পর্যন্ত বিভ্রান্ত করার জন্যে এখানেও আবিষ্কৃত এবং ব্যবহৃত হয় নিত্যনতুন মিথ্যা, আহিফেনের নব নব সংস্করণ। এদের একটি তার কার্যকরিতা হারালে অন্যটি এসে দখল করে তার স্থান।

আমাদের দেশে সাংস্কৃতি ক্ষেত্রে এই অহিফেনের তালিকায় সর্বশেষে সংযোজন নজরুল ইসলাম এবং তাঁর সাহিত্যকীর্তি। একে সর্বশেষ বললে হয়তো ভুল হবে। কারণ নজরুলকে এভাবে ব্যবহারের চেষ্টা পাকিস্তানোত্তর পূর্ব বাঙলায় প্রথম থেকেই দেখা গেছে। কিন্তু তা হলেও একথা নিঃসংশয়ে বলা চলে যে বর্তমানের সংগঠিত প্রচেষ্টার তুলনায় সে পূর্ব প্রয়াসের গুরুত্ব তেমন কিছুই ছিলো না।

কিন্তু সে প্রচেষ্টার গুরুত্ব না থাকার কারণ তখন পর্যন্ত অন্য অহিফেনের কার্যকারিতা খর্ব হয়নি। তখন তাদের হাতের মুঠোয় ছিল আরবী হরফ, রাষ্ট্রভাষা উর্দু, বাঙলা ভাষায় নতুন আরবী ফারসী শব্দের আমদানী, বাঙলা সহিত্যের ‘হিন্দু ঐতিহ্য’, রবীন্দ্রবিরোধিতা এবং আরো অনেক কিছু। তখন নজরুল সাহিত্যকে বাদ না দিলেও তার থেকে উপরোল্লিখিত অন্য অহিফেনের কার্যকারিতা ছিলো অনেক বেশী।

কিন্তু পূর্ব বাঙলার জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজ ধীরে ধীরে এসব নেশা কাটিয়ে উঠলেন এবং সেদিন থেকে রবীন্দ্রবিরোধিতার আংশিক পরাভব এদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এরপর থেকে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতিকে বাদ দেওয়ার আন্দোলনকে বিশেষভাবে অবলম্বন না করে যা কিছুকে অস্বীকার করার উপায় নেই তার সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার উপরই হলেন অধিকতর নির্ভরশীল। এই নতুন অফিফেনের সন্ধান মিললো নজরুল ইসলামে। তাই যে নজরুল ইসলাম আজীবন অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য সৃষ্টির সাধনায় ব্রত ছিলেন তাঁকেই আজ ইসলামের কবি, মুসলিম তমদ্দুনের বাহক, মুসলিম জাতীয়তাবাদের মুখপাত্র ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা হচ্ছে। এবং এ কাজ যাতে উপযুক্তভাবে সম্পন্ন করা হয় তার জন্যে চলেছে সংগঠিত প্রচেষ্টা, স্থাপিত হয়েছে এই নতুন অহিফেন প্রস্তুত এবং পরিবেশনের বিস্তৃত কারখানা!

সম্প্রতি একটি বিশেষ স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রে ‘সুধীবৃন্দের’ দরিরামপুর সাহিত্য সমাবেশের সম্পর্কে কয়েকদিন ধরে বিস্তৃত তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এগুলি থেকে মনে হয় ইসলাম বিষয়ক ব্যতীত অন্য কিছু সম্পর্কে নজরুল কোনদিন কিছু লেখেননি, ‘মুসলিম রেনেসাঁস’ই ছিলো তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র এবং তাঁর মতো ধার্মিক মুসলমান তৎকালীন বাঙলাদেশে প্রায় ছিলো না বললেই চলে।

সংবাদপত্রটি পরিবেশিত এই বিবরণ যদি অতিরঞ্জিত না হয় তাহলে দেখা যাবে যে উপরোল্লিখিত সাহিত্য সমাবেশে ‘সুধীজনেরা’, আমাদের দেশের চলিত ভাষায়, নজরুল ইসলামের মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলেছেন। নজরুল দরিরামপুর ইস্কুলে কিছুদিন অধ্যয়ন করেছিলেন। সে জন্যে তাঁরা সেই ‘পুণ্যস্মৃতির’ প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অছিলায় সেখানে গিয়ে নজরুল সাহিত্য এবং নজরুল সঙ্গীতের যে বিশেষ পরিচয়টি দেশের সামনে তুলে ধরেছেন সেটা যে নজরুল সাহিত্যের এবং নজরুল জীবনের যথার্থ পরিচয় নয় সেটা আজ পর্যন্ত অনেকেই ভালোভাবে জানেন। কিন্তু এই কর্মকাণ্ড যদি অব্যাহত থাকে এবং নজরুল ব্যবসার স্বরূপ যদি যথাযথভাবে জনসাধারণের সামনে উদ্ঘটিত না হয় তাহলে কিছুদিন পরেই নজরুল সাহিত্য অহিফেনরূপে ক্রিয়াশীল হয়ে সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনাকে অনেকখানি বিভ্রান্ত করতে সমর্থ হবে। এ জন্যেই আজ প্রয়োজন সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এই নজরুল প্রীতি ও নজরুল সাহিত্য চর্চার স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করা।

সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহলের অর্থ পরিপুষ্ট এই সংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের অহিফেনে রূপান্তরকে আজ তাই বন্ধ করতেই হবে। তার জন্যে প্রয়োজন নজরুল সাহিত্যের, নজরুল সঙ্গীতের এবং নজরুল জীবনের সত্যিকার চিত্র জনসাধারণ ও সংস্কৃতি কর্মীদের সামনে উপস্থিত করা। এভাবেই বাধা দিতে হবে নজরুলকে সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ারে পরিণত হওয়া থেকে, এভাবেই সৃষ্টি করতে হবে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে সুস্থ চেতনার, যে চেতনা সক্ষম হবে আমাদের সামগ্রিক জীবনকে সুন্দর ও শোষণমুক্ত করতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *