মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমান মধ্যবিত্তের মধ্যে যে সংস্কৃতি চেতনার উন্মেষ হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ নোতুন অথবা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। উপরন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, প্রাকৃতিক জগতের মতো মানুষ এবং তার সমাজ কতকগুলি অলঙ্ঘনীয় নিয়মের অনুবর্তী। কিন্তু এ চিন্তাধারা নোতুন না হলেও তার মধ্যে এই হিসাবে অনেকখানি নোতুনত্ব আছে যে, আজ এ চিন্তাধারার বিকাশ যাদের মধ্যে ঘটছে তারা এজাতীয় চিন্তা করতে এতদিন অভ্যস্ত অথবা প্রস্তুত ছিলো না।
এ কথার অর্থ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা চলে যে, ধর্মগতভাবে মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানীরা, প্রধানতঃ সামন্ততান্ত্রিক ও মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা, ভারতবর্ষ অথবা বাঙলাদেশকে উচিতমতোভাবে কখনো স্বদেশ মনে করেননি। শ্রেণীস্বার্থের কারণে স্বদেশের সাথে আন্তরিক যোগাযোগ স্থাপনে তাঁদের বরাবরই আপত্তি ছিলো এবং এই আপত্তি ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী ভেদনীতির ফলে অধিকতর ঘোরতর আকার ধারণ করে।
নিজের দেশকে স্বদেশ মনে না করার জন্যে মানুষের জীবনে যে দুর্যোগ স্বাভাবিক মুসলমানরা সে দুর্যোগকে রোধ করতে পারেননি। পাক-ভারত উপমহাদেশের অ্যাংলো- ইণ্ডিয়ানদের যে কারণে এদেশের সংস্কৃতিক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য অবদান নেই অনেকখানি সেই কারণেই মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জীবনও হয়েছে বহুলাংশে পঙ্গু ও সৃষ্টিহীন। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানরা এদেশের সাথে যে আত্মীয়তা বোধ করতে পারতো না তার কারণ প্রধানতঃ তিনটি। ধর্মগতভাবে তারা ছিল খৃষ্টান, তাদের ভাষা ছিলো ইংরেজী এবং তাদের দেহে প্রবাহিত ছিলো ইংরেজদের রক্ত। ইংরেজরা যেহেতু এ দেশের শাসনকর্তা ছিলো এবং অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানেরা ছিলো সেই শাসকদের ধর্মাবলম্বী, তাদের ভাষাভাষী এবং তাদের রক্তগত আত্মীয় – কাজেই তারা নিজেদেরকে মনে করতো ভারতবর্ষের লোকদের থেকে উচ্চ শ্রেণীর ও উচ্চ বংশীয়। তাছাড়া ধর্মগত, ভাষাগত এবং রক্তগত ঐক্য এবং সম্পর্কের জন্যে তারা নিজেদেরকে ভারতবর্ষের অগণিত মানুষের মতো বিদেশী শাসিত মনে না করে মনে করতো এ দেশের শাসনকর্তা – রাজার জাতি। কাজেই ইংরেজী ছিলো তাদের ভাষা, ইংলণ্ডের ইতিহাস ছিলো তাদের জাতীয় ইতিহাস এবং অ্যাংলিকান চার্চ ছিলো তাদের জাতীয় ধর্ম প্রতিষ্ঠান।
বিদেশের সাথে এই কৃত্রিম আত্মীয়তা এবং স্বদেশের সাথে অনাত্মীয়তাবোধের ফলে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের অবস্থা সংস্কৃতি ও রাজনীতিগতভাবে এক শোচনীয় আকার ধারণ করে। এই শোচনীয় অবস্থা অধিকতর শোচনীয় হয় ইংরেজদের ভারতবর্ষ পরিত্যাগের পর অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের অবস্থার সাথে এসব দিক দিয়ে ভারতবর্ষের, বিশেষ করে বাঙলাদেশে মুসলমানদের অবস্থা অনেকাংশে তুলনীয়। সামন্তশ্রেণীর মুসলমানেরা মোগল রাজত্ব, এমন কি ইংরেজ রাজত্ব পর্যন্ত, বাঙলায় কথা না বলে ফারসী-উর্দুতে কথা বলতেন, নিজেদেরকে জাতিগতভাবে মনে করতেন আরব, ইরানী, তুর্কী, খুরাসনী অথবা সমরখন্দী এবং তাঁদের ধর্ম ছিলো ইসলাম। তাই বৈদেশিক ভাষা, রক্ত ও ধর্মের প্রভাব সামন্ততান্ত্রিক এবং উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী স্বার্থের তাগিদে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে এ দেশের মাটির সাথে মুসলমানদের আত্মিক যোগ স্থাপনকে করলো বাধাগ্রস্ত। দেশের মাটির সাথে এই সম্পর্কহীনতার ফলে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক চেতনার উপযুক্ত উন্মেষ সম্ভব হলো না, তাদের সাংস্কৃতিক সৃষ্টিশীলতাও বাধাগ্রস্ত হলো বহুতরভাবে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ দেশকে বাতিল করে সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রচেষ্টা আকাশ কুসুম রচনার মতো অবাস্তব ও বন্ধ্যা হতে বাধ্য।
মুসলমানদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ধর্মভেদ থাকলে তাদের সাংস্কৃতিক দৈন্য এতখানি উৎকট আকার ধারণ করতো না। কিন্তু ধর্মভেদ অন্যান্য ভেদাভেদের ভিত্তিস্বরূপ কাজ করার ফলে অবস্থার অবনতি ঘটলো এবং সে অবনতিকে রোধ করা গেলো না। মুসলমান উচ্চ শ্রেণীর নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্যে মোগলযুগোত্তর বাঙলাদেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে এ দেশের সাথে এ দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে তাদের উৎসাহের অন্ত রইলো না। এর ফলে বাঙলা ভাষায় ধর্মচর্চা করাও তাদের পক্ষে হলো অসম্ভব। এবং ঊনিশ শতকে ধর্মচর্চার ক্ষেত্র থেকে মুসলমানরা বাঙলা ভাষাকে বাদ দেওয়াই হয়ে দাঁড়ালো তাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক দৈন্যের অন্যতম মূল কারণ। হিন্দুদের সাথে এদিক দিয়ে মুসলমানদের অবস্থা বিশেষভাবে তুলনীয়। মুসলমানদের থেকে ধর্মচচার তাড়না ঊনিশ শতকে হিন্দুদের মধ্যে কম ছিলো না। উপরন্তু এক হিসাবে বেশীই ছিলো। সে সময় হিন্দু সমাজে বহু ধর্মান্দোলনের উৎপত্তি এবং প্রসার হয়েছিলো। হিন্দুদের সংস্কৃতি চর্চা এই ধর্মান্দোলনের ফলে সমৃদ্ধ হলো কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটা হলো না। এর প্রধান কারণ মুসলমানদের চিন্তা বাঙলাদেশ এবং বাঙলা ভাষাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত না হয়ে আবর্তিত হলো আরব ইরান, তুর্কীর চতুর্দিকে – অনেকখানি যেমন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের চিন্তা আবর্তিত হচ্ছিলো বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে।
মাত্র কিছুসংখ্যক ব্যতীত বাঙলার সমস্ত মুসলমানেরই পূর্বপুরুষরা এদেশের অধিবাসী এবং হিন্দু। কাজেই ধর্মীয় কারণ ব্যতীত অন্য কোন কারণে বাঙলাদেশকে পুরোপুরি স্বদেশ মনে না করার কোন কারণ তাদের ছিলো না। কিন্তু উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানেরা নিজেদের সুবিধামতো এক জাতিতত্ত্ব আবিষ্কার করে ক্রমাগত প্রচার করলেন যে, সৎ বংশজাত মুসলমান মাত্রেরই পূর্বপুরুষ আরব, ইরান, তুর্কী থেকে আগত। এর ফলে মুসলমানরা নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নত হওয়ামাত্র সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্যে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বংশতালিকা রচনা করে সচেষ্ট হলেন নিজেদের বংশ পরিচয় পরিবর্তনে। এ ভাবেই মুসলমানরা আত্মিক দিক থেকে স্বদেশে থাকলেন পরবাসী হয়ে।
মুসলমানদের এই মানসিকতার পরিবর্তনের শুরু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এবং এই পরিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ ভাষা আন্দোলনে। পূর্বে উর্দু না জানলে কোন মুসলমানই সৎ বংশজাত বলে পরিচিত হতেন না। শুধু তাই নয়, বাঙলা তাঁর মাতৃভাষা একথা স্বীকার করলেও তাঁর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতো। পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাঙালী মুসলমান ‘মুসলমান বাঙালীতে রূপান্তরিত হতে শুরু করলো এবং সমস্ত সংস্কার বর্জন করে, উর্দুকে নিজের ভাষা হিসাবে বাতিল করে, বাঙলাকে স্বীকার করলো মাতৃভাষা রূপে। এইভাবে মধ্যবিত্ত বাঙালী মুসলমানদের জীবনে সূত্রপাত হলো এক অভূতপূর্ব চেতনার। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা দ্বারা মুসলমানদের মনে যদি কোন সত্যিকার বিপ্লব ঘটে থাকে তাহলে এই হলো তার সঠিক পরিচয়।
মুসলমানদের যে দৃষ্টি দেশের প্রতি এতকাল ছিল মমতাহীন, সেই দৃষ্টিই আচ্ছন্ন হলো স্বদেশের প্রতি প্রেম ও মমতায়। ১৯৪৭ সাল থেকে ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রাম তাই অনেকাংশে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেরই সংগ্রাম। যে মধ্যবিত্ত মুসলমান নিম্ন অবস্থা থেকে উন্নতি লাভ করে দেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে উদ্বিগ্ন হতো, এর পর থেকে তার সে উদ্বেগের অবসান হতে শুরু করলো। বাঙালী পরিচয়ে সে আর লজ্জিত হলো না। সে চিত্ত ছিল পরবাসী, সে চিত্ত সচেষ্ট হলো স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে। প্রতিকূল শক্তি এবং সংস্কার এ পরিবর্তনকে প্রতিহত করা সত্ত্বেও ঘরে ফেরার এ সংগ্রাম রইলো অব্যাহত এবং তারা জয় করে চললো একের পর এক ভূমি — স্বীকৃত হলো রাষ্ট্রভাষা বাঙলা, বাঙলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য; স্বীকৃত হলো রবীন্দ্রনাথ এবং পহেলা বৈশাখ। এ স্বীকৃতির কোন কোনটি এলো সরকারী ঘোষণাপত্রে কিন্তু তার সত্যিকার ক্ষেত্র হলো পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমান মধ্যবিত্তের বিস্তীর্ণ মানসলোক। এ দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়কে তাই মোটামুটিভাবে বলা চলে মুসলমান বাঙালী মধ্যবিত্তের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।