পরিশিষ্ট : আমার প্রথম বই সাম্প্রদায়িকতা
বদরুদ্দীন উমর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করার সময়েই ১৯৫৯ সালের অক্টোবরে পড়াশোনার জন্য আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে থাকার সময়েই, খুব সম্ভবতঃ ১৯৬০ সালে কোন এক বন্ধুর চিঠিতে খবর পাই যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং বাংলা বিভাগের শিক্ষক মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামের যৌথ সম্পাদনায় রাজশাহী থেকে পূর্বমেঘ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। আমি অক্সফোর্ড থাকার সময়েই পত্রিকাটি কয়েক সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে আমি যখন রাজশাহীতে ফিরি তখন পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়েছিলো। অন্য কারণের মধ্যে আর্থিক কারণই ছিল প্রধান।
সারা পূর্ব বাঙলায় বা পূর্ব পাকিস্তানে তখন সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ এবং সরকারী ব্যবস্থাপনায় মাহে নও ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকা নিয়মিত বের হতো বলে মনে পড়ে না। আজকাল যে রকম চারদিকে পত্রিকার ছড়াছড়ি দেখা যায় সে সময় তেমন ছিলো না। কালে-ভদ্রে কেউ কোনো সংকলন বের করলেও নিয়মিত পত্রিকা বের করার সক্রিয় চিন্তা তখন বিশেষ কেউ করতেন না। সেই পরিস্থিতিতে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ একটি চমৎকার ব্যতিক্রম ছিলো। আমি দেশে ফেরার আগেই সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশ খারাপ লাগলো। কিন্তু তাড়াতাড়ি এ ক্ষেত্রে করার মতো কিছু আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
কিছুদিন পর, যতদূর মনে পড়ে, ১৯৬৩ সালে পূর্বমেঘ আবার বের করার ব্যাপারে আমি তার সম্পাদকদের সাথে আলাপ করি। প্রধান সমস্যা দাঁড়ায় টাকার অভাব। আমি তখন বলি যে, ঢাকায় কিছু বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগযোগ করে বিজ্ঞাপনের চেষ্টা করলে হয়তো কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে। আমি তখন প্রায়ই ঢাকা আসতাম। কাজেই ঢাকাতে এসে এ ব্যাপারে প্রথম আলাপ করলাম জিয়াউল হকের সাথে। তিনি তখন ছোটখাট কি ব্যবসা করতেন, কিন্তু তাঁর যোগাযোগ ছিলো অনেকের সাথে। তাঁর সহায়তার পূর্বমেঘ এর জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করি। এছাড়া সিদ্দিকী এবং মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামও নিশ্চয় কিছু টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। এভাবে সামান্য কিছু টাকার ব্যবস্থা করে পূর্বমেঘ আবার বের করার ব্যবস্থা হয়। ঠিক কোন্ মাসে মনে নেই, তবে ১৯৬৩ সালেই দ্বিতীয় পর্যায়ে পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়।
পত্রিকা ছাপার আগে লেখা সংগ্রহের একটা ব্যাপার থাকে। এই তাগিদেই আমি নিজে পূর্বমেঘ এর জন্য ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখি। দীর্ঘ দিন পর সেটাই ছিলো আমার প্রথম লেখা।
এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, আমার একবারে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৪৬ সালে। আমি তখন বর্ধমান টাউন স্কুলে ক্লাস নাইনের ছাত্র। তখন কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’ নামে একটি পত্রিকা বের হতো। আমার আব্বা আবুল হাশিম সাহেব তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হলেও পত্রিকাটি সম্পাদিত হতো কাজী মহম্মদ ইদরিসের দ্বারা। আমি বর্ধমান থেকে ডাকযোগে একটি ছোট প্রবন্ধ ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় ছাপার জন্য পাঠাই। ইদরিস সাহেব কয়েকটি শব্দ পরিবর্তন করে লেখাটি ছাপেন। প্রবন্ধটির নাম ছিলো, “বিদেশীরা প্রভুত্ব করিবে কেন?
এর পর আমি বহুদিন লিখি নি। ১৯৫০ সালে ঢাকায় আসার পর তমদ্দুন মজলিস নামে একটি ইসলামপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। সংগঠনটি ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে খুব সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। অধ্যাপক আবুল কাসেম, শাহেদ আলী, আবদুল গফুর প্রমুখ ছিলেন সেই সংগঠনের নেতৃস্থানীয় লোক। সাপ্তাহিক সৈনিক নামে তাঁরা একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করতেন ‘তমদ্দুন মজলিসে’র মুখপত্র হিসেবে। সেই সৈনিক পত্রিকায় আমি ১৯৫১ থেকে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখি। এই লেখা শুরু করার সময় আবদুল গফুর আমার পুরো নাম বদরুদ্দীন মহম্মদ উমর থেকে মহম্মদ শব্দটি বাদ দিয়ে তাকে করেন ‘বদরুদ্দীন উমর।’ আমার আব্বার অবশ্য ধারণা ছিলো যে, আমি নিজেই আমার নাম থেকে মহম্মদ শব্দটি বাদ দিয়েছি।
যাই হোক, সৈনিক পত্রিকায় আমি বেশি দিন লিখি নি এবং তমদ্দুন মজলিসের চিন্তাধারার সাথে আমার নিজের চিন্তার যোগ ছিন্ন হতে থাকার সাথে সাথে তাদের সাথে আমার যে সামান্য সাংগঠনিক যোগ ছিলো সেটাও ছিন্ন হয়।
এর পর পাকিস্তান দর্শন কংগ্রেস অথবা দুই একটি সেমিনারের জন্য ইংরেজীতে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখলেও বাঙলা ভাষায় কিছু লিখি নি বললেই চলে। আসলে সে সময় আমার চিন্তার মধ্যে পরিবর্তন আসছিলো। কোনো বিশেষ আদর্শগত প্রত্যয় নোতুনভাবে আমার মধ্যে দানা বাঁধে নি। সেই অবস্থায় লেখালেখির থেকে নিজের চিন্তাকে গঠন করার তাগিদই আমার মধ্যে বেশি ছিলো। কাজেই লেখালেখির কোন বিশেষ তাগিদও তখন বোধ করতাম না। পড়াশোনার চেষ্টাই করতাম।
১৯৬৩ সালে পূর্বমেঘ পত্রিকায় উপরোক্ত যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় সেটিকেই বলা চলে নতুন পর্যায়ে আমার প্রথম লেখা। অবশ্য সেই প্রবন্ধটিকেও আমি পরবর্তী পর্যায়ে আমার নিজের দ্বারা স্বীকৃত রচনার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি, কারণ তার কিছু বক্তব্যকে পরে আমার কাছে ঠিক মনে হয় নি। তাই পূর্বমেঘ-এ প্রকাশিত আমার দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘সাম্প্রদায়িকতাকেই’ আমি মনে করি আমার প্রথম বিবেচনাযোগ্য রচনা। পূর্বমেঘ যদিও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং মুস্তাফা নূর-উল-ইসলামের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো কিন্তু পত্রিকাটি প্রকাশ করার ব্যাপারে যত রকম কাজ ছিলো তার বেশিটাই, প্রায় সবটাই করতেন মুস্তাফা। লেখা সংগ্রহ, প্রেসে ছাপার ব্যবস্থা, প্রুফ দেখা এবং অর্থ সংগ্রহ ও বিক্রীর ব্যবস্থা সব কিছু তাঁকেই দেখতে হতো। আমি মাঝে মাঝে লেখা সংগ্রহ ও প্রুফ দেখার কাজ কিছুটা করতাম।
যাই হোক, এরপর পূর্বমেঘ পত্রিকাটি কিছুদিন মোটামুটি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো। এবং তার প্রত্যেক সংখ্যাতেই আমি লিখতাম। এভাবে পত্রিকাটির সাথে সম্পর্কিত থাকার কারণেই আমিও নোতুন করে লেখালেখি শুরু করলাম।
তখনকার দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের একটি বন্ধুমহল ছিলো। এই মহলে ছিলেন সালাহউদ্দীন আহমদ, মোশাররফ হোসেন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূর- উল-ইসলাম, ফজলুল হালিম চৌধুরী, রশীদুল হক, আমানুল্লাহ আহমদ, জিল্লুর রহীম, বদরুল হাসান, আলী আনোয়ার প্রমুখ। এঁদের মধ্যে পরের দিকে কেউ কেউ এসেছিলেন এবং বয়সে অন্যদের থেকে ছোট থাকলেও তাতে কোন অসুবিধে হতো না।
সে সময় পরস্পরের বাসায় খাওয়া দাওয়া ছিলো প্রায় একটা নিয়মিত ব্যাপার। এই খাওয়া দাওয়ার সাথে মাঝে মাঝেই আমরা কোনো না কোনো বিষয়ে আলোচনায় বসতাম। কোনো লেখা নিয়ে আলোচনাও হতো। সে সময়টা ছিলো আইয়ুব-মোনেমের সময়।
এই আলোচনার আসরে আমার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ পড়া এবং আলোচনা হয়। আমার দ্বিতীয় বই সংস্কৃতির সংকট-এ অন্তর্ভুক্ত ‘মুসলিম সংস্কৃতি’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠের কথাটি বেশ ভালোভাবেই মনে আছে। সেটি আমার বাসাতেই হয়েছিলো। সে লেখাটিও পূর্বমেঘ প্রথম প্রকাশ করেছিলো।
আমার প্রথম বই সাম্প্রদায়িকতা। এই বইয়ের কোনো কোনো প্রবন্ধও এভাবে পঠিত হয়ে পরে পূর্বমেঘ-এ প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর শিক্ষক ডক্টর সাজ্জাদ হোসাইন লেখাটির নানা সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ তাঁর ছাত্র এবং পূর্বমেঘ-এর সম্পাদক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কাছে পাঠান। সেটি পূর্বমেঘ-এর পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হয়। সেই সাথে ছাপা হয় আমার জবাবটিও। সাজ্জাদ সাহেবের এই সমালোচনা এবং আমার জবাব সে সময় ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই নিউ মার্কেটের দোকানগুলো থেকে পূর্বমেঘ-এর সব কপি বিক্রী হয়ে যায়। আমার দিক থেকে বলা চলে যে, সেটাই ছিলো আমার প্রথম বিতর্কমূলক রচনা। যাই হোক, এভাবে পূর্বমেঘ পত্রিকায় তখন যে লেখাগুলি প্রকাশিত হয় সেগুলি সবই ছিল সাম্প্রদায়িকতার কোনো না কোনো দিক নিয়ে। এভাবে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়া এবং সেগুলো সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় ঢাকার বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে বলেন, এগুলি একত্র করে বই প্রকাশ করলে ভালো হয়। আমিও তখন এ ব্যাপারে কিছুটা উৎসাহ বোধ করি।
কিন্তু সেকালে বই প্রকাশ করা, বিশেষত, প্রবন্ধের বই প্রকাশ করা সহজ ছিলো না। তার ওপর লেখক একেবারে নোতুন হলে তো কথাই নেই। তাছাড়া ঢাকায় প্রকাশক বলতে তখন যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশক অথবা প্রধানতঃ তাই। কালেভদ্রে তাঁরা প্রবন্ধের বই প্রকাশ করতেন। কাজেই আমি যখন সাম্প্রদায়িকতা নামে আমার বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম তখন সেটি ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশের চেষ্টাই করতে হলো।
এভাবে যখন চিন্তা করছি তখন ঢাকায় জিয়াউল হক নামে আমার এক বন্ধু বললেন যে, বইটি ছাপার জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু টাকা দেবেন এবং ছাপার জন্য প্রেসের ব্যবস্থাও করতে পারবেন। ঢাকায় কোনো প্রেসের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না।
তিনি আমাকে প্রথমে নিয়ে গেলেন সমকাল সম্পাদক ও কবি সিকান্দার আবু জাফর এর প্রেসে। তাঁর সাথে আমার সে সময় কোন ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না, যদিও পরে, বিশেষ করে তাঁর প্রেসে প্রথম দিকে সাপ্তাহিক গণশক্তি ছাপার সময় পরিচয় বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো। জিয়াউল হক (টুলু) জাফর ভাইকে আমার পাঁচ ফর্মা সাইজের বইটি ছাপার কথা বললেন তাঁর প্রেসে। কিন্তু জাফর ভাই রাজী হলেন না। টুলু নিশ্চিত ছিলেন যে জাফর ভাই এতে সম্মত হবেন। কিন্তু তিনি রাজী না হওয়ায় অসুবিধা হলো। তা সত্ত্বেও তিনি তখন বললেন, অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।
আমরা জাফর ভাইয়ের প্রেস থেকে গেলাম তৎকালীন ভিক্টোরিয়া পার্ক (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক)-এর কাছে হামিদুল হক চৌধুরীর প্রেসে। সেখানে তখন টুলুর পরিচিত আব্দুল মালেক চৌধুরী নামে এক অল্পবয়সী ম্যানেজার প্রেসের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বইটি ছাপার দায়িত্ব নিতে রাজী হলেন। তাঁর সাথে এ ব্যাপারে কথা পাকাপাকি হলো এবং টুলু ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে তিনশো টাকা দিয়ে ছাপার কাজ শুরু করতে বললেন। বইটি সোয়া দুই হাজার ছাপতে দুই হাজার টাকার মত খরচ হয়েছিলো সেকালে। বাকীটা আমি নিজেই দিয়েছিলাম। বইটি প্রেসে দেয়ার পর প্রচ্ছদের ব্যাপারে আনিসুজ্জামান আমাকে সাহায্য করেন। তখন শিল্পী আবদুর রউফ খুব সম্ভবতঃ মাহে নও পত্রিকায় কাজ করতেন। তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন আনিস। রউফ বইটির প্রচ্ছদ তৈরী করে দিতে রাজী হলেন এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেটা দিলেন। এর জন্য তিনি আমার কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক কিছুতেই নিলেন না।
একটা সমস্যা অবশ্য হলো। ব্যক্তিগতভাবে বইটি ছাপা হলেও প্রকাশক হিসেবে আমার নিজের নাম না দিয়ে একটি প্রকাশনা সংস্থার এবং অন্য কোনোও নাম দেওয়ার কথা হলো। কিন্তু সে রকম ব্যক্তি ও প্রকাশনা সংস্থা কোথায়? অবশেষে ঠিক হলো একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থার নামে বইটি প্রকাশিত হবে। আমার অন্য এক বন্ধু কামাল হোসেনের স্ত্রী, যিনি আমারও বন্ধু, সেই হামিদা হোসেনের নাম প্রকাশিকা হিসেবে দিয়ে ‘জনমৈত্রী পাবলিকেশন্স লিমিটেড’-এর নামে সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশিত হলো। মুদ্রক হিসেবে ‘এসোসিয়েটেড প্রিন্টার্স লিমিটেড’ এর পক্ষে ছাপা হলো আব্দুল মালেক চৌধুরীর নাম। বইটি আমি উৎসর্গ করেছিলাম আমার মাকে।
সাম্প্রদায়িকতা নামে আমার প্রথম বইটিতে যে প্রবন্ধগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেগুলি হলো: ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ’, ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্র’, ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম সংস্কৃতি’, ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ এবং ‘সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক অগ্রগতি’। এছাড়া ‘পরিশিষ্ট’ অংশে আমি এ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি বইয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম। পরবর্তী সংস্করণে আমি প্রথম প্রবন্ধটিকে বাদ দিয়েছিলাম। সাজ্জাদ সাহেবের সমালোচনার জবাবটিও পরে পরিশিষ্ট অংশে সংযোজিত হয়েছিলো।
সাম্প্রদায়িকতা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে। বইটির কপি কিভাবে কলকাতা পৌঁছেছিলো জানি না। কিন্তু তারপর আমি ওখান থেকে যাঁদের চিঠিপত্র পেয়েছিলাম তাঁদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, আবু সয়ীদ আইয়ুব, মৈত্রেয়ী দেবী এবং পান্নালাল দাশগুপ্তের নাম উল্লেখযোগ্য। মৈত্রেয়ী দেবী ও পান্নালাল দাশগুপ্ত তাঁদের সম্পাদিত নবজাতক ও কম্পাস পত্রিকায় সাম্প্রদায়িকতার ওপর আলোচনা করেছিলেন এবং সেই সাথে সি.পি.এম.-এর সদস্য বর্ধমানের জাহেদ আলী সাহেবও খুব খুশী হয়ে সে সময় আমাকে একটি সুন্দর চিঠি দিয়েছিলেন। ঢাকার প্রগতিশীল মহলে সাম্প্রদায়িকতা বেশ ভালোভাবে গৃহীত হলেও বইটির ওপর কোনো লিখিত আলোচনা হয়েছিলো বলে মনে নেই। তবে তখন কলকাতায় পত্র-পত্রিকা ছাড়া রেডিওতে নারায়ণ চৌধুরী বইটির ওপর আলোচনা করেছিলেন। পরে অন্যদের মধ্যে অন্নদাশংকর রায়ও ১৯৭১ সালে সাম্প্রদায়িকতার ওপর আলোচনা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যাপক সৈয়দ আলী আশরাফ ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে মহম্মদ মাহফুজউল্লাহ সম্পাদিত একটি পত্রিকায় আমার তীব্র সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সে পত্রিকাটির নাম আমার আজ আর মনে নেই। পরে আবুল মনসুর আহমদ আহমদ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় সাম্প্রদায়িকতার ওপর একটি দীর্ঘ সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখেন। তৎকালীন পূর্ব বাঙলায় বইটির সমালোচনা করে এছাড়াও আরও কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও বইটির বক্তব্য সমর্থন করে কোনো লেখা প্রকাশিত হয় নি। সাম্প্রদায়িকতা প্রথম ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকা এবং কলকাতায় অনেকবার ছাপা হয়েছে। এখনো হচ্ছে।