একুশে ফেব্রুয়ারী

একুশে ফেব্রুয়ারী

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দিক হলো তার স্বাতঃস্ফূর্ততা। একটু ভালোভাবে আন্দোলনের গতিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এই বিস্ময়কর স্বতঃস্ফূর্ততা যেন আন্দোলনকে প্রবল প্রতাপে এগিয়ে নিচ্ছে। সংগঠন ও ব্যক্তির ভূমিকা সেখানে অবশ্যই আছে কিন্তু সেটা মুখ্য নয়। আন্দোলনের তীব্রতা, ব্যাপকতা এবং সাফল্য তাদের কাছেও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এই স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যেই তার সত্য চরিত্রের অনেকখানি পরিচয় পাওয়া যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র পুলিশী জুলুম অথবা ছাত্রহত্যার দ্বারা এই স্বতঃস্ফূর্ততার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। এ জাতীয় পুলিশী জুলুম এবং ছাত্র-নির্যাতন পূর্ব পাকিস্তানে নোতুন ছিলো না। ১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দীদের উপর মুসলিম লীগের পুলিশ গুলী চালায় এবং তার ফলে বেশ কিছুসংখ্যক দেশপ্রেমিক হতাহত হন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়কার গুলীচালনা থেকেও রাজশাহী কারাগারের হত্যাকাণ্ড অনেক বেশী নৃশংস এবং বর্বরোচিত। কিন্তু তার জন্যে সে সময় দেশব্যাপী কোন আন্দোলন তো দূরের কথা, তেমন কোন ছোটখাটো সংগঠিত বিক্ষোভও ঘটেনি। নাচোলের কৃষক আন্দোলনের সময় ইলা মিত্রের উপর পূর্ব পাকিস্তানী সরকারের পুলিশ নির্মম অত্যাচার করেছে। কিন্তু তার জন্যে এদেশের অন্যান্য স্থানের কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত জনসাধারণ তেমনভাবে বিক্ষুব্ধ হয়নি। এমন কি ১৯৪৮ সালেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে শহরে বাঙলা ভাষার সমর্থকদের উপর পুলিশ নানাভাবে যে নির্যাতন করেছিলো তারও বিশেষ কোন প্রতিবাদ হয়নি। শুধু তাই নয়। ঢাকার জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ সে সময় বাঙলা ভাষা এবং তার সমর্থক ছাত্র-জনতার সক্রিয় বিরুদ্ধাচরণ করেছে।

এ কথা যদি সত্যি হয় তাহলে দেখা দরকার ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগাষ্ট এবং ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে এদেশে এমন কি ঘটলো যার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন লাভ করলো এতখানি ব্যাপকতা ও সাফল্য?

এই মধ্যবর্তী সময়ে যা ঘটলো তাকে এক কথায় বর্ণনা করলে বলতে হয় যে ভাষার প্রশ্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে দ্রুতগতিতে রূপান্তরিত হলো রাজনৈতিক আন্দোলনে। স্বাধীনতার পূর্বে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের যে স্বর্গীয় চিত্র অঙ্কন করেছিলো তার চরিত্র এবং স্বরূপ অচিরেই জনগণের সামনে রূঢ়ভাবে উদঘাটিত হলো। শোষণ-শাসন এবং অন্যান্য দুষ্কৃতির অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া পূর্ব বাঙলার মানুষকে করে তুললো ক্রমশঃ অশান্ত ও বিক্ষুদ্ধ। নিজ দিশে তারা যেন হলো পরবাসী।

এতখানি শঠতা, শোষণ ও প্রবঞ্চনায় তাদের সহ্যসীমা লঙ্ঘিত হওয়ার উপক্রম হলো। এমন সময় এলো প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা। এ ঘোষণা ছাত্র- জনসাধারণের কাছে শুধু রাষ্ট্রভাষার ঘোষণারূপেই প্রতিভাত হলো না। এ ঘোষণার মধ্যে তারা দেখলো শোষণ, তারা দেখলো প্রভুত্ব এবং তাদের স্বদেশকে বিদেশ করার ষড়যন্ত্র। এই চেতনা পূর্ব বাঙলার বারুদসদৃশ রাজনৈতিক জীবনে অগ্নিসঞ্চার করলো। শুরু হলো ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। এবং এ আন্দোলন এবার শুধু স্বল্পসংখ্যক ছাত্র এবং শিক্ষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পরিণত হলো জনগণের গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক আন্দোলনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *