বাঙলা ভাষায় বিদেশী শব্দ

বাঙলা ভাষায় বিদেশী শব্দ

কোন্ ভাষা কতখানি সমৃদ্ধ সেটা বহুলাংশে নির্ভর করে ভাষার শব্দসম্ভারের উপর। ভাষার শব্দসম্ভার আবার সেই ভাষাভাষী সমাজের জীবনব্যবস্থার উপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। অর্থাৎ কোন ভাষা যদি শব্দসমৃদ্ধ হয় তাহলে একথা নিরাপদে বলা চলে যে, সেই ভাষায় যাঁরা কথা বলেন তাঁদের সমাজও সে তুলনায় সমৃদ্ধ এবং অগ্রসর। এ জন্যেই যে কোন একটি পশ্চাৎপদ সমাজের ভাষা সেই তুলনায় পশ্চাৎপদ এবং উন্নত সমাজের ভাষা অনুরূপভাবে উন্নত হতে বাধ্য।

নৈতিকতার মতো ভাষাকেও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। ভাষার মাধ্যমে সমাজের চিত্রই প্রতিফলিত হয়। ভাষাকে তাই শুধু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বললেই তার বর্ণনা সম্পূর্ণ হয় না। ভাষা প্রকৃতপক্ষে মানুষের সমগ্র জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

সব ভাষায় সবরকম শব্দের প্রচলন থাকে না। কারণ শব্দের প্রচলন নির্ভর করে সেগুলি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার উপর। সে প্রয়োজন যদি বিশেষ কোন সমাজের মধ্যে অনুভূত না হয় তাহলে অনুরূপ কোন শব্দের আবির্ভাব তার ভাষার মধ্যে ঘটে না। উদাহরণস্বরূপ প্রথমে মানুষের ঘরোয়া কথার উল্লেখ করা যেতে পারে। কারো বাড়ীতে যদি টেলিফোন, গাড়ী, ফ্রিজ থাকে তাহলে এই শব্দগুলির ব্যবহার তার বাড়ীতে প্রায়ই হবে কিন্তু পল্লীগ্রামের এক সাধারণ গৃহস্থ বাড়ীর ঘরোয়া কথায় তাদের কোন ব্যবহার হবে না। কারণ গ্রামের সে বাড়ীতে এসব জিনিসের ব্যবহার নেই। শহরের ধনী গৃহস্থ এবং পল্লীগ্রামের দরিদ্র গৃহস্থের জীবনযাপন ও ব্যবহার্য দ্রব্যের পার্থক্যের ফলে তারা যে শব্দগুলি ব্যবহার করে তাদের মধ্যে অনেক তফাৎ হয়। বস্তুত ব্যবহারের উপর এক্ষেত্রে শব্দের ব্যবহার একান্তভাবে নির্ভরশীল। বালিশ, টেবিল এবং টেলিফোন এই শব্দগুলি বাঙলা ভাষায় একই সময়ে অথবা রাতারাতি আমদানী হয়নি। এগুলির ব্যবহারের মধ্যে বহু বছরের ব্যবধান তার কারণ বাঙালী সমাজে এই জিনিসগুলির প্রচলনের মধ্যেও ব্যবধান ঘটেছে বহু বছরের।

অনেক সময় আবার দেখা যায় এক এক ভাষার এমন বিশিষ্ট কতকগুলি শব্দ থাকে যেগুলি অন্য ভাষায় অনুবাদ করে তার অর্থ বোঝানো যায় না। অর্থাৎ সেই শব্দগুলোর কোন যথার্থ প্রতিশব্দ অন্য ভাষাটিতে নেই। যেমন বাঙলা ভাষার ‘ন্যাকামী’ এবং ‘অভিমান’ এই দুই শব্দের তেমন কোন ইংরেজী প্রতিশব্দ নেই। এ শব্দগুলি বস্তুনির্ভর হলে ঘরে অথবা সমাজে সেই জিনিসের আমদানীর ফলে হয়তো অনুরূপ শব্দ ব্যবহারও সম্ভব হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে শব্দ দুটির সাথে বস্তুর কোন যোগাযোগ নেই। তাদের যোগ হচ্ছে বাঙালী সমাজের বিশিষ্ট মানসিকতা এবং মনের গঠনের সাথে। এ মনের গঠন যাদের নেই তাদের সমাজে ‘ন্যাকামী এবং ‘অভিমানে’র যথার্থ প্রতিশব্দ না থাকাই স্বাভাবিক। শুধু উর্দু ইংরেজী বাঙলার ক্ষেত্রেই নয় প্রত্যেক ভাষার মধ্যেই এ রকম কিছু শব্দ থাকে এবং সেই বিশেষ ভাবকে অন্য ভাষায় ব্যক্ত করার জন্যে প্রতিশব্দের সন্ধান না করে অনেক সময় এক ভাষার শব্দটিকে অন্য ভাষায় হুবহু গ্রহণ করা হয়।

নির্বিশেষ বা অ্যাবস্ট্রাক্ট শব্দ সম্পর্কে একই কথা বলা চলে। যে সমাজে যত উঁচু চিন্তা করতে মানুষ অভ্যস্ত সেই সমাজের ভাষায় নির্বিশেষ শব্দের সংখ্যা তত বেশী। এই জন্যে সাঁওতালদের ভাষায় নির্বিশেষ শব্দের সংখ্যা হাতে গোনা সম্ভব হলেও ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান এবং রাশানে এ জাতীয় শব্দের সংখ্যাগণনা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শুধু তাই নয়। এ সমস্ত ইউরোপীয় ভাষা শব্দসম্ভারও এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। ল্যাটিনকে বাতিল করে ইউরোপে আধুনিক ভাষাগুলির উদ্ভব ও উন্নতি ইউরোপীয় জাতিগুলির জাগতিক উন্নতি এবং বুদ্ধিচর্চার ইতিহাসের থেকে অবিচ্ছিন্ন। বস্তুতঃ এ উন্নতি না হলে তাদের ভাষার উন্নতি কোন প্রকারেই সম্ভব হতো না।

ভাষার কাঠামো সামাজিক কাঠামোর উপর যেমন নির্ভরশীল তেমনি ভাষায় বিভিন্ন শব্দের আবির্ভাব ও প্রচলন সমাজের মধ্যে বিভিন্ন বস্তুসামগ্রী ও ভাবধারার প্রচলনের উপর নির্ভরশীল।

প্রত্যেক ভাষারই কতকগুলি মূল শব্দ থাকে। এ শব্দগুলি হতে অর্থের প্রকারভেদ অন্যান্য বহু সম্পর্কিত শব্দের সৃষ্টি হয়। শব্দসংখ্যার এই বৃদ্ধিকে মূল থেকে একটি বৃক্ষের কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখার বৃদ্ধি ও বিস্তারের সাথে তুলনা করা চলে। বৃক্ষ যেমন নীচের মাটি থেকে রস সংগ্রহ করে ভাষার মধ্যে এই জাতীয় শব্দগুলিও তেমনি এক একটি সমাজের জীবনভূমি থেকে রস সংগ্রহ করে বৃক্ষের মতই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।

গতিশীল সমাজে উন্নতির বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক নোতুন নোতুন শব্দ ও ভাবধারার সৃষ্টি হয়। এ সব ক্ষেত্রে যে নোতুন শব্দগুলি সৃষ্টি ও প্রচলিত হয় সেগুলির সাথে ভাষার মূল শব্দগুলির কোন না কোন প্রকার যোগ সম্পর্ক থাকে। এজন্যে যে সমাজ যখন গতিশীল হয় তখন তার ভাষার মধ্যেও নোতুন নোতুন শব্দের সৃষ্টি ও প্রচলন হতে থাকে।

ভাষার মধ্যে তাহলে বিদেশী শব্দের প্রচলন হয় কখন ও কীভাবে? সামাজিক উন্নতির সাথে সাথে যদি শব্দসংখ্যার বৃদ্ধি হয় তাহলে সেগুলি সবই তো সেই ভাষার মূল শব্দগুলি থেকেই উদ্ভূত হতে পারে। কাজেই তার জন্য অন্য ভাষার দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন কী?

বিদেশী ভাষা আমদানী হয় প্রধানতঃ দুই কারণে। প্রথমতঃ এক একটি ভাষায় ‘ন্যাকামী’, ‘অভিমান’ ইত্যাদির মত এমন কতকগুলি শব্দ থাকে যেগুলি অন্য ভাষায় অনুবাদসাপেক্ষ নয়। অনেক সময় আবার দার্শনিক ও চিন্তাবিদেরা এমন কতকগুলি বিশেষ শব্দ নিজ নিজ ভাষায় ব্যবহার করেন যেগুলির প্রতিশব্দও অন্য ভাষায় তৈরি করা মুশকিল এবং হয়তোবা অসাধ্য। এ জাতীয় অসুবিধার জন্যে ভাষায় বিদেশী শব্দ আমদানী করা হয়। এবং এই ধরনের শব্দ লেনদেন সমভাবে উন্নত ভাষাসমূহের মধ্যেও হয়ে থাকে। কিছুকাল ব্যবহারের ফলে এই বিদেশী শব্দগুলি এমনভাবে ভাষায় অঙ্গীভূত হয় যে, তাদেরকে বিদেশী বলে শব্দতাত্ত্বিকেরা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সহজে চেনা সম্ভব হয় না।

কিন্তু এই প্রথম কারণে কোন ভাষার মধ্যেই খুব বেশী বিদেশী শব্দ আমদানী হতে পারে না। বিপুল সংখ্যায় বিদেশী শব্দ আমদানী হয় সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন কারণে।

যে সমস্ত ভাষায় অধিক সংখ্যক বিদেশী শব্দের প্রচলন আছে সে ভাষাগুলির ইতিহাস দেখলে সহজেই চোখে পড়বে যে একই সময়ে সেগুলি ভাষার মধ্যে আসেনি। তারা আমদানী হয়েছে পর্যায়ক্রমে। এক্ষেত্রে বাঙলা ভাষাকে উদাহরণ হিসাবে ধরা যেতে পারে। বাঙলাতে অসংখ্য পর্তুগীজ, আরবী, তুর্কী, ফারসী, ইংরেজী এবং ফরাসী শব্দের প্রচলন আছে। কিন্তু বাঙলা ভাষার মধ্যে এই শব্দগুলি একই সময়ে আমদানী হয়নি। বাঙালীরা তাদের ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে ক্রমে ক্রমে যেভাবে পর্তুগীজ, আরব, তুর্কী, ইরানী, ফরাসী, এবং ইংরেজী বাণিজ্য, শাসনব্যবস্থা ও সংস্কৃতির সংস্পের্শে এসেছে ঠিক তেমনিভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে এই ভিন্নদেশীয় শব্দগুলি ধীরে ধীরে তাদের ভাষার অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।

এটা ঘটলো কেন? এর উত্তর খুবই সোজা। সামাজিক উন্নতির মত ভাষার উন্নতিও কতকগুলি নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় যে কোন অপেক্ষাকৃত অনুন্নত সমাজ ও তার সংস্কৃতি একটি উন্নত সমাজ ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এলে অথবা তার প্রভাবভুক্ত হলে নিম্নতর সমাজ ও সংস্কৃতিটি অন্যটির থেকে বহু কিছুর আমদানী এবং অনুকরণে প্রবৃত্ত হয়। নিম্নতর সমাজটি যদি উন্নত সমাজের রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের আওতায় পড়ে তাহলে এই সাংস্কৃতিক প্রভাব হয় আরও অনেক সুদূরপ্রসারী। সমগ্র সমাজ এইভাবে প্রভাবিত হওয়ার ফলে ভাষাও স্বভাবতঃই সেই প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়।

এইভাবে দেখা যায় যে বঙ্গোপসাগরে পর্তুগীজ আধিপত্যের যুগে কিছু পর্তুগীজ শব্দ বাঙলা ভাষায় এসেছে। তার পর কয়েক শতাব্দীর তুর্কী-পাঠান-মোগলদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ আধিপত্যের সময় অসংখ্য তুর্কী আরবী ফারসী শব্দ বাঙলা ভাষায় অঙ্গীভূত হয়েছে। এখানে একটি জিনিস খুবই উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে জমিজমা, খাজনা, কোর্ট-কাছারীর সাথে সম্পর্কিত যত শব্দ বাঙলায় প্রচলিত আছে সেগুলির প্রায় সবই ফারসী। এর কারণ মোগল আমলে নোতুনভাবে জমি জরীপ, ভূমি রাজস্বের ব্যবস্থা এবং বিস্তৃত শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রচলন হলো। এবং এসবের সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলি স্বভাবতই হলো রাজভাষা ফারসী ইংরেজ আমলেও ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত ফারসীই সরকারী ভাষা থাকার ফলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সত্ত্বেও জমিজমা রাজস্ব ইত্যাদি সংক্রান্ত শব্দগুলি ফারসীই রয়ে গেলো। বেশ কয়েক শতক ধরে এ শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়ে এমনভাবে আমাদের ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে যে, পশ্চিম বাঙলাতেও সেগুলিকে বাতিল করার কথা কেউ চিন্তা করে না। কিন্তু শুধু জমি ও রাজস্বের সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দ ছাড়াও অন্যান্য বহু আরবী ফারসী শব্দ সেকালের সাধারণ সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙলায় এসেছে। সেগুলিও বাঙলা হয়ে গেছে এবং তাদেরকেও বাতিল করার প্রশ্ন ওঠে না।

ইংরেজ রাজত্বে ফারসী শব্দের প্রচলন থাকলেও নোতুন ফারসী শব্দ আমদানী কিন্তু বেশী দিন অব্যাহত থাকলো না এবং ১৮৩৭ এর পর প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। যে কারণে বাঙলাতে ফারসী শব্দের আমদানী হয়েছিলো এবারে সেই কারণেই বাঙলায় শুরু হলো নোতুন ইংরেজী শব্দ আমদানীর। বৃটিশ বাণিজ্য, রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষা এবং ভাবধারার প্রসার ও প্রচলনের সাথে সাথে বহু শত ইংরেজী শব্দ বাঙলা হয়ে গেলো।

বাঙলা ভাষার উন্নতির যুগে বাঙলাদেশ বিদেশী রাষ্ট্রীয় শাসন ও সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত হওয়ার ফলে বাঙলাতে এত অধিক সংখ্যক বিদেশী শব্দের প্রচলন হয়েছে। অন্যথায় তা কিছুতেই সম্ভব হতো না।

বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙলা ভাষার উন্নতির এক নোতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। এ পর্যায়ে কি বাঙলা ভাষায় নোতুন বিদেশী শব্দ আমদানী হবে? এবং সেটা হলে আমরা কোন ভাষার দ্বারস্থ হবো, আরবী-ফারসীর, না জার্মান-ইংরেজীর, না অন্য কিছুর?

এক্ষেত্রেও ভাষার উন্নতি যে নিয়মতন্ত্রের অধীন সেই নিয়মসমূহের দ্বারাই বিদেশী শব্দের প্রচলন নিয়ন্ত্রিত হবে। পূর্বের কথার পুনরুক্তি করে এক্ষেত্রে আবার বলা চলে যে উন্নত ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ভাষায় শব্দ আমদানী হয়। উন্নত ভাষাটি যে সমাজের সেই সমাজের রাষ্ট্রীয় শাসন এই নিয়ন্ত্রণে খুব বেশী সহায়তা করে। অন্য পক্ষে অনুন্নত ভাষা থেকে শব্দ আমদানী করার কোন প্রয়োজন উন্নত ভাষায় থাকে না। তবে এই দুই ভাষার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে অনেক সময় উন্নত ভাষার মধ্যে কিছু সংখ্যক শব্দ অনুন্নত ভাষা থেকে আমদানী হতে পারে। যেমন ‘ডাকোয়েট’, ‘জগরনাট’, ‘ফকীর’, ‘ভারান্দা’ ইত্যাদি অল্পসংখ্যক ভারতীয় শব্দ ইংরেজীতে প্রচলিত হয়েছে। ইংরেজ কিন্তু বেশী ভারতীয় শব্দ নিজেদের ভাষায় আমদানী করার কথা কখনো চিন্তা করেনি এবং তার কোন প্রয়োজনও তাদের হয় নি।

আমরা আমাদের ভাষার ইতিহাসের এই নতুন অধ্যায়ে তাহলে কোন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করবো? এই প্রসঙ্গে প্রথমতঃ একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, যথেচ্ছভাবে বিদেশী শব্দের আমদানী ভাষার সত্যিকার উন্নতির পক্ষে ক্ষতিকর। কাজেই বাঙলাতে নোতুন বিদেশী শব্দের ব্যবহার সাবধানে ও সংযতভাবে করা দরকার। দ্বিতীয়তঃ ভাষার সত্যিকার উন্নতি সাধন করতে হলে এমন শব্দ ভাষায় আমদানী করা প্রয়োজন যেগুলি আমাদের শিক্ষা, গবেষণা, আর্থিক ও সমগ্র সাংস্কৃতিক জীবনের গঠনকার্যে সহায়ক হবে। এদিক বিচার করলে আমাদেরকে প্রয়োজনমতো ইউরোপীয় ভাষাগুলিরই আশ্রয় নিতে হবে। কারণ বর্তমান জগতে ইংরেজী, ফারসী, জার্মান, রাশান ইত্যাদি ভাষাতেই সর্বোচ্চ শিক্ষা এবং জ্ঞানের চর্চা আছে। যদি আমাদেরকে বিদেশী শব্দ একান্ত নিতেই হয় তাহলে তাদের থেকেই সেগুলি নিতে হবে।

এদিক দিয়ে বিচার করলে আরবী ফারসী শব্দ নোতুন করে আমাদের ভাষায় আমদানী এবং চালু করার প্রচেষ্টা নিরর্থক এবং মৃঢ়তাপ্রসূত। আরব ও ইরানী সমাজ বর্তমানে সাংস্কৃতিক উন্নতির যে পর্যায়ে আছে সেটা বাঙালী সংস্কৃতির থেকে কোন হিসাবেই উন্নত নয়। এবং আরব ইরানীদের কোন রাষ্ট্রীয় আধিপত্যও আমাদের উপর নেই। কাজেই আমাদের উন্নতির বর্তমান পর্যায়ে তাদের ভাষা থেকে নোতুন শব্দ আমদানী করা অথবা যে সমস্ত আরবী ফারসী শব্দ যথার্থভাবে বাঙলা ভাষায় অঙ্গীভূত না হয়ে এখনো কিছু কিছু আধাবাঙালীদের বাঙলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় সেগুলিকে গায়ের জোরে চালু করতে যাওয়া অন্ধ উন্মাত্ততারই নামান্তর। যে সব আরবী ফারসী শব্দ বাঙলা হয়ে গেছে সেগুলি আজ বাঙলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ। সেগুলি আমাদের ভাষায় প্রচলিত আছে এবং থাকবে। কাজেই বর্তমান আরবী ফারসী শব্দ নোতুন করে চালু করার প্রচেষ্টার সাথে আমাদের জীবনের কোন যোগ নেই। এ প্রচেষ্টা যারা করবে তারা বাঙলা ভাষার ইতিহাসে শুধু রক্ষণশীল নয়, প্রতিক্রিয়াশীল নামেই পরিচিত হবে। কেউ যদি এ জাতীয় শব্দ বোঝাই করে কাব্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা করে তাহলে সে কাব্য হবে ব্যক্তিগত অহমিকা এবং কুসংস্কারের মহাকাব্য। আমাদের জীবনে তার কোন স্থান নেই। কারণ এদেশেও জাতীয় ‘মহাকাব্যের যুগ শেষ হইয়াছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *