পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে বিদেশী প্রভাব
ইদানিং প্রায়ই দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকপত্র, সাহিত্যিক ভাষণ এবং মেঠো বক্তৃতায় এক শ্রেণীর লোক সংস্কৃতি প্রসঙ্গে কতকগুলি কথার পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন। তাঁদের এসব কথা বলার কায়দা অনেকটা শেখানো আবৃত্তি করার মতো এবং তাঁদের প্রধান বক্তব্য হলো দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিতে আমাদের জীবন প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। এতো ভালো কথা। কিন্তু সংস্কৃতির এই সব মুরুব্বীদের আলোচনা, সমালোচনা এবং গঞ্জনাজ্ঞাপক উক্তি থেকে প্রথমতঃ মনে হয় তাঁরা ছাড়া এদেশে অন্য সকলে যাঁরা সাহিত্য সঙ্গীত সংস্কৃতি চর্চা করছেন তাঁরা মঙ্গলগ্রহ এবং চন্দ্রলোকের জীবন চিত্রণে ব্যাপৃত। কিন্তু তাঁদের বক্তব্যকে আরও কিছুটা অনুসরণ করলে দেখা যাবে যে তাঁরা মঙ্গলগ্রহ অথবা চন্দ্রলোকের কথা বলছেন না। তাঁরা বলতে চান যে বিদেশী সংস্কৃতির কোন প্রভাব আমাদের জীবনে পড়তে দেওয়া হবে না এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিদেশী প্রভাবকে বর্জন ও প্রতিহত করতে হবে।
অনেকের কাছে এ জাতীয় কথা মনে হবে বিস্ময়কর। কারণ তাঁরা জানেন যে সংস্কৃতির সাথে জীবনযাত্রার যোগ স্বভাবতঃই নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্ন। কাজেই জীবনে যদি গতি ও চাঞ্চল্য থাকে, আমাদের দেশের জীবন যদি অন্যান্য দেশের সমাজ ও জীবনের সাথে বিভিন্ন সূত্রে যুক্ত হয় তাহলে সাহিত্য সংস্কৃতিতে সেই যোগাযোগ ও প্রভাব চিহ্নিত হতে বাধ্য। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এ প্রভাবকে রোধ করতে হলে তার একমাত্র উপায় আমাদের জীবনের সাথে অন্য সমাজ এবং অন্য দেশের যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন করা। অর্থাৎ সংস্কৃতিতে বিদেশী প্রভাব বন্ধ করতে হলে আমাদের দেশে বিদেশী চাল গম আমদানী বন্ধ করতে হবে; বিদেশী গাড়ী, বইপত্র, সিনেমা, প্রসাধন সামগ্রী এবং অন্যান্য জিনিসের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে হতে হবে নিষিদ্ধ। এ ছাড়া বন্ধ করতে হবে বিদেশীদের এদেশে আগমন এবং এদেশীয় লোকদের বিদেশ যাত্রা। এক কথায় আমাদের দেশটিকে পরিণত করতে হবে এমন একটি সামাজিক দ্বীপে যেখানে বিদেশী কাকপক্ষীর আকাশচারণও হবে অসম্ভব।
কিন্তু উপরোন্তু মুরুব্বীরা কি এই পথে অগ্রসর হচ্ছেন, না হতে চান? এদিকে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে তাঁরা এ পথে অগ্রসর হচ্ছেন না এবং হতে চান তার কোন সঙ্কেতও দেখা যাচ্ছে না। প্রথমতঃ একাজ সম্ভব নয় এজন্যে যে হাজার ইচ্ছে করলেও আজকের দুনিয়ায় কোন সমাজের জীবনই অন্যান্য সমাজের জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অথবা যোগাযোগহীন হতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ বিদেশী সামগ্রী ছাড়া মুরুব্বীদের নিজেদের জীবনযাত্রাই এখন আর সম্ভব নয়। বিদেশী গাড়ী, সিনেমা, প্রধাসন উপকরণ, কাপড়, ফ্রিজ, রেডিও, টেলিভিশন তাঁদের দরকার। এছাড়া তাঁদের অনেকে বিদেশের ‘নিষিদ্ধ পানীয় সেবনে এবং সস্তা মার্কিন ম্যাগাজিন চিত্রদর্শনে আসক্ত। কাজেই এসব জিনিসের আমদানী বন্ধ করার কথা বলতে তাঁরা নারাজ। কিন্তু এ কাজ করতে রাজী না হলে বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাব প্রতিরোধ করা যাবে কেমন করে?
এবার দেখা যাবে যে আসলে তাঁদের মনে এ জাতীয় বিদেশী প্রভাব বন্ধ করার প্রশ্ন নেই। ধর্মশাস্ত্রে যাই থাক স্কটল্যাণ্ডীয় সোমরস, মার্কিনী সিনেমা এবং মার্কিন ম্যাগাজিনের ইন্দ্রিয়হর্ষক চিত্র তাঁদের এতই মজ্জাগত যে, সেগুলিকে বিদেশী বা ধর্মবিরোধী বলে তাঁদের মনে হয় না। কাজেই এদেশীয় লোকেরা মার্কিনী কায়দায় ঘোরাফেরা এবং জীবন যাপন করলেও কোন ক্ষতি নেই। তাতে দেশীয় সংস্কৃতি বিপন্ন হয় না।
আমাদের সংস্কৃতি তাহলে বিপন্ন হয় কিসে? এর উত্তরে তাঁরা বলবেন জ্যাজ ও চাচাচার বদলে কীর্তন, অতুলপ্রসাদ ও রবীন্দ্রনাথের গানে; শার্টপ্যান্টের পরিবর্তে ধুতীচাদরে; লিপষ্টিকের বদলে কপালের টিপে; লাইফের নগ্নচিত্রের পরিবর্তে অবনী ঠাকুর যামিনী রায়ের ছবিতে; এবং ফ্রাঙ্কলিন প্রকাশনীর ‘সাহিত্য সম্পদের’ পরিবর্তে ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশের সাহিত্যে।
উপরের অঙ্কিত বিপদের চিত্র থেকে সহজেই বোঝা যাবে যে বিদেশী প্রভাব বলতে এই সব মুরুব্বীরা আসলে যে প্রভাবের কথা বলতে চান সেটা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাষ্টের আগে পর্যন্ত সমগ্র বাঙালী ‘বিদেশী’ প্রভাব থেকেই তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে চান। কারণ তার সাথে নিজেদের যোগকে ছিন্ন করতে না পারলে আমাদের নাকি পরিত্রাণ নেই।
মুরুব্বীদের মতানুসারে উপরোল্লিখিত ‘বিদেশী’ প্রভাব বর্জন করতে হবে তার কারণ সেই প্রভাব ‘ইসলাম’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের তমদ্দুন’ এবং ‘পাকিস্তান’ বিরোধী।
যে সকল বিদেশী প্রভাব আজ আমাদের সমাজে সব থেকে বেশী কার্যকরী এবং যেগুলিকে প্রতিরোধ অথবা বর্জন করার কোন সঙ্কল্প এবং প্রস্তুতি তো নেইই উপরন্তু যাদের অবাধ রাজত্বকে এদেশে সক্রিয়ভাবে সাহায্য ও প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে সেগুলির চরিত্র বিচার করলেই ইসলাম এবং পাকিস্তানের প্রতি মুরুব্বীদের আনুগত্যের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে। মার্কিনী এবং অন্যান্য পশ্চিমদেশীয় সিনেমা শিল্পের অনুকরণে এদেশে যে সিনেমা শিল্প গড়ে উঠছে তার সাথে ইসলামের এবং আমাদের সংস্কৃতির যোগ কোথায়? এসব ছায়াছবির মাধ্যমে যে উগ্র ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, বিকৃত সমাজদৃষ্টি এবং কুৎসিৎ মনোবৃত্তির সৃষ্টি ও প্রসার হচ্ছে তার সাথে ইসলামের তত্ত্বগত সম্পর্ক কি এবং পূর্ব পাকিস্তানের জীবনচিত্র তার মধ্যে আজ কিভাবে প্রতিফলিত? এর মাধ্যমে যা প্রতিফলিত হচ্ছে সেটিকে আমাদের সমাজের চিত্র হিসাবে বর্ণনা করার থেকে অপমানকর আমাদের পক্ষে আর কি হতে পারে? কিন্তু তবু এ জাতীয় সিনেমা শিল্পই এখন অপ্রতিহতভাবে আমাদের সমাজে বিস্তার লাভ করছে এবং মুরুব্বীদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতাতেই তা সম্ভব হচ্ছে।
কাজেই মুখে তাঁরা যাই বলুন নিজেদের কর্মের মধ্যে দিয়ে তাঁরা ইসলাম এবং এদেশীয় সংস্কৃতির বিরোধিতাই করছেন। দূষিত মার্কিনী প্রভাবের রাজত্ব কায়েম করে তাঁরা এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করছেন।
কেবলমাত্র মার্কিনী সিনেমা আমাদের দেশে আমদানী করে এবং তার প্রভাবের আওতায় এ দেশের সিনেমা শিল্প গঠনে সাহায্য করেই তাঁরা ক্ষান্ত নন। অজস্র বিদেশী মুদ্রার বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যে মার্কিন সাময়িকপত্রগুলি আমদানী হচ্ছে তাদের মধ্যে সুস্থ সংস্কৃতির বদলে উৎকট নৈতিক নৈরাজ্যই বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ জাতীয় সাময়িক পত্র আমাদের দেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশকেই যে রুদ্ধ করছে তাই নয় এগুলির দ্বারা আমাদের সমগ্র নৈতিক জীবনই আজ বিপন্ন। এবং মুরুব্বীদের সক্রিয় সমর্থনেই এই ‘মহৎ’ কাৰ্য সম্পন্ন হচ্ছে।
মার্কিন তথ্য সরবরাহ বিভাগ ও ফ্রাঙ্কলিন প্রকাশনীর উদ্যোগে যে বইগুলিকে আজ এদেশে সম্ভ্রান্ত প্রকাশনা বলে পরিচিত করার চেষ্টা হচ্ছে সেগুলির মধ্যে উচ্চ মানের সাহিত্য ও সত্যিকার শিক্ষা বিষয়ক বইপত্র নিতান্তই নগণ্য। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে মার্কিনদেশীয় ভাল নাটক, নভেল ও অন্যান্য লেখা তারা বিশেষ প্রকাশ করে না। যে বিকৃত সাংস্কৃতিক প্রচার সাহিত্য তারা প্রকাশ করে সেগুলি আমাদের ‘নিজস্ব’ সংস্কৃতির বিকাশে কোন অর্থে সহায়ক? যদি সহায়ক না হয় তাহলে তাদেরকে এদেশে প্রকাশনার অনুমতি ও সুযোগ দেওয়া হয় কেন, মুরুব্বীরা কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলতে নারাজ।
এ জাতীয় বিদেশী প্রভাবের উদাহরণ অনেক দেওয়া চলে। কিন্তু উপরে যে কটির উল্লেখ করা হলো তার দ্বারাই স্পষ্ট বোঝা যায় যে ‘স্বদেশের সংস্কৃতি’, ‘দেশের জীবনচিত্র’, ‘ইসলাম’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের তমদ্দুন’ ইত্যাদির জন্যে মুরুব্বীদের জীবন উৎসর্গীকৃত এই ঘোষণা বার বার উচ্চারিত হলেও এগুলির মূলোচ্ছেদ যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে তাঁদের কোন বিক্ষোভ নেই। বস্তুতঃপক্ষে অস্বাস্থ্যকর বিদেশী প্রভাবের বন্যায় নিজেরাই অনেকে ভেসে চলেছেন।
এবার তাহলে দেখা যাক লিপস্টিকে যদি মুসলমানদের জাত বজায় থাকে তাহলে কপালে টিপ দিলে তাদের জাত যাবে কেন, পশ্চিমী চিত্র-শিল্পীদের ছবি দেওয়ালে টাঙালে যদি আমাদের সংস্কৃতি বিনষ্ট না হয় তাহলে অবনী ঠাকুর, যামিনী রায়ের ছরিতে তা বিনষ্ট হবে কেন? ফ্রাঙ্কলিন-মার্কা মার্কিনী সাহিত্য আমদানী করলে পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা যদি বিপন্ন না হয় তাহলে বিশ্বভারতীয় বই পত্রে হবে কেন? এদেশের উচ্চশ্রেণীর ক্লাবে হোটেলে পশ্চিমী নাচ যদি স্বদেশী সংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক না হয় তাহলে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের দ্বারা সে বিপদপাত হবে কি কারণে?
কপালের টিপের থেকে লিপষ্টিক, অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়ের থেকে ভ্যান গগ্-প্যল-গঁগা, বিশ্বভারতীর থেকে ফ্রাঙ্কলিন, রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের থেকে ওয়াজ-চাচাচা কোন অর্থে ‘ইসলাম’, ‘মুসলিম সংস্কৃতি’ অথবা ‘পাক বাঙলা’র কালচারের নিকটতর আত্মীয়? কার সাথে কার আত্মীয়তা বেশী একথা মুরুব্বীদেরও অজানা নেই। কিন্তু সেটা জানা থাকলে এক্ষেত্রে তাঁদের আসল বক্তব্য কি এবং তাঁদের সত্যিকার উদ্বেগটি কোথায়?
পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিক্ষেত্রে বর্তমানে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়েছে তার ফলে এক শ্রেণীর লোকের স্বার্থ আজ বিপন্ন। তাঁরা ধর্মের ব্যবসা করেন এবং সাম্প্রদায়িকতা তাঁদের এই ব্যবসার প্রধান মূলধন। এই ব্যবসায়ীদেরকে এমন অনেকেই আবার সাহায্য ও সমর্থন করেন যাঁরা নিজেরা ধর্মের ব্যবসা না করলেও নানা প্রকার ধর্মীয় সংস্কারের প্রতাপে সঙ্কুচিত। বিদেশী বলতে তাঁরা সকলেই সত্য অর্থে বৈদেশিক কোন কিছু বোঝেন না। তাঁদের মতে বিদেশীয় অর্থ হিন্দু। এদেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দুর প্রতি এই মনোভাব সগৌরবে প্রকাশ করে তাঁরা নিজেরাই ভয়াবহভাবে পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংহতিকে বিপন্ন করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গীর ফলেই সমগ্র বাঙলার হাজার বছরের বিশিষ্ট সংস্কৃতিকে তাঁরা আজ পশ্চিম বাঙলার সংস্কৃতি এবং ‘বিদেশী’ বলে চালাতে আগ্রহশীল। এজন্যেই মাইকেলের সাহিত্যকেও ‘বিদেশী’ আখ্যা দিতে তাঁদের বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ অথবা লজ্জা নেই। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে বিদেশী প্রভাব প্রতিরোধ করার অর্থ যা কিছুর সাথে বাঙলাদেশের হিন্দুদের সম্পর্ক তাকে বর্জন ও প্রতিরোধ করা। এই হলো তাঁদের সত্যিকার বক্তব্য।
কিন্তু কোন্ উদ্বেগের থেকে এই বক্তব্যের উদ্ভব? এর উত্তরও অতিশয় সহজ। অন্যান্য কথা বাদ দিয়ে শুধু সংস্কৃতির কথা ধরলেও দেখা যাবে যে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে হিন্দু বিতাড়ন না হলে মুরুব্বীদের নিজেদের ব্যবসা এবং রাজ্যবিস্তার ঠিকমতো সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া জোনাকীর রাজত্ব কায়েম করতে হলে চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র তাড়াতেই হবে। কাজেই তারা আজ বাঙলাদেশের ঊনিশ শতকের সংস্কৃতি ও সাহিত্য সাধনাকে ‘বিদেশী’ আখ্যা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়ন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। যাঁরা তাঁদের সাথে এ ব্যাপারে একমত নন তারা নাকি পাকিস্তান বিরোধী রাষ্ট্রদ্রোহী!
মুরুব্বীদের ব্যবসাবুদ্ধি অস্বীকার করবে কে?