গোর্কী জন্মশতবার্ষিকীতে
ম্যাক্সিম গোর্কীর মতো সাহিত্য প্রতিভা পৃথিবীতে বিরল নয়। কিন্তু সাহিত্য ক্ষেত্রে একদিক দিয়ে তিনি সর্বপ্রথম ব্যতিক্রম এবং সেই হিসেবে এক নোতুন ধারার প্রবর্তক। শিল্প- সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কলাকৈবল্যবাদ নামে যে শঠতা প্রচলিত আছে তার প্রধান কথা হলো শিল্পী- সাহিত্যিক ও অন্যান্য সংস্কৃতিসেবীরা সমাজের মধ্যে বসবাস করলেও তাদের সাধনা ও সৃষ্টির সাথে সমাজের কোন প্রয়োজনীয় সংযোগ নেই। অর্থাৎ সৃষ্টিকালে শিল্পী আকাশবিহারী হন এবং এমন এক কল্পলোকে বিচরণ করেন. যেখানে মানবিক ও সামাজিক সমস্যার তেমন কোন স্থান নেই। এই শিল্পদর্শন অনুসারে সৃষ্টিকালে শিল্পীর পক্ষে সামাজিক অবস্থার কথা চিন্তা করে নিজের প্রতিভাকে পীড়িত করা অথবা আমাদের পক্ষে শিল্পীকে তাঁর কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়া, এ দুইই শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অত্যন্ত মারাক্তক। এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে শিল্পের উন্নতি না হয়ে তার অপমৃত্যু ঘটে। কাজেই শিল্পীদের প্রতি তাঁদের নির্দেশ ‘কলাকে কৈবল্য জ্ঞান করে শিল্প সৃষ্টি করো।’
এই বুর্জোয়া শিল্পাদর্শকে সচেতনভাবে অমান্য ও লঙ্ঘন করেই গোর্কী-সাহিত্যের সৃষ্টি। সাহিত্য অথবা শিল্পচর্চা গোর্কীর কাছে অবসরক্লান্ত মানুষের বিলাসিতা নয়। তাঁর কাছে এ হলো মানুষের সামগ্রিক জীবন-চর্চারই একটি বিশেষ অঙ্গ।
এ জন্যে বৃহত্তর জীবণক্ষেত্রের আন্দোলন ও গতি থেকে সাহিত্যিক শিল্পী হিসাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না। তাই সমাজ-নিরপেক্ষ সাহিত্য বলে আসলে কিছু নেই। এমন কি কলাকৈবল্যবাদের নামে যে সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা হয় সে সাহিত্যও সমাজের ঊর্ধ্বে ওঠে না। উপরন্তু সমাজেরই এক বিশেষ শ্রেণীর জীবনযাত্রাকে নানাভাবে টিকিয়ে রাখতে যত্নশীল হয়। সমাজের সাথে সাহিত্যের সংযোগের কথা গোর্কীর আগে কোন শিল্পী উপলব্ধি করেননি তা নয়। অনেকেরই মধ্যে সে উপলব্ধি এসেছে এবং তাঁদের সাহিত্যের মধ্যে নানা সামাজিক সমস্যার চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। গোর্কীর সাথে তাঁদের পার্থক্য এই যে, অন্যান্যদের থেকে সমাজ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের পরিধি এবং চরিত্র অনেকখানি স্বতন্ত্র। মানুষে মানুষে সম্পর্কের আসল বুনিয়াদ যে সমাজের আর্থিক ব্যবস্থা, তার উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতি, এ বোধ গোর্কীর পূর্বে অন্য কোন সাহিত্যিকের সার্থকভাবে ছিলো না। গোর্কীসাহিত্যের সমাজমুখিতা তাই শুধু তাঁর সংবেদশীলতা থেকে জন্ম লাভ করেনি। সমাজচরিত্রের উপলব্ধিই তার সত্যিকার জনক।
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেণীসংগ্রামে মানব সমাজ দ্বিধাবিভক্ত। এর একদিকে তারা, যারা উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যের পরিশ্রমের ফল ভোগ করে এবং অবসরযাপনের জন্যে নানা বিলাসিতায় মগ্ন থাকে এবং অন্যদিকে থাকে তারা, যারা নিজেদের শ্রমের দ্বারা গড়ে তোলে ধনিকশ্রেণীর নিশ্চিত জীবন ও সভ্যতার বিবিধ উপকরণ, যারা শোষিত হয়, যাদের অবসর বলতে কিছু নেই।
গোর্কী নিজে এই দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত এবং সমাজকে শোষণমুক্ত করার উদ্দেশ্যেই তাঁর সাহিত্যসাধনা। কিন্তু তিনি করুণার বশে এ কাজ করেননি। কারণ, করুণার বশবর্তী হয়ে কিছু করা অথবা করুণা গ্রহণ করা, এ দুইই মানবচরিত্রকে কলুষিত করে, মানুষে মানুষে সম্পর্ককে উন্নত না করে তার অবনতি ঘটায়। এজন্যে তাঁর সাহিত্যে করুণা নেই, নেই অক্ষম অশ্রুপাত। নিজের সাহিত্য সাধনার মধ্যে দিয়ে তিনি মানুষের মনে সঞ্চার করতে চেয়েছেন চেতনা ও শক্তি, যার মহিমায় তারা নিজেদের অবস্থা বিবেচনা করে চোখের পানি ফেলবে না, সে অবস্থাকে চিরন্তন মনে করে বসে থাকবে না। তারা উপলব্ধি করবে যে মানুষের মধ্যে শোষণ-শাসনের সম্পর্ক সর্বাংশে পরিবর্তনসাপেক্ষ এবং সে পরিবর্তনের জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত জ্ঞান, চেতনা এবং দুর্বার সাহস। সমাজের প্রতি সাহিত্যিকের দায়িত্ব তিনি নিজে সম্পন্ন করেছিলেন, শুধু সেজন্যে নয়, অন্যদেরকেও সে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সচেতন এবং উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলোন বলেই গোর্কী-সাহিত্যের এতো গুরুত্ব। এজন্যেই তিনি সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদী সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা।