ভাষা ও বানান সংস্কারের রাজনীতি

ভাষা ও বানান সংস্কারের রাজনীতি

ভাষা ও বানান সংস্কার নিয়ে এখন যে বিতর্ক চলছে সেটা নোতুন নয়। পূর্ব বাঙলায় ভাষা আন্দোলনের গোড়াতেই এ বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিলো। তাছাড়া এর একটা পূর্ব ইতিহাসও আছে। কিন্তু সে পূর্ব ইতিহাসের সাথে পাকিস্তানোত্তর সংস্কার আন্দোলনের অনেক পার্থক্য। পূর্বে বানান সংস্কার-প্রচেষ্টা কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষিত মহলের একটি ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কারের জন্য সেকালে একটি কমিটিও নিয়োগ করেছিলো। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী অধ্যায়ে এই সংস্কার-প্রচেষ্টা সাংস্কৃতিক থেকে রাজনৈতিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এজন্যেই দেখা যায় যে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর দাবী এবং বাঙলা ভাষার হরফ পরিবর্তনের দাবী একই সময়ে এবং একই সূত্র থেকে উত্থিত।

পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৪৭ সাল থেকেই বাঙলা হরফ পরিবর্তনের আওয়াজ তোলেন। সে সময় ভাষার দাবীতে জনমত যথাযথভাবে গঠিত না হওয়ার ফলে ভাষার ক্ষেত্রে সরকারী বক্তব্য পরবর্তীকালের থেকে অনেক বেশী বেপরোয়া ছিলো। সেজন্যে ফজলুর রহমান হরফ সংস্কারের কথা না বলে সোজাসুজি বাঙলা হরফ বাদ দিয়ে আরবী হরফকে তার স্থলাভিষিক্ত করার প্রস্তাব করেন। এ ব্যাপারে তাঁর প্রধান যুক্তি ছিলো এই যে, বাঙলা অক্ষর পুরোপুরি দেবনাগরী থেকে সৃষ্টি, কাজেই সে হরফ হিন্দু। অর্থাৎ হিন্দু হরফ দিয়ে কোন মুসলমানী ভাষা সম্ভব নয়, কাজেই বাঙলা ভাষার ‘ধর্মান্তরের’ জন্যে তার হরফের ধর্ম পরিবর্তন অপরিহার্য।

শুধু আরবী হরফই নয়, কোন কোন ‘সংস্কারক’ আবার ‘অবৈজ্ঞানিক’ বাঙলা অক্ষর বাদ দিয়ে রোমান হরফ প্রবর্তনেরও সুপারিশ করেন। আরবী হরফ যেমন বাঙলা ভাষকে ইসলামী চরিত্র দান করবে, রোমান হরফ তেমনি নাকি বাঙলা ভাষাকে দাঁড় করাবে একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর।

‘ইসলাম’ এবং ‘বিজ্ঞানের’ এই জয়যাত্রা কিন্তু ব্যাহত হলো। কারণ সরকার এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল মহলের প্রথম প্রস্তাব রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধেই ১৯৪৮ সালে ছাত্র এবং শিক্ষিত সমাজের এক বিরাট ও প্রভাবশালী অংশ রুখে দাঁড়ালো। শুরু হলো পূর্ব বাঙলার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়। এবং সেই আন্দোলনের তুফানে হরফ সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে কেউই আর মাথা ঘামালো না।

কিন্তু ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পর হরফের প্রশ্ন আবার তোলা হলো। ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাঙলা সরকার মৌলানা আকরম খানের সভাপতিত্বে যে ভাষা কমিটি নিয়োগ করেন সে কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিলো হরফ সংস্কার প্রশ্ন বিবেচনা করে সরকারের কাছে উপযুক্ত সুপারিশ পেশ করা। উপর্যুক্ত কমিটি ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে তাঁদের রিপোর্ট পূর্ব বাঙলা সরকারের কাছে দাখিল করেন। কিন্তু সরকার জনমতের কথা স্মরণ করে রিপোর্টটি অনির্দিষ্টকালের জন্যে চাপা দেন। পার্লামেন্টারী প্রথা উচ্ছেদের পর ১৯৫৮ সালে এই রিপোর্ট প্রথম প্রকাশিত হয়।

রিপোর্টটিতে কতকগুলি উদ্বেগ অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা যায় এবং সেই উদ্বেগের তাগিদে কমিটি কতকগুলি উদ্ভট সুপারিশ করেন। তাঁদের প্রথম ও প্রধান উদ্বেগ হলো বাঙলা ভাষায় হিন্দু ও সংস্কৃত প্রভাব। এই প্রভাব উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে তাঁদের বিবিধ রকম সুপারিশ যেমন—হিন্দু-ধর্ম, পুরাণ ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দ ও বাক্যরীতি বর্জন এবং অসংস্কৃতি ও ইসলামী ভাবধারা প্রচলন (উদাহরণ : ‘আমি তোমায় জন্মাজন্মান্তরেও ভুলিব না’র স্থলে ‘আমি তোমায় কেয়ামতের দিন পর্যন্ত ভুলিব না’ ইতাদি)।

তাঁদের দ্বিতীয় উদ্বেগ বাঙলা ভাষার অসরলতা। বর্তমানে প্রচলিত বাঙলা ভাষা এতো কঠিন যে, সে ভাষায় কোন গুরুতর আলোচনা সাধারণ মানুষের পক্ষে কিছুতেই বোধগম্য হওয়ার উপায় নেই। কাজেই তার সরলীকরণ প্রয়োজন। এরজন্যে তাঁরা বাঙলাকে সরল করে ‘সহজ বাঙলা’ নামে এক ধরনের গদ্য রচনার প্রস্তাব করেন (উদাহরণ : ‘মাসের পরিসমাপ্তিতে ঋণ শোধ করিব’র স্থলে ‘মাস কাবারিতে দেনা বা করজ আদায় করিব’)। [১]

[১. উদাহরণগুলি কমিটির রিপোর্ট থেকে গৃহীত]

কমিটির তৃতীয় উদ্বেগ বাঙলা হরফের অবৈজ্ঞানিক চরিত্র এবং অনুপযোগিতা। প্রথমতঃ এই হরফগুলির সংখ্যা এতো অধিক যে, টাইপ রাইটারে সেগুলির ব্যবহার এক দুরূহ ব্যাপার। দ্বিতীয়তঃ, তা কোমলচিত্ত শিশু এবং সরলপ্রাণ জনসাধারণের শিক্ষার পক্ষে বাধাস্বরূপ। কাজেই তার জন্যে তাঁদের সুপারিশ বাঙলা ভাষার একরাশি অক্ষরকে বর্জন করা।

উপরোক্ত তিনটি উদ্বেগ এবং তার থেকে উদ্ভূত তিন প্রকার প্রস্তাবই এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথম প্রস্তাবটির মধ্যে যে ভাষাগত কোন যুক্তি নেই তা স্পষ্ট! রাজনৈতিক উদ্বেগ থেকেই এই প্রস্তাবের সরাসরি উদ্ভব। দ্বিতীয় প্রস্তবটিতে ধরে নেয়া হয়েছে যে, ‘জনসাধারণ’ চিরকাল অশিক্ষিত ‘সরলপ্রাণ’ জনসাধারণই থাকবে। তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির মান কোনদিনই উন্নত হবে না। কাজেই তাদেরকে উন্নত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না করে শিক্ষাদীক্ষাকে তাদের বর্তমান বোধশক্তির আয়ত্তের মধ্যে এনে দাঁড় করাতে হবে। এ প্রস্তাবটির প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রও সহজেই লক্ষণীয়। কমিটির তৃতীয় প্রস্তাব হরফ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সেই একই প্রশ্ন। হরফের সংখ্যা বেশী হওয়ার জন্যে টাইপ করতে অসুবিধা হয় কাজেই হরফ বদলাতে হবে। এ যুক্তি দেখে মনে হয় মানুষ যন্ত্র আবিষ্কার করেনি। যন্ত্র আকাশ থেকে পতিত হয়েছে এবং তার কোন পরিবর্তন অথবা উন্নতি সম্ভব নয়।

যন্ত্রকে আমাদের ভাষার উপযোগী করার পরিবর্তে আমাদের ভাষাকে যন্ত্রের উপযোগী করার এই সুপারিশকে বলা যেতে পারে অতি উন্মাদ অথবা অতিশয় দূরভিসন্ধিমূলক। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, চীনা এবং জাপানীরা এখনো তাদের ভাষায় কোন টাইট রাইটার ব্যবহার করে না। কাজেই টাইপ রাইটার ছাড়া আমাদের উন্নতির কোন উপায় নেই এ আশঙ্কাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

কমিটির তৃতীয় প্রস্তাবের আর একটি কারণ এই যে, বাঙলা হরফ কঠিন এবং অবৈজ্ঞানিক হওয়ার জন্যে শিশু এবং অধিক বয়স্ক জনসাধারণের পক্ষে সে বর্ণমালা আয়ত্ত করা খুবই দুঃসাধ্য। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের শিশুরা এই অক্ষরগুলিই শিখে এসেছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের পক্ষে সেটা সম্ভবও হয়েছে। বর্তমানে লেখাপড়া, শিক্ষাদীক্ষায় পূর্বের মতো উচ্চমান বজায় রাখা সম্ভব না হওয়ার কারণ অক্ষর সমস্যা, এ কথা মনে করা চূড়ান্ত মূর্খতার পরিচায়ক। চীনাদের সাংকেতিক অক্ষরগুলি আমাদের থেকে শতগুণ অবৈজ্ঞানিক হলেও জনশিক্ষা তাদের মধ্যে আমাদের থেকে দ্রুততরভাবে এবং বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই কী কারণে, এদেশে শিক্ষা আজ সহজ ও সুচারুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না সেটা বোঝার জন্যে হরফকে রেহাই দিয়ে সরকারী শিক্ষা নীতি ও সমাজের সাধারণ অবস্থায় দিকে নজর দিলেই সমস্যার আসল চেহারা চোখে পড়বে।

বর্তমান প্রবন্ধে ১৯৫০ সালের ভাষা কমিটির সুপারিশের বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ নেই। তবে রিপোর্টটিতে যে উদ্বেগগুলি ব্যক্ত এবং যে প্রশ্নগুলি উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলি মৌলিক এবং তাদের জারিজুরি আজ পর্যন্ত অব্যাহত। এখানেই কমিটির সুপারিশগুলির গুরুত্ব।

যে সাহসের অভাবে ১৯৫০ সালে রিপোর্টটি সাধারণের সামনে প্রকাশ করা হয়নি, সেই সাহসের আবির্ভাবেই ১৯৫৮ সারে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। সেই থেকেই ভাষা ও বানান সংস্কার আন্দোলনের নোতুন সূত্রপাত।

পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার মতো বাঙলা ভাষারও বর্ণমালার কিছু সংস্কার যে প্রয়োজন, একথা এক হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত। আগেই বলা হয়েছে যে দেশ বিভাগের পূর্বেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা ও হরফ সংস্কারের জন্যে একটি কমিটি নিয়োগ করেছিলেন। এছাড়া অন্যান্য অনেকের মতো রবীন্দ্রনাথ হরফ নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা এবং ইচ্ছেমতো তার ব্যবহার করে গেছেন। কিন্তু ব্যাপকভাবে কোন সংস্কার প্রস্তাবকেই কখনো কার্যকরী করা হয়নি। সেটা না করার কারণ উপযুক্ত আর্থিক, সামাজিক ও কারিগরী উন্নতির অভাব। সোজা কথায় বলতে গেলে অতো বড়ো একটা পরিবর্তন সাধন করার জন্যে যে সাধারণ প্রস্তুতির প্রয়োজন, তৎকালীন সমাজের তা ছিলো না।

কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজের কি তা আছে? আজকের ভাষা সংস্কারের বিতর্কে এটাই হলো সব থেকে বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর আলোচনার জন্যে প্রশ্নটিকে মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত করা দরকার। প্রথমতঃ, দেখতে হবে যে, আমরা আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির এমন পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছি কিনা, যখন হরফ সংস্কার ব্যতীত আমাদের উন্নতির আর কোন সম্ভাবনা নেই। দ্বিতীয়তঃ, আমরা বর্তমান পর্যায়ে যদি এ ধরনের কোন সংস্কার করতে উদ্যোগী হই – আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার কি প্রভাব পড়বে। তৃতীয়তঃ, বর্তমান পর্যায় এসব প্রস্তাবকে সার্থকভাবে যদি কার্যকরী করা না হয়, তাহলে তার ফলে সমগ্র সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে হতবুদ্ধিতা এবং নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে তার মুনাফাভোগী কে হবে। এই তিনটি প্রশ্নের আলোচনার মাধ্যমেই আমরা বর্তমান ভাষা ও বানান সংস্কার আন্দোলনের প্রকৃত চরিত্র ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো।

প্রথম প্রশ্নের আলোচনা প্রসঙ্গে দেখতে হবে উন্নতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতদূর অগ্রসর হয়েছি। সাংস্কৃতিক জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, পূর্ব পাকিস্তানী লেখক- সাহিত্যিকদের মধ্যে স্বাধীনতা-উত্তরকালে কিছুটা নোতুন উৎসাহ-উদ্যম সত্ত্বেও বিগত একুশ বছরে এখানে সাহিত্যের উন্নতি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কথাসাহিত্যের সাধারণ দারিদ্র্যের কথা স্মরণ করলে একথা বোঝার সুবিধা হবে। কিন্তু শুধু কথাসাহিত্য কেন, সাহিত্য সংস্কৃতির কোন এলাকাতেই এমন উন্নতি সাধিত হয়নি, যার ফলে একথা বলা চলে যে হরফ সংস্কার আমাদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে হরফকে নিয়ে রবিঠাকুর, নজরুল ইসলাম সুখে-স্বচ্ছন্দে ঘর করতে পেরেছেন এবং আজও বাঙলাদেশের কবি সাহিত্যকেরা ঘর করছেন, তাকে ঘরছাড়া করার কোন সত্যিকার প্রয়োজনই বস্তুতঃপক্ষে আমাদের সমাজে এখনো পর্যন্ত অনুভূত হয়নি। এমন কোন্ লেখক আমাদের দেশে আছেন যিনি দাবী করতে পারেন যে, তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা বাঙলা হরফের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? এই দাবী কেউ করলে বানান সংস্কার আন্দোলনের পাণ্ডারা নিজেরাই তাঁকে বিদ্রূপবাণে বিদ্ধ করবেন। কারণ হরফ সম্পর্কে এই অভিযোগ সত্যিই হাস্যকর।

ব্যবসা-বাণিজ্য আর্থিক জীবনের ক্ষেত্রে বাঙলা হরফ উন্নতির পক্ষে বর্তমানে বাধাস্বরূপ, এ বক্তব্যেরও কোন ভিত্তি নেই। প্রথমতঃ, অক্ষর বাধাস্বরূপ হয়তো হতে পারে তখনই, যখন আমরা আমাদের সমস্ত কাজকর্ম বাঙলা ভাষার মাধ্যমে সম্পন্ন করবো। প্রথম ধাপ সেটাই। কিন্তু বাঙলা ভাষার এ ধরনের ব্যবহারই যেখানে নেই, সেখানে বাঙলা অক্ষর উন্নতির প্রতিবন্ধক হয় কোন্ হিসাবে? টাইপ-রাইটারের উল্লেখ করে বলা হয় যে সংখাধিক্যের কারণে বাঙলা অক্ষরগুলি টাইপ রাইটারের পক্ষে অনুপযোগী। উপযোগিতার প্রশ্ন বাদ দিয়ে এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, পূর্ব পাকিস্তানে বাঙলা টাইপ রাইটারের সংখ্যা কতো? খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে যে তাদের সংখ্যা দুই এক ডজনের বেশী নয়। সমগ্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সংখ্যা মাত্র দুই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে ব্যবসা- বাণিজ্য, অফিসের কাজকর্ম ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাঙলার ব্যবহার কতখানি হচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা চলে। কাজেই ভাষার ব্যবহারই যেখানে নেই, সেখানে বাঙলা অক্ষর উন্নতির প্রতিবন্ধক, একথা বলার উদ্দেশ্য কি?

বাঙলার ব্যবহার যে উচিতমতো হচ্ছে না, এমনকি শিক্ষার মাধ্যমে হিসেবেও আজ পর্যন্ত বাঙলাকে সার্থকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না, তার বিশেষ কতকগুলি কারণ আছে। প্রধান কারণ শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং আর্থিক জীবনের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন সাধন করার উপযুক্ত অবস্থার অভাব। বাঙলাকে সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যমে হিসাবে চালু করতে হলে তার জন্যে প্রয়োজন উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত ব্যবহৃত বইপত্রগুলিকে বাঙলায় অনুবাদ করা এবং নোতুন পুস্তক প্রণয়ন করা। আমাদের শিক্ষিত মহলের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং সর্বোপরি দেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এমন নয়, যাতে করে আমরা একাজ এখন সম্পন্ন করতে পারি। তার জন্যে যে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের প্রয়োজন তারও আজ নিতান্ত অভাব। এ জন্যেই দেখা যায় যে, নিম্ন পর্যায়ে, এমনকি বিএ ক্লাস পর্যন্ত বাঙলার মাধ্যমে পড়াশোনা করে এসেও ছাত্রেরা পাঠ্য বিষয়বস্তুর সাথে তেমনভাবে পরিচিত হয় না। এর কারণ এই যে বাঙলা ভাষাতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই খুব কম এবং যা আছে তারও মান নিতান্ত নীচু। এর ফলে ছাত্রেরা এমএ পড়তে এলেও তাদেরকে পড়ানোর বিশেষ কিছু থাকে না। তাদের বোধশক্তি স্তিমিত হয়ে আসে এবং তারা মুখস্ত করে পরীক্ষা পাশ করে। এর দ্বারা প্রকৃত শিক্ষা তো হয়ই না, উপরন্তু এই অর্ধশিক্ষিত যুবকরাই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে শিক্ষার মানকে ক্রমাগত নীচের দিকে নামিয়ে নিয়ে যায়। শিক্ষার এই সমস্যার সাথে পাঠ্য তালিকার সমস্যাও জড়িত। অতি অল্প বয়স থেকে ছাত্রদের ঘাড়ে এখন যে অসংখ্য পাঠ্যবিষয় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে তাদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ অথবা জ্ঞানের পরিধির বিস্তৃতি, কোনটাই হচ্ছে না। দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রদেরকে যদি পৌরনীতি, বিজ্ঞান, দীনিয়াত, ইতিহাস, ভূগোল, স্বাস্থ্য ইত্যাদি পড়তে বাধ্য করা হয়, তাহলে তাদের পক্ষে ভাষা ও গণিত শিক্ষা উপযুক্তভাবে সম্ভব হয় না। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে এই দুইয়ের গুরুত্বই সর্বাধিক। ভাষা যদি কোন ছাত্র ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারে, তাহলে দুই তিন ক্লাস উপরে উঠে উপর্যুক্ত বিষয়গুলি আয়ত্ত করতে তার বিশেষ কষ্ট অথবা অসুবিধা হয় না। কিন্তু নীচের ক্লাসে অন্যান্য বিষয় পাঠের চাপে ভাষা অথবা গণিত শিক্ষা তাদের দ্বারা ভালোভাবে সম্পন্ন হয় না। এর ফলে তারা উপর দিকে গিয়ে কলা অথবা বিজ্ঞান, কোন ক্ষেত্রেই যতটুকু বোঝা দরকার তা বুঝতে পারে না। ভাষা ও গণিতবিদ্যার দৈন্যের ফলে তারা অন্যান্য বিষয় আয়ত্ত করতে অক্ষম হয়।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যখন এই অবস্থা, তখন অক্ষর নিয়ে এতো চেঁচামেচির স্থান কোথায়? শিক্ষার নিম্ন স্তরে এবং তার ফলে অন্যান্য স্তরে যে নৈরাজ্য আজ বিরাজ করছে তার জন্যে দায়ী কি বাঙলা হরফ, না উপরোক্ত কারণসমূহ?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেটের সুপারিশ অনুযায়ী বাঙলা ভাষা থেকে যদি এখন ‘ঙ,ঈ, ী, ঊ, ঋ,,ঐ, ঔ, ৈ, ে, ঞ, জ্ঞ, ক্ষ এবং এই ধরনের আরও অনেক অক্ষর বাদ দেওয়া যায় তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হবে সেটা দেখা দরকার।

প্রথম কথা হলো আর্থিক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অসুবিধার দরুন পুরাতন বই-পুস্তকগুলিকে নোতুন অক্ষরে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। এর ফল দাঁড়াবে এই যে, সরকারী প্রকাশনালয় এবং সরকারী নির্দেশে কতগুলি বেসরকারী প্রকাশনালয় থেকে অক্ষরান্তরিত হয়ে যে পুরাতন বইগুলো প্রাকশিত হবে, সেগুলির সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য এবং তাদের নির্বাচনও হবে উপরোক্ত প্রকাশকদের দ্বারা সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রিত। কাজেই যে স্বল্পসংখ্যক বইপত্র নোতুন অক্ষরে প্রকাশিত হবে, সেগুলির চরিত্রের উপর অন্য কারো হাত থাকবে না এবং ছাত্র ও সাধারণ পাঠকদেরকে প্রকাশকদের নির্দেশিত গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে হবে। কাজেই বর্তমানে ভালো ইংরাজী না জানার ফলে ছাত্রদের শিক্ষার পরিধি যেভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে সেইভাবে পুরাতন অক্ষরগুলির সাথে পরিচয়ের অভাবে ছাত্রদের শিক্ষার পরিধি আরও সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। বস্তুতঃ পূর্ব প্রচলিত হরফে লেখা বাঙলা বইপত্র হবে প্রায় বিদেশী ভাষায় লেখা বইয়ের মতোই দুর্বোধ্য। কেউ যদি বলেন যে, আপাততঃ এই দুই বর্ণমালাই কিছুকাল আয়ত্ত করতে হবে, তাহলে তিনি তার দ্বারা ‘কোমলমতি’ ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার থেকে অসুবিধাই সৃষ্টি করবেন বেশী।

আর্থিক অভাব ও অন্যান্য কারণে অন্য ভাষা থেকে যখন বাঙলা ভাষায় অনুবাদের কাজতে ত্বরান্বিত করাই সম্ভব হচ্ছে না, তখন বাঙলা থেকে বাঙলায় অক্ষরান্তরণ কাজে এই পর্যায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা উন্মত্ততা অথবা উদ্দেশ্য-প্রণোদিত চক্রান্ত ব্যতীত আর কি?

উপর্যুক্ত অসুবিধাগুলির জন্যে গণচীনের অভূতপূর্ব অগ্রগতি সত্ত্বেও লিপি সংস্কারের কাজে হাত দিতে তারা এখনো সক্ষম হয়নি। অথচ তাদের সমস্যা যে আমাদের থেকে অনেক বেশী দুরূহ, একথা সকলেই জানে। গণচীনে যে কারণে এ জাতীয় সংস্কারকার্যে হাত দেওয়া হয়নি, ঠিক সেই কারণের প্রতি লক্ষ্য রেখেই পাকিস্তানে অন্যান্য ভাষা বাদ দিয়ে বাঙলা ভাষার বানান সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত। একথা যতো শীঘ্র এবং যতো ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়, দেশের পক্ষে ততোই মঙ্গল।

বর্তমানে আমাদের দেশে শুধু যে অক্ষর সংস্কারের প্রয়োজন আছে তাই নয়, এ দেশে আজ প্রয়োজন জীবনযাপনের ভিত্তিকেই আমূলভাবে পরিবর্তন করা। তার জন্যে যে প্রচেষ্টা, পরিশ্রম, আন্তরিকতা এবং স্বচ্ছদৃষ্টি প্রয়োজন তার কোন অস্তিত্ব এখন নেই। যে দেশে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বাসগৃহের সমস্যা আজ অধিকাংশ মানুষকে বিপর্যস্ত করছে, সেখানে বর্ণমালা-সংস্কার আন্দোলন কোন অর্থে বাস্তব এবং প্রয়োজনীয়? যে কোন দেশেই সমস্যার অভাব থাকে না; কিন্তু সব সমস্যার গুরুত্ব এবং তাগিদ এক হয় না। কাজেই গুরুত্ব ও তাগিদ অনুসারে প্রত্যেকটি সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা করা দরকার। শুধু তাই নয়। এমনভাবে একে একে সমস্যাগুলির সমাধান প্রয়োজন, যাতে করে পরবর্তী সমস্যা সমাধানের পক্ষে পূর্ব সমাধান সহায়ক হয়। এ জন্যেই চীনারা প্রথমে তাদের অসুবিধাজনক চিত্রলিপির ক্ষেত্রে তাদের শক্তি ক্ষয় না করে সে সমস্যাকে আপাততঃ ইচ্ছাকৃতভাবে টিকিয়ে রেখেছে। নিজেদের আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের বুনিয়াদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করার পরই তারা এ কাজে হাত লাগাতে সক্ষম হবে এবং তখন তারা অন্যান্য কাজের মতো লিপি পরিবর্তনও সুসম্পন্ন করবে।

কিন্তু আমাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। চীনারা যেখানে চিত্রলিপির সংস্কার তাদের উন্নতির পক্ষে বর্তমান পর্যায়ে বাধা স্বরূপ বলে সে কাজ স্থগিত রেখেছে, আমরা সেখানে কল্পিত বর্ণমালা সমস্যা সমাধানের জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েছি। বর্তমান পর্যায়ে ওটা সে সত্যি অর্থে আমাদের ক্ষেত্রে কোন সমস্যাই নয়, একথাও অনেকে বিবেচনা করার অবসর পাচ্ছে না। আমাদের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে উন্নত করা দূরের কথা, অক্ষর সংস্কার করে তাদের উন্নতিকে বিপর্যন্ত করার প্রচেষ্টাতেই বস্তুতঃ তারা ব্যাপৃত আছেন। সোজা কথায় বলতে গেলে, বর্ণমালা-সংস্কার আজকে আমাদের সমগ্র সাংস্কৃতিক ও আর্থিক জীবনের মধ্যে যে বিপর্যয় ঘটাবে, তার ফলে আমরা নিদারুণভাবে পিছিয়ে থাকবো। প্রথমতঃ শিক্ষার মান এবং কাঠামো ভেঙে পড়বে এবং শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতিক্ষেত্রে তার প্রভাব এড়ানো যাবে না। দ্বিতীয়তঃ, এই হঠকারী কার্যক্রমের দ্বারা সমাজের সর্বস্তরের চিন্তাক্ষেত্রে এমন হতবুদ্ধিতা এবং নৈরাজ্য দেখা দেবে, যার ফলে কোন ক্ষেত্রেই সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ এদেশের লোকের পক্ষে সম্ভব হবে না। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই প্রকৃত পক্ষে অক্ষর- সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত।

১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা এবং সংস্কৃতির উপর আক্রমণ একদিনের জন্যেও স্থগিত থাকেনি। এ আক্রমণের বাহ্যিক রূপের পরিবর্তন হলেও তার সত্যিকার চরিত্র অপরিবর্তিত আছে। শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় চেতনার (যে চেতনা কোন অর্থেই রাষ্ট্রবিরোধী নয়) উন্মোষ ভাষাকে কেন্দ্র করেই প্রধানতঃ গড়ে উঠেছে। এর ফলে তাদের সমগ্র জীবনের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। এ পরিবর্তন আর্থিক জীবনক্ষেত্রেও সহজেই লক্ষণীয়। কিন্তু জাতীয় জীবনের পরিবর্তনের এই প্রেরণা পাকিস্তানের বৃহৎ বুর্জোয়া স্বার্থের পরিপন্থী। কংগ্রেসের অন্তর্গত হিন্দু বুর্জোয়ারা যেভাবে ভারতের অখণ্ডতার আওয়াজ তুলে অন্যান্য শোষিত শ্রেণীর সাথে সাথে তাদের জাতভাই মুসলমান বুর্জোয়াদেরকেও দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিলো, সেইভাবে পাকিস্তানের বৃহৎ বুর্জোয়ারা এখন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ইত্যাদির আওয়াজ তুলে যে কোন প্রকার জাতীয় আন্দোলনকে বাধা দান করতে বদ্ধপরিকর। অক্ষর-সংস্কার আন্দোলন বৃহৎ বুর্জোয়াদের সেই চক্রান্তেরই অন্যতম অংশ।

এই চক্রান্ত্রের মধ্যে অক্ষর-সংস্কার আন্দোলনের সকল সমর্থকরাই জ্ঞানতঃ অংশ নিচ্ছেন এমন নয়। কোন আন্দোলনের ক্ষেত্রেই সেটা হয় না। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, বিশেষ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট মহল থেকে এ জাতীয় প্ররোচনা এবং প্রচারণার উৎপত্তি হয়। তারপর অন্যান্য অনেকে সংস্কার অথবা ক্ষুদ্র স্বার্থের বশে তাতে যোগদান করে পরোক্ষভাবে সেই চক্রান্তের শরীক হন। ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সত্যটিই বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়।

বৃহৎ বুর্জোয়া স্বার্থ যেভাবে বিগত একুশ বছরের পূর্ব বাঙলায় ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আক্রমণ চালিয়ে এসেছে, ঠিক সেইভাবেই এখনো তারা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। বর্তমান অক্ষর সংস্কার আন্দোলনও পূর্বের মতোই বিশেষ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট মহলের প্ররোচনা এবং প্রচারণা থেকেই উদ্ভূত। এতে যারা সাহায্যকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ তাঁদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে একাজ করছেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের যে সব ‘সংস্কৃতিসেবীরা’ এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করছেন, তাঁদের অধিকাংশই এ দেশে বৃহৎ বুর্জোয়া স্বার্থ উদ্ধারে ব্যাপৃত। এঁরা হলো প্রকৃতপক্ষে তাদেরই সাংস্কৃতিক মুৎসুদ্দি।

ছাত্র, জনসাধারণ এবং শিক্ষিত মহলের একথা উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, বর্তমানের অক্ষর পরিবর্তন ও ভাষা সংস্কার আন্দোলন আমাদের আর্থিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের উপর এক মস্ত হামলাস্বরূপ। এবং প্রতিটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীরই আজ কৰ্তব্য বৃহৎ বুর্জোয়ার এই হামলাকে প্রতিহত করে এ দেশে গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জীবন গঠন কার্যে সচেষ্ট হওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *