সমার্থক যুগ্মশব্দ
আমরা মাঝে মাঝেই একই অর্থের দু’টি শব্দ পাই। এ দেশে এর সূত্রপাত— আর্যরা যখন এ দেশে এল, তখন প্রাগার্যদের সংস্পর্শে আসে। কী প্রতিবেশী হিসেবে, কী দাম্পত্য সম্পর্কে, দৈনন্দিন প্রয়োজনে এই ধরনের সমার্থক যুগ্মশব্দ একেবারে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আর্য বলবে ‘নদী’, প্রাগার্য বলবে ‘নালা’ তেমনি ‘বনজঙ্গল’। প্রথমটি আর্যের দ্বিতীয়টি প্রাগার্যের। এমনই ‘বনবাদাড়’, ‘পাহাড়পর্বত’, এদের একটি আর্য অব্দ অন্যটি প্রাগার্য, ফলে দু’তরফেই বুঝতে সুবিধা হয়। এমনই আছে গাছপালা; গাছ প্রাগার্য, তার থেকে ‘পালা’। আর্য পল্লব শব্দ দুটোই সমার্থক। তেমনই ছেলেপুলে: পুত্র শব্দ থেকে এল পুল-পুল্ল-পুলে; ছেলে শব্দের সঙ্গে একারান্তে মিল রেখেও। ‘ঘরবাড়ি’-র ঘর কথাটি সংস্কৃত গৃহ শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন আর ‘বাড়ি’ও প্রকারান্তরে সংস্কৃত বাটিকা শব্দ থেকে এসেছে, কিন্তু সে বহু পূর্বের কথা, তাই তাকে প্রাগার্য কথা বলেই ধরা হত। ‘গ্রামগঞ্জ’-এর গ্রাম সংস্কৃত গঞ্জ প্রাগার্য, গাঁ-গঞ্জ ও তাই। ‘ঝড়বাদলে’ও প্রথমটি, ঝটিকা শব্দটি, সংস্কৃত থেকে, বাদল প্রাকৃত। তেমনই ‘পুজো আচ্চা’ পূজা অর্চা, এর মধ্যে প্রথমটি সম্ভবত তামিল থেকে, দ্বিতীয়টি সংস্কৃত। ‘বৃষ্টিবাদল’ এরও প্রথমটি সংস্কৃত, দ্বিতীয়টি দেশজ। ‘ফলপাকড়’ও সংস্কৃত ও আদিবাসী শব্দের সমাহার। ‘গাড়িঘোড়া’র মধ্যে ঘোড়া আর্য ঘোটক থেকে, যেমন ‘খেতখামার’-এর ‘খেত’ সংস্কৃত ক্ষেত্র থেকে, ‘বনবাদাড়’-এর বাদাড় প্রাগার্য কিংবা ‘ফল-পাকড়’-এর ফল সংস্কৃত পাকড় প্রাগার্য। আগে সোনার সঙ্গে দামি পাথর গেঁথে গয়না তৈরি হত। সে ইতিহাস ধরা রয়েছে গয়নাগাঁটির গাঁটি অংশে, ‘গয়না’ শব্দটা প্রাগার্য। ‘ঝড়বাদল’ এর ঝড় এসেছে সংস্কৃত ঝটিকা থেকে, ‘বাদল’ দেশজ; ‘বৃষ্টিবাদল’ও তেমনই। ঠাকুরদেবতার দেবতা সংস্কৃত, ঠাকুর প্রাগার্য, তেমনই ‘ইষ্টকুটুম্ব’র প্রথমাংশ সংস্কৃত, কুটুম্ব সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের কোনও ভাষা থেকে উদ্ভূত।
শতাব্দীর পর শতাব্দী যেতে লাগল, সমস্যাটা নতুন চেহারা নিল পাঠান ও পরে মোগল রাজত্বে। এ বারও প্রতিবেশী হিসেবে ব্রাহ্মণ্যসমাজ ও বহিরাগত সমাজ একই সমস্যার সম্মুখীন হল। নতুন নতুন যুগ্মশব্দ এ সমস্যাটার সমাধান করল একই উপায়ে; একটি আর্য ও একটি বহিরাগত ভাষার প্রতিশব্দ দিয়ে। লোকে বলতে লাগল, ‘হাটবাজার’, হট্ট থেকে হাট, আর্য, বাজার বিদেশি। তেমনই ‘জামাকাপড়’, কর্পট থেকে কাপড়, জামাটা আগন্তুক। যেমন ‘বিয়েশাদি’, ‘ঢালতলোয়ার’, ‘দাসীবাঁদি’, ‘পয়সাকড়ি’ বা ‘টাকাকড়ি’। অবশ্য টাকাপয়সা দুটো অংশই বিদেশি শব্দ। ‘মোক্তার’ যদিও ঠিক, ‘উকিল’ নয় তবু প্রায় সমার্থক শব্দ দু’টি দ্বন্দ্বসমাজবদ্ধ হয়ে প্রযুক্ত হয়। ‘ঝি-চাকর’ শব্দের ‘ঝি’ সংস্কৃত ‘দুহিতা’ শব্দের বিবর্তিত রূপ, আর চাকর বহিরাগত। লিঙ্গভেদ থাকলেও দু’টি শব্দই সমার্থক। এমনই ‘মাঝিমাল্লা’, মাঝি অনার্য শব্দ। ‘ঢালতলোয়ার’ও তেমনই দুটি সমার্থক না হলেও প্রায় সর্বদা যুগ্ম ভাবে ব্যবহৃত। তেমনই ‘বীরপালোয়ান’ প্রথমটি সংস্কৃত দ্বিতীয়টি বহিরাগত। ‘হিরেজহরত’, ‘মালমশলা’ শব্দ দুটিতেও সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত অংশটির প্রায় সমার্থক বা একত্র ব্যবহৃত বলে অর্থের দিক থেকে কাছাকাছি। প্রাত্যহিক জীবনে এলে ‘চটিজুতো’– সামান্য প্রভেদ থাকলেও প্রায় সমার্থকই। মোল্লাপুরোহিত স্পষ্টতই সম্প্রদায়ভেদে হলেও সমার্থক দুটি শব্দ। জন্তুজানোয়ার (জানবর্ থেকে) একেবারেই সমার্থক যুগ্ম শব্দ।
শতকের পর শতক গেল, ইংরেজ রাজত্বে সমস্যাটি একটু ভিন্ন চেহারায় দেখা দিল। মনে রাখতে হবে, ইতিমধ্যে ফারসি হয়েছে রাষ্ট্রশাসনের ভাষা, কিন্তু দেশের অধিকাংশ লোক সেটা বোঝে না; বোঝে শুধু উচ্চশিক্ষিতরা বা যাদের রাজদরবারে বা দরগা মসজিদে যাতায়াত আছে। নতুন রাজভাষা ইংরেজি তখন খুব কম লোকই বোঝে। এবং ততদিনে সংস্কৃত, তৎসম ও তদ্ভব শব্দের একত্র বিন্যাসে অধিকাংশ লোকের কাজ চলে যাচ্ছিল। নতুন ইংরেজি ভাষার প্রয়োজন হত খুব কম লোকেরই। তাই সামান্য যে ক’টি শব্দ এখন যুগ্মরূপে দেখা দিল, তার প্রয়োজন বিচারবিভাগ চিকিৎসা ও বিনোদনের মধ্যে প্রধানত আবদ্ধ রইল।
বৈদ্য আগেই ছিল, এখন সাহেব ডাক্তারের সঙ্গে যুগ্মপ্রয়োগে পাওয়া গেল ‘ডাক্তারবদ্যি’ তেমনই বিচার সম্পর্কিত শব্দ পেলাম ‘উকিলব্যারিস্টার’। এর আগে উকিল পূর্ববর্তী যুগের ফারসি, ‘ব্যারিস্টার’ইংরেজি। তেমনই পাই ‘উকিলম্যাজিস্ট্রেট’। এরই সঙ্গে আসে ‘কোর্টকাছারি’। প্রথমটি ইংরেজি, দ্বিতীয়টি তার পূর্বেকার। বিনোদনের ক্ষেত্রে পাই ‘যাত্রাথিয়েটার’, ‘জলসা-মেহফিল’। ক্রমে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন বাড়ল, শিক্ষিত দম্পতি বা প্রতিবেশীর তখন দুই ভাষাতেই স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, ইংরেজি শব্দ তখন থেকে এখনও স্বতন্ত্র ভাবে প্রয়োগ করে বহু লোকই, কাজেই আর যুগ্ম শব্দ প্রবর্তনের প্রয়োজন বা চাহিদা রইল না।