বামিয়ানে শিল্পহত্যা

বামিয়ানে শিল্পহত্যা

বামিয়ানের দু’টি বিখ্যাত বুদ্ধমূর্তি, ১৭৫ ফুট ও ১২০ ফুট উঁচু, কুষাণ যুগে বেলেপাথর কেটে নির্মাণ করা হয়েছিল। এ দু’টি তখন থেকেই ক’দিন আগে পর্যন্ত যেন রূপক ছিল বৌদ্ধধর্মের। বিশেষত বুদ্ধের মহিমার, যা ছিল কুষাণ যুগের একটি বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়াও ইতস্তত পাওয়া হাজারখানেক ছোট বড় মূর্তি ও তার ভগ্নাংশ ছিল ওখানকার জাদুঘরে আর ছিল ছবির সারি— রাজহাঁসরা নানা গ্রিবাভঙ্গিতে ভেসে যাচ্ছে জলের ওপরে, হরিণ, পাখি ইত্যাদি। এই শেষেরগুলো বেঁচে যাওয়ার কথা, কারণ, কোরানে শুধু ভাস্কর্যে নর-নারীদেহ নির্মাণের ওপরেই নিষেধ। একটি অপূর্ব বুদ্ধমূর্তি, আসনে উপবিষ্ট, মহিমা ও লাবণ্যে উজ্জ্বল— সে দিন ভেঙে দিল তালিবানরা; পৃথিবীর কেউ কোনও দিনই আর সেটি দেখতে পাবে না। মহাপুরুষের লক্ষণ-সমন্বিত ওই অতিকায় দু’টি বুদ্ধমূর্তিও ইতিহাস থেকে ভেঙে গড়িয়ে পড়ল। কুষাণ যুগের গান্ধার রীতির শিল্পে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের উৎকর্ষ দেখা গিয়েছিল ওই অঞ্চলে, যে সমৃদ্ধি আর কখনও ফিরে আসবে না। বৌদ্ধধর্মের শিল্পিত মহিমা ওই সময়ে ওই অঞ্চলে এমন ভাবে বিকশিত হয়েছিল যে, তার বিবরণ রয়ে গেছে পর্যটকদের বিবরণে। বিখ্যাত রাজা কনিষ্কের মূর্তিটিও তখনকারই, রেহাই পাবে না ধ্বংস থেকে।

ওই অঞ্চলটি প্রাক্-ইসলাম যুগে বৌদ্ধ ছিল এবং বৌদ্ধশিল্প কুষাণ আমলে গান্ধার রীতির ভাস্কর্যে অতুলনীয় ছিল। এখন থেকে মানুষ শুধু তার নীরস বিবরণই পড়বে। শিল্প নিদর্শন আর কোনও দিনই দেখতে পাবে না। এ ধ্বংসের কারণ কী, মূর্তিগুলি শালীনতার আদর্শে নিখুঁত নির্মাণ। তা হলে? কোরানে নিষেধ আছে মানুষের মূর্তি রচনা এবং আড়াই হাজার বছর পর সেই অনুশাসন অনুসারে এই ভাঙন চলছে।

শোনা যাচ্ছে, এ দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি চোদ্দোটি দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন এই ধ্বংসকাণ্ড বন্ধ করতে। কারণ, এ কাজ ‘অসভ্য, বর্বর’। ভুলে যাবার কথা নয়, এই প্রধানমন্ত্রীর নানা সাম্প্রদায়িক ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যে চিঠি দিয়েছিলেন, তাতে ঠিক ওই দু’টি বিশেষণই ব্যবহার করেছিলেন।

তৈমুরলঙ, চেঙ্গিস খাঁর যুগ পেরিয়ে এসেছি এমন একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল আমাদের মনে। ভুল, একেবারেই ভুল, যতক্ষণ অশিক্ষিত, ঈর্ষা ও লোভ মানুষকে প্রণোদিত করবে অন্যের সমৃদ্ধি নষ্ট করতে, ততক্ষণ কে তাকে ঠেকাবে? সে দিনও কেউ পারেনি, আজও এখনও কেউ পারল না। মার্কিন শিল্প সংগ্রহশালা থেকে বলা হয়েছে, তারা শিল্পগুলি কিনে নেবে, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।

ভাঙছে কারা? তালিবানরা। এরা হল সম্পূর্ণ অশিক্ষিত একটি গোষ্ঠী, যারা ইসলামের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করবে অনিসলামি শিল্প নষ্ট করে। অবশ্য যথার্থ কথা বলতে হলে বলতে হয়, এদের মধ্যে মূল্যবোধের বালাই নেই। ওপরওয়ালাদের নির্দেশে এরা বৃহৎ ধ্বংসক্রিয়ায় নিজেদের শক্তি ও পৌরুষ জাহির করছে। যেমন করে বজরংবলী, রণবীর সেনা, শিবসেনা এবং অন্য কোনও কোনও দল।

১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বরের বহু পূর্বে জ্যোতি বসু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে জানিয়েছিলেন এমন একটা প্রলয়ংকর অপকর্ম হবার তোড়জোড় চলছে এবং সেটা নিবারণ করা একটা জাতীয় কর্তব্য। প্রধানমন্ত্রী নাকি সম্মতিও জানিয়েছিলেন। অথচ ঘটনাকালে টিভিতে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে ধ্বংসলীলা উপভোগ করেছিলেন, নিবারণের কোনও উদ্যোগ নেননি। মসজিদটা ছিল বাবরের নামে উৎসর্গিত, যে বাবর মৃত্যুর পূর্বে পুত্র হুমায়ুনকে চিঠিতে লিখে গিয়েছিলেন, ‘মনে রেখো, তুমি যে দেশে রাজত্ব করবে সেখানে হিন্দু ও মুসলমান দু’ সম্প্রদায়ই তোমার প্রজা। উভয়কেই তুমি সমদৃষ্টিতে দেখবে।’ এই বাবরেরই নামের মসজিদ সমবেত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শক্তি দিয়ে ভাঙা হল।

যারা ভাঙল তাদের অধিকাংশই করসেবক, লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পর্ক কম ছিল, সঙ্ঘ পরিবারের বিশেষ প্রশিক্ষণে ধ্বংসশক্তিতে পটুত্ব অর্জন করেছিল মাত্র। কিন্তু এদের পিছনে ছিলেন অতি সুশিক্ষিত আটটি ভাষায় দক্ষ প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও।

তালিবানরা রূঢ়, বর্বর, পরুষ, ঘোরতর অশিক্ষিত এবং পুরোপুরি ধর্মান্ধ, যারা ভাস্কর্য ধ্বংস করে কোরানের নির্দেশ মতো পুণ্য অর্জন করছে, এদের পিছনে যাঁরা আছেন তাঁরা এদের ধর্মান্ধতায় দীক্ষা দিয়ে বর্বরতায় উত্তীর্ণ করে দিয়েছেন। তালিবানদের ক্রিয়াকলাপ একেবারেই সমর্থন করা যায় না, তাদের কাজ যেমন গর্হিত তেমনই নিষ্ঠুর। এদের প্ররোচকরাও অমানবিক ও ধর্মান্ধ। এই ছুতোটুকু কিন্তু সে দিনের অতি সুশিক্ষিত নরসিমা রাওয়ের ছিল না। আজ এই রক্তপিপাসু জঙ্গী সঙ্ঘ পরিবারেরও নেই, যারা পরমতসহিষ্ণু হিন্দু উদারতার গুমর করে এবং একই সঙ্গে দরিদ্র সর্বহারা খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ঘর পোড়ায়, প্রাণে মারে, নিরপরাধ ধর্মগুরুকে দু’টি নাবালক পুত্র-সহ পুড়িয়ে মারে, ধর্মসেবিকাদের ধর্ষণ করে। এরা প্রচার করে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। সারা দেশ শুধু নয়, সারা পৃথিবী আজ দেখছে সে-শ্রেষ্ঠতার চেহারা।

বামিয়ানে ও আফগানিস্তানের অন্যত্র যে বর্বরতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার পিছনে আছে মৌলবিদের ধর্মান্ধতা। এটা কারও কাছে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। শিল্প হল মানুষের সভ্যতার এক পরাকাষ্ঠার পরিচয়, সেই শিল্প যখন যেখানে যে-ই ধ্বংস করুক, সে নির্বোধ পশুর মতো আচরণ করে, মানুষের সম্মানের সম্পূর্ণ অযোগ্য সে। কিন্তু একই কাজ যখন শিক্ষিত দৃষ্টিমান ধর্মান্ধদের প্ররোচনায় অনুষ্ঠিত হয় তখন সেটা অনেক বেশি গর্হিত। তালিবানরা পৃথিবী জোড়া বর্বরতার হিমশিলার উপরিভাগ মাত্র, তার নীচে অনেক গভীরে, গূঢ় অভিসন্ধিমূলক যে সব ধ্বংসের পরিকল্পনা হচ্ছে তার কোনওটা হিন্দু-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যে কোনওটা বা মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য, সে সব অন্তর্গুঢ় শক্তির খেলা চলে জনতার চোখের আড়ালে, রাজনীতির প্ররোচনায়।

শিল্প মানুষের শ্রেষ্ঠ সত্তার প্রকাশ, তাকে ধ্বংস করা বর্বরের কাজ— তা সে বুদ্ধমূর্তিই হোক আর বাবরি মসজিদই হোক। সমস্ত সভ্য মানুষের কর্তব্য, এ সবের উদ্দেশ্য উদ্ঘাটন করে ধ্বংসক্রিয়াকে ধিক্কার দেওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *