দেবতার প্রতারণা

দেবতার প্রতারণা

ত্রিপাদবিক্রমেই বিষ্ণু বিখ্যাত। কিন্তু অন্যান্য দেশের পুরাণে অন্যান্য দেবতারও ত্রিপাদবিক্রমে মতো কাহিনি আছে, সর্বত্রই মানুষ কিংবা অন্য জাতের জীবকে প্রতারণা করার জন্য দেবতার এই ভূমিকা

ফিনল্যাণ্ডের মহাকাব্য ‘কালেহ্বালা’র নায়ক হাইনায়মোয়েনেন সন্দেহ করেছিলেন, বামনাকৃতি এক ব্যক্তি বিশেষ একটি প্রকাণ্ড ওক গাছটিকে উপড়ে ফেলতে পারবে কি না; কিন্তু আসলে বামন যখন স্বরূপ ধারণ করল তখন দেখা গেল যে, সে একটি বৃহদাকার দৈত্য। কাজেই স্থানীয় লোকেদের ঠকিয়ে সে ওই ওক গাছটি উপড়ে ফেলল, যেটা সূর্যের আলো আটকে রাখছিল। এই কাহিনির প্রতারক চরিত্রটি যথেচ্ছ রূপ ধারণ করে ইষ্টসিদ্ধি করতে পারে, এমন নানা কাহিনি বিভিন্ন দেশের পুরাণে পাওয়া যায়।

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে বা তার কিছু আগে ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠী ইয়োরোপে নানা দিকে ছড়িয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন দলে। এরা মূলত পশুচারী। এদের মুশকিল হল বাসস্থানের। নতুন জায়গায় অচেনা জনগোষ্ঠীকে কে আশ্রয় দেবে? চেয়েচিন্তে বাসযোগ্য ভূখণ্ড পাওয়া যায় না, কাজেই প্রায়ই এরা ছলনার আশ্রয় নিত। এ সব কাহিনি বিভিন্ন দেশের পুরাণে ধরা আছে। পটভূমিটা পৃথক হলেও, আমাদের পুরাণে বিষ্ণুর ত্রিপাদবিক্রমের উপাখ্যানটা অন্য রকম মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটিও ইন্দো-ইয়োরোপীয় অনুপ্রবেশকারীদের ছলনার আশ্রয় নিয়ে জমি দখলেরই ইতিহাস। সুইডেনের মহাকাব্য এড্ডার একটি কাহিনির নাম গিলফাগিং অর্থাৎ ‘গিলফিদের প্রতারণা’। গিলফিদের রাজা একখণ্ড জমি দান করতে প্রস্তুত। দেশের আদি অধিবাসীরা ছিল ‘হ্বানি’র জাতের, আর মোটামুটি দেবতারা ছিল ‘ঈসির’ জাতের। এরা আগন্তুক, এবং এদের ছিল জমির প্রয়োজন। তাই এক বৃদ্ধা ভিখারিনি রাজার কাছে এসে চাষের জমি চাইতে রাজা বললেন, চারটে বলদ একদিন এক রাতে যতটা জমিতে লাঙল দিতে পারবে ততটা জমি তিনি ওই ভিখারিনিকে দান করবেন। এ দিকে ওই বৃদ্ধা ছিল ঈসির জাতের। দৈত্য দেশ থেকে সে চারটে বলদ নিয়ে এল; এরা আসলে তার দৈত্য স্বামীর সন্তান, ছদ্মবেশী বলদ। বৃদ্ধা তাদের লাঙলে জুতে দিলে, লাঙলের ফলা খুব গভীরে গিয়ে জমিটাকে আলগা করে দিলে, বলদরা লাঙল টেনে পশ্চিম সমুদ্রের কাছে নিয়ে গেল একদিন, এক রাতের মধ্যে। এ জমি ঈসিরদেরই হয়ে গেল— অতি বৃহৎ একখণ্ড জমি। লক্ষ করার ব্যাপার হল, দেবতার জাত ঈসিররা পৃথিবীর আদি অধিবাসীদের প্রতারণা করে এখানে বিস্তৃত ভূখণ্ড দখল করছে, ঈসিররা সেই দেবতার জাত, আর হ্বানিরা পৃথিবীর প্রাচীন ও যথার্থ অধিবাসী।

এই বোধটা নানা কাহিনিতেই পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের প্রাচীন গ্রন্থেরও অনেক জায়গায় এমন কাহিনি আছে। বিষ্ণু বামন অবতারে রাজা বলির কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, তিনটি পদক্ষেপে যে পরিমাণ জমি অতিক্রম করা যায়, ততটা জমি রাজা কি তাকে দেবেন? রাজা সম্মত হলে, বামন স্বরূপে বিরাট আকৃতি ধারণ করে, একটি পদক্ষেপে স্বর্গ ও আর একটিতে মর্ত অধিকার করলে আর তৃতীয় পদক্ষেপের জন্যে কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। তখন বামন বাকি পদক্ষেপের জন্য জমি চাইতে বলি বললেন, ‘তা হলে নরকে পদক্ষেপ করো।’ বামন বলির মাথায় পা দিয়ে চেপে তাকে নরকে পাঠালেন। এই ভাবে ত্রিপাদ পরিমাণ জমি দখলের ছলে স্বর্গ মর্ত পাতাল দখল করে নিলেন। এ দিকে স্বর্গ ও মর্ত বামনের অধিকারে এসে গেল। বিষ্ণু দেবতা ছিলেন। এমনই টিউটনিক সাহিত্যে দেখি, ‘ফ্রে’-ও রূপ পরিবর্তন করতে পারতেন, যেমন জার্মান পুরাণ নিবেলুঙ্গেনলিডে ‘আগুহ্লারি’ সৌর দেবতাদের সঙ্গে প্রতারণা করবার জন্যে ভিন্নরূপে দেখা দিতেন। কেন? কোনও ইষ্টসিদ্ধির জন্যে; এবং এ ইষ্টসিদ্ধি হত স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে কিছু কিছু ‘আদায়’ করে নেবার জন্যে।

পৃথিবীর আদি যুগ থেকেই মাঝে মাঝেই কিছু কিছু জাতিগোষ্ঠী দলবদ্ধ ভাবে আদিম বাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেত; কখনও খাদ্যের অভাবে, কখনও পশুচারণ-ভূমি রুক্ষ হয়ে গেলে, তা ছাড়া অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পঙ্গপাল ইত্যাদি কারণে। চলে যেতে যেতে যেখানে দেখত জল, গাছপালা আর অনুকূল জমি, সেখানেই বাস করতে চাইত। কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা সব সময়ে আগন্তুকদের বিনা প্রতিবাদে জমি দিত না। কখনও কখনও দিলেও অধিকাংশ সময়েই আপত্তি করত। তখন নিরুপায় হয়ে ছলে-বলে-কৌশলে আগন্তুকরা জমি আদায় করত। যে ক’টা উপাখ্যান উল্লেখ করা হল (এবং আরও অনেক আছে এমন কাহিনি), সেখানে কৌশল এবং ছল দিয়েই ইষ্টসিদ্ধি করতে হত। সব ক’টাতেই স্থানীয় অধিবাসীরা দেবজাতি এবং আগন্তুকরা অসুরজাতি। কেন এমন হল? কারণ, এ সব উপাখ্যান লিখেছে যে সব দেশের আদি অধিবাসীরা; স্বভাবতই তারা নিজেদের দেববংশীয় বলে চিত্রিত করেছে এবং যে আগন্তুকরা ছলে তাদের ভূমি ও সম্পত্তি আদায় করে, তাদের অসুরবংশীয় বলেছে। সব দেশেই ধারণা ছিল, অসুররা মায়াবী এবং অলৌকিক শক্তির অধিকারী। আমাদের পুরাণে ময়দানব এই রকম এক শক্তিমান দানব, কৌরব ঐশ্বর্যের প্রতিস্পর্ধায় এক আশ্চর্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন অলৌকিক শক্তিতে। এমন অনেক কাহিনি নানা পুরাণে ছড়ানো আছে, সর্বত্রই আগন্তুকরা অলৌকিক শক্তিশালী এবং সেই শক্তিতে তারা ছলে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে যা প্রয়োজন, তা প্রতারণার দ্বারা আদায় করে নিয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে আদিপর্বে আগন্তুক আর্যরা প্রাগার্যদের অধিকৃত ভারত ভূখণ্ডের অনেকটা অংশই এই রকম কোনও ভাবে অথবা যুদ্ধ করে দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া তাদের কোনও উপায় হয়তো ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

দেবতার প্রতারণা

দেবতার প্রতারণা

দেবতার প্রতারণা

ত্রিপাদবিক্রমেই বিষ্ণু বিখ্যাত। কিন্তু অন্যান্য দেশের পুরাণে অন্যান্য দেবতারও ত্রিপাদবিক্রমের মতো কাহিনি আছে, সর্বত্রই মানুষ কিংবা অন্য জাতের জীবকে প্রতারণা করার জন্য দেবতার এই ভূমিকা।

ফিনল্যান্ডের মহাকাব্য ‘কালেহ্বালা’র নায়ক হ্রাইনায়মোয়েনেন সন্দেহ করেছিলেন বামনাকৃতি এক ব্যক্তি বিশেষ একটি প্রকাণ্ড ওক গাছটিকে উপড়ে ফেলতে পারবে কিনা; কিন্তু আসলে বামন যখন স্বরূপ ধারণ করল তখন দেখা গেল যে সে একটি বৃহদাকার দৈত্য। কাজেই স্থানীয় লোকেদের ঠকিয়ে সে ওই ওক গাছটি উপড়ে ফেলল, যেটা সূর্যের আলো আটকে রাখছিল। এই কাহিনির প্রতারক চরিত্রটি যথেচ্ছ রূপ ধারণ করে ইষ্টসিদ্ধি করতে পারে, এমন। নানা কাহিনি বিভিন্ন দেশের পুরাণে পাওয়া যায়।

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে বা তার কিছু আগে ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠী ইয়োরোপে নানা দিকে ছড়িয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন দলে। এরা মূলত পশুচারী। এদের মুশকিল হল বাসস্থানের। নতুন জায়গায় অচেনা জনগোষ্ঠীকে কে আশ্রয় দেবে? চেয়েচিন্তে বাসযোগ্য ভূখণ্ড পাওয়া যায় না, কাজেই প্রায়ই এরা ছলনার আশ্রয় নিত। এসব কাহিনি বিভিন্ন দেশের পুরাণে ধরা আছে। পটভূমিটা পৃথক হলেও আমাদের পুরাণে বিষ্ণুর ত্রিপাদবিক্রমের উপাখ্যানটা অন্যরকম মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটিও ইন্দো-ইয়োরোপীয় অনুপ্রবেশকারীদের ছলনার আশ্রয় নিয়ে জমি দখলেরই ইতিহাস। সুইডেনের মহাকাব্য এড়ার একটি কাহিনির নাম গিলফাগিনুং অর্থাৎ ‘গিলফিদের প্রতারণা’। গিলফিদের রাজা একখণ্ড জমি দান করতে প্রস্তুত। দেশের আদি অধিবাসীরা ছিল ‘হানির’ জাতের, আর মোটামুটি দেবতারা ছিল ‘ঈসির’ জাতের। এরা আগন্তুক, এবং এদের ছিল জমির প্রয়োজন। তাই এক বৃদ্ধা ভিখারিনি রাজার কাছে এসে চাষের জমি চাইতে রাজা বললেন চারটে বলদ একদিন এক রাতে যতটা জমিতে লাঙল দিতে পারবে ততটা। জমি তিনি ওই ভিখারিনিকে দান করবেন। এদিকে ওই বৃদ্ধা ছিল ঈসির জাতের। দৈত্য দেশ থেকে সে চারটে বলদ নিয়ে এল; এরা আসলে তার দৈত্য স্বামীর সন্তান, ছদ্মবেশী বলদ। বৃদ্ধা তাদের লাঙলে জুতে দিলে লাঙলের ফলা খুব গভীরে গিয়ে জমিটাকে আলগা করে দিলে বলদরা লাঙল টেনে পশ্চিম সমুদ্রের কাছে নিয়ে গেল একদিন, এক রাতের মধ্যে। এ জমি ঈসিরদেরই হয়ে গেল— অতি বৃহৎ একখণ্ড জমি। লক্ষ করার ব্যাপার হল, দেবতার জাত ঈসিররা পৃথিবীর আদি অধিবাসীদের প্রতারণা করে এখানে বিস্তৃত ভূখণ্ড দখল করছে, ঈসিররা সেই দেবতার জাত, আর হুনিরা পৃথিবীর প্রাচীন ও যথার্থ অধিবাসী।

এই বোধটা নানা কাহিনিতেই পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের প্রাচীন গ্রন্থেরও অনেক জায়গায় এমন কাহিনি আছে। বিষ্ণু বামন অবতারে রাজা বলির কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, তিনটি পদক্ষেপে যে পরিমাণ জমি অতিক্রম করা যায় ততটা জমি রাজা কি তাকে দেবেন? রাজা সম্মত হলে বামন স্বরূপে বিরাট আকৃতি ধারণ করে একটি পদক্ষেপে স্বর্গ ও আর একটিতে মর্ত অধিকার করলে আর তৃতীয় পদক্ষেপের জন্যে কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। তখন বামন বাকি পদক্ষেপের জন্য জমি চাইতে বলি বললেন ‘তা হলে নরকে পদক্ষেপ করো।’ বামন বলির মাথায় পা দিয়ে চেপে তাকে নরকে পাঠালেন। এইভাবে ত্রিপাদ পরিমাণ জমি দখলের ছলে স্বর্গ মর্ত পাতাল দখল করে নিলেন। এদিকে স্বর্গ ও মর্ত বামনের অধিকারে এসে গেল। বিষ্ণু দেবতা ছিলেন। এমনই টিউটনিক সাহিত্যে দেখি ‘ফ্ৰে’-ও রূপ পরিবর্তন করতে পারতেন, যেমন ‘জার্মান পুরাণ নিবেলুনেলিডে ‘আন্ডহুরি’ সৌর দেবতাদের সঙ্গে প্রতারণা করবার জন্যে ভিন্নরূপে দেখা দিতেন। কেন? কোনো ইষ্টসিদ্ধির জন্যে; এবং এ ইষ্টসিদ্ধি হত স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে কিছু কিছু ‘আদায়’ করে নেবার জন্যে।

পৃথিবীর আদি যুগ থেকেই মাঝে মাঝেই কিছু কিছু জাতিগোষ্ঠী দলবদ্ধভাবে আদিম বাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেত; কখনো খাদ্যের অভাবে, কখনো পশুচারণ-ভূমি রুক্ষ হয়ে গেলে, তা ছাড়া অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পঙ্গপাল ইত্যাদি কারণে। চলে যেতে যেতে যেখানে দেখত জল, গাছপালা আর অনুকূল জমি সেখানেই বাস করতে চাইত। কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা সব সময়ে আগন্তুকদের বিনা প্রতিবাদে জমি দিত না। কখনো কখনো দিলেও অধিকাংশ সময়েই আপত্তি করত। তখন নিরুপায় হয়ে ছলে-বলে-কৌশলে আগন্তুকরা জমি আদায় করত। যে কটা উপাখ্যান উল্লেখ করা হল (এবং আরো অনেক আছে এমন কাহিনি) সেখানে কৌশল এবং ছল দিয়েই ইষ্টসিদ্ধি করতে হত। সব কটাতেই স্থানীয় অধিবাসীরা দেবজাতি এবং আগন্তুকরা অসুরজাতি। কেন এমন হল? কারণ এসব উপাখ্যান লিখেছে যেসব দেশের আদি অধিবাসীরা; স্বভাবতই তারা নিজেদের দেববংশীয় বলে চিত্রিত করেছে এবং যে আগন্তুকরা ছলে তাদের ভূমি ও সম্পত্তি আদায় করে তাদের অসুরবংশীয় বলেছে। সব দেশেই ধারণা ছিল, অসুররা মায়াবী এবং অলৌকিক শক্তির অধিকারী। আমাদের পুরাণে ময়দানব এইরকম এক শক্তিমান দানব, কৌরব ঐশ্বর্যের প্রতিস্পর্ধায় এক আশ্চর্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন অলৌকিক শক্তিতে। এমন অনেক কাহিনি নানা পুরাণে ছড়ানো আছে, সর্বত্রই আগন্তুকরা অলৌকিক শক্তিধারী এবং সেই শক্তিতে তারা ছলে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে যা প্রয়োজন তা প্রতারণার দ্বারা আদায় করে নিয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে আদিপর্বে আগন্তুক আর্যরা প্রাগার্যদের অধিকৃত ভারতভূখণ্ডের

অনেকটা অংশই এইরকম কোনো ভাবে অথবা যুদ্ধ করে দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া তাদের। কোনো উপায় হয়তো ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *