মেঘদূতের সমস্যা
‘মেঘদূত’-এর বিষয়ের কাঠামোটা সকলেই জানে— নিজের কাজে অমনোযোগী হওয়াতে মনিব কুবের কর্মচারী এক যক্ষকে এক বছর দূর দেশে নির্বাসন দেন, ফলে তাকে নিজের স্ত্রীর থেকে দূরে থাকতে হল ওই এক বছর। রামগিরি পাহাড়ে বাস করত যক্ষটি। আষাঢ়ের প্রথমদিনে পাহাড়ের সানুদেশে মেঘের সমারোহ দেখে সে স্থির করল, ওই মেঘকে দিয়ে উত্তরে হিমালয়ের অলকায়, যেখানে তার স্ত্রী বাস করে সেখানে তার কাছে খবর পাঠাবে। সেই খবরের বয়ানটাই উত্তরমেঘ বা মেঘদূতের দ্বিতীয়ার্ধ। প্রথমার্ধে যক্ষ মেঘকে তার যাত্রাপথটা ভাল করে বুঝিয়ে বর্ণনা করছে।
এখানে কাব্যের দিক থেকে কিছু সমস্যা আছে, তার দিকে একটু তাকানো যাক। প্ৰথমেই যক্ষ মেঘকে সচেতন প্রাণী ধরে নিয়ে কথা বলছে— এর ব্যাখ্যায় কালিদাস বলছেন দুটো কথা: প্রথমত, মেঘ দেখলে সকলেরই মন উতলা হয়, আর যার প্রিয়া একদিন তার কণ্ঠলগ্না ছিল কিন্তু এখন বহুদূরে, সে তো অত্যন্ত বিচলিত হবেই এবং প্রাণী-অপ্রাণী ভেদ ভুলে যাবে। দ্বিতীয়ত, তার এক বছরের নির্বাসনের এই প্রথম ক’মাসেই সে ধৈর্য হারিয়েছে: যক্ষবধূ কেমন আছে তার কোনও খবর পাচ্ছে না, এবং সে কেমন আছে তা-ও তাকে জানাতে পারছে না। তাই খবর দিতে ও নিতে হবেই, না হলে সে বিরহযন্ত্রণা সহ্য করতে পারবে না।
এই বারে সমস্যা। মেঘ তো অচেতন প্রাকৃতিক বস্তু। তাকে কেমন করে সচেতন দূতের কাজে নিযুক্ত করছে যক্ষ? এর উত্তরে কালিদাস বলছেন, যক্ষের বিরহযন্ত্রণা এমন তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে মানুষ চেতন-অচেতনের ভেদ ভুলে যায়, যক্ষেরও এখন সেই দশা, বিরহযন্ত্রণার ফলে অচেতন মেঘকে বিভ্রান্ত হয়ে সচেতন জ্ঞান করে তাকে দৌত্যে নিযুক্ত করছে। যন্ত্রণার তীব্রতায় একান্ত নিরুপায় হয়ে যক্ষ মেঘকে সচেতন কল্পনা করে দূত হিসেবে পাঠাচ্ছে।
সচেতন বুদ্ধিমান দূত হিসেবে কল্পনা করছে বলেই যক্ষ মেঘকে বলছে, ‘পৃথিবীবিখ্যাত পুষ্কর এবং আবর্তক মেঘের বংশে তোমার জন্ম। তুমি ইচ্ছেমতো রূপ পরিবর্তন করতে পারো, তোমাকে আমি ইন্দ্রের মহাকরণে কর্মচারী বলে জানি। [বেদে মেঘবর্ষার দেবতারা ইন্দ্রের সখা, সেই বোধই চলে আসছিল] লক্ষণীয়, পুষ্কর, আবর্তক দু’টি বংশের নাম করে যক্ষ যেন মেঘের পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়ের পরিচয় দিল। আর ইন্দ্রের করণিক বলে যক্ষের মনুষ্যোচিত মর্যাদা ও ক্ষমতার ও কর্মক্ষমতার অস্তিত্ব স্বীকার করা হল। কোনও মানুষের পরিচয় জানতে আমরা যেমন তার বংশপরিচয় ও কর্মক্ষেত্রের খবর শুনতে চাই, তেমনি যক্ষও মেঘের বংশপরিচয় ও কর্মস্থলের খবর দিল। এবং দুটোই উচ্চমানের: পুষ্কর ও আবর্তক উঁচু মানের মেঘের বংশ। এবং যক্ষের কর্মস্থলও খোদ দেবরাজ ইন্দ্রের অধিকরণ। অর্থাৎ মেঘ সব রকমেই অভিজাত। এই ভাবে ধীরে ধীরে পাঠকের অগোচরে মেঘ ব্যক্তিতে পরিণত হল। অর্থাৎ এ বার সে যক্ষের বার্তাবহ হতে পারে। এর পরে যক্ষ মেঘকে বলল, তোমাকে সদ্বংশজাত এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারী জানি বলেই তোমার কাছে প্রার্থী হয়ে এসেছি। কারণ, দুদৈবের বশে আজ আমাকে প্রার্থী হতে হয়েছে; অথচ এও ঠিক যে, যার তার কাছে আমি চাইতে পারিনে। যক্ষ নিজেও রাজকর্মচারী, উচ্চবংশের এবং উচ্চপদের কাজে নিযুক্ত। তাই সে বলে, সাধারণ নিচু মানের কারও কাছে চেয়ে সার্থক হওয়ার চেয়ে অভিজাত ব্যক্তির কাছে চেয়ে ব্যর্থ হওয়াও ভাল, তাতে নিজের সম্মান থাকে।
এর পরেই যক্ষ মেঘের যাত্রাপথ সবিস্তারে বর্ণনা করতে পারে। প্রথমেই যক্ষ মেঘের গন্তব্যস্থলের নাম করল, যক্ষদের রাজা কুবেরের রাজধানী অলকার এবং রামগিরি থেকে অলকার দীর্ঘ পথটি মনোরম বর্ণনায় বিবৃত করল।
উত্তরমেঘে মেঘ যখন অলকাপুরীতে পৌঁছবে তখন সে বিরহবিশীর্ণা যক্ষবধূকে দেখবে, যে মেঘের ভ্রাতৃবধূ। এই ভাবে একটা মানবিক সম্পর্কের সৃষ্টি করে যক্ষ মেঘকে আরও ব্যক্তিমর্যাদা দিল। পূর্ব ও উত্তর মেঘের বর্ণনায় ইতস্তত যক্ষ মেঘকে মানুষের মতো দেখেছে সে বিশীর্ণা নদীকে প্রেমিকের মতো জলদানে আশ্বস্ত করতে বলেছে মেঘকে, জনপদবধূদের প্রতি প্রসন্ন হতে বলেছে। অর্থাৎ ধাপে ধাপে তার মানবিক সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে চলেছে।
এই ভাবে মেঘ যখন পাঠকের কাছে যক্ষের ভ্রাতৃসম একটি ব্যক্তিতে পরিণত, তখন যক্ষ কাব্যের শেষে তাকে বলে, ‘বিরহখিন্ন এই যক্ষের জন্য তুমি যা করলে, বা করবে তার জন্যে তোমাকে আমি অগ্রিম আশীর্বাদ করছি: তোমার প্রিয়া বিদ্যুতের সঙ্গে যেন তোমার এক মুহূর্তের জন্যেও না বিচ্ছেদ হয়। যে বিচ্ছেদের দুঃখ যক্ষকে জর্জরিত করছে, সেই অপার দুঃখ যেন মেঘকে কোনও দিন স্পর্শ না করে।’ এই শেষ উক্তিটিতে মেঘের ব্যক্তিসত্তা, পুরুষসত্তা, এমনকী প্রেমিকসত্তা স্বীকৃতি পেল। যক্ষ নিজে প্রেমের আর্তিতে যত যন্ত্রণা ভোগ করেছে তা যেন তার উপকারী ভ্রাতৃসম বন্ধুকে কখনও না পীড়া দেয়। বিরহী যক্ষের কাছে তখন এর চেয়ে বড় কোনও আশীর্বাদই নেই।
যক্ষের সমস্যা ছিল, আটমাস বিরহ সহ্য করে সে অস্থির ও সহ্যশক্তির শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে, আরও চার মাস বধূর সংবাদ না পেয়ে নিজের সংবাদ না দিতে পেরে, তার প্রাণ তখন কণ্ঠাগত হয়েছে। এখন রামগিরি পাহাড়ে সে বার্তাবহ পাবে কোথায়? চোখের সামনে পাহাড়ে মেঘের সারি। মেঘ ও বর্ষার বাতাস যেন অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাসের অর্থাৎ বিরহেরই প্রতীক, তাই সে-ই হবে বিরহের উপযুক্ত বার্তাবহ। উচ্চবংশ, কর্ম এবং পৃথিবীর সন্তাপহারী মেঘই যক্ষের বিরহের যন্ত্রণা লাঘব করতে পারে। মুশকিল মেঘ তো নিষ্প্রাণ জড় পদার্থ, সে কথা এখন নিদারুণ বিরহে ক্লিষ্ট যক্ষের মনে রাখলে চলে না, তাই ধাপে ধাপে তার ওপর মানুষের গুণ, কর্ম, বংশ, দুঃখহরণের অভ্যাস এ সব আরোপ করে, স্মরণ করিয়ে দিল যে, যেহেতু বিরহীর তাপ মোচন করা তার স্বভাবধর্ম, তাই যক্ষবধূর কাছে তার প্রেমিক স্বামীর বার্তাটুকু পৌঁছে দেওয়া তার অভ্যস্ত তাপনিবারণ কর্মের মধ্যেই পড়ে, তাই যক্ষের জন্যে এটা করলে, যক্ষ ও যক্ষবধূর সন্তাপ দূর হলে নির্বাসনের বাকি চার মাস তারা কোনও রকমে কাটিয়ে দিতে পারবে। অলকাপুরীতে পৌঁছে মেঘ হয়তো দেখবে বিরহে, আর্তিতে, ক্লান্তিতে যক্ষবধূ ঘুমিয়ে পড়েছে, ‘সে রকম দেখলে, তার দুর্লভ ঘুমটুকু ভেঙে দিয়ো না, জানালার আলসেতে বসে অপেক্ষা কোরো। ঘুম ভাঙলে তার সঙ্গে কথা বোলো।’
যক্ষবধূর কাছে নিজের কুশলবার্তা জানাতে বলছে মেঘকে। যক্ষ মেঘকে ভ্রাতৃসম্বোধন করে একটা মানবিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এ-ও জড়পদার্থ যে মেঘ তার ধাপে ধাপে মানবকল্প দূত হয়ে ওঠার একটি ধাপ। পাঠক এতক্ষণে মেঘকে আর জড় পদার্থ ভাবছে না, সচেতন দূতই ভাবছে।