মায়াতি

মায়াতি

ব্রাহ্মণ কায়স্থের বিরোধিতা ও পারস্পরিক বিদ্বেষ বহুকাল ধরেই সমাজে বর্তমান। একাদশ শতকের ক্ষেমেন্দ্রের নির্মমালা’য় এ মর্মে বেশ কিছু শ্লোক আছে। আছে চলতি পরিহাস শাস্ত্রেও, যেমন ‘উদ্ভট-শ্লোকসাগর’-এও। ব্রাহ্মণের রচিত শ্লোকে পড়ি : ‘কায়স্থ উদরাবছো মাতুর্মাংসং ন খাদতি। ন হি তত্র দয়া হেতুদন্তাভাববা হি কারণম’।। অর্থাৎ মাতৃগর্ভে কায়স্থ শিশু যে মায়ের মাংস খায় না তার কারণ এই নয় যে মায়ের প্রতি তার দয়া, প্রকৃত কারণ হল তখনো তার দাঁত ওঠেনি। বলাবাহুল্য মূল বক্তব্য হল কায়স্থ স্বভাবতই নৃশংস ও হিংস্র এবং পারলেই ব্রাহ্মণের ক্ষতি করে।

এ ধরনের শ্লোক প্রমাণ করে দু-সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ এবং হিংস্রতা ছিল। এমন ভাবের কারণ কী? ঠিক জানা যায় না, তবে মনে হয় ব্রাহ্মণ বিদ্যাচর্চা ইত্যাদি থেকে ক্রমেই সরে আসছিল, অন্যান্য অর্থকরী বৃত্তিতে নিযুক্ত হচ্ছিল, যেমন পৌরোহিত্য, গুরুগিরি এবং স্মৃতিশাস্ত্রের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম গ্রাম্য স্মার্ত আচার্যের উদ্ভব হয়। এ সব কটি বৃত্তিই লেখাপড়ার চেয়ে বেশি অর্থকরী কাজেই সত্যকার বিদ্যাচর্চা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছিল ব্রাহ্মণ, তা ছাড়া জন্মসত্বেই রাজার কাছে শিরোপা ও দানদাক্ষিণ্য পাচ্ছিল তারা। কিন্তু এই ফাঁকে কায়স্থ যখন। একনিষ্ঠ বিদ্যাচর্চায় এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন স্বভাবতই রাজদরবারে তাদের খাতির বাড়ছিল। লেখাপড়ার কদর রাজদরবারে বাড়ছিল, বাণিজ্য, পাশাপাশি রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক এইসব নানা কারণে। একটা সময়ে সম্ভবত অষ্টম থেকে দশম শতকে রাজসভায় কায়স্থ নানা ব্যাপারে বুদ্ধিগত ও পরামর্শ দেবার জন্য রাজার বা জমিদারের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠল। ব্রাহ্মণের চেয়েও ঈর্ষার কারণ তখন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। তখনই ব্রাহ্মণের মনে হয়ে থাকবে যে। কায়স্থদের সংখ্যা, গুরুত্ব এবং সামাজিক ভূমিকা হ্রাস না করতে পারলে ব্রাহ্মণের গুরুত্ব ও মর্যাদা ক্রমেই পিছিয়ে পড়বে। এর একটা প্রতিবিধান চাই। একটা উপায় হল, সমাজে গুরুত্ব আছে এমন কায়স্থদের সরিয়ে দেওয়া।

এবার বলি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের একটি উপাখ্যান (প্রকৃতিখণ্ড ২৭১২০ ৫৪৯১৯২; প্রকৃতিখণ্ড ৬৫) ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বলছে মায়াতিকে বধ করা দেবীর প্রীতিজনক। সে মায়াতি সচ্ছদ্র বংশের হবে। এখন সচ্ছদ্র হল বৈশ্য ও শূদ্রার সন্তান (বহদ্ধর্মপুরাণ)। প্রসঙ্গটা হল নরমেধ ও অশ্বমেধ। এবং দেখা যায় দুটির মধ্যে অনেক মিল আছে, দুটিতেই দুর্গা সহস্রবৎসর প্রীত থাকেন। এ প্রথা অথর্ববেদে উল্লিখিত আছে।

সচ্ছদ্র, পিতার একমাত্র সন্তান, বিবাহিত, দীক্ষিত এবং অপুত্রক এমন ব্যক্তি হল মায়াতি। পুণ্যার্থী তার আত্মীয়দের কাছে মূল্য দিয়ে তাকে কিনবেন, এরপর একে স্নান করিয়ে চন্দন। লেপন করিয়ে বস্ত্রাদি পরিধান করাবে, মাল্য এবং ধূপ দিয়ে পূজা করবে। একবছর তাকে চক্রদ্বারেণ অর্থাৎ গোল দণ্ডে ঘুরিয়ে বৎসরান্তে তাকে দুর্গার কাছে অষ্টমী বা নবমী তিথিতে বলি দেবে।

এ অনুষ্ঠানে দুটো ব্যাপার চোখে পড়ে: প্রক্রিয়াটা অশ্বমেধ যজ্ঞের যেটা রাজারা করত পাশ্ববতী আঞ্চলিক রাজাদের জয় করবার জন্য। নিজেদের সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়াবার জন্য। সেইরকমই একেও আপ্যায়ন করার কথা। অশ্বমেধের ঘোড়ারই মতন এক বছর ধরে তাকে ঘোরাতে হবে। এবং ‘শেষে’ অশ্বমেধেরই মতো নরমেধ অর্থাৎ বলিদান দিতে হবে। এতে দুর্গা একহাজার বছর প্রীত থাকতেন কিনা জানা যায় না। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা দীর্ঘকালের মতো নিষ্কণ্টক, নিরুপদ্রব, শান্তিপূর্ণ জীবন পেতেন সেটা নিশ্চিত।

কণ্টক হল সচ্ছূদ্র, রাজদ্বারে যার প্রচুর খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বাড়ছিল সেই পরিমাণে যে পরিমাণে ব্রাহ্মণের প্রতিপত্তি কমছিল। সচ্ছদ্র ও ‘করণ’রাই তখন বিদ্যাশিক্ষায় ও চর্চায় অগ্রসর। রাজার সঙ্গে প্রতিবেশী রাজশক্তিগুলির বণিকের, বহির্বাণিজ্যের ও অন্তর্বাণিজ্যেরও হিসাব ও বৃদ্ধির উপায় নির্ণয়ে রাজাকে উপযুক্ত পরামর্শ দেবার মতো সাধারণ জ্ঞান ও শাস্ত্রজ্ঞান তারা। অর্জন করেছিল বলে ভেতরে ভেতরে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। এটা স্বভাবতই ব্রাহ্মণদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল ক্রমেই, এবং এর প্রতিকারের জন্য তারা এই মায়াতি-নিধনের ব্যবস্থা উদ্ভাবন ও অনুষ্ঠান করেন। যদি ধরেও নিই যে একটা অঞ্চলে বছরে চার-পাঁচটার বেশি মায়াতি পাওয়া যেত না তা হলেও একটির নিধন মানে একটি কায়স্থ বা সচ্ছদ্র বংশের বিলোপ হত তা হলেও সামাজিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি রক্ষার ব্যাপারে তার মূল্য কম ছিল না।

মূল্য এই : একটি সহূদ্র বংশের বিলোপ মানে শুধু সে-ই নয়, সে পিতৃমাতৃহীন কাজেই তার ভাই জন্মাবে না। সে বিবাহিত কিন্তু অপুত্রক কাজেই তার বংশবৃদ্ধিও আর হবে না। সে অভ্রাতৃক, পিতামাতার একমাত্র সন্তান, কাজেই সে বংশের বৃদ্ধির আর সম্ভাবনা থাকল না। এর দ্বারা একটি অঞ্চলে একটি সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবার একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেল। ঠিক সেই পরিমাণে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় আরো বেশি নিষ্কণ্টক হল। বলা বাহুল্য, এভাবে সমস্ত সচ্ছদ্র নিকেশ করা সম্ভবও ছিল না এবং ব্রাহ্মণদেরও তা অজানা ছিল না। তবু যতটুকু করা যায় ততটুকুই লাভ। লক্ষণীয়, এটা নরমেধ, যা পণ্ডিতেরা অনুমান করেন খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের পরে কখনোই অনুষ্ঠিত হয়নি, আগেও খুব কমই হয়েছে, কারণ খুব অল্পকালের মধ্যেই মানুষের বিকল্প নির্ধারিত হয় এবং সেই বিকল্পকেই হত্যা করে নরমেধের পুণ্য অর্জিত হত।

মায়াতির মধ্যে সমস্ত সামাজিক সম্ভাবনাযুক্ত একটি পুরুষের বিকাশের দ্বারা তাঁর, তাঁর বংশের দ্বারা বেশি সম্মুদ্রজন্মের সম্ভবনা নষ্ট হল। একজন বিদ্বান বুদ্ধিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধীতী পণ্ডিতের পরামর্শ, যেটা অনেক ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণবিরোধী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেই আশঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়া গেল।

ব্রাহ্মণও ক্ষত্রিয়ের (যার মধ্যে করণ, সচ্ছদ্র) মতো অস্ত্রধারণ করে মায়াতি নিকেশ করতে পারত না (যদিও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বেশ কিছু ব্রাহ্মণ অস্ত্রধারণ করেছিল— তবে সেটা ছিল যুদ্ধ) তাই এই একটা বিকল্প উপায়ে অল্প কিছু হলেও কৃতী, বিজ্ঞান সহ্দ্র প্রতিদ্বন্দ্বীর বিলোপ সম্ভব হতে পারত যথালাভ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *