দেবতাদের ছলনা

দেবতাদের ছলনা

দেবতারা সকলে নয়, তবে অনেকেই তাঁদের অলৌকিক শক্তির মহিমায় উচ্চস্থানে আসীন, নৈতিক উৎকর্ষের জন্য নয়। শিবের সঙ্গে গ্রাম্য মেয়েদের নানা সম্পর্কের কথা শাস্ত্রে লেখে। ব্রহ্মা নিজের কন্যার প্রতি আসক্ত হন। বিষ্ণু বহু রূপে নারীদের ভোগ করেছেন। কৃষ্ণ অবতারে আটটি স্ত্রী এবং ষোলোশো গোপিনী ছাড়াও আরও অনেক রূপে নারীকে ভোগ করেছেন। ইন্দ্র নানা রকম অপকর্ম করেছেন— ভিন্ন বেশে পরস্ত্রী সম্ভোগ থেকে ছদ্মবেশে অসুরী বিলিষ্টেঙ্গা ও অন্যান্য নারীকে প্রবঞ্চনা করে ভোগ করা এ সব তাঁর নিত্যকর্মের মতো ছিল। বেদের ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে এক জায়গায় তাঁর নানা পাপের ফিরিস্তি দেওয়া আছে। ছোট একটা অপেক্ষাকৃত ‘নির্মল’ পাপ হল: অসুররা স্বর্গে যাবার জন্যে ইটের পরে ইট সাজিয়ে স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি করছিলেন, এমন সময়ে, শুরুর কাছাকাছি সময়েই ইন্দ্ৰ বললেন, ‘আমার এই চিত্রা ইষ্টকাখানি (ছবি আঁকা ইট) তোমরা তোমাদের সিঁড়িতে নেবে?’ শুনে তো অসুররা মহা খুশি, পেতে দিল ইন্দ্রর ইট। সিঁড়ি যখন খুব উঁচু হয়ে স্বর্গের প্রায় কাছাকাছি, তখন ইন্দ্র এসে ঘাড় চুলকিয়ে বললেন, ‘ভারী মুশকিল হয়েছে, ওই ইটটি যজ্ঞবেদিতে লাগবে, ওটি আমার চাই।’ নিয়ে নেওয়ামাত্র সিঁড়িটি ভেঙে পড়ল, অসুরদের স্বর্গারোহণের স্বপ্ন ভেঙে গেল। এ ছাড়া, বাঁকে করে জিনিসপত্র এনে অসুরদের ঠকানো, ছদ্মরূপে স্বামীর বেশে স্ত্রীকে ছলনা করা, এ সব তাঁর নিত্যকর্ম ছিল বললেই হয়। লোককে মিথ্যা বলে ঠকানো, এও তাঁর অভ্যাস ছিল।

বৃহস্পতি ছিলেন দেবগুরু, দেবতাদের আচার্য, খুব খাতির তাঁর দেবতা এবং মানুষের মধ্যে। তাঁর স্ত্রী তারা, দেবতাদের গুরুপত্নী। বেশ অনেক কাল দু’জন সংসার করবার পর তারার কামনা হল, চন্দ্রের জন্য; চন্দ্র অবশ্য অনেককাল ধরেই তারার জন্য লুব্ধ ছিলেন। একসময় বৃহস্পতির প্রতি তারার অনীহা এমন প্রবল হল যে, তিনি বৃহস্পতিকে ত্যাগ করে চন্দ্রের বাড়ি এসে উপস্থিত হন। চন্দ্ৰ তো মহা উল্লসিত। এক সঙ্গে রইলেন দু’জনে বেশ কিছুকাল। বৎসরান্তে তারার একটি পুত্র হল, নাম হল বুধ। বৃহস্পতি চন্দ্রের বাড়ি হাজির হয়ে স্ত্রী এবং পুত্রকে দাবি করলেন। চন্দ্র আপত্তি করলেন না; তারা বুধকে নিয়ে বৃহস্পতির বাড়ি চলে এলেন এবং সেখানেই রইলেন।

এ সব কাহিনিতে কতকগুলি লক্ষ করবার বিষয় আছে, তারা-বৃহস্পতি-চন্দ্রের কাহিনিটি আজকের সমাজে প্রায় অচল। এর নায়ক-নায়িকা দেবতা, তবুও পরস্ত্রীর সঙ্গে সহবাস এবং নিজের ঔরসে পরস্ত্রীর গর্ভে জাত পুত্রকে চন্দ্র ছেড়ে দিলেন, ছেড়ে দিলেন স্বয়মাগতা প্রণয়িনী তারাকেও। দেবগুরু বৃহস্পতি চন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘকাল সহবাস করার পরও তারাকে পুনরায় গ্রহণ করলেন এবং তারই সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। হয়তো বৃহস্পতির পুত্রের প্রয়োজন ছিল এবং নিজ ঔরসে পাননি সে পুত্র বলেই বুধকে গ্রহণ করলেন। কিন্তু সমাজ তখনও পরস্ত্রীর সঙ্গে সহবাসকে পাপ মনে করত, এখনও করে। তবু এমনটা ঘটেছিল।

তুলসী ছিলেন এক বণিকের তরুণী স্ত্রী। নারায়ণ তাঁর প্রেমে পড়ে তুলসীর স্বামীর রূপ ধারণ করেন এবং নিজেকে তুলসীর স্বামী বলে পরিচয় দিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। তুলসীর একটু খটকা লাগে, বলেন, ‘তুমি আমার স্বামী নও’। তাতে নারায়ণ বললেন, তিনি নারায়ণ, বৈকুণ্ঠে তিনিই তুলসীর স্বামী নারায়ণ ছিলেন, তুলসী ছিলেন তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী। মুনিঋষিরাও এমন প্রতারণা হামেশা করতেন, তার প্রভূত নজির রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণগুলিতে। সংখ্যাতেও যেমন কম নয়, বৈচিত্র্যেও তেমনি অসংখ্য।

দেবতারা মিথ্যাচারণ করতেন প্রায়ই। এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু কেন করতেন? প্রথমেই বলা প্রয়োজন, মানুষের অর্থে এঁরা ছিলেন অনৈতিক। যখন আর্যরা এ দেশে এসে প্রাগার্যদের হঠিয়ে দিয়ে বসবাস শুরু করেন, তখন তাঁদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল প্রাগার্যদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করা। এর জন্যে চাই শৌর্য, তারই চর্চা হত এবং সেটাই চরিত্রের ঐশ্বর্য বলে গণ্য হত। অন্যান্য নৈতিকতা হয়ে গেল গৌণ। বিষ্ণু-নারায়ণের ছলনা ও মিথ্যাচারের বহু কাহিনি প্রচলিত, এমন কারও নয়। গীতায় অর্জুন নানা প্রতিবাদী যুক্তি দিয়ে কৃষ্ণের কথার খণ্ডন করেই চলেছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণ কোনও মতেই অর্জুনের সমর্থন বা আনুগত্য পাচ্ছিলেন না। এ-ই চলেছিল দশটি অধ্যায় ধরে। অবশেষে একাদশ অধ্যায়ে জাদুবিদ্যায় তিনি তাঁর বিশ্বরূপ দেখালেন অর্জুনকে এবং তার পরেই অর্জুন নতমস্তকে কৃষ্ণের ওই রূপের কাছে বা তার মধ্যে যে অলৌকিক মহিমা প্রকাশ হয়েছিল, তার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেন। যুক্তির স্তরে যে গ্রন্থে দশ অধ্যায়ের তর্ক, তার সমাধান হল যুক্তি বহির্ভূত জাদুবিদ্যায়। এটিও যেন এক ধরনের ছলনা। মনে রাখতে হবে, বিশ্বরূপ দর্শনের আগে অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছিলেন কৃষ্ণ, এর মাধ্যমেও প্রসঙ্গটা চিন্তার স্তর থেকে অকস্মাৎ অলৌকিকের স্তরে উঠে গেল। এর মধ্যেও কি কোনও প্রচ্ছন্ন প্রতারণার আভাস নেই?

হঠাৎ মনে হচ্ছে, দেবতারাই ছলনা করেছেন মহাকাব্যে ও পুরাণে, দেবীরা নয়। না, কোনও মন্তব্য করছি না, শুধু একটা তথ্য পরিবেশন করছি মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

দেবতাদের ছলনা

দেবতাদের ছলনা

দেবতাদের ছলনা

দেবতারা সকলে নয়, তবে অনেকেই তাঁদের অলৌকিক শক্তির মহিমায় উচ্চ স্থানে আসীন, নৈতিক উৎকর্ষের জন্য নয়। শিবের সঙ্গে গ্রাম্য মেয়েদের নানা সম্পর্কের কথা শাস্ত্রে লেখে। ব্রহ্মা নিজের কন্যার প্রতি আসক্ত হন। বিষ্ণু বহু রূপে নারীদের ভোগ করেছেন। কৃষ্ণ অবতারে আটটি স্ত্রী এবং ষোলোশো গোপিনী ছাড়াও আরো অনেক রূপে নারীকে ভোগ করেছেন। ইন্দ্র নানারকম অপকর্ম করেছেন— ভিন্ন বেশে পরস্ত্রী সম্ভোগ থেকে ছদ্মবেশে অসুরী বিলিষ্টেঙ্গা ও অন্যান্য নারীকে প্রবঞ্চনা করে ভোগ করা এসব তাঁর নিত্যকর্মের মতো ছিল। বেদের ব্রাহ্মণ সাহিত্যে এক জায়গায় তাঁর নানা পাপের ফিরিস্তি দেওয়া আছে। ছোটো একটা অপেক্ষাকৃত ‘নির্মল’ পাপ হল: অসুররা স্বর্গে যাবার জন্যে ইটের পরে ইট সাজিয়ে স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি করছিলেন, এমন সময়ে, শুরুর কাছাকাছি সময়েই ইন্দ্র বললেন, ‘আমার এই চিত্রা ইষ্টকা (ছবি আঁকা ইট) খানি তোমরা তোমাদের সিঁড়িতে নেবে?’ শুনে তো অসুররা মহা খুশি, পেতে দিল ইন্দ্রর ইট। সিঁড়ি যখন খুব উঁচু হয়ে স্বর্গের প্রায় কাছাকাছি, তখন ইন্দ্র এসে ঘাড় চুলকিয়ে বললেন, ‘ভারী মুশকিল হয়েছে, ওই ইটটি যজ্ঞবেদিতে লাগবে, ওটি আমার চাই।’ নিয়ে নেওয়ামাত্র সিঁড়িটি ভেঙে পড়ল, অসুরদের স্বর্গারোহণের স্বপ্ন ভেঙে গেল। এ ছাড়া, বাঁকে করে জিনিসপত্র এনে অসুরদের ঠকানো, ছদ্মরূপে স্বামীর বেশে স্ত্রীকে ছলনা করা এসব তাঁর নিত্যকর্ম ছিল বললেই হয়। লোককে মিথ্যা বলে ঠকানো, এও তাঁর অভ্যাস ছিল।

বৃহস্পতি ছিলেন দেবগুরু, দেবতাদের আচার্য, খুব খাতির তাঁর দেবতা এবং মানুষের মধ্যে। তাঁর স্ত্রী তারা, দেবতাদের গুরুপত্নী। বেশ অনেক কাল দুজন সংসার করবার পর তারার কামনা। হল চন্দ্রের জন্য; চন্দ্র অবশ্য অনেককাল ধরেই তারার জন্য লুব্ধ ছিলেন। একসময় বৃহস্পতির প্রতি তারার অনীহা এমন প্রবল হল যে তিনি বৃহস্পতিকে ত্যাগ করে চন্দ্রের বাড়ি এসে উপস্থিত হন। চন্দ্র তো মহা উল্লসিত। একসঙ্গে রইলেন দুজনে বেশ কিছুকাল। বৎসরান্তে তারার একটি পুত্র হল, নাম হল বুধ। বৃহস্পতি চন্দ্রের বাড়ি হাজির হয়ে স্ত্রী এবং পুত্রকে দাবি করলেন। চন্দ্র আপত্তি করলেন না; তারা বুধকে নিয়ে বৃহস্পতির বাড়ি চলে এলেন এবং সেখানেই রইলেন।

এসব কাহিনিতে কতকগুলি লক্ষ করবার বিষয় আছে, তারা-বৃহস্পতি-চন্দ্রের কাহিনিটি আজকের সমাজে প্রায় অচল। এর নায়কনায়িকা দেবতা তবুও পরস্ত্রীর সঙ্গে সহবাস এবং নিজের ঔরসে পরস্ত্রীর গর্ভে জাত পুত্রকে চন্দ্র ছেড়ে দিলেন, ছেড়ে দিলেন স্বয়মাগতা প্রণয়িনী। তারাকেও। এবং দেবগুরু বৃহস্পতি চন্দ্রের সঙ্গে দীর্ঘকাল সহবাস করার পরও তারাকে পুনরায়

গ্রহণ করলেন এবং তারই সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। হয়তো বৃহস্পতির পুত্রের প্রয়োজন ছিল এবং নিজ ঔরসে পাননি সে পুত্র বলেই বুধকে গ্রহণ করলেন। কিন্তু সমাজ তখনো পরস্ত্রীর সঙ্গে সহবাসকে পাপ মনে করত, এখনো করে। তবু এমনটা ঘটে ছিল।

তুলসী ছিলেন এক বণিকের তরুণী সুন্দরী স্ত্রী। নারায়ণ তাঁর প্রেমে পড়ে তুলসীর স্বামীর রূপ ধারণ করেন এবং নিজেকে তুলসীর স্বামী বলে পরিচয় দিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। তুলসীর একটু খটকা লাগে, বলেন, ‘তুমি আমার স্বামী নও’। তাতে নারায়ণ বললেন তিনি নারায়ণ, বৈকুণ্ঠে তিনিই তুলসীর স্বামী নারায়ণ ছিলেন, তুলসী ছিলেন তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী। মুনিঋষিরাও এমন প্রতারণা হামেশা করতেন, তার প্রভূত নজির রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণগুলিতে। সংখ্যাতেও যেমন কম। নয়, বৈচিত্র্যেও তেমনি অসংখ্য।

দেবতারা মিথ্যাচারণ করতেন প্রায়ই। এ নিয়ে কোন সংশয় নেই। কিন্তু কেন করতেন? প্রথমেই বলা প্রয়োজন, মানুষের অর্থে এঁরা ছিলেন অনৈতিক। যখন আর্যরা এদেশে এসে প্রাগার্যদের হঠিয়ে দিয়ে বসবাস শুরু করেন, তখন তাঁদের সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন ছিল প্রাগার্যদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করা। এর জন্যে চাই শৌর্য, তারই চর্চা হত এবং সেটাই চরিত্রের ঐশ্বর্য বলে গণ্য হত। অন্যান্য নৈতিকতা হয়ে গেল গৌণ। বিষ্ণু-নারায়ণের ছলনা ও মিথ্যাচারের বহু কাহিনি প্রচলিত, এমন কারো নয়। গীতায় অর্জুন নানা প্রতিবাদী যুক্তি দিয়ে কৃষ্ণের কথার খণ্ডন করেই চলেছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণ কোনোমতেই অর্জুনের সমর্থন বা আনুগত্য পাচ্ছিলেন না। এ-ই চলেছিল দশটি অধ্যায় ধরে। অবশেষে একাদশ অধ্যায়ে জাদুবিদ্যায় তিনি তাঁর বিশ্বরূপ দেখালেন অর্জুনকে এবং তার পরেই অর্জুন নতমস্তকে কৃষ্ণের ওই রূপের কাছে বা তার মধ্যে যে অলৌকিক মহিমা প্রকাশ হয়েছিল তার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেন। যুক্তির স্তরে যে গ্রন্থে দশ অধ্যায়ের তর্ক, তার সমাধান হল যুক্তি বহির্ভূত, জাদুবিদ্যায়। এটিও যেন এক ধরনের ছলনা। মনে রাখতে হবে বিশ্বরূপ দর্শনের আগে অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছিলেন কৃষ্ণ, এর মাধ্যমেও প্রসঙ্গটা চিন্তার স্তর থেকে অকস্মাৎ অলৌকিকের স্তরে উঠে গেল। এর মধ্যেও কি কোনো প্রচ্ছন্ন প্রতারণার আভাস নেই?

হঠাৎ মনে হচ্ছে, দেবতারাই ছলনা করেছেন মহাকাব্যে ও পুরাণে, দেবীরা নয়। না, কোনো মন্তব্য করছি না, শুধু একটা তথ্য পরিবেশন করছি মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *