মানুষ বাঁচে কেন

মানুষ বাঁচে কেন

প্রশ্নটি চিরকালের: উত্তরও নানা দেশে কালে কালে ভিন্ন রূপে এসেছে। মহাভারতে এর একটি উত্তর স্ত্রীপর্বে (৫:২-২২, ৬:১-১২) একটি রূপক কাহিনিতে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে একটি গল্প বললেন। এক ব্রাহ্মণ সিংহব্যাঘ্রসংকুল এক অরণ্যে প্রবেশ করে নীরন্ধ্র অন্ধকারে চলেছেন, ভয়ে তাঁর দেহে রোমাঞ্চ হচ্ছে। এগোতে এগোতে দেখলেন, ওই বনটির চতুর্দিক লতাগুল্মজালে আবৃত, কোনও এক ঘোররূপিণী নারী যেন দু’হাত বিস্তৃত করে সমগ্র আয়তনটিকে ধারণ করে আছেন। পঞ্চশীর্ষ সর্পেরা, পর্বতের মতো উচ্চ বৃক্ষশীর্ষ এবং কূপের জলের নীচে ভেকেরা। মানুষটি পড়বার সময়ে উচ্চপদ, অধোমুখ অবস্থায় পড়ে একটি ঝুলন্ত লতাকে আঁকড়ে ধরে আছে। সেই লতাটির মূলে ইঁদুর নিরন্তর দাঁত দিয়ে কেটে চলেছে, যে-কোনও মুহূর্তে মূল বিচ্ছিন্ন হলেই মানুষটি নীচে কূপের জলে পড়ে যাবে। অপেক্ষমান সাপেদের উপরে পড়ে সে প্রাণ হারাবে। এখন কাঁঠাল গাছে লম্বমান ফলের মতো সেই মানুষটি লতা অবলম্বন করে ঝুলে আছে। কূপের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রকাণ্ড হাতি; অর্থাৎ লম্বমান মানুষটি যদি কোনওক্রমে উঠতেও পারে, তা হলে হাতিটিই তার প্রাণনাশ করবে। চারিদিকে ঘোররূপ মৌমাছি উড়ছে। হাতিটিও ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। কূপের তটে বৃক্ষের শাখায় শাখায় এরা মধু সঞ্চয় করছে একাগ্র ভাবে। ওই মধুচক্র থেকে মধুর ধারা নীচে পড়ছে এবং মধ্যে মধ্যে দু’-এক বিন্দু মধু ঝরে পড়ছে তার মুখে। পরিমাণে তা এতই সামান্য যে, একটি বালকেরও তাতে তৃপ্তি হবে না। তবু সেই বিন্দু বিন্দু মধু সাগ্রহে সানন্দে পান করছে লোকটি।

এই হল মানুষের জীবন। চতুর্দিকে নানা রকম বিপদে, রোগের আক্রমণের আতঙ্কে এবং অকস্মাৎ মৃত্যুভয়ে, বন্ধুবিরহে, নানা ভাবে মানুষ পর্যুদস্ত। ভয় ও আশঙ্কা বহুরূপে মানুষকে চারিদিক থেকে অতর্কিত আক্রমণের সম্ভাবনা আনে এবং বিপদ নানারূপে আক্রমণও করে, নিরপরাধ মানুষের জীবনান্তও হয়। সব মানুষই এ কথা জানে এবং এই বিপদসংকুল পরিবেশের মধ্যেই জীবন কাটায়। দেখতে পায়, চতুর্দিকে মানুষের যে পরিবেশ তাতে তার আতঙ্ক বাড়ে, ত্রাসে ব্যাকুল হয়ে জীবন সম্বন্ধে হতাশ হয়ে পড়ে। দিন চলে এই চতুর্দিকের সন্ত্রাস, অনিশ্চয়তা এবং প্রায় ধ্রুব মৃত্যুর পরিবেশে। এর থেকে মানুষ কোনও পরিত্রাণ খুঁজে পায় না। এবং পাবে না যে— সে কথাও সে নিশ্চিত ভাবেই জানে।

ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে প্রশ্ন করেন, সেই বিপন্ন মানুষটির কি কোনও পথ আছে পরিত্রাণের? সে কি বাঁচবে কোনও মতে? মৃত্যুই তো তার অবধারিত শেষ, কী হবে তার? তখন বিদুর বলেন, মহারাজ, এটি একটি রূপক, সত্য ঘটনা নয়। ওই যে অরণ্যটি, ওটিই হল সংসার। হিংস্র জন্তুগুলি হল নানা ব্যাধি। ওই যে নারীটি দু’-হাত প্রসারিত করে দু’-দিক থেকে সংসারকে আগলে রেখেছে, সে হল জরা, যার থেকে কারও পরিত্রাণ নেই। ওই কূপটি হল মানুষের দেহ। তার নীচে যে মহাসর্প, সে হল কাল। ব্যাধিও নয়, শোকও নয় কিন্তু কাল বা মহাকাল মানুষকে ধীরে ধীরে অক্ষম, অসমর্থ, নিস্তেজ ও নির্জীব করে তোলে। হয় জীবন স্বল্পস্থায়ী; কৈশোরে বা যৌবনে অকালমৃত্যুতে শেষ হয়, নয়তো দীর্ঘ-বিলম্বিত হয়ে অক্ষম, জীবনৃত অবস্থায় প্রলম্বিত হতে থাকে। মানুষ তার অভ্যস্ত কর্মক্ষমতা হারায় ও অর্ধমৃত অবস্থায় দিন কাটায়। মহাকাল এমন এক শক্তি, সব মানুষকেই তার বশ্যতা স্বীকার করতে হয় এবং কালের দ্বারা গ্রস্ত মানুষের স্বাধীন কর্মের ক্ষমতা থাকে না বলে তার জীবন ক্রমেই তার কাছে অর্থহীন হয়ে ওঠে। কালের কাছে নতিস্বীকার করার পর থেকে তার মনুষ্য-মর্যাদা ক্রমেই ক্ষীণ হতে থাকে এবং জীবনটা অনেকাংশেই যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। এই সম্ভাবনা— অর্থাৎ কালের অধীনে থাকা বাকি জীবনটা জীবনের আনন্দ, স্বাধীনতা ও মর্যাদাও অনেকাংশে হারায়। ব্যতিক্রম আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তারা নিতান্তই সংখ্যালঘু, অধিকাংশের পক্ষে কাল এক ক্রূর এবং সর্বশক্তিমান প্রভু, তার অধীন মানুষরা মৃত্যুর পরের অবস্থা জানে না তাই আরও ভয় পায়। মহারাজ, মানুষের শেষ অবস্থা— মৃত্যু। কূপের মধ্যে প্রলম্বিত যে লতাটি, যাকে অবলম্বন করে লোকটি লম্বিত অবস্থায় আছে, সেটি হল বাঁচবার আশা, যাকে মানুষ দৃঢ় হাতে ধরে থাকে, মনে করে লতাটি শক্ত, ছিঁড়বে না কোনও দিন। কিন্তু একদিন আসে যখন তার জীবনের আশা ছিঁড়ে যায়, লতা থেকে খসে পড়ে মানুষটি, আশা করবার আর কিছু থাকে না তার। ওই রূপটি হল মানুষের দেহ। কূপটির অভ্যন্তরে ধাপে ধাপে এগোচ্ছে ছয়মুখের যে মহাগজটি, সেটি হল সংবৎসর, তার ছটি মুখ হল ছয় ঋতু। যে ইঁদুরগুলি চারদিক থেকে গাছের মূলগুলি কেটে দিচ্ছে, সেগুলি হল, দিন ও রাত। কালের প্রত্যক্ষ রূপ হল সংবৎসর। মানুষ তো কালকে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারে না, সে খবর রাখে সংবৎসরের। যাকে সে নির্দিষ্ট কালের আবর্তনে ক্রমে ক্রমে চিনে রাখে এবং ফলে যা তার কাছে অমোঘ এক শক্তি হিসেবেই জানে, যার বিরুদ্ধতা করা তার পক্ষে অসম্ভব। অদৃশ্য মহাকালের প্রত্যক্ষ রূপ হল সংবৎসর। অনিবার্য এবং যান্ত্রিক ভাবে সুনির্দিষ্ট হবার ফলে, মানুষের শক্তির পরিসরের বাইরে বলেই সংবৎসর ভয়াবহ। ওই যে মৌমাছিগুলি গাছের ওপর নিরন্তর ভনভন করে, সেগুলি হল মানুষের কামনা, যার থেকে মানুষের পরিত্রাণ নেই। আর ওই যে মধুধারা বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ে, তা হল কামরস, অর্থাৎ কামনার পরিতৃপ্তি, যার ফলে মানুষ বাঁচে, বাঁচতে চায়। অর্থাৎ যা দিয়ে মানুষ এত অজস্র বিপদ, রোগব্যাধি আপতিক আক্রমণের পরিবেশের মধ্যেও বেঁচে থাকে এবং বেঁচে থাকতে চায়। মানুষ সন্ন্যাস গ্রহণ না করলে নানা বাসনার প্রভাবেই নিয়ন্ত্রিত তার জীবন। এর অন্যথা নেই বলেই সকল মানুষ এগুলির প্রভাবের অধীন, তাই এগুলি ভয়াবহ।

এই তো হল জীবন। সংসারচক্রের ঘূর্ণন এই ভাবেই ঘটে চলে। মানুষ তার দেহ, মনের নানাবিধ কামনার আবর্তন, চারিপাশে নানা ধরনের রোগব্যাধি, দুর্যোগ, বিপর্যয় সম্বন্ধেও অবহিত, মৃত্যুর যন্ত্রণায় আশাভঙ্গের সম্ভাবনা সম্বন্ধেও যে অবহিত এবং সে এ-ও জানে যে, বাঁচতে হলে এর মধ্যেই বাঁচতে হবে। তবু মানুষ হাল ছেড়ে দেয় না, বিপদের সম্ভাবনা সম্বন্ধে তার কোনও মোহ নেই, সে জানে যে, বেঁচে থাকা মানেই নানা আতঙ্ক, আশঙ্কা, সত্যকার বিপদ নানা দিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করতে পারে এবং অহরহ করছেও। যতদিন সে বাঁচবে, এ সব আক্রমণ নিরন্তর চলবেই। কিন্তু মানুষ হাল ছাড়ে না। যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও ক্রূর রূপ ধরে মৃত্যুদূত এসে জীবনের অবসান ঘটাবে— এর থেকে কোনও আত্যন্তিক নিষ্কৃতি নেই— যন্ত্রণা, বিপদ এবং অবশেষে মৃত্যু অবধারিত। তার থেকে কিছুই তাকে বাঁচাতে পারবে না। তবুও সে বাঁচবার জন্যে ব্যাকুল। প্রাণপণে ওই আশালতাটি ধরে আছে, বিচিত্র এ জীবনের নানা রূপের আক্রমণ থেকে বাঁচবার চেষ্টা করছে এটা জেনেই যে, শেষরক্ষা হবে না। যে-কোনও রোগের আক্রমণ, দুঃখ, বিচ্ছেদ অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুর আক্রমণ, ইষ্টবিরহ, অনিষ্ট-সংযোগ, প্রচণ্ড অভাব, দুঃসহ যন্ত্রণা এ সবই তার পাওনা। সংসার যেন বিচিত্র অনাকাঙ্ক্ষিত রূপে নানা অয়োজন করে রেখেছে, একেবারে অনতিক্রম্য বিপদের অক্ষৌহিণী চতুর্দিকে অপেক্ষা করছে, তাকে, মানুষকে, নানাবিধ যন্ত্রণা দিয়ে অবশেষে মৃত্যুতে তার জীবনের অবসান ঘটাবে।

আশ্চর্য এই যে, মানুষ এ সম্ভাবনার কাছে হার মানে না, বাঁচবার চেষ্টা নিয়তই করে চলে। কেন? ওই যে মৌচাক থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু তার মুখে ঝরে পড়ছে, এতে তার তৃষ্ণা মেটে না বরং বেড়েই চলে। তবু ওই মধু তো মধুই। তা লোভ জাগায়, লোভ বাড়ায়, যথেষ্ট না পাওয়ার ক্ষোভ বাড়ায়। কিন্তু এত সামান্য পরিমাণে তা পাওয়া যায়, যে তৃপ্তি আসে না। তৃষ্ণাই বাড়ে শুধু। তবু মানুষ অদম্য। ওইটুকু মধুর ফোঁটার জন্য বিচিত্র ধরনের দুঃখ্যাতনা ভয়সন্ত্রাস সহ্য করেই চলে, অন্তিমে মৃত্যুকে ঠেকানো যাবে না, এটাও সে নিশ্চিত ভাবে জানে।

একদিকে এর মধ্যে মানুষের মহত্ত্বই ঘোষিত হল— তার বিপদসন্ত্রাস থেকে কোনও দেবতা তাকে বাঁচাবে না, তা সে জানে। জ্বালাযন্ত্রণা নানারূপে তাকে সারাজীবন তাড়া করে ফিরবে, তার থেকে কেউ পরিত্রাণ করবে না, এ কথাও সে নিশ্চিত ভাবে জানে, তবু ওই বিপৎসংকুল পরিবেশের মধ্যেই মধুলোভী মানুষটি মধ্যে মধ্যে ঝরে-পড়া মধুবিন্দুর আশায় উপরে-নীচে-পাশে সব দিক থেকে আসা বিপদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সঙ্গে নিরন্তর যে সংগ্রাম করে চলেছে— পৃথিবীর ইতিহাসের আদি পর্ব থেকে— শুধু আজ পর্যন্ত নয়, অনন্ত কাল ধরেই করে চলবে, তার কোনও তুলনা নেই। শুধু তাই নয়, তার একটা অম্লান গৌরবও আছে, সে কথা প্রতিবিম্বিত হয়েছে এই রূপক কাহিনিতে। বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা… বিপদে যেন করিতে পারি জয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

মানুষ বাঁচে কেন

মানুষ বাঁচে কেন?

মানুষ বাঁচে কেন?

প্রশ্নটি চিরকালের : উত্তরও নানা দেশে কালে কালে ভিন্ন রূপে এসেছে। মহাভারতে এর একটি উত্তর স্ত্রীপর্বে (৫/২-২২, ৬/১-১২) একটি রূপক কাহিনিতে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে একটি গল্প বললেন। এক ব্রাহ্মণ সিংহব্যাঘ্ৰসংকুল এক অরণ্যে প্রবেশ করে নীর অন্ধকারে চলেছেন, ভয়ে তাঁর দেহে রোমাঞ্চ হচ্ছে। এগোতে এগোতে দেখলেন ওই বনটির চতুর্দিক লতাগুল্মজালে আবৃত, কোনো এক ঘোররূপিণী নারী যেন দুহাত বিস্তৃত করে সমগ্র আয়তনটিকে ধারণ করে আছেন। পঞ্চশীর্ষ সর্পেরা, পর্বতের মতো উচ্চ বৃক্ষশীর্ষ এবং কূপের জলের নীচে ভেকেরা। মানুষটি পড়বার সময়ে উচ্চপদ, অধোমুখ অবস্থায় পড়ে একটি ঝুলন্ত লতাকে আঁকড়ে ধরে আছে। সেই লতাটির মূলে ইঁদুর নিরন্তর দাঁত দিয়ে কেটে চলেছে, যে-কোনো মুহূর্তে মূল বিচ্ছিন্ন হলেই মানুষটি নীচে কূপের জলে পড়ে যাবে। অপেক্ষমান সাপেদের উপরে পড়ে সে প্রাণ হারাবে। এখন কাঁঠাল গাছে লম্বমান ফলের মতো সেই মানুষটি লতা অবলম্বন করে ঝুলে আছে। কূপের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রকাণ্ড হাতি; অর্থাৎ লম্বমান মানুষটি যদি কোনোক্রমে উঠতেও পারে, তা হলে হাতিটিই তার প্রাণনাশ করবে। চারিদিকে ঘোররূপ মৌমাছি উড়ছে। হাতিটিও ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। কূপের তটে বৃক্ষের শাখায় শাখায় এরা মধু সঞ্চয় করছে একাগ্রভাবে। ওই মধুচক্র থেকে মধুর ধারা নীচে পড়ছে এবং খুব মধ্যে মধ্যে দু-এক বিন্দু মধু ঝরে পড়ছে তার মুখে। পরিমাণে তা এতই সামান্য যে একটি বালকেরও তাতে তৃপ্তি হবে না। তবু সেই বিন্দু বিন্দু মধু সাগ্রহে সানন্দে পান করছে লোকটি।

এই হল মানুষের জীবন। চতুর্দিকে নানারকম বিপদে, রোগের আক্রমণের আতঙ্কে এবং অকস্মাৎ মৃত্যুভয়ে, বন্ধুবিরহে, নানাভাবে মানুষ পর্যুদস্ত। ভয় ও আশঙ্কা বহুরূপে মানুষকে। চারিদিক থেকে অতর্কিত আক্রমণের সম্ভাবনা আনে এবং বিপদ নানারূপে আক্রমণও করে, নিরপরাধ মানুষের জীবনান্তও হয়। সব মানুষই একথা জানে এবং এই বিপৎসংকুল পরিবেশের মধ্যেই জীবন কাটায়। দেখতে পায় চতুর্দিকে মানুষের যে পরিবেশ তাতে তার আতঙ্ক বাড়ে, ত্রাসে ব্যাকুল হয়ে জীবন সম্বন্ধে হতাশ হয়ে পড়ে। দিন চলে এই চতুর্দিকের সন্ত্রাস অনিশ্চয়তা এবং প্রায় ধ্রুব মৃত্যুর পরিবেশে। এর থেকে মানুষ কোনো পরিত্রাণ খুঁজে পায় না। এবং পাবে না যে—সে কথাও সে নিশ্চিতভাবেই জানে।

ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে প্রশ্ন করেন, সেই বিপন্ন মানুষটির কি কোনো পথ আছে পরিত্রাণের? সে কি বাঁচবে কোনোমতে? মৃত্যুই তো তার অবধারিত শেষ, কী হবে তার? তখন বিদুর বলেন, মহারাজ, এটি একটি রূপক, সত্য ঘটনা নয়। ওই যে অরণ্যটি ওটিই হল সংসার। হিংস্র জন্তুগুলি হল নানা ব্যাধি। ওই যে নারীটি দু-হাত প্রসারিত করে দু-দিক থেকে সংসারকে আগলে রেখেছে সে হল জরা, যার থেকে কারো পরিত্রাণ নেই। ওই কূপটি হল মানুষের দেহ। তার নীচে যে মহাসর্প সে হল কাল। ব্যাধিও নয় শোকও নয় কিন্তু কাল বা মহাকাল মানুষকে ধীরে ধীরে অক্ষম, অসমর্থ, নিস্তেজ ও নির্জীব করে তোলে। হয় জীবন স্বল্পস্থায়ী; কৈশোরে বা যৌবনে অকালমৃত্যুতে শেষ হয়, নয়তো দীর্ঘ-বিলম্বিত হয়ে অক্ষম, জীবন্মত অবস্থায় প্রলম্বিত হতে থাকে। মানুষ তার অভ্যস্ত কর্মক্ষমতা হারায় ও অর্ধমৃত অবস্থায় দিন কাটায়। মহাকাল এমন এক শক্তি সব মানুষকেই তার বশ্যতা স্বীকার করতে হয় এবং কালের দ্বারা গ্রস্ত মানুষের স্বাধীন। কর্মের ক্ষমতা থাকে না বলে তার জীবন ক্রমেই তার কাছে অর্থহীন হয়ে ওঠে। কালের কাছে নতিস্বীকার করার পর থেকে তার মনুষ্য মর্যাদা ক্রমেই ক্ষীণ হতে থাকে এবং জীবনটা অনেকাংশেই যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। এই সম্ভাবনা— অর্থাৎ কালের অধীনে থাকা বাকি জীবনটা জীবনের আনন্দ, স্বাধীনতা ও মর্যাদাও অনেকাংশে হারায়। ব্যতিক্রম আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তারা নিতান্তই সংখ্যালঘু, অধিকাংশের পক্ষে কাল এক জুর এবং সর্বশক্তিমান প্রভু, তার অধীন মানুষরা মৃত্যুর পরের অবস্থা জানে না তাই আরো ভয় পায়। মহারাজ, মানুষের শেষ অবস্থা— মৃত্যু। কূপের মধ্যে প্রলম্বিত যে লতাটি, যাকে অবলম্বন করে লোকটি লম্বিত অবস্থায় আছে, সেটি হল বাঁচবার আশা, যাকে মানুষ দৃঢ় হাতে ধরে থাকে, মনে করে লতাটি শক্ত, ছিড়বে না কোনোদিন। কিন্তু একদিন আসে যখন তার জীবনের আশা ছিড়ে যায়, লতা থেকে খসে পড়ে মানুষটি, আশা করবার আর কিছু থাকে না তার। ওই রূপটি হল মানুষের দেহ। কূপটির অভ্যন্তরে ধাপে ধাপে এগোচ্ছে ছয়মুখের যে মহাগজটি সেটি হল সংবৎসর, তার ছটি মুখ হল ছয় ঋতু। যে ইঁদুরগুলি চারদিক থেকে গাছের মূলগুলি কেটে দিচ্ছে সেগুলি হল দিন ও রাত। কালের প্রত্যক্ষ রূপ হল সংবৎসর। মানুষ তো কালকে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারে না, সে খবর রাখে সংবৎসরের। যাকে সে নির্দিষ্ট কালের আবর্তনে ক্রমে ক্রমে চিনে রাখে এবং ফলে যা তার কাছে। অমোঘ এক শক্তি হিসেবেই জানে, যার বিরুদ্ধতা করা তার পক্ষে অসম্ভব। অদৃশ্য মহাকালের প্রত্যক্ষ রূপ হল সংবৎসর। অনিবার্য এবং যান্ত্রিকভাবে সুনির্দিষ্ট হবার ফলে সংবৎসর মানুষের শক্তির পরিসরের বাইরে বলেই সংবৎসর ভয়াবহ। ওই যে মৌমাছিগুলি গাছের ওপর নিরন্তর ভনভন করে সেগুলি হল মানুষের কামনা, যার থেকে মানুষের পরিত্রাণ নেই। আর ওই যে মধুধারা বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ে তা হল কামরস, অর্থাৎ কামনার পরিতৃপ্তি, যার ফলে মানুষ বাঁচে, বাঁচতে চায়। অর্থাৎ যা দিয়ে মানুষ এত অজস্র বিপদ, রোগব্যাধি আপতিক আক্রমণের পরিবেশের মধ্যেও বেঁচে থাকে এবং বেঁচে থাকতে চায়। মানুষ সন্ন্যাস গ্রহণ না করলে নানা বাসনার প্রভাবেই নিয়ন্ত্রিত তার জীবন। এর অন্যথা নেই বলেই সকল মানুষ এগুলির প্রভাবের অধীন, তাই এগুলি ভয়াবহ।

এই তো হল জীবন। সংসারচক্রের ঘূর্ণন এইভাবেই ঘটে চলে। মানুষ তার দেহ, মনের নানাবিধ কামনার আবর্তন, চারিপাশে নানা ধরনের রোগব্যাধি, দুর্যোগ বিপর্যয় সম্বন্ধেও অবহিত, মৃত্যুর যন্ত্রণায় আশাভঙ্গের সম্ভাবনা সম্বন্ধেও যে অবহিত এবং সে এ-ও জানে যে বাঁচতে হলে এর মধ্যেই বাঁচতে হবে। তবু মানুষ হাল ছেড়ে দেয় না, বিপদের সম্ভাবনা সম্বন্ধে তার কোনো মোহ নেই, সে জানে যে বেঁচে থাকা মানেই নানা আতঙ্ক, আশঙ্কা, সত্যকার বিপদ নানা দিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করতে পারে এবং অহরহ করেছেও। যতদিন সে বাঁচবে এসব আক্রমণ নিরন্তর চলবেই। কিন্তু মানুষ হাল ছাড়ে না। যে-কোনো মুহূর্তে যে-কোনো ত্রুর রূপ ধরে মৃত্যুদূত এসে জীবনের অবসান ঘটাবে— এর থেকে কোনো আত্যন্তিক নিষ্কৃতি নেই— যন্ত্রণা, বিপদ এবং অবশেষে মৃত্যু অবধারিত। তার থেকে কিছুই তাকে বাঁচাতে পারবে না। তবুও সে বাঁচবার জন্যে ব্যাকুল। প্রাণপণে ওই আশালতাটি ধরে আছে, বিচিত্র এ জীবনের নানা রূপের আক্রমণ থেকে বাঁচবার চেষ্টা করছে এটা জেনেই যে, শেষরক্ষা হবে না। যে-কোনো রোগের আক্রমণ, দুঃখ, বিচ্ছেদ অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুর আক্রমণ, ইষ্টবিরহ, অনিষ্ট-সংযোগ, প্রচণ্ড অভাব, দুঃসহ যন্ত্রণা এ সবই তার পাওনা। সংসার যেন বিচিত্র অনাকাঙ্ক্ষিত রূপে নানা আয়োজন করে রেখেছে একেবারে অনতিক্রম্য বিপদের অক্ষৌহিণী চতুর্দিকে অপেক্ষা করছে, তাকে, মানুষকে, নানাবিধ যন্ত্রণা দিয়ে অবশেষে মৃত্যুতে তার জীবনের অবসান ঘটাবে।

আশ্চর্য এই, যে, মানুষ এ সম্ভাবনার কাছে হার মানে না, বাঁচবার চেষ্টা নিয়তই করেই চলে। কেন? ওই যে মৌচাক থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু তার মুখে ঝরে পড়ছে। এতে তার তৃষ্ণা মেটে না বরং বেড়েই চলে। তবু ওই মধু তো মধুই। তা লোভ জাগায়, লোভ বাড়ায়, যথেষ্ট না পাওয়ার। ক্ষোভ বাড়ায়। কিন্তু এত সামান্য পরিমাণে তা পাওয়া যায়, যে তৃপ্তি আসে না। তৃষ্ণাই বাড়ে শুধু। তবু মানুষ অদম্য। ওইটুকু মধুর ফোঁটার জন্য বিচিত্র ধরনের দুঃখ্যতনা ভয়সন্ত্রাস সহ্য করেই চলে, অন্তিমে মৃত্যুকে ঠেকানো যাবে না এটাও সে নিশ্চিতভাবে জানে।

একদিকে এর মধ্যে মানুষের মহত্বই ঘোষিত হল— তার বিপদসন্ত্রাস থেকে কোনো দেবতা তাকে বাঁচাবে না তা সে জানে। জ্বালাযন্ত্রণা নানারূপে তাকে সারাজীবন তাড়া করে ফিরবে, তার থেকে কেউ পরিত্রাণ করবে না একথাও সে নিশ্চিতভাবে জানে, তবু ওই বিপৎসংকুল পরিবেশের মধ্যেই মধুলোভী মানুষটি মধ্যে মধ্যে ঝরে পড়া মধুবিন্দুর আশায় উপরে-নীচে পাশে সবদিক থেকে আসা বিপদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সঙ্গে নিরন্তর যে সংগ্রাম করে চলেছে— পৃথিবীর ইতিহাসের আদিপর্ব থেকে শুধু আজ পর্যন্ত নয়, অনন্ত কাল ধরেই করে চলবে তার কোনো তুলনা নেই। শুধু তাই নয়, তার একটা অম্লান গৌরবও আছে সে কথা প্রতিবিম্বিত হয়েছে এই রূপক কাহিনিতে। ’বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা… বিপদে যেন করিতে পারি জয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *