প্রেত জগৎ এ জগতে
আমাদের চলতি ভাষায় অন্তত কিছুদিন আগে পর্যন্ত কিছু কিছু অসুখ-বিসুখের বর্ণনা বা প্রতিশব্দ একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন ‘জ্বরে ফেলেছে’ (যার থেকে ‘জ্বরে পড়েছে’) ‘মাথা ধরেছে’ ‘ গা হাত কামড়াচ্ছে’ (পূর্ববঙ্গে ‘চ্যাবাচ্ছে’), পেট নামাচ্ছে’, জ্বরে পুড়িয়ে দিচ্ছে’, ‘গা-হাত কাঁপাচ্ছে’, ‘শির টান ধরেছে’, এরকম আরো আছে। এর মধ্যে একটা সাধারণ লক্ষণ আছে : প্রত্যেকটি রোগের বিবরণে যেন কেউ একজন নেপথ্যে থেকে রোগীর কষ্টগুলি সৃষ্টি করছে। কোনো এক ব্যক্তির ইচ্ছায় ও প্রয়াসে রোগগুলি রোগীকে আক্রমণ করছে। এমনটা কেন হল? রোগের আক্রমণ কেন অদৃশ্য শক্তিমান কোনো শত্রুর ওপরে আরোপিত হচ্ছে?
প্রথমত, বীজাণু কি ব্যাকটিরিয়ার কোনো ধারণা তখন ছিল না, তা হলে রোগ হল কেন? নিশ্চয়ই কোনো অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে। অথর্ববেদে কিছু কিছু নামও পাওয়া যায়, স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই। বলা বাহুল্য, সাধারণ মানুষের কল্পনায় এরা প্রেতাত্মা। [মনে পড়ে, কেউ মারা গেলে ইংরেজিতে বলে, He has gone to join the majority, অর্থাৎ জীবিতদের তুলনায় মৃত অর্থাৎ প্রেতের সংখ্যা অনেক বেশি তাই প্রেতরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।]
কিন্তু প্রেত ছাড়াই বহু ধরণের ডাকিনী, শঙ্খিনী জাতের আত্মা— অতৃপ্ত আত্মা পরলোকে বিচরণ করে এবং জীবন তাদের সুখের ছিল না বলে তারা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তুলে আনন্দ পায়। সাধারণ মানুষের মনে এইসব বাযুভূত নিরালম্ব আত্মা আকাশে বাতাসে অহরহ বিচরণ করছে। গর্ভবতী নারী, শিশু, অশুচি ব্যক্তিদের কোনোরকমের শারীরিক কষ্ট দিয়েই তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করে।
যজুর্বেদ আনুমানিক অষ্টম-সপ্তম খ্রিস্টপূর্ব শতকে রচিত, সেখান থেকেই এ জাতীয় মন্দ শক্তির প্রতীকের নাম ও কাজের কথা শোনা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ অথর্ববেদে— এখানে এসব মন্দ আত্মাদের বহু নামও পাওয়া যায়, এ বিশ্বাস দেশের বাতাসে সঞ্চরণ করত।
অনেক পরে সাহিত্যেও এর প্রমাণ আছে। বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ (খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের রচনা) সেখানে শিশু জন্মের পূর্ব হতেই আঁতুড় ঘরে নানা ডালপালা ও ধাতুর খণ্ড নির্দিষ্ট স্থানে ঝোলানো, বাঁধা, বা রাখা রয়েছে শুনি। প্রেতের বিশেষ রুচি গর্ভবতী নারী ও নবজাতকের দেহমাংসে। প্রেতেরও ভয়স্থল আছে— ওইসব ধাতু, পাতা, শাখা এরা সহ্য করতে পারে না। তা ছাড়া ইতিমধ্যেই বহু বস্তু কুসংস্কারের জগতে অশুচি বলে পরিগণিত হচ্ছিল, সেগুলি প্রেতদের অনুকূল বা প্রতিকূল, তাই অনেক হিসেব করে রোগী, শিশু ও গর্ভবতী নারীর প্রতি মন্দ আত্মার
লোভ থেকে এদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হত। এ বিশ্বাসের অবশিষ্ট এখনও দেশে নানা আকারে প্রতিষ্ঠিত। কুসংস্কারের প্রভাব যতদিন না যায় ততদিন অলক্ষ্য কোনো শক্তি মাথা ধরাবে, পা কামড়াবে।