নায়াগ্রার এক ঝলক
১৯৮০ সালে একটা বিশ্বসম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে ক্যানাডার উইনিপেগ শহরে যাই। সম্মেলনের শেষে এক বন্ধু মার্কিন-দম্পতি তাঁদের গাড়িতে বিস্তর ঘোরালেন। ২৩ জুন ওঁদের গাড়িতে লেক অটোরিয়োর পৌঁছে সেখান থেকে হ্যান্ডলেন দ্বীপে এলাম মোটরলঞ্চে চড়ে। দ্বীপটি ভারী সুন্দর — সমুদ্রের মতো বিস্তার চারিদিকের হ্রদের জলে। ছোটো ছোটো ঝাঁকে সিন্ধু-বিহঙ্গ অদ্ভুত সুন্দর ছন্দে উড়ছে, জলের উপর বসছে। দ্বীপটার বিস্তার সাড়ে তিন বর্গমাইল। এই দ্বীপের এক তৃতীয়াংশ পরিকল্পিতভাবে আদিম অবস্থায় রাখা আছে। দ্বিতীয় অংশে নানা বিলাসের আয়োজন — নাগরদোলা, ছোটো মোটর ঘোড়া, বিদ্যুৎ-চালিত ডোঙা উঁচু থেকে নেমে হঠাৎ জলের ওপরে এসে পড়েছে, বিদ্যুৎ-চালিত হাঁস আরো কত কী!
ওখান থেকে ঘণ্টা কতক টরেন্টো শহর ঘুরে নায়াগ্রা প্রপাতের কাছে এলাম। তখন পৌনে সাতটা কিন্তু আকাশে বিকেলের আলো তখনো। প্রপাতের এই ক্যানাডার দিকটার বৃহৎ অংশের নাম মেপল ভিলেজ। মেপল গাছ ক্যানাডার জাতীয় প্রতীক।
প্রথম দর্শনে, নায়াগ্রাকে যেমন ভেবেছিলাম তার চেয়ে যেন ছোটো মনে হল। কারণ দুটো, নায়াগ্রাকে দেখতে পেয়েছিলাম প্রায় আধমাইল দূর থেকে। দ্বিতীয়ত, সত্যিই প্রপাত বছরে এক ফুট করে সরে বা নেমে যাচ্ছে। অত প্রচণ্ড জোরে পাথরের ওপরে আছড়ে পড়ার জন্য পাথর। ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। ১৯২৯ সালে ছোটোমাসিমা যা দেখেছিলেন তার চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ ফুট ক্ষয়ে গেছে। এমনকী ১৯৫৩-য় আমার মেজোবোন যা দেখেছিল তার চেয়েও কুড়ি ফুট ক্ষয়ে গেছে। একটা জায়গায় ঘোড়ার খুরের আকৃতিতে ঘুরে গেছে পাহাড় ও প্রপাত। সেই বাঁকের জায়গাটায় অত উঁচু থেকে পড়ার জন্যে প্রপাতের জলকণা সত্যিকার মেঘ হয়ে স্তম্ভের আকারে অনেক ওপরে উঠে গেছে।
নীচে টিকিট কেটে মোটরলঞ্চে উঠে আধঘণ্টা ওই ঘোড়ার খুরের আকারের জায়গায় জলের ওপরে ঘোরাবার ব্যবস্থা আছে। ওই জলকণা যেখানে প্রপাতের বেগে বৃষ্টিকণা হয়ে যাচ্ছে সেইখানকার জন্যে ওরা মোটরলঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মোটা কালো রবারের রেনকোট ও টুপি দেয়। লঞ্চে আধঘন্টা ঘোরায়। ঘোড়ার খুরের আকৃতির দুটো জায়গায় প্রবল বেগে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়, মাথার ওপরে সত্যিকার সেই ঘন মেঘ স্তম্ভ অনেক দূরে উঠে গেছে। এই দুটো জায়গার মধ্যে প্রথম জায়গায় মেঘ কতকটা নিচুতে, পরেরটায় বেশ উঁচুতে। তার মধ্য দিয়ে ইন্দ্রধনু বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, বেশ অনেকক্ষণ এবং খানিকটা জায়গা জুড়ে। মেঘের নীচে একটানা প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে রীতিমতো বেগে, প্রবল শব্দে।
লঞ্চটার নাম ‘মেড অব দা মিস্ট’। সত্যিই পুরো পথটাই কুয়াশায় ঘেরা এবং শীকরসিক্ত। কবে কোন কুমারীকে প্রপাতের কাছে যেন বলিদান দেওয়া হয়েছিল, তারই কাহিনি চলে আসছে লোকমুখে। কিছু কিছু বেপরোয়া ছেলে ও-পার থেকে নামতে যায় জলের স্রোতে নিশ্চিহ্ন হয়ে। তলিয়ে যায়। স্বনির্মিত যন্ত্র-ধরা একটা হাত পাওয়া যায়, আর কিছুই না। হতভাগ্য ওই যন্ত্র নির্মাণ করে জলের তোড় রুখতে পারবে এমন দুরাশা করেছিল, নায়াগ্রার শক্তি তাকে চিনতে হল প্রাণের বিনিময়ে। এমনই মাঝে মাঝে কোনো দুঃসাহসী মানুষের ভাগ্যকে জয় করার দুশ্চেষ্টাকে প্রবল স্রোতের বেগে বিলীন করে দিয়ে নায়াগ্রা ঝরে পড়ছে তার উত্তাল গতিতে।
যে নদীর জলস্রোত পাথরে আছড়ে প্রপাত হয়েছে, তারই নাম নায়াগ্রা। আড়াই হাজার ফুট ধরে একে বেঁকে পাথরের ওপর থেকে একশো সাতষট্টি ফুট উঁচু থেকে সজোরে আছড়ে পড়ে আবার নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে। ক্যানাডার ওপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে এর উচ্চতা ও বিস্তার অনেকটাই কম। দু’দিকেই এ নদীর পথ গেছে এঁকে বেঁকে বহু ঝোপজঙ্গল, জনপদ, ছোটো পাহাড়, অরণ্য ও নানা জলধারার পথ পেরিয়ে। ঘুরে ঘুরে নদী পৌঁছেছে পাহাড়ে এবং সেখানে দু’দিকেই প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে আবার নদী হয়ে বয়ে চলেছে। শুধু যেখানে যেখানে মেঘস্তম্ভ থেকে প্রবল বারিবর্ষণ, সেখানে তার নীচে ছোটো হ্রদের আকারে জলাশয়।
পাহাড় দুটোর খাড়া পাড়, অনেক অনেক নীচে আবার সমভূমি। নীচের জল ফেনায় ফেনায় সাদা হয়ে উঠেছে। ছোটো বড়ো সিন্ধুবিহঙ্গ দুলছে ফেনার ওপরে ঢেউয়ের তালে তালে; যেন ওই সমভূমির স্রোতস্বিনীটাই সত্যি, প্রপাতটা কিছু নয়। ক্যানাডার দিকে প্রপাতের বিস্তার আড়াই হাজার ফুট। মার্কিন দিকে এর বিস্তার মাত্র এক হাজার ফুট। মার্কিন দিকে হলুদ রঙা রেনকোট পরা মূর্তিরা ঘোরাঘুরি করছে পাথরের খাঁজে খাঁজে, কেউ-বা স্নানবস্ত্র পরে নদীর প্রান্তের জলে স্নান করছে, সাঁতার দিচ্ছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর জলের ওই বেগ, প্রবণতা, উচ্চতা। দেখে দেখে বিস্ময় আর ফুরোয় না। হৃৎপিণ্ডেরগতি দ্রুত হয়ে যায়—রাবণের দুর্বার অতুগ্র কামনা কিংবা এ যেন সেই গ্রীক প্রেমিকা রাজকন্যা মিডিয়ার আহত প্রেম, উন্মাদ প্রতিহিংসা যা কোনো বাধা মানে না। অথচ আছড়ে পড়ে ফেনায় ফেনায় স্তিমিত হয়ে যেন শান্ত নদীটি হয়ে বয়ে যাচ্ছে আবার। তবে চেয়ে চেয়ে দেখে মনে হচ্ছিল আগে-পরে বহু যোজন শান্তভাবে চলে আসার চেয়ে ওই আছড়ে পড়ার মুহূর্তটাই ওর ইতিহাসে সত্যতর মহত্তর।
সন্ধেয় আবার যখন দেখতে গেলাম প্রপাত, তখন চতুর্দশীর চাঁদ আকাশে যেন পরাজিত গ্লানিময় বিরাজ করেছে। মেপল লিফ ভিলেজের পুরো পরিসর, প্রপাতটাকে ঘিরে বিস্তীর্ণ এলাকা ওপার থেকেই লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, সাদা আলো ফেলে কী উদ্ভট করে তুলেছে তা না দেখলে বোঝা যায় না যে প্রকৃতির অমন অভাবনীয় বিস্ময়কর মহিমাকে এরা তথাকথিত সুসভ্য আধুনিক মানুষ কী অসংকোচে কী ঘঘারতর অপমানই না করেছে। তার চারপাশে আছে সেই অতিপরিচিত নাগরদোলা, প্রকাণ্ড উঁচু টাওয়ারগুলো বেয়ে লিফটের আনাগোনা। টাওয়ারের মাথায়, আলোর অক্ষরে রেস্তরাঁ, ক্যাবারে, সিনেমা, নাচঘরের বিজ্ঞাপন সময় ও খরচের বিজ্ঞপ্তি। চারিদিকে বিচিত্র আলো, ঐশ্বর্য ও আমাদের ঘটা ও প্রচার। কেবলই মনে হচ্ছিল, দু মিনিট এগুলো যদি বন্ধ রাখত তো দু-চোখ ভরে দেখে নিতে পারতাম পূর্ণচাঁদের আলোয় স্বর্গীয় জলস্তম্ভের শোভা। না জানি সে কীরকম দেখতে, কোনোদিনই আর তা জানা যাবে না। হয়তো একশো বছর আগের ক্যানাডা যারা দেখেছে, সওয়া দুশো ফুট উঁচু থেকে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ে ফেনায় ফেনায় ছড়িয়ে পড়ছে নীচে, তারা পেয়েছিল এর অপার্থিব মহিমার পরিচয়। জোৎস্নাকিরীট তরঙ্গায়িত সে জলরাশির রূপ না জানি কেমন ছিল। প্রকৃতি-প্রেমিক যথার্থ সৌন্দর্যপিপাসু কোনো কিশোর সে-দিন মুগ্ধ বিস্ময়ে নিসর্গের এই অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি দেখেছিল নিবিষ্ট চিত্তে।
পরদিন খুব ভোরে উঠে একা গেলাম প্রপাতের দিকে। কোনো রঙিন আলোর বাহার তখন নেই, প্রভাতের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। অবর্ণনীয় একটা শুভ্র দ্যুতি আকাশ থেকে প্রপাতে; অপূর্ব এক দৃশ্য: ধূর্জটির জটায় যেন গঙ্গার অবতরণ। মনে পড়ল, শিবের স্তোত্রের একটি চরণ : ‘গঙ্গাফেনসিতা জটা পশুপতেশ্চন্দ্রঃ সিতো মূর্ধনি’, গঙ্গার ফেনায় সাদা শিবের জটা, শীর্ষে তাঁর শ্বেত চন্দ্র তিলক। মনে হল যেন ভগীরথ মন্দাকিনীকে নামিয়ে এনেছেন মর্তে, তারপর নীচে দাঁড়িয়ে দু-হাত জোড় করে প্রণাম করেছেন নিজের কীর্তিকে।