ভবিষ্যৎ পিছনের দিকে?

ভবিষ্যৎ পিছনের দিকে?

এতদিন শিশুপ্রেমী জওহরলাল নেহরুর জন্মতিথিকেই শিশুদিবস বলে স্বীকার করা হত। এটি খুবই সঙ্গত ও যথার্থ তিথি ছিল; স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি শিশুদের জন্যে চিন্তা করতেন, তাদের ভালবাসতেন; তাঁর জন্মতিথিকে শিশুদিবস বলে অভিহিত করা তো ঠিকই ছিল। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের তাতে চলবে না। এক তো নেহরু যথেষ্ট ‘হিন্দু’ ছিলেন না; রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ বলে থাকে, নেহরু শুধু জন্মসূত্রেই হিন্দু। শিক্ষা সংস্কারে তিনি অনেক বেশি মুসলিম এবং রুচিতে পাশ্চাত্য অথাৎ খ্রিস্টান। এমন লোকের জন্মতিথির সঙ্গে হিন্দু ভারতীয় শিশুদের সম্পৃক্ত করা তাদের কাছে ঘোরতর অন্যায়। যিশুখ্রিস্টের কাছে একবার ভিড় করে শিশুরা আসছিল, বড়রা তাদের ঠেলে সেখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল। তখন তিনি বলেন, ‘শিশুদের আমার কাছে আসতে দাও, কারণ স্বর্গরাজ্য এই রকম মানুষেরই জন্যে।’ অর্থাৎ শিশুর মতো সরল লোকেরাই স্বর্গে যাবে। যিশু ঐতিহাসিক ব্যক্তি হলেও, যিশুর প্রকৃত জন্মতিথি ইতিহাস লেখে না। কিন্তু যে কল্পিত তিথিটি প্রায় দু’হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীতে তাঁর জন্মতিথি বলে উদ্যাপিত হয়ে এসেছে, শিশুপ্রেমী সেই মানুষটির জন্মতিথিকেও তো শিশুদিবস বলা চলত?

কিন্তু তা কেমন করে হবে? যিশু তো হিন্দু ছিলেন না। বিজাতীয়, বিধর্মের প্রবক্তা, তাঁর জন্মদিন তো সৎ হিন্দুর সযত্নে পরিহার করাই উচিত। তাই ওটাও হল না। সিদ্ধার্থ ঐতিহাসিক চরিত্র এবং তিনি ব্রাহ্মণ্যসমাজেই জন্মেছিলেন। তাঁর জন্মস্থান, কর্মস্থান ও পুণ্যস্থান (বারাণসী, গঙ্গা ইত্যাদি) সবই ভারতবর্ষেই ছিল, তাঁর জন্মদিনটা— বৈশাখী পূর্ণিমা, যতদূর জানা যায় নির্ধারিতই। কিন্তু এ মানুষ হিন্দুধর্মে মারাত্মক আঘাত হেনেছিল। যজ্ঞ উঠিয়ে দিতে বলেছিল, হিংসাকে বর্জন করতে বলেছিল এবং জাতিভেদ উঠিয়ে দিতে বলেছিল। আরও মুশকিল, দলে দলে লোক তাঁর পথ ও মত মেনে নিয়েছিল। ধর্মান্তকরণ মহাপাপ তাঁর জীবৎকালে শুরু হয়েছিল, আর এই সে দিন তো আম্বেদকর বহু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে সুপবিত্র হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কোনও সৎ হিন্দুর পক্ষে এ সব মেনে নিয়ে, এ সব মানুষের জন্মতিথিকে শিশুদিবস বলে অভিহিত করা কেমন করে সম্ভব? বরং অহিংসাবাদীর সেই জন্মতিথিতে হিংসার অস্ত্র পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে আরও যথার্থ ভাবে উদ্যাপন করে, সারা পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বলা যায় ‘বুদ্ধ হাসলেন’। মহম্মদের জন্মতিথি সুনিশ্চিত ভাবে জানাও যায় না, গেলেও কোনও লাভ হত না, হিন্দুর প্রতিস্পর্ধী যবন ধর্মপ্রবক্তার জন্মতিথি পরম অশুচিতিথি বলেই গণ্য হত। কাজেই জন্মাষ্টমী।

সঙ্ঘ পরিবারের বহুতর অপপ্রচেষ্টার অন্যতম হল জন্মাষ্টমীকে ‘শিশুদিবস’ বলে ঘোষণা করা। প্রচ্ছন্ন কারণটা বোধহয় বালকৃষ্ণের ছবি, গান, কাহিনি ও অতিকথা। বিশেষ করে হরিবংশে যে অলৌকিক শৌর্যের ক্রিয়াগুলি বর্ণিত আছে। বলা বাহুল্য, সে সবই কবি কল্পনাপ্রসূত অলৌকিকতার কাহিনি, কোথাও তার সত্যতার এতটুকু প্রমাণ নেই, থাকা সম্ভব নয়।

কৃষ্ণ কতটা ঐতিহাসিক চরিত্র, সে সম্বন্ধে শাস্ত্র থেকে তথ্য দেখা যেতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম-৬ষ্ঠ শতকে রচিত ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩:২:৬)-এ পড়ি এক কৃষ্ণের কথা, যাঁর মা দেবকী এবং যিনি ‘ঘোর আঙ্গিরস’-এর শিষ্য। এ কৃষ্ণ সম্পূর্ণ মানুষ। ওই কালসীমার মধ্যে বা একটু পরে রচিত ‘ঘটজাতক’-এ এক বাসুদেবের নাম পাই, যার পিতা অন্ধকবেহু (সংস্কৃতে অন্ধকবৃষ্ণি)। [জাতক সংখ্যা ৪৫৪] এর থেকে মনে হয়, বাসুদেব ছিলেন অন্ধকবৃষ্ণি গোষ্ঠীর, অথবা তাঁর মাতৃকুল পিতৃকুলের পরিচয় হয়তো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে এক সূত্রে অর্জুন ও বাসুদেবের নাম এক সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। (সূত্র সংখ্যা ৪:৩:৯৮) এখানে কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্কের উল্লেখ প্রসঙ্গটা ছিল দু’জনেই ভক্তির পাত্র। স্পষ্টতই শৌর্যের জন্য। এবং পাণিনির এই সূত্রেই প্রথম ভক্তিমার্গের উল্লেখ পাই, অর্থাৎ কৃষ্ণ যে ভক্তির পাত্র তাঁর বীরত্বের জন্যে, সেটা জানতে পারি; কিন্তু তখনও তাঁকে মানুষ অর্জুনের মানুষ সহচর হিসেবেই দেখা হচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ দিকে মেগাস্থিনিসের ভ্রমণ বৃত্তান্তের যে বিবরণ আরিয়ান তাঁর ‘ইণ্ডিকে’ গ্রন্থে দিয়েছেন সেখানে দেখি, ‘শৌরসেনী (নামের) এক ভারতীয় জনগোষ্ঠী এই হেরাক্লেসকে বিশিষ্ট ভাবে সম্মান করে, ইনি দু’টি বৃহৎ নগরীর অধিপতি মেথ্রো (মথুরা) ও ক্লেইসোবোরা (কৃষ্ণপুর, বৃন্দাবন)’। (ইণ্ডিকে ৮:৫-৭) এই হেরাক্লেসকে কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়, ইনি বৃষ্ণিদের বাসভূমি শূরসেন দেশে বাস করতেন। এই শূরসেন আদিতে একটি গোষ্ঠীরাজ্য ছিল, কিন্তু পরে ক্রমে ক্রমে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি ষোড়শ মহাজনপদের একটি হয়ে ওঠে। শূরসেন অঞ্চলে কৃষ্ণ বিশেষ সমাদৃত বীর ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পতঞ্জলি পাণিনির ব্যাকরণের ব্যাখ্যায় তাঁর ‘মহাভাষ্য’ রচনা করেন। পাণিনির একটি সূত্রের (৪:৩:৯৮) ভাষ্যে তিনি কৃষ্ণকে দেবতা বলে উল্লেখ করেন। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের মানুষ কৃষ্ণ ধীরে ধীরে লোককথায় আতিশয্যে অতিকথায় দেবায়িত হলেন, এই প্রথম খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে, প্রথম উল্লেখের পাঁচশো বছর পরে। এই শতকের শেষ দিকে দেশে ভক্তির নানা প্রকাশের একটি হয়ে উঠল বাসুদেব-পন্থা; কৃষ্ণ হলেন দেবতা, গরুড় হলেন তাঁর বাহন। এই সময়ে বেসনগরে গরুড়ধ্বজ স্তম্ভটি দেবদেব-বাসুদেবের উদ্দেশে নির্মিত হয়। এই শিলালেখটি গ্রিক রাজা আন্তিয়ালকিদেস (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের তৃতীয় পাদের)-এর সময়ের; এই সময়ে বহু মুদ্রাতেও বাসুদেবের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরের শতকে দেখি, বৃষ্ণিবংশের পাঁচটি বীর বিশেষ ভাবে সম্মানিত; এঁরা হলেন বাসুদেব, সংকর্ষণ প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ ও শাম্ব। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে এঁরা ‘পঞ্চবৃষ্ণিবীর’ বলে পূজিত হতেন। এই ব্যূহবাদ কিন্তু উদ্ভূত হয় শ-খানেক বছর আগেই; এই মতে ব্যূহবাদ বাসুদেব হলেন দেবতা, পরা বাসুদেবেরই প্রকাশ। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের শেষ দিকের নানাঘাট শিলালেখেও সংকর্ষণ ও বাসুদেবের উল্লেখ পাই। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের একদম শেষ দিকে ঘোসুণ্ডি শিলালেখে পরমদেবতা হয়ে ওঠেন নারায়ণ, ‘পাঞ্চরাত্র সত্র’-এর অনুষ্ঠান করে। নারায়ণের সঙ্গে বাসুদেবের অভেদ সম্পর্ক এই সময়ে নির্মিত হয়। গরুড়, যাকে সূর্যের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হত, তাঁর সঙ্গে সংযোগের ফলে নারায়ণ বাসুদেবের ‘চক্র’ এখন হয়ে ওঠে সৌর বিষ্ণুর চিহ্ন এবং বিষ্ণু ও নারায়ণ একীভূত হবার ফলে বাসুদেব-নারায়ণ ও বিষ্ণুও একাত্ম হন। অর্থাৎ বিভিন্ন স্থানে ও অঞ্চলে এই তিন দেবতাকে কেন্দ্র করে যে সব উপাসনাগোষ্ঠী গঠিত হয়েছিল, সেগুলি এই সময়ে একই মার্গের মধ্যে বিলীন হল এবং এর মধ্যেই অভ্যুত্থান ঘটল বৈষ্ণব মতের। এ দিকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মেই অবতারবাদ খুব প্রবল হয়ে ওঠে; ফলে বিষ্ণুনারায়ণের অবতার হলেন কৃষ্ণ। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, বলরাম, রামচন্দ্র, পরশুরাম, বুদ্ধ ও কল্কি হলেন কৃষ্ণের দশটি অবতার; কুষাণ যুগে অবতারবাদের খুব প্রাদুর্ভাব ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মহাভারতে ও জাতকে নানা নামের ও আকৃতির অবতার দেখা দেন। কোনও মহৎ কীর্তির কর্তা হন অবতার এবং সৃষ্টির বিবর্তনের গোড়া থেকেই যে অবতার ছিল তা প্রতিপন্ন করবার জন্যে পিছিয়ে গিয়ে, মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ ও বামনকে কল্পনা করা হল। রামায়ণ-মহাভারতে বলরাম, রামচন্দ্র ও পরশুরাম এবং বহু শতাব্দী আগের বুদ্ধের ভক্তসংখ্যা, মহিমা ও প্রভাব বাড়ার জন্যে অনেক পরে তাঁকেও অবতারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হল। প্রলয় ঘটাবার জন্যে যে অবতারটির প্রয়োজন পরে হবে, কল্পি নামে তাঁকেও উপস্থাপিত করা হল এ তালিকার মধ্যে। নানা অঞ্চলে নানা ধরনের দেবতা দেবায়িত (টোটেম) জীবজন্তুর উপাসনা প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের আওতায় তাদের আনার জন্যেও অবতারবাদের প্রয়োজন ছিল। দশাবতারের বাইরেও আরও বহু অবতারের নাম ও লীলার কাহিনি পাই পুরাণগুলিতে।

অবতারবাদের প্রভাবে দেবায়িত মানুষ কৃষ্ণ ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্যসমাজে প্রাধান্য লাভ করলেন, এটা আরও সম্ভব হল প্রধানত দুটো কারণে: প্রথমত, আর্যাবর্তে ভক্তিবাদের উদ্ভব মুখ্যত ভাগবত প্রস্থানের মধ্যে দিয়ে এবং কৃষ্ণের সঙ্গে এই উপাসনা জুড়ে যাওয়াতে কৃষ্ণই এর কেন্দ্র-দেবতা হয়ে উঠলেন। ভগবৎ শব্দ (ভগবান যার থেকে হয়েছে) থেকে ‘ভাগবত’ সম্প্রদায়ের নামে। অর্থাৎ কৃষ্ণই ভগবান। এই সম্প্রদায়ের মধ্য দিয়েই কৃষ্ণ প্রাধান্য লাভ করেন, সম্প্রদায়ের মানুষের ভক্তির কেন্দ্রেই ভগবান কৃষ্ণ। সম্প্রদায়ের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণের প্রভাবও বাড়তে লাগল। দ্বিতীয়ত, উত্তর ভারতে কৃষ্ণকে অবলম্বন করে কয়েক ধরনের অতিকথা চালু হচ্ছিল তখন, কৃষ্ণে এসে সেগুলি জুড়লেন। ফলে কৃষ্ণকে নিয়ে নানা কাহিনি নির্মিত হল; বাল্যে তিনি নানা অলৌকিক কাজ করেন। অসীম শৌর্যের পরিচয় দেন। বহু পরাক্রান্ত শত্রুকে অনায়াসে পরাস্ত ও নিহত করেন। অন্য দিকে জননী যশোদার আদরের দুলাল বালগোপাল। ননী চুরি করে খান— যে সমস্ত দুষ্টুমি সব ছোট ছেলেই বাড়িতে করে থাকে, কৃষ্ণের বেলা সেগুলি বিশেষ বিশেষ লীলার মর্যাদা পেল ভক্তির মুগ্ধতায়। বালগোপাল ছাড়াও কিশোর কৃষ্ণ সম্মানের সঙ্গে বৃন্দাবনের বনে বনে গোচারণ করতেন। এ সব দিয়ে গোষ্ঠলীলায় অতিকথা তৈরি হয়। তার মধ্যে অলৌকিক কিছু না থাকলেও কবিত্বের দ্বারা সে সব লীলা সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল।

এর পরের যুগে কৃষ্ণের অন্য দু’টি পরিচয়ও এ কাহিনিতেই সংযোজিত হয়। প্রথমত, যৌবনের কৃষ্ণ অর্জুনের সখা এবং মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের সারথি। এখানে পঞ্চ বৃষ্ণিবীরের অন্তর্গত বাসুদেবকেই দেখতে পাই বীরের ভূমিকায় এবং সখার ভূমিকায়। কৌরব-পাণ্ডবের লোকক্ষয়ী যুদ্ধ নিবারণ করার সাধ্য থাকা সত্ত্বেও করেননি; এ জন্যে গান্ধারী তাঁকে যে অভিশাপ দিয়েছিলেন তা ফলে যাওয়াতে কৃষ্ণের অপরাধ প্রমাণিত হয়। এ ছাড়া তরুণ কৃষ্ণ বাঁশি বাজায় এবং গোপকন্যা রাধার প্রেমিক। সমাজবিধির হিসাবে এ প্রেম অবৈধ, রাধা বিবাহিত, এবং সম্পর্কে কৃষ্ণের গুরুজন। প্রেমের কাহিনিতে এমন হয়েই থাকে, তবে ভগবান কৃষ্ণের কাহিনিতে এটা তো ঠিক সঙ্গত নয়। এ কৃষ্ণও ভগবান কৃষ্ণের মূল কাহিনির অন্তর্গত, এটা বাদ দিয়ে উপাস্য দেবতার চরিত্র হয় না। প্রেম কাহিনির নায়ক নির্মিত হলেও এত রকমের কৃষ্ণকথা দেশে চলিত ছিল নানা অঞ্চলে— বৃন্দাবনে, মথুরায়, দ্বারকায় ও অন্যত্র— সেগুলি এক সঙ্গে জুড়ে তৈরি হল একটি বিচিত্র জটিল কাহিনি, কাব্যে, গানে। যাত্রাপালয়, নাটকে যার সুদূর প্রসারিত জনপ্রিয়তা। কিন্তু এর বিভিন্ন খণ্ডের উৎপত্তি ও বিকাশ যেমন বিভিন্ন অঞ্চলে, তেমনই বিভিন্ন কালেও; অর্থাৎ বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে এর বিবর্তন। সাহিত্যে, বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশে ও ভাগবতপুরাণে একটি পূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে; আজকের কৃষ্ণকথাতে সেই পূর্ণ রূপটি পাওয়া যায়।

আজ সঙ্ঘ পরিবার এর একটি অংশ আরোপ করতে চায় শিশুদিবসের ওপরে; সেই অংশটিকেই যার কোনও প্রমাণ নেই। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের অন্ধ-কবৃষ্ণিবংশের সেই যে মানুষ কৃষ্ণ, যার মধ্যে আচার্যের নামই শুধু জানা যায়, তিনি কবে জন্মেছিলেন তার কোনও হদিশ কোথাও মেলে না। পঞ্চবৃষ্ণিবীরের অন্তর্গত বাসুদেবেরও কোনও জন্মতিথির খবর পাওয়া যায় না। ভাগবত প্রস্থানের বাসুদেবেরও নয়। মহাভারতের কৃষ্ণের বংশপরিচয় মিললেও জন্মদিনের তারিখ মেলে না। পুরাণে যখন প্রায় হাজার বছর ধরে বহুতর কৃষ্ণকথার দ্বারা কৃষ্ণ কাহিনিকে নির্মাণ করা হল, তখন এক কৃষ্ণ। অষ্টমী তিথিতে কংসের হাতে আসন্ন মৃত্যু এড়াতে পিতা বাসুদেব শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে গোপপল্লিতে যশোদার জিম্মায় তার নিরাপত্তা বিধানের যে কাহিনিটি তৈরি করা হল, সেটি প্রথম কৃষ্ণের উল্লেখ থেকে হাজার বছরেরও বেশি পরে নির্মিত। অর্থাৎ কৃষ্ণকথা জন্মেছিল যখন তার প্রায় হাজার বছর পরে কৃষ্ণের একটা জন্মদিন কল্পিত হল; গল্পটিকে ভাল মতো গড়ে তোলার জন্যে। অতএব জন্মাষ্টমীর কল্পনা পুরাণের শেষের দিকের। প্রমাণ তো নেই-ই, কারণও কিছু নেই।

এতক্ষণ পর্যন্ত যা আলোচনা করা হল, এক অর্থে তা ভূমিকা মাত্র। ভূমিকা সঙ্ঘ পরিবারের এই নবতম সিদ্ধান্তের। দেশে সমাজের নানা অংশ নিয়ে নানা দিবস যাপন করার প্রথা আছে, তার কোনওটা সাময়িক, কোনওটা স্থায়ী, শিশুদিবস প্রতি বছরেই একদিন উদযাপিত হয়। এই একটি দিনই দেশের ভবিষ্যতের অভিমুখে, ভারতবর্ষের ভাবী নাগরিকদের অভ্যর্থনা করার দিন, শুভদিনগুলির মধ্যে শুভতম একটি বিশিষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ দিন।

যে মানুষটা তাঁর বর্তমান পরিচয়ে ইতিহাসে কোনও দিন ছিলেন না, যাঁর বাল্যলীলায় বহু প্রতারণার, ছলায় ইষ্টসিদ্ধি, এবং অসম্ভাব্য কবিকল্পিত বীরত্বের উপাখ্যান দিয়ে যা নির্মিত তাঁর কল্পিত জন্মতিথি— যার একফোঁটাও ঐতিহাসিকতা নেই— সেই হল নিষ্পাপ শিশুদের অভ্যর্থনা দিবস। যৌবনেও তাঁর বহু কাজ অনৈতিক। সে জন্যে ধর্মচারিণী গান্ধারী তাঁকে নিষ্ঠুর শাপ দিয়েছিলেন, এবং সে শাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়ে প্রমাণ করেছিল যে, গান্ধারীর অভিযোগ যথার্থ ছিল। গীতায় যুক্তি দিয়ে অর্জুনের যুক্তির সদুত্তর দিতে না পেরে যে কৃষ্ণ জাদুপ্রভাবে অর্জুনকে বশীভূত করেছিল, সেই কৃষ্ণের জন্মতিথি শিশুদিবস? কোনও শিশু বড় হয়ে কৌতূহলবশে যদি কৃষ্ণের জীবনী অনুধাবন করতে চায় ও দেখে শৈশব থেকে শত্রুজয়, বিপদ উদ্ধার ইত্যাদির জন্য তাঁর মিথ্যাচারণে কখনও বাধেনি, কুরুক্ষেত্রের বিপুল লোকক্ষয় ইচ্ছে করলেই নিবারণ করতে পারলেও করেনি, আকৈশোর বন্ধু অর্জুনের মর্মান্তিক প্রশ্নের উত্তর যুক্তি দিয়ে দিতে না পেরে, জাদু দিয়ে তার সন্দেহ নিরসন করেছেন, বয়সে ও সম্পর্কে বড় পরস্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ প্রেমের দীর্ঘলীলার পর, তাঁকেও প্রবঞ্চনা করে ত্যাগ করে চলে গিয়ে রাজা হয়ে বসলেন বসুদেবের সিংহাসনে— এবং নানাবিধ অপরাধ ও প্রতারণার পর, পরিত্যক্ত নির্বান্ধব অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হল, তাঁর বংশের নারীরা শত্রুহস্তে লুণ্ঠিত হল তাঁর পাপের ফলে, তখন সেই কৌতূহলী শিশুর কতটা সঙ্গত মনে হবে জন্মাষ্টমীকে শিশুদিবস হিসেবে চিহ্নিত করা?

কিন্তু কে জানে, ওই ধরনের বহু প্রতারণা, ধূর্ততা, শঠতায় যেন তারা নিজেদের অগোচরে দীক্ষা পায়, এইটেই হয়তো এ সব কর্মকর্তাদের অভিপ্রেত। তাদের আচরণে আজ কৃষ্ণের নানা অসাধুতা সর্বত্র নানা ভাবেই প্রতিফলিত, সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শ হিন্দু নাগরিকের বাল্যদীক্ষা কি তাই জন্মাষ্টমীতে শিশুদিবস উদ্যাপন করার মধ্য দিয়ে শুরু করার দ্বারা সূচিত? বেদব্যাসের জীবনকথার কিছুই জানা যায় না, তাঁকেও টেনে আনা হচ্ছে। কিন্তু এ সবের চেয়ে অনেক বেশি অর্থবহ গোলওয়ালকার ইত্যাদির জন্মদিবস উদ্যাপনে বাধ্য করা ভারতবর্ষের ভাবী নাগরিককে। অবশ্য সূচনাই যদি হয় নানা মিথ্যাজালে জড়িত একটি জন্মদিবসকে দিয়ে, তবে বাকিগুলি তো আপনিই আসবে। কী জাতীয় নাগরিক গড়ার ব্রত এদের, তা আজ আর দেশের কাছে বিশেষ গোপন নেই। কিন্তু এখনও দেশের শিশুগুলি সম্বন্ধে সাধারণ দেশবাসীর একটা নির্মল আবেগ আছে। জন্মাষ্টমীকে শিশুদিবস ঘোষণা করার মধ্যে সেটিকে অঙ্কুরে বিনাশ করার প্রয়াস দেখা যায়। নেহরু জন্মদিবসেই যদি অধিকাংশ শিশু-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশু দিবসের উৎসব অনুষ্ঠান করে, জন্মাষ্টমী তিথি হিসাবে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তবেই এ অপপ্রচেষ্টার সমুচিত উত্তর দেওয়া হয়।

সঙ্ঘ পরিবারের সাম্প্রতিকতম দু’টি স্বপ্নবিলাস হল: সাপ্তাহিক ছুটিটা রবিবার থেকে মঙ্গলবার করা হোক আর বিশ্ব শ্রমিক দিবসটা পয়লা মে থেকে সরিয়ে বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে নিয়ে আসা হোক। যুক্তি কী? রবিবারের ছুটিটা খ্রিস্টানদের ধর্মশাস্ত্র বাইবেল থেকে পাওয়া। সেখানে প্রথম পর্বে সৃষ্টির বিবরণ আছে: ঈশ্বর প্রথম দিনে আলো সৃষ্টি করলেন এবং ক্রমে ক্রমে ছ’দিন জড়জগৎ ও জীবজগৎ সৃষ্টি করে ষষ্ঠদিনে মানুষ সৃষ্টি করলেন। সমাপ্ত হল সৃষ্টিপর্ব, ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টি নিরীক্ষণ করে খুশি হলেন এবং সৃষ্টির আয়াসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে সপ্তম দিনে বিশ্রাম করলেন। এই বিশ্রামবারকে হিব্রুতে স্যাবাথ বলে। সোমবার সপ্তাহের শুরু, কাজেই স্যাবাথ হল রবিবারে। এই কাহিনির অনুসরণে মানুষ রবিবারকে বিশ্রামবার বলে অভিহিত করে সে দিনটিকে সাপ্তাহিক বিশ্রামের জন্যে নির্দিষ্ট করল। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষে এত বড় একটা অহিন্দু ঐতিহ্য মেনে নেওয়া অসম্ভব। কাজেই সাপ্তাহিক বিরতির বার বদলাতে হবে এবং সেটা নির্ধারিত হল মঙ্গলবার; কেন? মঙ্গলবার বজরংবলী হনুমানের জন্মবার। প্রথমত, দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে হনুমান ‘রামায়ণ’ কাহিনির একটি কল্পিত চরিত্র মাত্র, শ্রদ্ধেয় বা উপাস্য দেবতা নয়। দ্বিতীয়ত, কোনও শাস্ত্রে হনুমানের জন্মবার নির্দিষ্ট করে বলা নেই; মঙ্গলবার একটা অর্বাচীন আরোপমাত্র। তৃতীয়ত, হনুমানের জন্মবারের কী মাহাত্ম্য থাকতে পারে অধিকাংশ হনুমানে অবিশ্বাসী হিন্দু, বহুসংখ্যক মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ ও বিপুলসংখ্যক আদিবাসীর কাছে? রবিবারের স্বপক্ষেও কোনও ইতিহাস নেই, কিন্তু প্রায় দু’হাজার বছরের ঐতিহ্য আছে, সারা পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে এটি স্বীকৃত সাপ্তাহিক বিরতির দিন। শুধু খ্রিস্টান জগৎ উদ্ভূত হওয়ার কারণে এই সুদীর্ঘ ঐতিহ্যকে পদদলিত করতে হবে? তা-ও হনুমানের জন্যে— যে বারটা উপকথার উপনায়কের কল্পিত জন্মবার, তার জন্যে? সংকীর্ণ দৃষ্টির জুলুম আরও কত দূরে যাবে?

মে দিবস সম্বন্ধে এদের অনীহার প্রকৃত কারণ হল, সমগ্র সাম্যবাদী দেশে ও ইতিহাসে এটি বিশ্ব-শ্রমিক ঐক্যের প্রতীক বলে উদ্যাপিত হয়। এরা কি জানে না যে, মে দিবস প্রথম উদ্যাপিত হয় আমেরিকায়, রাশিয়ায় নয়? এর উদ্ভাবক কার্ল মার্কস নন, সমবেত শ্রমিক শ্রেণি যারা দৈনিক পরিশ্রমের কালসীমা নিরূপিত করতে চেয়েছিল আট ঘণ্টায়। কারণ, ধনিক সমাজ সুদীর্ঘকাল ধরে নির্মম ভাবে শ্রমিকের শ্রম শোষণ করছিল অপর্যাপ্ত পরিমাণে। তাদের শ্রমের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না, দশ-বারো থেকে ষোলো-সতেরো ঘণ্টা পর্যন্ত খাটিয়ে নিত শ্রমিককে সুবিধে পেলেই। স্বাস্থ্য ভেঙে যেত শ্রমিকের, বিশ্রাম থাকত না, পুষ্টি থাকত না, নিরাপত্তা থাকত না, অবকাশ বলে কিছুই থাকত না। সমস্ত শ্রমিকসমাজ বাস্তবক্ষেত্রে ক্রীতদাসের মতো অনিয়মিত পরিমাণ শ্রম দিতে বাধ্য হত নামমাত্র বেতনে। এর বিরুদ্ধে সংহত শক্তিশালী শ্রমিক সংগ্রামের জয়ের তিথি হল মে দিবস। দিনটির অপরিসীম তাৎপর্য আছে আজও। কারণ, প্রথমত, ওই দিনে সংহত শ্রমিকশক্তি প্রবল প্রতিপক্ষ এটিটদের বাধ্য করেছিল তাদের দাবি মানতে। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক এখনও ওই দিনে অর্জিত অধিকার থেকে বঞ্চিত। ফলে পয়লা মে এখনও দিকচক্রবালের সেই উদয়সূর্যের মহিমার প্রতীক শ্রমিকসমাজের কাছে।

কিন্তু পয়লা মে-র গায়ে লেগে আছে সাম্যবাদের সংস্পর্শের গন্ধ, বড্ড বেশি অনুষঙ্গ এবং দুনিয়াকে মজদুরের সংগ্রামের ডাকের সঙ্গে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে, তাদের অপ্রাপ্ত অধিকার অর্জনের অঙ্গীকারের সঙ্গে। যাদের শেকল ছাড়া কিছুই হারাবার নেই তাঁরা উলঙ্গ নাগা সন্ন্যাসীর চেয়েও ভয়াবহ জীব, মে দিবস সেই শক্তিহীন সর্বহারার বিজয়ের তিথি, যা শ্রমিকের স্বপ্নের সূচনা করেছিল। তাই যত সত্বর সম্ভব এই ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করা প্রয়োজন। বিকল্পে বিশ্ব শ্রমিক দিবস কবে উদ্যাপিত হবে? বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। নয় কেন, বিশ্বকর্মাজিও তো শ্রমিকেরই প্রতীক? শ্রমের অধিদেবতা এবং তাঁর সবচেয়ে বড় দাবি তিনি হিন্দুর দেবতা। অতএব মামলা টিকবে না কেন?

কারণ, বিশ্বকর্মা ধোপে টেকে না। কে এই বিশ্বকর্মা? ঋগ্বেদে বিশ্বকর্মা বিশেষ্য নয়, বিশেষণ, প্রধানত ইন্দ্রের। কিন্তু তা ছাড়াও ব্রহ্মা, প্রজাপতি, অগ্নি, সূর্য ইত্যাদি বহু দেবতার বর্ণনায় তাঁদের সম্বন্ধে ‘বিশ্বকর্মা’ শব্দটি গুণবাচক বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বেদে একটা প্রবণতা একৈকাপি দেববাদ (henotheism)। এর ফলে যখন যে দেবতার স্তব করা হচ্ছে, তিনি তখনকার মতো সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা বলে বর্ণিত হন; এরই একটা প্রকাশ পর্যায়ক্রমে সমস্ত প্রধান দেবতাকে বিশ্বস্রষ্টা বা বিশ্বকর্মা বলা হয়েছে। এঁরা শ্রোতার কাছে বিশ্বস্রষ্টা, অন্তত তখনকার মতো। কিন্তু বেদে শ্রমের প্রথম অধিদেবতা ত্বষ্টা। যিনি দধীচির অস্থি দিয়ে বজ্র নির্মাণ করেছিলেন অসুর নিধনের জন্য; আরও অনেক পরিচয় দিয়েছিলেন কারুবিদ্যার। খোদাই করে এমন আর একজন হল তক্ষা, যে শব্দটির সঙ্গে ব্যুৎপত্তিগত যোগ গ্রিক ‘টেখনে’ শব্দের, যার থেকে ইংরেজিতে পাই টেকনোলজি বা টেকনিশিয়ান, কারিগরি বিদ্যা বা কারিগর। ত্বষ্টা শ্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত। বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে তত্ত্বগত ভাবে প্রজাপতি, বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি, পুরুষ এঁদের যোগ। পরবর্তী পুরাণে স্থাপত্যের অধিদেবতা ময়দানব যিনি ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণ করেন, বিমান নির্মাণ করেন ও অন্যান্য স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে যিনি যুক্ত। কিন্তু ত্বষ্টা বা ময় বিশ্বকর্মা নামের দেবতা নয়।

এ বিশ্বকর্মা কবে এল, কোথা থেকে এল? ঊনবিংশ শতকের শেষ পাদে স্বদেশি ভাবনা নানারূপে প্রকাশ পায়; কংগ্রেস স্থাপিত হয়, শিবাজী-উৎসব, গণেশ পূজা প্রবর্তন, হিন্দুমেলায় স্বদেশি শিল্পকলার চর্চা ও প্রদর্শনী ইত্যাদি রূপে। পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লবের পরে শ্রমিক, কারিগর, কারুকৃৎ ও কারুশিল্পী স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা পেতে আরম্ভ করে এবং তখন সন্ধান শুরু হয় এদের একজন অধিদেবতার। এই বার, বেদের বিশেষণটি বিশেষ্য হয়ে ওঠে— জন্ম হয় ঝা-চকচকে নতুন এক দেবতা বিশ্বকর্মার। এঁকে দেবমণ্ডলীতে আভিজাত্য দেবার উদ্দেশে দেবরাজ ইন্দ্রের পৌরাণিক মূর্তিই একে দেওয়া হল— গজারোহী সুসজ্জিত অলংকৃত এক দেবতা, আধুনিক কালের ইন্দ্র, যে দেবতাটি সম্বন্ধে বেদে বারবার বিশ্বকর্মা বিশেষণটি ব্যবহৃত হয়েছিল। আজকের রূপের এই বিশ্বকর্মা সৃষ্টিকর্তা হওয়া দূরস্থান, শ্রমিকের সঙ্গে এঁর সামান্যতম যোগসূত্রও নেই।

ইনি যে দেবমণ্ডলীতে সদ্য-নির্মিত অর্বাচীন, এমনকী পুরাণোত্তর এক দেবতা, তার একটি প্রমাণ হল, অন্য প্রসিদ্ধ দেবদেবীর মতো এঁর পূজাতিথি চান্দ্রমাসের তিথি হিসেবে হয় না, ইংরেজি বর্ষপঞ্জিতে নির্দিষ্ট বড়দিনের মতোই একই তিথিতে— ১৭ সেপ্টেম্বরে এঁর পুজো হয়। কোনও অভিজাত পৌরাণিক দেবতার পুজোই বিজাতীয় বর্ষপঞ্জির তিথি ধরে হয় না। তবু এই পুজোর তিথিকে বিশ্বশ্রমিক দিবস হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিতে চায় সঙ্ঘীরা। কারণ, এঁর প্রধান গুণ হল, শ্রম বা শ্রমিকের সঙ্গে এঁর দূরতম যোগও নেই। বেশ শুদ্ধসত্ত্ব, সম্ভ্রান্ত, ভদ্রলোক দেবতা, ঊনবিংশ শতকের বাঙালি জমিদারের গৌরবান্বিত মূর্তি। এবং এ পূজা একান্তই বাঙালির, প্রবাসী বাঙালির। তবু একে গোবলয়ের সঙ্ঘীরা জাতে তুলছে কেন? কারণ, অন্য প্রদেশে এঁর কোনও বিকল্প নেই এবং এঁর গায়ে একফোঁটাও শ্রমিক রক্ত নেই। এখন যখন সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রমিকরা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে, তখন এই বেশ ধনী ভদ্রলোক-চেহারার দেবতাটিকে দিয়ে সেই বন্যা রুখবার চেষ্টা করে দেখছে এরা। শিকল ছড়া যাদের হারাবার কিছু নেই, তারা কি এই ফাঁকিতে ভুলতে পারে? সনাতন মে দিবসই তাদের প্রেরণা জুগিয়েছে এতদিন; এর পরেও ওই তিথিটিই তাদের কাছে পুণ্যতিথি হয়ে থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *