সপ্তম পরিচ্ছেদ – দেউলপোতা

সপ্তম পরিচ্ছেদ – দেউলপোতা

আড়িয়াদহের দক্ষিণ পল্লি দক্ষিণেশ্বর নামে প্রসিদ্ধ। কথিত আছে, অতি পূৰ্ব্বকালে এই পল্লিমধ্যে বাণরাজার এক দেবালয় ছিল। আমরা যে সময়ের বিবরণ লিখিতেছি, সে সময়ে এই দেবালয়ের কোনই চিহ্ন ছিল না, কেবল ষাট-সত্তর বিঘা পরিমিত জমির উপরে ইষ্টক ও একপ্রকার পাটলবর্ণ মৃত্তিকার একটি স্তূপ মাত্র বিদ্যমান ছিল। এই প্রকাণ্ড স্তূপ নানা প্রকার গুল্ম লতা ও মহাভ্রুমে আকীর্ণ থাকায় ইহাকে একটি জঙ্গলময় পৰ্ব্বত বলিয়া বোধ হইত। এখানে মনুষ্যের সমাগম ছিল না, রজনীর কথা দূরে থাকুক, দিবসেও এই দেউলপোতার নিকট দিয়া একাকী যাইতে কাহারও সাহস হইত না। এই স্থান ভূত, প্রেত ও ব্রহ্মদৈত্যের আবাসভূমি বলিয়া সকলের সংস্কার ছিল। ঘোর নিশীথ সময়ে এই স্থানে সুমধুর রমণীকণ্ঠনিঃসৃত সঙ্গীতধ্বনি সৰ্ব্বদাই শুনা যাইত এবং অত্যুচ্চ অশ্বত্থশাখায় বিলম্বিত চরণে উপবিষ্টা শুভ্রবসনা প্রেতিনী জ্যোৎস্নায় চুল শুকাইতেছে, ইহাও কখন কখন দেখা যাইত।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে, পঞ্চমীর চন্দ্রমার সহিত সদালাপ করিয়া সেঁজোতারা বিদায় লইলে, পথ ঘাট জনশূন্য ও পৃথিবী নিস্তব্ধ হইলে সেই ঘোর বিভীষিকা-সঙ্কুল স্তূপোপরি এক দীর্ঘাকার মূর্ত্তির আবির্ভাব হইল। তাহার সর্ব্বাঙ্গ চন্দনে চর্চিত, গলদেশে গুচ্ছবদ্ধ যজ্ঞোপবীত এবং কটিদেশে পরিহিত শুভ্র-বসনোপরি একখানি রঞ্জিত গাত্র-মার্জ্জনী ত্রিকোণাকারে আবদ্ধ ছিল। সেই মূৰ্ত্তি স্তূপের অতি উচ্চস্থান হইতে অবনত হইয়া কি যেন দেখিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ এইভাবে থাকিয়া স্তূপজাত কণ্টকাকীর্ণ জঙ্গল ভেদ করিয়া ক্রমে এক বাপীকূলে আসিয়া উপস্থিত হইল। এই জলাশয় খুব গভীর অথচ প্রশস্ত এবং নানা প্রকার জলজলতায় অলঙ্কৃত।

তড়াগের সুবিশাল বক্ষে একখানি ক্ষুদ্র তরণী একটি যুবতী কর্তৃক যথেচ্ছা সঞ্চালিত হইতেছিল। রমণী কৃষ্ণবর্ণা ও আলুলায়িতকেশা, তাহার ঘন কুঞ্চিত কুন্তলদাম লম্বমান হইয়া স্থূল নিতম্ব স্পর্শ করিয়াছিল, এবং বসনাঞ্চল দক্ষিণ স্কন্ধদিয়া কটিদেশ বেষ্টন করিয়া তাহার উন্নত বক্ষঃ অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিয়াছিল। তাহার মুখমণ্ডল ও অঙ্গের গঠন অতীব মনোহর, ফলতঃ এই চাব্বঙ্গীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এরূপ সুগঠিত যে, সেরূপ সুঠাম গঠন সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না। বামা এক হস্তে জালের দড়ী ধরিয়া বীণাবিনিন্দিতকণ্ঠে একটা গান করিতেছিল

“চাকা চাকা মেঘ উঠেছে,
চাঁদ উঠেছে আকাশে।
চাঁদের আলো জ্বল্‌ছে জলে,
ঢেউ উঠেছে বাতাসে।
চলে আয় শাল, শোল,
চেলা, চেতল, রাঘব-বোল,
দেখে যারে হেলার হাসি,
পলাস্ কেন তরাসে?”

আগন্তুক তীরস্থ জঙ্গল হইতে একখানি ভেলা টানিয়া বাহির করিল। তৎপরে তাহা জলে ভাসাইয়া আপনি তদুপরি আরোহণ করিয়া সেই রমণীর প্রতি ধাবমান হইল।

আগন্তুককে দেখিবামাত্র গায়িকা নীরব হইল এবং তরণী ভিন্নদিকে চালাইয়া দিল। আগন্তুকও সেইদিকে ভেলা লইয়া ধাবমান হইল এবং রমণীর নিকটবর্ত্তী হইলে, রমণী গতি পরিবর্ত্তন করিল, কিন্তু বহিত্র একটি লতায় সংলগ্ন হওয়াতে আর যাইতে পারিল না। আগন্তুক দ্রুতবেগে যাইয়া নৌকা ধরিল। রমণী নিরুপায় হইয়া বলিয়া উঠিল, “ডেক্রা বামুন, আবার এসেছিস্?”

আগন্তুক। দেখি, কি মাছ ধরেছিস্?

রমণী। তোকে দেখাব কেন?

আ। তুই এমনি করে রোজ রোজ মাছ ধরিস্, আজ তোকে ধরিয়ে দিব।

র। তুই ত আমাকে ধরিয়ে দিবি; কিন্তু তুই কাল কোথা গিয়েছিলি, বল্ দেখি।

আ। (একগাছি কণ্ঠহার দেখাইয়া) দেখেছিস্?

র। কার সর্ব্বনাশ করে এনেছিস?

আ। নিবি?

র। ডেক্রা বামুন, তুই আমায় লোভ দেখাচ্ছিস? গহনাগাঁটির লোভ থাকলে, কজ্জলাকে আর এমন করে মাছ ধরে খেতে হত না।

রমণীর নাম কজ্জলা।

আ। নিবিনি? তবে তুই কি চাস?

কজ্জলা। আমি কিছুই চাই না—কেবল তোর ও কালামুখ আমায় আর দেখতে না হয়, আমি এই চাই।

আগ। পোড়ার মুখি! এই কি তোর ভালবাসা?

কজ্জলা উত্তর না দিয়া গান ধরিল;—

“প্রেম, পীরিতি, ভালবাসা ছেঁড়া করে খাব, সই
সবাই দেখি ছেঁচড়া, ওলো, ভালবাসার মানুষ কই?
যে বুঝে না মনের বেদন, ছি ছি, তার সনে কি মনের মিলন!
মনের মতন পুরুষ রতন পাই যদি তার দাসী হই।”

আগ। কেন কজ্জলা, আমি কি তোকে ভালবাসি না?

কজ্জলা। মুখে আগুন তোর ভালবাসার, অমন ভালবাসা আমি চাই না। ভালবাসার কাজ তুই করলি কই?

আগ। কেন, কি করতে হবে বল্ না?

কজ্জলা। মর, আমি তোকে বলে দেব যে, তুই আমায় এমনি করে ভালবাস্, তবে তুই আমায় ভালবাবি? একথা বলতে তোর একটু লজ্জা হল না! কেমন করে ভালবাসে, তাও কি আবার শিখিয়ে দিতে হবে?

আগ। এখন তোর ও হেঁয়ালির কথা রাখ। কি চাস, বল।

ক। ওরে বানা, কতবার করে বলতে হবে। আসল কথাই তুই ভুলে যাস যে—

আগ। নারে ভুলিনি সব মনে আছে। (কজ্জলার চিবুক ধরিল।)

ক। দূর দূর, দূর-হ—মর্ ছোঁড়া

আগ। আ মর ছুঁড়ী, দূর দূর করিস কেন? তুই যা বলবি তাই করব।

ক। তুই আমায় নিকে করতে পারবি? পৈতে ফেলতে পারবি?

আগ। এই বৈত নয়? ওরে প্রেমের কাছে জাতিভেদ কতক্ষণ রয়?

ক। বান্না, তোর কথায় আমি ভুলব না, তোর ভালবাসা আমি কাজে দেখতে চাই। আগ। আচ্ছা তাই হবে। এখন এই হারছড়াটা পর।

ক। আ মর্! পরের হার আমি পরতে গেলেম কেন?

আগ। আমি কি তোর পর লো ছুঁড়ি?

ক। তুই আমার কে?

আগ। এখন নেথ্রা রাখ। নিবি কি না, বল।

ক। না, আমি কখনই নেব না। যার জিনিষ তাকে যদি ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারিস, তবে জানব যে, তুই আমায় ভালবাসিস।

“এ আমার জিনিষ, আমি তোর গলায় পরিয়ে দিব,” বলিয়া আগন্তুক যেমন কজ্জলার কণ্ঠে হার পরাইতে গেল, কজ্জলা অমনি ধাক্কা মারিয়া তাহাকে জলে ফেলিয়া দিল, এবং দ্রুতবেগে নৌকা চালাইয়া তীরে যাইয়া নামিল।

কজ্জলা, বাগ্দীর মেয়ে বলিয়া পরিচিত ছিল; সে কি দিনমানে, কি রাত্রিকালে সর্ব্বদাই দেউলপোতায় নির্ভয়ে যাতায়াত করিত বলিয়া, সকলেই তাহাকে উপদেবতাশ্রিত বলিয়া জানিত কজ্জলা যে ব্যক্তিকে জলে ফেলিয়া দিল, পাঠক, তাহাকে আর একবার আর একস্থানে আর একবেশে দেখিয়াছেন, সে ব্যক্তি প্রসিদ্ধ দস্যু—রত্নাপাখী। রতন সন্তরণ করিয়া তীরে উঠিল এবং আর্দ্রবস্ত্রে ও বিরক্তচিত্তে দেউলপোতা হইতে অবতরণপূর্ব্বক অন্ধকারে মিশাইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *