ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পরামর্শ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পরামর্শ

বিনোদিনী পূর্ব্বোক্ত দ্বিতলগৃহে পর্য্যঙ্কোপরি স্পন্দহীনা পড়িয়া আছেন। এখনও তাঁহার চেতনা, হয় নাই এবং বিধবা বধু তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া শুশ্রূষা করিতেছেন। দেওয়ান দরদালানে বসিয়া বৃদ্ধ শ্বশুরের ক্ষতস্থান সকল সলিল-সিক্ত-ছিন্নবস্ত্র পরম্পরায় বাঁধিয়া দিতেছেন। ভীম সর্দ্দার সিঁড়ির দরজায় দাঁড়াইয়া হস্তে কলিকা ধরিয়া তামাকু খাইতেছে। সকলেই নীরব, কেহ কোন কথা কহিতেছে না।

বহির্বাটীতে গোয়ালঘর এখনও জ্বলিতেছে, এখনও চটাস্ পটাস্ শব্দ হইতেছে এবং গাভীটি হম্বারব করিয়া বাটীর চতুৰ্দ্দিকে দৌড়িয়া বেড়াইতেছে। কিয়ৎকাল এইভাবে গত হইলে, বিনোদিনী দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া ক্ষীণস্বরে বলিলেন, “বৌ!”

বিধবা। কেন, দিদি? এই যে আমি।

বিনো। বৌ, আমার বড় যাতনা হচ্ছে, আমার প্রাণের ভিতর কেমন ছট্‌ফট্ করছে, তুমি আমার বুকে হাত বুলাইয়া দাও।

বিনোদিনীর এইকথা শুনিয়া বৃদ্ধ উঠিয়া বসিলেন।

তাঁহাকে উঠিতে দেখিয়া দেওয়ান কুণ্ঠিতভাবে বলিলেন, “আপনি উঠিলেন কেন?”

হলধর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “আঃ, এই বৃদ্ধ বয়সে আমার অদৃষ্টে এত কষ্ট ছিল। মা বিনোদ! বিনোদ! আঃ! তুইও আমায় ছেড়ে চল্লি রে?”

“কি করেন? আপনি অস্থির হচ্ছেন কেন? মূৰ্চ্ছার পর হৃদয়ের এইরূপ যাতনা হইয়া থাকে। আপনি স্থির হউন।”

এই বলিয়া গোবিন্দরাম তৎক্ষণাৎ বিনোদিনীর শয্যাপার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইলেন।

বিধবা। ঠাকুর-ঝি! চেয়ে দেখ, কে এসেছে দেখ।

বিনোদিনী একবারমাত্র গোবিন্দরামের মুখপানে চাহিয়া লজ্জায় নয়ন নিমীলিত করিলেন। তখন দেওয়ানের হৃদয়ে যে কি অপূর্ব্ব ভাবের আবির্ভাব হইল, তাহা স্বাধীন প্রেমের পক্ষপাতী যুবকগণ কখনই বুঝিবেন না। বিবাহিত স্ত্রী পুরুষের চিরবৃদ্ধিশীল স্বর্গীয় প্রণয়ে তাঁহারা চিরদিন বঞ্চিত থাকিবেন।

বিনোদিনীকে তদবস্থ দেখিয়া গোবিন্দরামের দাম্পত্য-স্নেহ উছলিয়া উঠিল। তিনি বিধবাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “দেখুন, ওকে এখন কদাচ উঠিতে দিবেন না। এখন উঠিলে পুনর্ব্বার মূৰ্চ্ছিতা হইবার সম্ভাবনা। ঘরে দুগ্ধ থাকে ত একটু খাইতে দিন।”

এই বলিয়া তিনি আবার বৃদ্ধ শ্বশুর মহাশয়ের নিকটে আসিয়া বসিলেন। বৃদ্ধ বলিলেন, “বাবা! আজ তুমি যথার্থ পুত্রের কাজ করিলে, আজি তোমা হইতেই আমরা কয়জন প্রাণ পাইলাম।”

দেওয়ান উত্তর করিলেন, “না মহাশয়! বরং আমার জন্যই আপনাদের এই বিপদ ঘটিল।”

এই বলিয়া তিনি সেই ভয়ঙ্করী শব্বরীর সমস্ত বৃত্তান্ত শ্বশুরকে বলিতে লাগিলেন। এই সময়ে বহির্বাটীতে কাহার আর্তনাদ শুনা গেল। সকলেই উদ্বিগ্ন হইলেন। গোবিন্দরাম তরবারি গ্রহণ করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন।

হলধর ঘোষ তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন, “কি কর, বাপু? স্থির হও। তোমার যাওয়া হইবে না। কিছুতেই তোমার এখন যাওয়া হুইবে না।”

“আপনি থাকুন, আমি যাচ্ছি,” এই বলিয়া, প্রভুর অনুমতির অপেক্ষা না করিয়া ভীম সদার নিমেষের মধ্যে বহির্বাটীতে উপস্থিত হইল। তথায় কাহাকেও দেখিতে পাইল না; দেখিল গোয়ালের চাল ভস্মীভূত হইয়া ভূমিসাৎ হইয়াছে এবং বহ্নির প্রবলতা অনেক পরিমাণে হ্রাস হইয়া আসিয়াছে। পরে চণ্ডীমণ্ডপে যাইয়া খুঁজিল, সেখানেও কাহাকে দেখিতে পাইল না। পরিশেষে বাটীর বাহিরে যাইয়া দেখিল, একব্যক্তি ধরাশায়ী হইয়া রহিয়াছে, তাহাকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারিল। সে ব্যক্তি তাহার প্রভুর ভগ্নীপতি হরজীবন কুমার। অমনি তাঁহাকে বক্ষে করিয়া তুলিয়া অন্তঃপুরে লইয়া গেল।

দেওয়ান ভগ্নীপতির তথাবিধ অবস্থা দেখিয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলেন এবং তাঁহার চেতনা সম্পাদনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে হরজীবনের চৈতন্য হইল। দেওয়ান ভগ্নীপতির পরিধেয় আর্দ্র দেখিয়া গৃহমধ্য হইতে একখানি বস্ত্র আনিয়া তাঁহাকে পরিতে দিলেন। কুমারজী বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া দেওয়ান ও তদীয় শ্বশুর মহাশয়ের সহিত একত্রে বসিলেন। ভীম সদার তামাকু সাজিয়া দিল।

দেও। কুমারজি! ব্যাপার কি?

হর। ভাই, তখন যদি তোমার সঙ্গে আসতেম, তা’হলে এমন বিপদে পড়তে হত না। বাপ্ রে! বাপ্ রে! আমার জীবনে আমি এমন বিপদে কখনও পড়ি নাই। বালীর ঘাটে তোমাদের নামাইয়া দিয়া আমরা নৌকা ছাড়িয়া দিলাম। গঙ্গা একটানা, নৌকা এগোয় না। মাঝীরা প্রাণপণে বেয়ে বেয়ে সবেমাত্র কোন্নগর ছাড়াইয়াছে, এমন সময়ে কোথা হইতে দুইদিক দিয়া দুইখানি সড়পি আমাদের নৌকায় আসিয়া চাপিয়া পড়িল। একজন লোক আমাদের নৌকায় উঠিয়া মাঝীকে জলে ফেলিয়া দিল, দাঁড়ীরা তাহা দেখিয়া জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। তারপর আর দুই-তিন জন লোক আসিয়া আমাদের জিনিষপত্র লুঠপাট করিতে লাগিল। আমি বিপদ দেখিয়া নৌকা হইতে লাফ দিয়া পড়িলাম। স্রোতে আমাকে বহুদূর টানিয়া লইয়া গেল, অতি কষ্টে সাঁতার দিয়া কিনারায় আসিলাম। জল হইতে উঠিয়া এদিক-ওদিক দেখিলাম; কিন্তু আমাদের নৌকা দেখিতে পাইলাম না। অত্যন্ত শীতবোধ হইতে লাগিল। উপরে উঠিয়া দেখিলাম, সে স্থানটি জঙ্গলময়, সেখানে পথ- ঘাট কি লোকের বসতি নাই। নিরুপায় হইয়া চড়ার উপর দিয়া চলিলাম। বহুদূর যাইয়া একজন জেলেকে দেখিতে পাইয়া বলিলাম, ‘ভাই! আমি বড় বিপদে পড়িয়াছি, আমায় রক্ষা কর।’ আমার কাতরতা দেখিয়া সে ব্যক্তির দয়া হইল। আমি অনুরোধ করায় সে আমায় কালীপুরের পথ দেখাইয়া দিল। পথে আশ্রয় পাইবার জন্য চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। একাকী মাঠের উপর দিয়া চলিতে লাগিলাম, তারপর অতিকষ্টে এ পৰ্য্যন্ত আসিলাম; কিন্তু এখানে আসিয়া যাহা দেখিলাম, তাহা আর এ জীবনে ভুলিব না—কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য! কি ভয়ানক কাণ্ড! গৃহ পুড়িতেছে, অগ্নিশিখা গগনস্পর্শ করিতেছে, আর একটা বিকটাকার রাক্ষস একটা মানুষকে ধরিয়া কড়মড় করিয়া খাইতেছে। সে ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিয়া আমার প্রাণে আর কিছু রহিল না। আমার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। আমি আর দাঁড়াইতে পারিলাম না, চীৎকার করিয়া পড়িয়া গেলাম।

দেও। ও হো! ভীমে, দেখ ত রে সে ডাকাতটা পড়ে আছে কি না?

ভীম সর্দ্দার তৎক্ষণাৎ নীচে নামিয়া গেল; ক্ষণপরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “আজ্ঞা, দেখিতে পাইলাম না।”

কথাটা শুনিয়া গোবিন্দরামের মুখমণ্ডল কিছু অপ্রসন্ন হইল। তিনি বলিলেন, “যাহা ভাবিয়াছি, তাহাই হইল। বেটারা লাস্টা সরাইয়াছে।” পরে গোবিন্দরাম নিজের বিপদের কথা হরজীবনকে বলিতে লাগিলেন। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইল—কাক কোকিল প্রভৃতি বিহঙ্গম-কোলাহলে চতুৰ্দ্দিক আকুলিত হইতে লাগিল।

দেওয়ান, হরজীবন কুমার ও ভীম সদার বহির্বাটীতে গেলে, বৃদ্ধ হলধর ঘোষও একগাছি লাঠী ধরিয়া ধীরে ধীরে চণ্ডীমণ্ডপে যাইয়া বসিলেন। তাঁহার বদান্যতা ও পরোপকারিতাগুণে গ্রামের সকল লোকেই তাঁহাকে ভালবাসিত। তাঁহার বিপদের কথা শুনিয়া সকলেই কাতর হইয়াছিল। অনেকেই তাঁহাকে দেখিতে আসিল। তাঁহাদের মধ্যে কোন প্রাচীন ব্যক্তি দেওয়ানকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “বাবুজি, আমায় চিনিতে পারেন?”

দেও। আজ্ঞা, আপনাকে পূর্ব্বে এইস্থানেই দেখিয়াছিলাম।

এই ব্যক্তি বৃদ্ধ হলধর ঘোষের সমবয়স্ক বন্ধু, নাম জগন্মোহন বসু। ইনি প্রায় প্রতিদিনই হলধর ঘোষের বাটীতে আসিতেন ও তাঁহার সহিত পাশা খেলিতেন।

হল। জগন্মোহন দাদা, আমার এই জামাতা হতেই আমরা এ যাত্রা রক্ষা পেলেম। দেও। আপনাদের দেশ যে এ প্রকার ভয়ানক স্থান, তা আমি জানিতাম না।

জগ। ভয়ের কথা বরাবরই শুনা যায়; বিশেষ ঐ পাখীর বাগানের সামনেটা বড়ই কদর্য্য স্থান।

দেও। কলিকাতার নিকটেও এমন বদ্‌মাসের আড্ডা? এ সকল দুষ্ট লোকের দমন হয় না কেন?

জগ। সে বাবু অনেক কথা। শুনা যায়, রাঘব সেন ডাকাত পোষে, তার দলকে গ্রেপ্তার করা বড় সহজ কাজ মনে করিবেন না।

দেও। তথাপি এ প্রকার অরাজকতা নিবারণের চেষ্টা করা খুব কর্তব্য হয়েছে।

জগন্মোহন, হলধর ঘোষকে বলিলেন, “তুমি যদি কলিকাতার ফৌজদার বিশ্বনাথ ঘোষকে ধরে একটু বিশেষ চেষ্টা কর, তা হলে বোধ হয়, এ অরাজকতার দমন হতে পারে।”

দেও। এ বিষয়ে ঔদাস্য করিলে চলিবে কেন। আপনি একটু সুস্থ হইলেই আমরা উভয়ে কলিকাতায় গিয়া এই সকল অত্যাচারের কথা তাঁহাকে বলিব, আর যাহাতে শীঘ্র ইহার প্রতীকার হয়, তাহার পরামর্শ করিব।

জগ। ভায়া, যত শীঘ্র পার,,জামাই বাবুকে সঙ্গে করে কলিকাতায় যাও;এ অত্যাচার আর সহ্য হয় না—এর একটা প্রতীকার করা খুব কৰ্ত্তব্য হয়েছে।

নানা কথাবার্তায় বেলা অধিক হইলে সমাগত ব্যক্তিগণ স্ব স্ব গৃহে প্রস্থান করিলেন; এবং দেওয়ান শ্বশুরের নিকট বিদায় লইয়া স্বস্ত্রীক স্বদেশ যাত্রা করিলেন। হরজীবন ও ভীম সর্দ্দার তাঁহার অনুসরণ করিল। প্রান্তর পথে যাইতে যাইতে পূর্ব্বরাত্রির কথা স্মরণ হওয়ায় গোবিন্দরাম অশ্বত্থ তরুমূলে সেই সন্ন্যাসীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলেন, কিন্তু তথায় কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *