বিংশ পরিচ্ছেদ – দেওয়ানের বৈঠকখানা

বিংশ পরিচ্ছেদ – দেওয়ানের বৈঠকখানা

চুনকাম করা ধবধবে বৈঠকখানায় তক্তাপোষ, ধন্ধবে জাজিমে আবৃত। জাজিমের উপর কয়েকটা তাকিয়া, একটা পাখওয়াজ ও একটা তানপুরা পড়িয়া আছে এবং মধ্যস্থলে একটি মৃদঙ্গ াকার কাচাবরণ মধ্যে পিত্তল নির্ম্মিত দীপাধারে মৃণ্ময় প্রদীপ জ্বলিতেছে। এই গৃহে দেওয়ান গোবিন্দরাম, তদীয় ভগ্নীপতি হরজীবন কুমার, শ্রীনিবাস মুখোপাধ্যায় ও পাচক ব্রাহ্মণ নিত্যানন্দ একাগ্রচিত্তে সমাগত হলধর ঘোষের বিপদের কথা শুনিতেছিলেন; বৃদ্ধ হলধর প্রান্তরে দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া কিরূপে উদ্ধার লাভ করিয়াছিলেন, তত্তাবৎ পাঠক অবগত আছেন।

হলধর সেই বিবরণ পরিসমাপ্ত করিয়া জামাতাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “এ দেশ বড় অরাজক স্থান হয়ে উঠল—আমার জমি-জমা যাহা কিছু আছে, সমস্ত বিক্রয় কোরে, তুমি বাপু, আমায় কিঞ্চিৎ অর্থ দাও, আমি কাশীতে গিয়া বাস করি, এ নরকে আর আমার একদণ্ডও থাকিতে ইচ্ছা নাই।”

শ্রীনিবাস। সে কি মহাশয়! ঢেউ দেখে ‘না’ ডুবাইলে চলিবে কেন? দেশে ভয় হয়েছে, সে ভয় যাহাতে নিবারিত হয়, তাহার উপায় করুন।

হরজীবন। হাঁ, তোরা বড় তেজীয়ান পুরুষ হয়েছিস কি না? যে কাণ্ডটা বাধিয়েছিস, এখন ভালয় ভালয় এই রাত্রিটা কাটিলে হয়।

দেওয়ান। কুমারজী ভয়েই সারা। কি মুস্কিল! আমরা কি মরে রয়েছি যে, তারা স্বচ্ছন্দে এসে ডাকাতি করে চলে যাবে?

হর। মরে ত নাই, কিন্তু মরতে কতক্ষণ—আজরাত্রে যে কে বেঁচে থাকবে তা, কে বলতে পারে?

দেও। ডাকাতি না হইলেও যে আজরাত্রে বাঁচিয়া থাকিব, তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? কখন কাহার কি হইবে, তাহা কে বলিতে পারে? মৃত্যু যখন নিশ্চয় অবধারিত রহিয়াছে, তখন মৃত্যুকে ভয় করিব কেন?

এই সময়ে একজন দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ ব্রাহ্মণ “জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যু, ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ” এই কৃষ্ণোক্তিটি আম্রেড়ন করতঃ গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। দেওয়ান, হরজীবন ও হলধর ঘোষ তাঁহাকে সসম্ভ্রমে প্রণামপূর্ব্বক “বসতে আজ্ঞা হয় বলিয়া,” আগন্তুকের অভ্যর্থনা করিলেন। অভ্যাগত রতন শৰ্ম্মা “কল্যাণ হউক” বলিয়া উপবেশন করিল।

দেও। মহাশয়ের নাম কি, কোথা হতে আসা হচ্ছে?

রত্না। আমার নাম হরিহর শর্ম্মা, পিতার নাম রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য, নিবাস হরিপাল, কলিকাতায় শিষ্যালয়ে গমন করা হইয়াছিল, সম্প্রতি মহাশয়ের বাটীতে অতিথি। এ প্রদেশে যে প্রকার দস্যুভয়, বিশেষ এই পূজার সময়, রাত্রিকালে একাকী আর অধিক দূর যাইতে সাহস হইল না।

দেও। তা ভালই করেছেন। ওরে ব্রাহ্মণের হুঁকায় তামাক দে, পথ ঘাট বড়ই খারাপ, আজ সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমার এই শ্বশুর মহাশয়কে ঝাঁকারিয়ার মাঠে ডাকাতে ঘিরিয়াছিল। সৌভাগ্যক্রমে অপর কয়েকজন রাহী আসিয়া সাহায্য করাতে ইনি বাঁচিয়া আসিয়াছেন।

শ্রীনিবাস। এরূপ ঘটনা মহাশয়, এ অঞ্চলে প্রত্যহই ঘটিতেছে, এই আজ পাঁচদিন হল, আমি আর এই ব্রাহ্মণ ঠাকুর বোম্বেটের হাতে পড়েছিলাম; তারা আমাদের সমস্ত সামগ্রী লুঠপাট করে কেবল পৈতা দেখে ব্রাহ্মণ বলে ছেড়ে দিয়াছে।

হর। আবার সেই ডাকাতেদরই তোরা ঘাঁটাচ্ছিস।

রত্না। সে কিরূপ?

এই সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া “মহাশয় তামাক ইচ্ছা করুন,” বলিয়া রতন শর্ম্মার হাতে হুঁকা দিয়া চলিয়া গেল।

হর। বলব কি মহাশয়, এদের নিতান্তই মতিচ্ছন্ন হয়েছে। এ প্রদেশে রাঘব সেন একজন প্রবল পরাক্রান্ত সম্ভ্রান্ত লোক, লোক-বল, ধন-বল, বুদ্ধি-বল তার সকলই আছে। তার ডাকাতের দলের কয়েকটা লোককে এঁরা গ্রেপ্তার করে কাল হুগলীতে চালান দিয়েছেন। কাজটা কি ভাল হয়েছে?

রত্না। (তামাক খাইতে খাইতে সহাস্য বদনে) কেন? ভালই ত করেছেন। দুষ্টের দমন করা চাই না?

দেও। আমিও সেই কথা বলিতেছিলাম। মৃত্যু যখন একদিন নিশ্চয়ই ঘটিবে, তখন মৃত্যুভয়ে মৃতপ্রায় হইয়া চিরদিন মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করিব কি জন্য? দেশে ঘোর অরাজকতা—কাহারই ধন-প্রাণ নিরাপদ নহে। দুর্বৃত্ত দস্যুদিগের দৌরাত্মে দেশস্থ সমস্ত লোক যৎপরোনাস্তি নিপীড়িত। এক মুহূর্ত্তের নিমিত্ত কেহ নিশ্চিন্ত নহে, কাহারও হৃদয়ে তিল মাত্র সুখ নাই। এরূপ অবস্থায় থাকিয়া যন্ত্রণা ভোগ করা অপেক্ষা অনিষ্ট নিবারণের চেষ্টা করা কি কর্ত্তব্য নয়? প্রতিদিন দস্যুদল আমাদের প্রহার ও নিপীড়ন করিয়া আমাদের যথাসর্ব্বস্ব হরণ করিয়া লইয়া যাইবে, আমাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতাদিগকে প্রান্তরে, রাজপথে, জলপথে যথায় তথায় হত্যা করিবে; আমাদের স্ত্রীলোকদিগকে অপমান ও নির্যাতন করিয়া তাহাদের গাত্রালঙ্কার ছিঁড়িয়া লইবে, আর আমরা জড়সড় হইয়া বসিয়া বসিয়া তাহা দেখিব, ভয়ে একটা হাতও তুলিতে পারিব না? কেন, এত প্রাণের ভয় কেন? মরিতে হয় মরিব, কিন্তু এ দারুণ অত্যাচার কখনই সহ্য করিব না। যে অপমান সহ্য করিতে পারে—অকারণ নির্যাতন সহ্য করিতে পারে, সে ত কাপুরুষ।

রত্নাপাখী, নিস্পন্দ, নিৰ্ব্বাক হইয়া নির্নিমেষ নয়নে দেওয়ানের মুখপানে চাহিয়া তাঁহার শৈলানলোদগীরণ-নিভ-বচন-পরম্পরা শ্রবণ করিতেছিল এবং মনে মনে বলিতেছিল, “রাঘব সেন—নররূপী পিশাচ; গোবিন্দরাম — মানবদেহধারী দেবতা।” দেওয়ানের বাক্যাবসানে সে ঈষদ্ধাস্যসহকারে বলিল, “মহাশয়, এ দেশের দস্যুদল অত্যন্ত প্রবল, আপনি এ কার্য্যে একাকী ব্ৰতী হইয়া কি কৃতকার্য্য হইবেন, বোধ করিতেছেন? দেশশুদ্ধ লোক যদি একমত হয়, তবে এ কার্য্যে সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা।”

দেও। চোরের শাসন করা, এমন কিছু কঠিন কাজ নয় যে, তাহাতে দেশস্থ সমস্ত লোকের সাহায্য আবশ্যক হইবে। আমি এই কয়েকদিনের মধ্যে চারি-পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করিয়া হুগলীতে চালান দিয়াছি; আবার অদ্য আমার বাড়ীতে ডাকাতি হইবার কথা আছে; দেখিব, তাহারা কেমন করিয়া আমার বাড়ী হইতে নিরাপদে বাহির হইয়া যায়।

হর। ওরে, রত্নাপাখী বড় সহজ ডাকাত নয়। তার নামে এই তিনখানা জেলার লোক হাড়ে কাঁপে। তাকে রুখতে গেলে, তুই নিশ্চয় মারা পড়বি, দেখছি।

দেও। আমি বিদেশে পড়িয়া থাকিয়া, পরের গোলামী করিয়া, বহু কষ্টে যাহা সঞ্চয় করিয়া আনিলাম, সেই সমস্তগুলি তাহাকে ধরিয়া দিতে হইবে নাকি?

রত্না। ধন-রত্ন বহুকষ্টে, বহু পরিশ্রমে উপার্জ্জিত হয়। তবে কথা হইতেছে, আপনি আপনার কায়িক বল ও সাহসের উপর এত নির্ভর করিবেন না। রত্নাপাখী বড়ই দুৰ্দ্দান্ত দস্যু, আপনি আপনার বহুমূল্য সামগ্রীগুলি স্থানান্তরিত করুন, অথবা কোন একটা নিভৃত স্থানে লুকাইয়া রাখুন।

দেও। কি বলেন মহাশয়! একটা সামান্য ডাকাতকে ভয় করিয়া চলিতে হইবে? রত্নাপাখী যে গহনার বাক্স হরণ করিতে চায়, সে বাক্স আমি সিন্দুকে তুলি নাই, গৃহমধ্যে অনাবৃত রাখিয়া দিয়াছি; দেখিব, সে কত বড় ডাকাত, কেমন করিয়া তাহা আত্মসাৎ করে।

হলধর ঘোষ গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, “বাপু, সাবধানের বিনাশ নাই। একটু বিবেচনা করিয়া চলিও, তুমি বুদ্ধিমান, তোমায় অধিক কথা আর কি বলিব, তোমায় একবার আমার সহিত কলিকাতায় যাইতে হইবে; কল্য প্রাতে ফৌজদার বিশ্বনাথ ঘোষকে এই ডাকাতদের দৌরাত্ম্যের বিষয় একবার জানাইব। দেখি, তিনি ইহার কোন প্রতীকার করিতে পারেন কি না? এখন এস, একবার বাড়ীর ভিতরে যাই।”

দেওয়ান, “আজ্ঞা চলুন” বলিয়া, শ্বশুর মহাশয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। শ্রীনিবাস নিজ গৃহে গমন করিল। নিত্যানন্দ, রতন শর্ম্মার যথাবিহিত আতিথ্য করিল— রতন শৰ্ম্মা জলযোগান্তে নিত্যানন্দের সহিত বৈঠকখানায় শয়ন করিয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *