দশম পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে

দশম পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে

আকাশে মেঘ নাই, চাঁদ নাই, কেবল লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র বিরাজিত রহিয়াছে। প্রান্তর ধূ ধূ করিতেছে, জনপ্রাণী কেহ নাই, সাড়া শব্দ কিছুই নাই, কেবল বৃক্ষে বৃক্ষে লক্ষ লক্ষ খদ্যোতিকা জ্বলিতেছে। রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে, এমন সময়ে রত্নাপাখী প্রান্তর পথ দিয়া রত্নপুর গ্রাম হইতে পাখীর বাগান অভিমুখে গমন করিতেছিল। তাহার গমন-প্রণালী বিচিত্র। সে কখন তীরবেগে, কখন বা হস্তহিত সুদীর্ঘ যষ্টির উপরে ভর দিয়া লম্ফ প্রদানে যাইতেছিল। যাইতে যাইতে একস্থানে শুনিতে পাইল, কে যেন গান করিতেছে, সেই গান শুনিয়া দাঁড়াইল; দাঁড়াইয়া মনোযোগের সহিত গানটি শুনিতে লাগিল। এমন সময়ে এমন স্থানে, কে গান করিতেছে? কে গাইতেছে?

“কেন রে বলিব তারে, কত তারে ভালবাসি?
সে কথা সে শুধাইলে, শুধু মনে মনে হাসি।
সে আমার, আমি তার,
সে বিনা জানি না আর,
সে ভাবিলে আপনার, হব তার দাসী।”

গান শুনিয়া রত্নাপাখী ঈষৎ হাসি হাসিল এবং যে স্থান হইতে সেই স্বরসুধাস্রোত প্রবাহিত হইতেছিল, সেই স্থানাভিমুখে চলিল। ক্রমে সে এক দীর্ঘকার উত্তুঙ্গতীরে আশ্বিশুরবাড়স্থিত হইল। তীরস্থ তালতরুরাজী নৈশ অন্ধকারে বিকটা সদ্ভাবস্থত্যসেনার ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছিল এবং সরোবরের বাঁধাঘাটে প্রলম্বিত চরণে উপবিষ্টা হইয়া এক রমণী গান করিতেছিল। রত্না নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সেই কামিনীর সমীপাগত হইয়া পশ্চাৎ হইতে তাহার আয়ত চক্ষু দুটি চাপিয়া ধরিল। কামিনী কিঞ্চিন্মাত্র ভীত বা চকিত না হইয়া দৃঢ়স্বরে বলিয়া উঠিল, “ছেড়ে দে বাম্‌না, ছেড়ে দে, আরে মলো! এখানেও আবার মরতে এসেছিস?”

রত্না। পোড়ারমুখী, তুই এখানে কি করতে এসেছিস্?

কজ্জলা। তোর কাণ্ডকারখানা দেখতে, তোর পিণ্ড দিতে এসেছি।

রত্না। কাণ্ডকারখানা কি?

ক। সে কথায় কাজ কি? যা দেখবার তা দেখেছি।

রত্না। দেখেছিস ত, তুই যা বলেছিলি, তা করেছি কি না?

ক। কি করেছিস?

রত্না। হার ফিরিয়ে দিয়েছি।

ক। হার ফিরিয়ে দিয়ে থাকিস, ভালই করেছিস, কিন্তু যা’ দেখলাম, তাতে ইচ্ছা হয় না যে, তোর সঙ্গে আর কথা কই? রতন, তুই একদিন মারা পড়বি, ও কাজ ছাড়—ডাকাতী ছাড়–রাঘব সেনের সংসর্গ ছাড়। রাঘব মানুষ নয়, পিশাচ—তুইও পিশাচ।

রত্না। তুই কি দেখেছিস্, অ্যাঁ?

ক। তা তোকে বলব কেন?

রত্না। বলতেই হবে।

ক। বলব না।

রত্না। তুই বলবি নি?

ক। না।

রত্না। জানিস, তুই এন আমার সম্পূর্ণ এক্তারে?

“আ মলো, আমায় ভয় দেখাচ্ছিস? তুই কি মনে করিস, আমি তোকে ভয় করি? আচ্ছা তুই কি করবি কর,” বলিয়া কজ্জলা সরোবরের জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয় ক্রোধে আহত বিষধরের ন্যায় গৰ্জ্জন করিয়া উঠিলেন, কিন্তু কোথাও আর কজ্জলাকে দেখিতে পাইলেন না। তখন চারিদিকে কাক কোকিল ডাকিতেছে, পূর্ব্বদিক ফরশা হইয়াছে, শুকতারা নিবিয়া গিয়াছে এবং প্রান্তরের প্রান্তবর্তী জনপদ সমূহে আনন্দজনক মঙ্গল বাদ্য বাজিয়া উঠিয়াছে।

অদ্য দুর্গাষষ্ঠী—বঙ্গে মহা আনন্দের দিন। বঙ্গে আজ বিশ্বজননীর শুভাগমন হইবে বলিয়াই যেন জলধর সমস্ত দেশ ধৌত ও পরিষ্কৃত করিয়া রাখিয়াছে। তরু, লতা, তৃণ, গুল্ম প্রভৃতি সমস্ত উদ্ভিদগণ ধৌত ও পরিষ্কৃত হইয়া চতুৰ্দ্দিকে মনোহর হরিৎ শোভা বিস্তার করিয়াছে। বিশ্ব-জননীর চরণ-প্রক্ষালনের উপযুক্ত হইবার জন্যই যেন জাহ্নবী-জল নিৰ্ম্মল হইয়াছে—জাহ্নবীর প্রাবৃট্‌-মালিন্য অপগত হইয়াছে। তদীয় পাদপদ্মে স্থান প্রাপ্ত হইবার জন্যই যেন বঙ্গের অসংখ্য সরোবরে শত শত শতদল প্রস্ফুটিত হইয়াছে। বিশ্ব-জননীর চরণার্চ্চনার উপযোগিনী হইবার জন্যই যেন সামান্যা শেফালিকার হৃদয়েও আজি স্বর্গীয় সৌরভ সঞ্চারিত হইয়াছে। স্বর্গের দেবতাগণ, বঙ্গে জগদম্বার মহাপূজা দেখিবে বলিয়াই যেন, গগনতল মেঘাশ্বশুরবাড়ি হইয়াছে। আজ বঙ্গবাসীর অতুল আনন্দ; বঙ্গে আজ যে সম্ভাব আনন্দ নাই, নিরানন্দ কেবল দুর্দান্ত দস্যু—রত্নাপাখীর

“কজ্জলা কি বলিল? কজ্জলা কি দেখিয়াছে? সে কি রাঘবের পাতালপুরী দেখিয়াছে? আমাদের গুপ্তমন্ত্রণা শুনিয়াছে? যদি দেখিয়া থাকে, যদি শুনিয়া থাকে? সে কি প্রকাশ করিবে? সে স্ত্রীলোক, তাহাকে বিশ্বাস কি? “স্ত্রী বুদ্ধিঃ প্রলয়ঙ্করী” রাবণের মৃত্যু-বাণের কথা মন্দোদরী ভিন্ন আর কেহই ত জানিত না, তবে রাবণ বধ হইল কেন? কজ্জলা আমায় ভালবাসিলেও বাসিতে পারে, তা ব’লে, সে যে এই সকল গুপ্ত বিষয় প্রকাশ করিবে না, ইহা আমি কি প্রকারে বিশ্বাস করিব? জানি না কি করিব? কলা! যদি যথার্থই আমাদের গুপ্তগৃহ দেখিয়া থাকিস, আমাদের গুপ্ত মন্ত্রণা শুনিয়া থাকিস, তবে জানিনা তোর অদৃষ্টে কি আছে,” এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে বিষম উদ্বিগ্ন-মনে রতন শর্ম্মা সেই সরোবর তীর হইতে প্রস্থান করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *