প্রথম পরিচ্ছেদ – গঙ্গা-হৃদয়ে

প্রথম পরিচ্ছেদ – গঙ্গা-হৃদয়ে

যদি আকাশের শোভা দেখিতে চাও, তবে শরৎকালে দেখ; যদি চাঁদের শোভা দেখিতে চাও, তবে শরৎকালে দেখ; যদি সরোবরের শোভা দেখিতে চাও, তবে শরৎকালে দেখ; যদি মাঠের শোভা দেখিতে চাও, তবে শরৎকালে দেখ; যদি সকল শোভা একত্রে দেখিতে চাও, তবে শরৎকালে দেখ। আকাশে চাঁদের হাসি, সরোবরে পদ্মের হাসি, মাঠে ধান্য, গৃহে অন্নপূর্ণা, শরতে সকলই সুন্দর, সকলই মনোহর। এই মনোহর সময়ে পূজা উপলক্ষে কাছারী বন্ধ হইলে, দেওয়ান গোবিন্দরাম নিয়োগী নৌকারোহণে বাটী আসিতেছিলেন। হুগলীর সন্নিহিত রত্নপুর গ্রামে তাঁহার বসতি, তিনি যশোহরে কর্ম্ম করিতেন। সূর্য্য অস্ত গিয়াছে; নীল আকাশে হেথা-সেথা এক-একটি প্রকাণ্ড জলদস্তূপ কাঞ্চন-গিরির ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে, চতুর্থীর চন্দ্র দেখা দিয়াছে, কিন্তু এখনও হাসে নাই; এইরূপ সময়ে মাঝীরা পাড়ি ধরিল। গঙ্গা একটানা, নৌকাখানি মৃদুগতিতে যাইতে লাগিল, দেওয়ান গোবিন্দরাম, তদীয় ভগ্নীপতি হরজীবন কুমার, বয়স্য শ্রীনিবাস মুখোপাধ্যায় এবং পাচক ব্রাহ্মণ নিত্যানন্দ রায়, এই চারিজনে নৌকাগৃহে বসিয়া তাস খেলিতেছিলেন। কে জিতিয়াছিলেন বা কে হারিয়াছিলেন, তাহা আমরা অবগত নহি। সন্ধ্যা হওয়ায় তাঁহারা খেলা বন্ধ করিলেন। নিত্যানন্দ ও শ্রীনিবাস বাহিরে আসিয়া, নৌকার ধারে বসিয়া গঙ্গাজলে সায়ংসন্ধ্যা আরম্ভ করিলেন, হরজীবন জপে বসিলেন; এবং দেওয়ানজী একটি পরিপাটী গান ধরিলেন। সে গানটি এই

গিরি, গা তোল হে, উমা এলো হিমালয়;
সরসে কমল হাসে, আকাশে ভানু উদয়;
কোকিল ডাকিছে,         মঙ্গল গায়িছে,
শীতল-সমীর সৌরভ বয়;
দুর্গা দুর্গা রবে,          ভুবন ভরিল,
অতুল আনন্দ ভারতময়।

চতুৰ্দ্দিক নিস্তব্ধ, গঙ্গার নিভৃত জলময় সুবিশাল বক্ষে কল-কলরবে নৌকা চলিতেছে, মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে এবং দেওয়ানজী মধুরস্বরে সেই মধুময় সঙ্গীত মন খুলিয়া গায়িতেছেন। সে সময়ে সকলই মধুর বোধ হইয়াছিল—সে সময়ে দেওয়ানের চিত্তপটে কতই মধুর ভাবনা, কতই মনোহর ছবি চিত্রিত হইতেছিল। তিনি যুবাপুরুষ, তাঁহার কল্পনা এখন খুব প্রবলা—বলবতী কল্পনাবলে তিনি কতই সুখের আশা করিতেছিলেন, মনে মনে কত নন্দনকানন, কত অপ্সরাপুরী, কত কাঞ্চনগিরি গড়িতেছিলেন ও ভাঙ্গিতেছিলেন। হায়, মনুষ্যের সকল আশ কি ফলবতী হয়!

ক্রমে পাড়ি জমিল–তরণী ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে আসিয়া উপস্থিত হইল, দেওয়াজনীয় গান থামিল, সুখ-স্বপ্ন ভাঙ্গিল, তিনি জিজ্ঞাসিলেন, “মাঝী, এটা কোন্ গ্রাম?”

মাঝী। হুজুর, অ্যাহন মোরা বেলুড়ির ট্যাক দ্যা যাইবার লাগচি।

দেও। বালীর খালমুখ এখান হইতে কত দূর?

“কর্তা এহান হতি তিন রশি পথ। হৈ–দেহা যাইবার লাগচে” বলিয়া মাঝী ঝিঁকা মারিয়া, দাঁড়ীদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “ভেলা মোর বাপ্পা—আর দুহাত টেনে, আর দুহাত টেনে।” একজন দাঁড়ী রুষ্টভাবে বলিয়া উঠিল, “হঃ–ভেলা মাঝীগিরী কমার আয়েচেন, আর মোরা কত টান টান্‌মু। দাঁড় টানি টানি পরাণটা খোয়াইমু নাহি?”

“মাঝী। আরে বাপ্পা রাগ করিস্ কেন? এ জায়গাটায় ডর মালুম দেয়। সাধে টানি যাতি কইচি।

এই কথায় হরজীবনের চৈতন্য হইল। তাঁর জপ তপ ঘুরিয়া গেল। একটু কাষ্ঠকাশি কাশিয়া বলিলেন, “হাঁ হে মাঝী, এ কথাটা কেমন হল? এখানে কিছু ভয় আছে নাকি?”

মাঝীকে উত্তর দিবার অবসর না দিয়া গলুয়ের দাঁড়ী বলিয়া উঠিল, “ডর নাই কর্তা মোশাই? এই হান্ডা একবার পার হতি পাল্লি হয়।

দেওয়ান। সে কিরে! আমাদের যে আজ বালীর ঘাটে নৌকা বেঁধে থাকতে হবে।

মাঝী। আরে বাপ্পারে—হুজুর কন কি?

অমনি দুইজন দাঁড়ী বলিয়া উঠিল, “আমাদের হতি সে কাজ হবিনি কর্তা, আপনকার লাগি জান্ খোয়াইমু নাহি?”

দেওয়ান। আরে বলিস্ কি? আমার যে এখানে ভারি প্রয়োজন রয়েছে, আমাকে এখানে নামতেই হবে।

কুমারজী কতক বিরক্তিভাবে, কতক পরিহাসচ্ছলে বলিলেন, “আরে শালা, প্রাণ বড় না স্ত্রী বড়? আজ না হয়, সপ্তমীর দিন সে চাঁদমুখখানি দেখতে পাবে। অত উতলা হয়ে শেষে কি প্রাণটা খোয়াবে?”

দেও। (কিঞ্চিৎ বিরক্তভাবে) তুমি বল কি! আমি যে তাদের পত্র লিখেছি, আমায় যেতেই হবে। মাঝী, নৌকা ভিড়াও।

মাঝী বাবুর আজ্ঞামত নৌকা ভিড়াইয়া বলিল, “হুজুর এহন মোর কথাডা শোল্লা না, শ্যাষে ট্যাডা পাবা।”

নৌকা ক্রমে বালীর ঘাটে ভিড়িল। দেওয়ান “ভীমে আয়”, বলিয়া, নৌকা হইতে তীরে লাফাইয়া পড়িলেন। ভীম-সদার আপনার লাঠি ও বাবুর বাক্সটি লইয়া তাঁহার অনুবর্ত্তী হইল। অন্যান্য সমস্ত দ্রব্যজাত নৌকাতেই রহিল।

দেওয়ানজী তীরে উত্তীর্ণ হইয়া ভগ্নীপতিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “দেখ কুমারজী, তোমাদের যদি এতই ভয় হইয়া থাকে, আজ শ্রীরামপুরে যাইয়া থাক; কল্য প্রাতে আবার এইখানে আসিয়া আমার জন্য অপেক্ষা করিও।”

হ। আমরা যেন আসিব, কিন্তু তোমার দেখা পাইব কি?

দে। কেন? আমার শ্বশুরবাড়ী ত এখান হইতে অধিক দূরে নয়। এখানে আমার দেখা না পাও, সেখানে পাবে। সেইখানেই চল না কেন?

হ। সেখানে আমরা পাঁচ-ছয়জন লোক রাত্রিকালে উপস্থিত হইলে, তোমার বৃদ্ধ শ্বশুর মহাশয় মহা বিব্রত হইয়া পড়িবেন; আর নৌকার এই সব জিনিষপত্র কাহার কাছে রাখিয়া যাইব? আমরা আজ শ্রীরামপুরেই গিয়া থাকিব। এখন তুমি এস, মা দুর্গা, তোমায় রক্ষা করুন।

“কর্তা মোরা আর দ্যার করতি পারি না,” বলিয়া মাঝী নৌকা ঠেলিয়া দিল। দেখিতে দেখিতে নৌকাখানি মাঝ-গঙ্গায় উপস্থিত হইল এবং পূর্ব্বের মত মৃদুমন্দ গতিতে চলিতে লাগিল। দাঁড়ীরা প্রাণপণে বাহিয়া যাইতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *