ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – পূজাবাটী

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – পূজাবাটী

ভোর হইয়াছে, এখনও অল্প ঘোর ঘোর রহিয়াছে, চারিদিকে ঢাক ঢোল বাজিতেছে, কাক কোকিল ডাকিতেছে এবং নহবৎখানায় হলা রসুনচৌকিওয়ালা মঙ্গল-বিভাস আলাপ করিতেছে, এমন সময়ে “হরিবোল”

“হরিবোল” বলিয়া প্রখ্যাতনামা পুণ্যশ্লোক রাঘব সেন গাত্রোত্থান করিলেন। তিনি ত্রিতলোপরি এক নিভৃত গৃহে শয়ন করিয়াছিলেন, শয্যা পরিত্যাগ করিয়া কিয়ৎক্ষণ প্রকাণ্ড পুরীর প্রসারিত ছাদে ইতস্ততঃ বিচরণ করিয়া দ্বিতলে অবতরণ করিলেন; দেখিলেন, প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে—গৃহে গৃহে প্রদীপ জ্বলিতেছে, বালক-বালিকাগণ আনন্দে কোলাহল করিতেছে, এবং পুরবাসিনী, কুটুম্বিনী ও দাস-দাসীগণ নানা কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছে।

তিনি যেদিক চাহেন, সেইদিকেই যেন আনন্দ-লহরী প্রবাহিত হইতেছে—আনন্দময়ীর শুভাগমনে আজি বঙ্গদেশ মহানন্দে প্লাবিত হইয়াছে—মহানন্দে সেন মহাশয় বহির্বাটীতে আসিলেন। প্রকাণ্ড উঠান—প্রকাণ্ড দালান—দালানে দশভূজামূর্ত্তি বিরাজমান। প্রতিমার দুই পার্শ্বে শতশাখাবিশিষ্ট দুইটি প্রকাণ্ড দীপদ্রুম প্রজ্জ্বলিত রহিয়াছে। বিশ্বজননীর আনন্দময়ী মূর্ত্তি উজ্জ্বল দীপালোকে -স্বর্গীয় শোভা ধারণ করিয়াছে, সে শোভা দেখিয়া কে না বলিবে, জননী যথার্থই স্বর্গশূন্য করিয়া মর্ত্তে অবতীর্ণ হইয়াছেন? সে মূর্তি দেখিয়া রাঘব সেন শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি পুলকিত মনে বিশ্বমাতার পদপ্রান্তে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া দালান হইতে উঠানে নামিলেন, বিচিত্ৰ চন্দ্রাতপাচ্ছাদিত সুসজ্জিত পুরীর মনোহর শোভা দেখিতে দেখিতে বহির্বাটীর প্রাঙ্গণে আগমন করিলেন। নয়নরঞ্জন দূর্বাদলাবৃত পরম-রমণীয় প্রসারিত প্রাঙ্গণ—স্থানে স্থানে বিচিত্র কুসুমকানন, স্থানে স্থানে এক-একটি নিভৃত সুদর্শন বনস্পতি বিরাজিত রহিয়াছে।

রাঘব সেন যথেচ্ছা বিচরণ করিতে করিতে একটি প্রস্তররচিত বেদীর নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন; দেখিলেন, বেদীর উপরে তাঁহার প্রিয়পাত্র রতন শর্ম্মা নিশ্চল, নির্নিমেষ ও নিশ্চেষ্টভাবে উপবিষ্ট রহিয়াছে; ভাবিলেন, “আ ম’লো! রত্নার আবার কি হইয়াছে, রত্না ওখানে অমন করিয়া বসিয়া কেন?”

আহা! রত্নার আজি যাহা হইয়াছে, অন্যে তাহা কি বুঝিবে? রত্না আজি যেন সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের যুগান্তর দেখিতেছে—তাহার নয়নে আজি সকলই নিরানন্দময়, সকলই বিষময়, সকলই বিভীষিকাময় বোধ হইতেছে—প্রভাতের মঙ্গলবাদ্য অদ্য তাহার হৃদয়ে যেন গরল বর্ষণ করিতেছে, প্রভাতের শীতল সমীরণ তাহার শরীরে যেন সর্প-দংশন বোধ হইতেছে। সে ভাবিতেছে, “কেন এমন দুষ্কর্ম্ম করিলাম, কেন কজ্জলাকে হত্যা করিলাম? যাহাকে দেখিলে আমার সমস্ত দুঃখ, সমস্ত যন্ত্রণার অবসান হইত, আমি স্বহস্তে তাহাকে বধ করিলাম! ভীরুর ন্যায়, কাপুরুষের ন্যায় তাহাকে বধ করিলাম! তাহার মুখপানে চাহিয়া মুগ্ধ হইয়া তাহার কোমলাঙ্গে অস্ত্রাঘাত করিতে পারিলাম না।” আহা! তখন স্থানান্তরে গেলাম না কেন? তাহাকে শূকরীর ন্যায় দগ্ধ করিয়া মারিলাম! চণ্ডালেও যে কাজ করে না, আমি ব্রাহ্মণের সন্তান হইয়া, সেই মহাপাতক করিলাম! এখন মৃত্যু বই আর উপায় নাই—এ যন্ত্রণার শান্তি নাই, কিন্তু মরিলেও ত নিস্তার নাই, ‘জাতস্যহি ধ্রুবো মৃত্যু ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ,’ পুনর্ব্বার ত জন্ম হইবে, জন্মিলেই ও কর্ম্মফল ভোগ করিতে হইবে—কৰ্ম্মফল ভোগ করিতে পারিব, কুষ্টব্যাধিগ্রস্ত হইয়া, পথে পথে ভিক্ষা করিয়া দারুণ যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করিতে পারিব, কিন্তু হৃদয়ের এ অরুন্তুদ যন্ত্রণা আর আমার সহ্য হয় না— তুষানলে দগ্ধ হওয়াও আমার পক্ষে অধিক যন্ত্রণাদায়ক নহে। আয়, কলা আয়, তুই স্বহস্তে আমার এই পাপদেহ তুষানলে দগ্ধ কর—হায়! তাহা যদি সম্ভব হইত, তবেই কেবল আমার এই মর্মান্তিক জ্বালার কথঞ্চিৎ প্রায়শ্চিত্ত হইতে পারিত। হায়, আমার পাপের কি প্রায়শ্চিত্ত আছে! আমি আযৌবন যে সমস্ত দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি, সে সকল পাপপুঞ্জের কি প্রায়শ্চিত্ত আছে! কুক্ষণে রাঘব সেনের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল—রাঘবই. আমার এই নিদারুণ যন্ত্রণার একমাত্র কারণ।”

রাঘব। কিরে রতন, এখানে অমন করে বসে রয়েছিস যে, কি হয়েছে?

রতন। সরে যা, আমার সামনে থেকে সরে যা, আমি রাগ বরদাস্ত করতে পারব না—তুই সরে যা, এখনই সরে যা।

রাঘব। আরে, হয়েছে কি বল না।

“তুই ত আমার সর্ব্বনাশ করেছিস। পাজি, আয় আজ তোর রক্তে হোম করব, তোকে বধ করে আমার পাপ-যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দিব,” বলিয়া ভয়ঙ্কর হুঙ্কার করিয়া রত্নাপাখী সিংহের ন্যায় লম্ফ প্রদানে রাঘব সেনের গ্রীবা ধারণ করিল। রাঘব তৎক্ষণাৎ তাহাকে সামান্য কীটের ন্যায় ভূমে নিক্ষেপ করিয়া তাহার বক্ষস্থলে চাপিয়া বসিলেন; বলিলেন, “বানা, আমার গায়ে হাত তুলিস, তোর এত বড় স্পর্দ্ধা?”

রতন। রাঘব, তোর পায়ে পড়ি, তুই আমায় খুন কর, এ দারুণ যন্ত্রণা থেকে আমায় নিস্তার কর।

রাঘব। পাজি, আমি ব্রহ্মহত্যা করব?

রতন। তোর জন্য যে আমি স্ত্রী হত্যা করিলাম, যাহার মুখ দেখিলে হৃদয় শীতল হইত, তাহাকে আমি যে স্বহস্তে শূকরীর ন্যায় পুড়াইয়া মারিলাম।

এই সময়ে একজন অশ্বারোহী তীরবেগে উদ্যানমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। রাঘব সেন রত্নাকে ছাড়িয়া দিলেন—রত্না উঠিয়া পুনর্ব্বার বেদীতে বসিল। অশ্বারোহী রাঘব সেনের সমীপাগত হইয়া অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন। রাঘব সেন বলিলেন, “কি দারোগা সাহেব, খবর কি?”

দারোগা। হুজুর, খবর বড় ভাল নয়, ধর্ম্মা যুগী ধরা পড়েছে।

রাঘব। কোথায়?

দারোগা। কাল রাত্রি দশটার সময় দেওয়ান গোবিন্দরাম তাকে আমার থানায় দিয়ে গেছে।

রতন। দেওয়ান গোবিন্দরাম?

দারোগা। আজ্ঞা হাঁ।

রতন। এইবার মাছি মাকড়সার জালে পড়িল।

রাঘব। মাছি কেরে, অ্যাঁ?

রতন। মাছি গোবিন্দরাম; মাকড়সা রাঘব

রাঘব। তবে যা দেখি, বেশ করে একখানা আজি লিখে নিয়ে আয় দেখি, আজ আমি বড় ব্যস্ত আছি—কেবল সহি করে দিব এখন। দারোগা সাহেব, তুমি এখন যাও, আমি এখনই একজন লোক পাঠাচ্ছি।

· দারোগা ফতেউল্লা প্রস্থান করিল। পুরীমধ্যে ঢাক ঢোল বাজিয়া উঠিল, রাঘব সেন, রত্নাকে দপ্তরখানায় যাইতে বলিয়া মহা সমারোহে নবপত্রিকা স্নান করাইবার নিমিত্ত গঙ্গাতীরের দিকে চলিলেন। রত্না কিন্তু দপ্তরখানায় গেল না, সে সেই স্থানে গুম্ হইয়া বসিয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *