সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ – উপবনে

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ – উপবনে

গোবিন্দরামকে গ্রেপ্তার করিয়া গঙ্গাপুরে আনা হইয়াছে। রাঘব সেনের প্রকাণ্ড পুরীর সম্মুখে বিস্তৃত তৃণ-প্রাঙ্গণে কলিকাতা ও হুগলীর ফৌজদারদ্বয়ের পটমণ্ডপ সন্নিবেশিত হইয়াছে। পট- মণ্ডপের চারিদিকে চারিজন বলবান বরকন্দাজ বন্দুকে সঙ্গিণ চড়াইয়া পাহারা দিতেছে। জনরব— কল্য গোবিন্দরামের ফাঁসী হইবে, সে রাঘব সেনের লোককে খুন করিয়াছে, রাঘব সেনের কিস্তি লুঠ করিয়াছে—তাঁহার কি আর নিস্তার আছে? কল্য বিজয়া দশমীর দিনেই তাঁহার ফাঁসী হইবে। পুরীর অভ্যন্তরে প্রসিদ্ধ থর-কাটা প্রেমচাদের কীর্ত্তন হইতেছে, মহা-সমারোহ, অসংখ্য লোকের সমাগম হইয়াছে, আর স্থান হইতেছে না। সেই লোক-সঙ্কুল পূজাবাটী হইতে দুইজন ভদ্রলোক বহির্গত হইয়া উপবনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ইঁহাদিগের মধ্যে একজন কলিকাতার ফৌজদার বিশ্বনাথ ঘোষ ও অপর ব্যক্তি হুগলীর ফৌজদার জগন্নাথ বক্সী, ইঁহারা কীৰ্ত্তন শুনিতেছিলেন, অসাধারণ জনতা নিবন্ধন ক্লেশ বোধ হওয়ায় বিশুদ্ধ বায়ু সেবনার্থে উদ্যানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

তখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর। নবমীর চন্দ্র পশ্চিমাকাশে ঢলিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু এখনও তাহার মনোহর রজতকিরণে বসুধা অলঙ্কৃত হইয়া রহিয়াছে—তরুশিরে জ্যোৎস্না, পুষ্পবনে জ্যোৎস্না, তৃণভূমে জ্যোৎস্না, চারিদিকে জ্যোৎস্না ধব্ ধব্ করিতেছে। ফৌজদারদ্বয় আরামাভ্যন্তরে কিয়দ্দূর গমন করিয়াছেন, এমন সময় শুভ্রবাসা অবগুণ্ঠনবতী এক রমণী-মূর্ত্তি তড়িদ্বেগে তাঁহাদের পার্শ্বদেশ দিয়া চলিয়া গেল, তাঁহারা শিহরিয়া উঠিলেন ও স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন! সেই রমণী-মূৰ্ত্তি কিঞ্চিদ্দূরে একটি ঝাবুক বৃক্ষের কাণ্ডে পৃষ্ঠদেশ সংলগ্ন করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল এবং এক-একবার দক্ষিণ হস্ত সঞ্চালন করিতে লাগিল।

জগন্নাথ বসী বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “ওহে ঘোষজা—এ আবার কি বিভীষিকা?”

বিশ্বনাথ। বোধ হয়, উন্মাদিনী।

জগন্নাথ। এত রাত্রে, এমন স্থানে উন্মাদিনী?

বিশ্ব। আপনি তবে কি অনুমান করেন?

জগ। আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।

বিশ্ব। সংশয় রাখিবার প্রয়োজন কি? আসুন, গিয়া দেখি বোধ হয়, হাত নাড়িয়া স্ত্রীলোকটি আমাদিগকে ডাকিতেছে।

জগ। ডাকিতেছে, না ভয় দেখাইতেছে?

বিশ্ব। স্ত্রীলোকের নিকট ভয়ের সম্ভাবনা কি? আপনি আসুন।

জগ। ও যে স্ত্রীলোক, তাহা তুমি কেমন করিয়া জানিলে?

বিশ্ব। স্ত্রীলোক না হয়, পুরুষই হইল, তাহাতেই বা কি?

জগ। আর যদি উপদেবতা হয়?

বিশ্ব। হইলই বা, যাহা কখন দেখি নাই, তাহা আজ ভাল করিয়া দেখিব, আপনি আমার পিছনে পিছনে আসুন।

এই বলিয়া বিশ্বনাথ ঘোষ অগ্রসর হইলেন, বক্‌সী মহাশয় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন, কতই ভাবিতে লাগিলেন, ভীত হইতে লাগিলেন এবং মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “এ গোঁয়ারটার সঙ্গে আসিয়া ভাল করি নাই, ও কখনই রমণী নয়, নিশ্চয়ই প্রেতিনী, নিকটে গেলে হয়ত খল খল্‌ করিয়া হাসিয়া বিকটাকার ধারণ করিবে, কি ঘটিবে—কে জানে? এখন যদি কোন একটা ওজর করিয়া সরিয়া পড়ি, বিশ্বনাথ আমায় ভীরু মনে করিবে, লোকের কাছে এই কথা গল্প করিয়া কতই আমার উপহাস করিবে।” এইরূপ, ভাবিতে ভাবিতে জগন্নাথ অগত্যা বিশ্বনাথের অনুবর্ত্তী হইলেন।

বিশ্বনাথ সেই রমণী-মূর্ত্তির সমীপাগত হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, “কে তুমি?”

রমণী উত্তর করিল, “আমি যেই হই না কেন, সে খোঁজে তোমার কাজ কি?”

বিশ্ব। এত রাত্রে তুমি এই নিৰ্জ্জন স্থানে কি জন্য দাঁড়াইয়া আছ, জানিতে চাই।

রমণী। তবে আমার সঙ্গে এস।

বিশ্ব। কোথায় যাইতে হইবে?

রমণী। যেখানে লইয়া যাইব।

বিশ্ব। কি মুস্কিল! তুমি যদি আমাদিগকে যমালয়ে লইয়া যাইতে চাও—সেখানেও কি আমরা যাইব?

রমণী হা হা করিয়া হাসিয়া বলিল, “যদি তোমাদের যমালয়ে যাইবার সময় হইয়া থাকে, কে তোমাদিগকে রক্ষা করিতে পারিবে? তোমরা না পুরুষ মানুষ, মরবার এত ভয় কেন?“

বিশ্বনাথ ঘোষ কিছু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “চল, কোথা যাইতে হইবে চল।”

রমণী-মূর্ত্তি অগ্রে অগ্রে চলিল, বিশ্বনাথ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাহার অনুসরণ করিতে লাগিলেন।

বক্‌সী মহাশয় মনে মনে বলিলেন, “যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিল—বিশ্বনাথ প্রেতিনী কর্তৃক প্রলোভিত ও সংজ্ঞাচ্যুত হইয়া তাহার অনুবর্ত্তী হইল, আমি ডাকিলেও ত সে আর শুনিবে না, সে আর ফিরিবে না, আর এখন যদি তাহাকে ডাকি, প্রেতিনী হয় তৃ ক্রুদ্ধ হইয়া আমারও অনিষ্ট করিবে।”

এইরূপ ভাবিয়া জগন্নাথ বক্সী ভয়-বিকম্পিত হৃদয়ে রাম নাম স্মরণ করিতে করিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

যখন তিনি নিজ যবনিকা-দ্বারে আসিয়া উপনীত হইলেন, তখন গগনতল ঘোর ঘনঘটায় আচ্ছন্ন হইয়াছে; আকাশের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিকশিত হইতেছে এবং সমস্ত জগৎ নিশ্চলভাবে অবস্থান করিতেছে। দেখিতে দেখিতে তড়ু তড্ করিয়া বৃষ্টি আসিল, কড় কড় করিয়া মেঘ ডাকিল, হুঙ্কার করিয়া বায়ু ছুটিল, নিমেষ মধ্যে যেন ভয়াবহ দানবাহব আরম্ভ হইল, প্রকৃতি ভয়ঙ্করী মূর্তি ধারণ করিল।

এই সময়ে রাঘবের অন্তঃপুরে কে যেন একবার কাতরস্বরে কাঁদিয়া উঠিল, তৎপরেই পূজা বাড়ীতে কোলাহল আরম্ভ হইল, কীৰ্ত্তন ভাঙ্গিয়া গেল; অসংখ্য লোকের জনতা চারিদিকে বিকীর্ণ হইতে লাগিল। ক্ষণকাল মধ্যেই সে লোক-কোলাহল থামিয়া গেল, কিন্তু প্রাকৃতিক কোলাহল সে রাত্রিতে আর থামিল না, বক্সী মহাশয় নিদ্রাদেবীর শরণাপন্ন হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *