ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ – রাঘবের উদ্যান

ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ – রাঘবের উদ্যান

খুব ভোরে উঠিয়া প্রাতঃকৃত্য সমাপনানন্তর বৃদ্ধ জগন্নাথ বক্সী ছোট-খাট একটি কুচকুচে কাল কলি-হুঁকায় তামাকু খাইতে খাইতে বিশ্বনাথ ঘোষের তাম্বুতে আসিলেন; সেখানে একজন চাপরাসীকে জিজ্ঞাসিলেন, “ফৌজদার কোথা?”

চাপরাসী উত্তর করিল, “তিনি এখনও উঠেন নাই।”

জগন্নাথ। তিনি কাল কত রাত্রে ফিরে এলেন?

চাপরাসী। তখন রাত্রি তিনটা হবে।

এই সময় বিশ্বনাথ ঘোষ তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং বক্সী মহাশয়কে একখানি চৌকীতে বসাইয়া আপনি অপর একখানি চৌকীতে বসিলেন। একজন ভৃত্য বক্সী মহাশয়ের হস্ত হইতে তাঁহার সখের হুঁকাটি গ্রহণ করিয়া ধূমিত আলবোলা আনিয়া সম্মুখে রাখিয়া গেল।

বিশ্বনাথ। আপনি ত খুব ভোরে উঠিয়াছেন?

জগন্নাথ। ভাই হে, তোমার সম্বন্ধে বড়ই দুর্ভাবনা হইয়াছিল, তাই প্রভাত হইবামাত্র তোমার সংবাদ লইতে আসিলাম। তুমি সে প্রেতিনীর হাত হইতে মুক্ত হইলে কিরূপে?

বিশ্বনাথ ঈষদ্ধাস্যসহকারে উত্তর করিলেন, “সে প্রেতিনীও নয়, পাগলিনীও নয়, সে এক বিচিত্র প্রতিভাশালিনী রমণী; সে যাহা দেখাইল, আর কখনও তাহা দেখি নাই; সে যাহা শুনাইল, আর কখনও তাহা শুনি নাই।”

জগ। সে তোমায় কোথায় লইয়া গিয়াছিল?

বিশ্ব। নরকে—মনুষ্যের কল্পনায় যাহা আসে না—সেখানে তাহা স্বচক্ষে দেখিলাম।

জগ। তুমি পরিহাস করিতেছ?

বিশ্ব। আজ্ঞা না, আমি আপনাকে স্বরূপ কথা বলিতেছি।

এই সময়ে রাঘব সেন তথায় আসিয়া বলিল, “এই যে বক্‌সী মহাশয়ও এখানে, আপনারা ত খুব প্রত্যূষে উঠিয়াছেন।”

বিশ্বনাথ ঘোষ সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক তাঁহার অভিবাদন ও বসিবার নিমিত্ত আসন প্রদান করিলেন।

রাঘব সেন বলিল, “না, এখন বসিব না, এখনই গিয়া নিরঞ্জনের উদ্যোগ করিতে হইবে। প্রতিমা-বিসর্জ্জন করিয়া বেলা নয়টার মধ্যে পুনর্ব্বার আসিয়া আপনাদের সহিত সাক্ষাৎ করিব, দেওয়ানের এই নোংরা বিষয়টা যত শীঘ্র চুকিয়া যায়, ততই ভাল।”

এই বলিয়া রাঘব সেন একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বিশ্বনাথের মুখের দিকে চাহিল, এবং যেমন দেখিল, বিশ্বনাথও তাহার পানে চাহিয়া আছেন; অমনি বলিল, “দেওয়ানজী আপনার আত্মীয়, তাহা আমি পূৰ্ব্বে জানিতাম না।”

বিশ্ব। হাঁ, গোবিন্দরাম আমার একজন জ্ঞাতির জামাতা; কিন্তু ইতিপূর্ব্বে কখনও তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই, আমি তাঁহার নাম শুনিয়াছিলাম মাত্র, আর জানিতাম, তিনি ইংরাজের একজন সম্ভ্রান্ত কৰ্ম্মচারী।

রাঘব। যাহা হউক, বড়ই দুঃখের বিষয় যে, তিনি এত বড় লোক হইয়া এরূপ ঘৃণিত-কাৰ্য্যে লিপ্ত হইলেন!

বিশ্ব। দুঃখের বিষয় বৈ কি! আমি ত এখনও বুঝিতে পারিতেছি না, যে তিনি কেন এমন কাৰ্য্য করিলেন? তাঁর অপরাধ কতদূর সপ্রমাণ হয়, দেখিবার জন্যই আমার এখানে আসা; আপনি নিশ্চয় জানিবেন, যদি তিনি যথার্থই অপরাধী হন, আত্মীয় বলিয়া তাঁহার পক্ষ আমি কখনই অবলম্বন করিব না। আমি বরং প্রাণপণে বক্সী মহাশয়ের সহায়তা করিব—যাহাতে ওঁর রায় বজায় থাকে, তাহার চেষ্টা করিব। দেওয়ান ইংরাজের একজন প্রধান কর্ম্মচারী, কলিকাতার বড় আদালত ভিন্ন অন্যত্রে তাঁহার চূড়ান্ত বিচার হইবে না।

জগ। আমি তোমার সামনে এই বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করিয়া যে মন্তব্য লিখিব, তুমিও তাহাতে একটা স্বাক্ষর করিলে আমার যথেষ্ট সহায়তা করা হইবে।

বিশ্ব। আমার কর্ত্তব্যের ত্রুটি হইবে না।

রাঘব। এ মামলা এইখানে আপনাদের নিকট চুকিয়া গেলেই ভাল হয়, দেওয়ানকে বিপদগ্রস্ত করা আমার ইচ্ছা নয়।

জগ। আহা! ভগবান এমন লোককেও এরূপ মনোকষ্ট দিলেন! যাঁহার নাম করিলে সুপ্রভাত হয়, তাঁহার বংশলোপ হইল, একি সামান্য পরিতাপের বিষয়!

রাঘব। যখন চন্দ্রবংশ, সূর্য্যবংশও লোপ হইয়াছে, যখন রাবণের বিপুল বংশ ও যাদবের যদুবংশও লোপ হইয়াছে, তখন বংশ লোপ হইল বলিয়া দুঃখ করিব কেন? এখন আসুন, বাসায় যাইবেন কি?

“আজ্ঞা হাঁ চলুন,” বলিয়া হুগলীর ফৌজদার, রাঘব সেনের সহিত প্রস্থান করিলেন।

বিশ্ব। চাপরাসী!

চাপরাসী। হুজুর।

বিশ্বনাথ। তুমি এখনই কলিকাতায় যাও, এখনও ভাঁটা আছে, নৌকায় যাইও, এই পত্রখানি হাবিলদারকে দিও, আমি তাহাকে কয়েকজন সিপাহী সঙ্গে লইয়া এখানে আসিতে লিখিলাম। তুমিও তাহাদের সহিত ফিরিয়া আসিও। যাও, আর বিলম্ব করিও না—বেলা দশটার মধ্যে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইতে চাও।

চাপরাসী “যে আজ্ঞা” বলিয়া প্রস্থান করিল। বিশ্বনাথ ঘোষ নিজ পটমণ্ডপের সম্মুখস্থ তৃণাস্তৃত বিস্তৃত প্রাঙ্গণে অবতীর্ণ হইয়া রক্তবর্ণ কঙ্করমণ্ডিত একটি পরিষ্কৃত সরল পন্থায় গম্ভীরভাবে বিচরণ করিতে লাগিলেন।

এই সময়ে হলধর ঘোষ যবনিকার বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; তৎক্ষণাৎ একজন প্রহরী তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়া “কাঁহা যাতে হো,” বলিয়া তাঁহার হস্ত ধারণ করিল।

হলধর। বিশ্বনাথ, ওহে ও বিশ্বনাথ, আমিও কয়েদী নাকি?

বিশ্বনাথ ঘোষ সহাস্যবদনে উত্তর করিলেন, “সম্প্রতি বটে, আপনি এখন ভিতরে যান।”

হলধর ঘোষ ক্রোধে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “কি—আমি কয়েদী, অ্যাঁ আমি কয়েদী? তুই আমার এই বৃদ্ধবয়সে নিরপরাধে যেমন আমায় এই মনঃকষ্ট দিলি, তেমনি মনঃকষ্টে যেন তোর মৃত্যু হয়, আর তোর বংশে বাতি দিতে যেন কেউ না থাকে।”

বিশ্বনাথ অবিচলিতভাবে দৃঢ়স্বরে উত্তর করিলেন, “দাদা মহাশয়, আমার কার্য্য আমি অবশ্য করিব—আপনি গালি দিলেও কর্তব্যে বিরত হইব না। এখন আপনি আপনার কামরায় যান।”

হলধর ঘোষ অধিকতর অবমাননার আশঙ্কায় অগত্যা পটমণ্ডপে পুনঃ প্রবেশ করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *