চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – পাতালপুরী

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – পাতালপুরী

রাঘব সেন যখন নবপত্রিকা স্নান করাইয়া ফিরিয়া আসিলেন, তখন বেলা এক প্রহর হইয়াছে। তখনও রতন শর্ম্মা সেই স্থানে সেই ভাবে বসিয়া আছে। রাঘব সেন ভাবিলেন, রত্নার ভাব বড় ভাল নয়, এই সময়ে উহাকে আয়ত্ত করিয়া না রাখিলে, পরে বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা। এইরূপ চিন্তা করিয়া তিনি রত্নার নিকট গিয়া তাহার হস্ত ধরিয়া বলিলেন, “কি করছিস রতন, আয়, উঠে আয়, তোর সঙ্গে বিরলে অনেক কথা আছে।”

রত্না নীরবে তাঁহার অনুসরণ করিল। রাঘব সেন তাহাকে সঙ্গে লইয়া, পূৰ্ব্ববর্ণিত পাতালপুরে প্রবেশ করিয়া তাহার গাত্রে হস্তার্পণপুর্ব্বক স্নেহাভিষিক্ত রচনে বলিলেন, “আচ্ছা রতন, তুই ছেলেবেলায় যাঁদের আপনার ব’লে জানতিস, যাঁরা তোকে আদর করতেন, স্নেহ করতেন, এখন তাঁরা কোথায়? তাঁদের আর তোর মনে পড়ে? তুই যখন বিদ্যানিধির টোলে পড়তিস, তখন তোর সমবয়স্ক, সমপাঠী কত বালকের সহিত তোর বন্ধুত্ব ছিল, এখন তারা সব কোথা? তাদের আর স্মরণ হয়? পূর্ব্বে তুইও আমায় চিনতিস না, আমিও তোকে চিনতেম না, কিন্তু এই দ্বাদশ বৎসর মধ্যে তোতে আমাতে এরূপ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ হয়ে পড়েছে যে, বোধ হয়, পিতা পুত্রেও এতাদৃশ আত্মীয়তা হয় না। কিন্তু সময়ে আমার সঙ্গেও তোর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হবে, সময়ে আমায়ও তুই ভুলে যাবি; তখন আবার অপরের সহিত তোর সম্বন্ধ সংঘটিত হ’বে, তাকেই তুই আত্মীয় বলে জানবি—সংসারের নিয়মই এই—আমিত্ব থাকিতে আত্মীয়ের অভাব হয় না। জোঁক যেমন একটা কুটা ছেড়ে আর একটা কুটা ধরে, মনুষ্য হৃদয়ও সেইরূপ একটি প্রিয়পদার্থে বঞ্চিত হ’লে অপর একটি পাত্র অবলম্বন করে। অতএব কজ্জলার জন্য তুই এত ক্ষতি বোধ করছিস কেন? কজ্জল তোর কে? তা’র সঙ্গে তোর সম্পর্ক কি? টাকা থাকলে, সুন্দরীর অভাব কি? যুবতীর অভাব কি? টাকায় না পাওয়া যায়, এমন কি সামগ্রী আছে? অনর্থক শোক করে কি হবে? যাতে টাকা হয়, তার চেষ্টা কর; অর্থেই সুখ।

রত্না। তুই পিশাচ, তুই পশু, আমার দুঃখ তুই কি বুঝবি? টাকায় সুখ থাকলে আমি সুখী হতেম। টাকায় আমি এক দিনের তরেও সুখী হই নাই, টাকায় আমি সুখী হব না, টাকা আমি চাই না। আমি কেবল সেই কজ্জলাকে চাই; তার সেই মুখখানি অন্ততঃ আর একবার প্রাণভরে দেখতে চাই—আর কিছুই আমি চাই না। সংসারে আমার কোনই আকর্ষণ নাই—এ অসহ্য জীবন-ভার বহন করতে আমি আর চাই না।

রাঘব সেন বলিলেন, “রতন তুই নিতান্ত নির্ব্বোধের মত কথা কচ্ছিস। শোকের তীব্রতা কি চিরদিন থাকে? নিশ্চয় জানিস সংসারে কোন দুঃখই চিরস্থায়ী হয় না, দুঃখ কিছুই না—কেবল সুখসূর্য্যের মেঘাবরণ মাত্র। জ্ঞানিগণ বিবেকবায়ু দ্বারা সে আবরণ সর্ব্বদা অপসৃত করেন। তুই বুদ্ধিমান হয়ে এ প্রকার শোকাভিভূত হচ্ছিস কেন? এ জগতে কেহ কাহারও নয়। যে ক’দিন বেঁচে থাকবি, সুখে থাকবার চেষ্টা কর—আর তোর ত স্ত্রী আছে, তাকে এনে কাছে রাখ—সে এখন যুবতী হয়েছে; এখন বোধ হয়, তাকে তোর মনে ধরতে পারে।”

এই বলিয়া রাঘব সেন রত্নাকে পাতালপুরে রাখিয়া দপ্তরখানায় চলিয়া গেলেন। সেখানে গিয়া ফতেউল্লা দারোগাকে একখানি পত্র লিখিয়া পাঠাইলেন। পত্র পাইয়া দারোগা সাহেব তৎক্ষণাৎ লোক-লস্কর সঙ্গে লইয়া রত্নপুরে যাইয়া গোবিন্দরামের বাটী ঘেরাও করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *