নবম পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী

নবম পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী

গোবিন্দরাম, রত্নপুর গ্রামে নিজালয়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। তাঁহার বাড়ী রাঘব সেনের অট্টালিকার ন্যায় বৃহৎ নহে, এবং অত জাঁকজমক-সম্পন্নও নহে; কিন্তু নিতান্ত সামান্যও নহে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুরুচিপরিচায়ক। বাড়ীর সম্মুখে সরকারী রাস্তা, রাস্তার অপরদিকে উদ্যান ও পুষ্করিণী। অন্দরমহলে দ্বিতলে, নূতন চুণ-কাম-করা একখানি ধপধপে প্রশস্ত গৃহ, গৃহের সম্মুখে খোলা ছাদ। এই গৃহটি দেওয়ানের শয়ন-মন্দির। গৃহের একদিকে একটি সামাদানে বাতী জ্বলিতেছিল। বর্তিকার উজ্জ্বল আলোকে গৃহস্থিত ধাতুনির্ম্মিত পরিষ্কৃত তৈজসরাজি অপূৰ্ব্ব চাকচিক্য ও শোভা-সম্পন্ন হইয়াছিল এবং দক্ষিণদিকে জানালার কাছে একখানি মনোহর পালঙ্কে বিনোদিনী নিদ্রা যাইতেছিলেন। বর্ত্তিকালোক তাঁহার মনোহর দেহে পতিত হওয়ায় বোধ হইতেছিল, কে যেন পর্য্যঙ্কে একরাশি গোলাপফুল ঢালিয়া রাখিয়াছে, অপরিমেয় রূপরাশি— আপ্সরসিক-সৌন্দর্য্য—সেরূপ সৌন্দর্য্য মানবে দুর্লভ। সুন্দরী স্বামীর আগমন প্রতিক্ষা করিয়া অনেকক্ষণ জাগিয়াছিলেন, কিন্তু পূর্ব্বরাত্রির জাগরণ ও ক্লেশজন্য তাঁহার শরীর অবসন্ন হইয়া আসিলে তিনি ঘুমাইয়া পড়িলেন। ক্ষণকাল পরে গৃহদ্বার উন্মুক্ত হইল, দেওয়ান গোবিন্দরাম গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই পর্য্যঙ্কের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং স্নেহ-বিকশিত-নয়নে প্ৰাণ- প্রতিমার মুখ-কমল ও অসামান্য লাবণ্যময়ী দেহলতা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন—নয়ন ভরিয়া, হৃদয় ভরিয়া, প্রাণ ভরিয়া–সেই লাবণ্যসুধা পান করিতে লাগিলেন।

তিনি এতাবৎকাল যে বিষয়ের চিন্তা করিতেছিলেন, গৃহে পদার্পণ করিবামাত্র তাঁহার সে চিন্তা তিরোহিত হইল। এখন স্নেহ, প্রেম, করুণা প্রভৃতি কোমল ভাবে তাঁহার হৃদয় বিগলিত হইতে লাগিল। তিনি মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “আহা! এমন কোমল অঙ্গে আঘাত করিতে পাষণ্ডের হস্ত-স্তম্ভিত হইল না। আহা! বিনোদিনী, সেই দস্যুর বিকট আকার দেখিয়া না জানি, কতই ভয় পাইয়াছিলে? তাহাদের অত্যাচারে কতই ব্যথিত হইয়াছিলে? আহা! এই নব-বিকশিত কমলদলের ন্যায় বিমল কপোল বহিয়া অবিশ্রান্ত কতই রুধির ধারা প্রবাহিত হইয়াছিল। “উঃ—অসহ্য! দেখিব, কেমন সেই রাঘব সেন! হউক— তাহার অতুল ঐশ্বর্য্য, হউক— তাহার বিপুল প্রতাপ, হউক— তাহার প্রবল সহায় ও দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠা। যদি সৰ্ব্বস্বান্ত হইতে হয়, যদি প্রাণান্তও হইতে হয়, তাহাও স্বীকার, সেই পিশাচ রাঘব সেনকে একবার দেখিব। সেই দুরাচারের অত্যাচারে কত দুগ্ধপোষ্য বালক পিতৃহীন, কত বৃদ্ধ পিতা মাতা পুত্রহীন, কত অবলাবালা পতিহীন হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। রাঘব, তুই কত লোককে পথের ভিখারী করিয়াছিস, তাহার সংখ্যা নাই— তোর পাপের প্রায়শ্চিত্ত নাই। নরাধম কোন্ ধৰ্ম্মশাস্ত্রে দেখিয়াছিস, কাহার মুখে শুনিয়াছিস যে, দস্যুবৃত্তি দ্বারা অর্থোপার্জ্জন করিয়া দান-বিতরণে ধর্ম্মসঞ্চয় হয়? ধিক্ তোর ধর্ম্ম-কর্ম্মে—ধিক্ তোর প্রবৃত্তিতে। রাঘব সেন, তুই নররূপী রাক্ষস!”

ক্রমে সেই চিন্তা দেওয়ানের মনোমধ্যে প্রবল হইয়া উঠিল। হৃদয়ের কোমল ভাব সকল অন্তর্হিত হইল। কি উপায়ে রাঘব সেনের পতন হইবে, কি উপায়ে তাহার ঘোর অত্যাচার হইতে দেশের মুক্তি সাধন হইবে, মনে মনে তাহারই আন্দোলন করিতে লাগিলেন। রাত্রি অধিক হইয়াছে, জগৎ নিস্তব্ধ, সকলেই নিদ্রিত, কিন্তু গোবিন্দরামের নিদ্রা নাই। যদিও তিনি পূর্ব্বরাত্রে একবারও চক্ষু মুদ্রিত করেন নাই, ক্ষণকালের জন্যও বিশ্রাম নাই। তথাপি তাঁহার আলস্য নাই, দেশের দস্যুভয় কি উপায়ে নিবারিত হইবে, তাহাই তাঁহার একমাত্র ধ্যান হইয়াছিল।

গোবিন্দরাম ঘোর চিন্তায় নিমগ্ন আছেন, এমন সময়ে অকস্মাৎ সেইস্থান চম্পক ও চন্দন গন্ধে আমোদিত হইয়া উঠিল। অকস্মাৎ গৃহদ্বারে এক দীর্ঘাকার ব্রহ্মচারী মূর্ত্তির আবির্ভাব হইল। সেই মূর্ত্তি গম্ভীরস্বরে বলিল, “গোবিন্দরাম, এই নে তোর স্ত্রীর কণ্ঠমালা নে,” বলিয়া একছড়া হার দেওয়ানের সম্মুখে ফেলিয়া দিল।

দেওয়ান এই অদ্ভুত ব্যাপারে হতবুদ্ধি হইয়া দ্বারের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

সেই মূর্ত্তি পুনর্ব্বার বলিল, “দেওয়ান তুই আমায় দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিস? হইবারই কথা—তুই আমায় চিনিতে পারিতেছিস না, কিন্তু আমার নাম অবশ্য শুনিয়াছিস—আমার নাম রতন শর্ম্মা—আমিই কল্যরাত্রে তোর শ্বশুরবাড়ীতে ডাকাতি করিয়াছি—মনে করিস না যে, তোর সহিত সদ্ভাব স্থাপনের জন্য কণ্ঠমালা ফিরাইয়া দিলাম, তাহা নহে—উহাতে আমার উদর পূর্ণ হইবে না। আমি তোর সেই গহনার বাক্স চাই। তিন দিন সময় দিলাম—আগামী অষ্টমীপূজার রাত্রে সেই বাক্স যেন এই স্থানে উপস্থিত থাকে, নতুবা তোর নিস্তার নাই।”

এই কথা বলিয়া দস্যুচূড়ামণি অন্তর্হিত হইল। দেওয়ান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিলেন। ক্ষণকাল পরে তাঁহার চৈতন্য হইল, ভূমি হইতে কণ্ঠহার উঠাইয়া লইয়া তৎক্ষণাৎ বাহিরে গেলেন, চতুৰ্দ্দিক অন্বেষণ করিলেন; কিন্তু তাহাকে আর কোথায়ও দেখিতে পাইলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *