ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – শ্বশুর ও জামাতা

ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – শ্বশুর ও জামাতা

দেওয়ান। প্রহরী যখন আপনাকে নিষেধ করিল, তখন আপনি বাহিরে গেলেন কেন? খামখা এ অপমান স্বীকার করিবার কি প্রয়োজন ছিল?

হলধর। বাপু, যখন কয়েদ হইলাম, তখন আর অপমানের বাকী রহিল কি? এখন আমার মৃত্যুই ভাল।

দেও। আপনি জ্ঞানবান হইয়া এত কাতর হইতেছেন কেন? বিশ্বনাথ ঘোষের অভিপ্রায়টা কি দেখাই যাক না?

হল। এখনও কি বাপু তাহার অভিপ্রায় বুঝতে পার নাই। আমি তার জ্ঞাতি, সে কেন আমার সহায়তা করিবে—এই সুযোগে আপনার উদর পূর্ণ করিয়া লইবে। তাহার কাছে আমার যাওয়াই ভুল হইয়াছিল। জ্ঞাতির কাছে যে অনিষ্ট ভিন্ন ইষ্টের আশা করে, সে মূর্খ। বরং সসর্প গৃহে বাস করিও, বরং হিংস্র সিংহ-শার্দুলেরও শরণাপন্ন হইও, বরং নরমাংসলোলুপ রাক্ষসের নিকট ও আত্মসমর্পণ করিও, কিন্তু বিপদ বা দুঃখের সময় কদাচ জ্ঞাতির দ্বারস্থ হইও না।

দেও। সে কি মহাশয়, যদি ভ্রাতার সহিত ভ্রাতার, স্বগোত্রীয়ের সহিত স্বগোত্রীয়ের স্বদেশীয়ের সহিত স্বদেশীয়ের সহানুভূতি না থাকিবে, তবে আর কাহার সহিত থাকিবে? বুঝিতেছি, এইজন্যই বাঙ্গালী অধঃপাতে যাইরে—সোনার বাঙ্গালার সর্ব্বনাশ হইবে–বাঙ্গালা ডুবিবে–রসাতলে ডুবিবে! তবে অপানি যেরূপ ভাবিতেছেন, সমাজের তদ্রূপ দুরবস্থা এখনও হয় নাই—এখনও ভারতে ভ্রাতৃভাব আছে। কতকলোক দোষী বলিয়া কি সমস্ত সমাজ দুষ্ট বলিতে হইবে? ভাল মন্দ সৰ্ব্বত্রেই আছে, যে সাগরে ভয়ঙ্কর হাঙ্গর বিচরণ করে, সেই সাগরেই মনোহর মুক্তা জন্মে, চন্দ্রে কলঙ্ক আছে, দীপ্তিও আছে,—সংসারে গরলও আছে, সুধাও আছে। ভারতে কি ভাল লোক নাই? বিশ্বনাথ ঘোষের এ পর্যন্ত এমন কোন অসদ্ব্যবহার দেখা যায় নাই, যাহাতে আপনি তাঁহাকে মন্দলোক বলিতে পারেন।

এই সময়ে বামাস্বরে কে বলিল, “দৃষ্টির দোষে ময়ূরকেও ছাতারে বলিয়া বোধ হয়।”

যেদিক হইতে এই উক্তি আগত হইল, সেইদিকে চাহিয়া হলধর ঘোষ বলিলেন, “তুমি যেই হও, তোমার জানা উচিত, এ সময়ে আমায় বিদ্রূপ করা আর মৃতদেহে পদাঘাত করা সমান; আর যে সহ্য হয় না—ভগবন্!”

দেওয়ান। আপনি করেন কি? ‘বিপদে ধৈর্য্য,’ এ কথা বিস্মৃত হন কেন?

“বাবা এ বৃদ্ধবয়সে আর কত সহ্য করিব, আর কত ধৈর্য্য ধরিব—উপযুক্ত পুত্র গিয়াছে— বংশলোপ হইয়াছে, সহ্য করিয়াছি, সেদিন দুর্বৃত্ত দস্যুদল যৎপরোনাস্তি নিগ্রহ করিয়াছে, যথাসৰ্ব্বস্ব হরণ করিয়াছে, তাহাও সহ্য করিয়াছি, এখন আবার আমার একমাত্র আশ্রয় অন্ধের যষ্টি তুমি, তোমাকেও হারাইতে বসিয়াছি,” বলিয়া বৃদ্ধ চক্ষুজল মুছিতে লাগিলেন।

দেও। মহাশয়, স্থির হউন, অত ব্যাকুল হইবেন না, আমরা নিরপরাধ, অবশ্যই এ বিপদ হইতে উদ্ধার পাইব—করুণাময়ী—স্নেহময়ী মা আমাদের রক্ষা করিবেন, যতক্ষণ জননীর প্রসন্নবদন দেখিতে দেখিতে ধর্ম্মপথে বিচরণ করিব, ততক্ষণ বিপদকে ভয় করিব কেন?

হল। বাবা, কাল-মাহাত্ম্যে ধর্ম্মের কি এখন আর সে তেজ আছে, এখন সর্ব্বত্রেই অধর্ম্মের জয় হইতেছে। পরিত্রাণের উপায়ও আমি কিছুই দেখিতেছি না। জমাদার, দারোগা, ফৌজদার সকলেই রাঘব সেনের পক্ষ; আমাদের সহায়তা কে করিবে? কে আমাদের হইয়া দুটা কথা বলিবে! কেই বা আমাদের কথায় কর্ণপাত করিবে! বাবা, তুমি বালক,.তাই এখনও বিপদের গুরুত্ব অনুভব করিতে পারিতেছ না।

দেও। বিপদ গুরুতর, তাহা বেশ বুঝিতেছি, রাঘবের ক্ষমতা অসীম এবং তাহার কৌশলজাল অভেদ্য, তাহাও বুঝিতেছি—কিন্তু আমরা নির্দোষী, তাই মুক্তির আশা করি; অনন্ত-শক্তির কাছে কিছুই অসাধ্য নয়, তিনিই নিরুপায়ের উপায় করিয়া দিবেন।

এই সময় একজন চাপরাসী আসিয়া বলিল, “ফৌজদার আপনাদিগকে ডাকিতেছেন।”

দেও। তিনি এখন কোথায় আছেন?

“তিনি পাশের কামরায় একটি স্ত্রীলোকের সহিত কথা কচ্ছেন, আপনারা শীঘ্র সেইখানে আসুন, এইকথা বলিয়া চাপরাসী চলিয়া গেল এবং দেওয়ান ও হলধর ঘোষ তাহার অনুবর্ত্তী হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *