চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্ন্যাসীর আশ্রম

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্ন্যাসীর আশ্রম

কালা ডাকাইত মুমূর্ষু মাধাকে কাঁধে লইয়া,,সেই বীরপুরুষের পশ্চাৎ পশ্চাৎ একটি বাঁধের উপর দিয়া যাইতে লাগিল। বাঁধের উভয় পার্শ্বে সারি সারি কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর বৃক্ষ। একে সেই অন্ধকারময়ী রজনী, তাহাতে আবার সঙ্কীর্ণ কদমময় পথ, তাহাদের যাইতে বড়ই কষ্ট হইতে লাগিল। কিন্তু কালার সে কষ্ট অপেক্ষা মনের কষ্ট অধিক হইয়াছিল। ভয়ে তাহার প্রাণ উড়িয়া গিয়াছিল। সে কাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতেছে? সে ব্যক্তি যে দেওয়ান গোবিন্দরাম, তাহা সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল। সে বুঝিতে পারিয়াছিল, দেওয়ান সহসা মৰ্ম্মদেশে আঘাতপ্রাপ্ত হইয়া মূৰ্চ্ছিত হইয়াছিলেন, এক্ষণে চৈতন্যলাভ করিয়া তাহাকে ধৃত করিয়াছেন। এখন তাহার কি দশা হইবে, সেই ভাবনায় তাহার হৃদয়ের শোণিত শুষ্ক হইয়া যাইতেছিল। সে ভয়ে ও নীরবে দেওয়ানের অনুসরণ করিতে লাগিল। ক্রমে আকাশ পরিষ্কার হইয়া আসিল, অন্ধকারের গাঢ়তা কিয়ৎপরিমাণে কমিয়া গেল, শরৎকালে জলাশয়ের নির্ম্মল, কাল জলে যেরূপ পুঞ্জ পুঞ্জ কুমুদ-পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়, সেইরূপ অনন্ত নৈশাকাশে সংখ্যাতীত নক্ষত্রপুঞ্জ ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পাইল। তাহারা যে দীপালোক লক্ষ্য করিয়া আসিতেছিল, ক্রমে তাহার নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিল, এক প্রকাণ্ড অশ্বত্থতরুমূলে জটাজুটশ্মশ্রুধারী, দীর্ঘাকার একজন যোগী নয়ন মুদ্রিত করিয়া যোগাসনে বসিয়া আছেন; এবং তাঁহার সম্মুখে একটি অগ্নিস্তূপ প্রজ্জ্বলিত রহিয়াছে।

গোবিন্দরাম ক্রমে সন্ন্যাসীর নিকটবর্ত্তী হইলেন এবং কালাকেও তথায় যাইতে ইঙ্গিত করিলেন। কালা অনিচ্ছায় তথায় গমন করিল এবং সাবধানে মাধাকে একপার্শ্বে শয়ন করাইয়া বিমর্ষভাবে তাহার নিকট দাঁড়াইয়া রহিল। ভয়ে তাহার হৃদয় অস্থির হইতেছিল। সে কি প্রকারে এই বিপদ হইতে পরিত্রাণ পাইবে, তাহারই উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া মৃদুস্বরে বলিল, “বাবু! আপনার পায়ে কাদা লাগিয়াছে, অনুমতি হয় ত ঐ বিল হইতে জল আনিয়া পা ধুয়াইয়া দিই।”

কালার মনস্কামনা সিদ্ধ হইল; সে অনুমতি পাইয়া জল আনিবার ব্যপদেশে ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল। ঘোর নিশীথ সময়, চতুৰ্দ্দিক নিস্তব্ধ, কিছুই শুনা যাইতেছে না, কেবল মধ্যে মধ্যে সম্মুখস্থ অগ্নিস্তূপে ইন্ধনরাশি চটাস্ পটাস্ করিয়া ফাটিয়া ফাটিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে, সন্ন্যাসী নীরবে নয়ন মুদিয়া বসিয়া আছেন, এবং একপার্শ্বে মাধা ডাকাইত শবের ন্যায় পড়িয়া আছে ও অপর পার্শ্বে দেওয়ান নিশ্চলভাবে বসিয়া অন্যমনে কি ভাবিতেছেন।

এই অবস্থায় কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হইলে দূরে একটা চীৎকার শব্দ শুনা গেল। সন্ন্যাসী নয়নোন্মীলন করিয়া জলদ্‌গম্ভীররবে বলিলেন, “ঘবরাও মৎ বেটা।”

গোবিন্দরাম চমকিত হইয়া সন্ন্যাসীর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। সন্ন্যাসী পুনর্ব্বার বলিলেন, “ঘবরাও মৎ বেটা—উও কাঁহা ভাগে গা, আবি পাড়া যায়েগা।”

সন্ন্যাসীর এই কথা শুনিয়া দেওয়ান বিস্মিত হইলেন; ভাবিলেন, তিনি তাঁহার মনের কথা কি প্রকারে জানিতে পারিলেন। পরক্ষণেই ভীম ‘সর্দ্দার পলায়নপর কালা ডাকাইতের চুলের ঝুঁটি ধরিয়া তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। কালা ডাকাইতের দক্ষিণহস্তের কিয়দংশ কাটা গিয়াছে, এবং ক্ষতস্থান হইতে অবিশ্রান্ত রক্ত নিঃসৃত হইতেছে। ভীম সর্দ্দারেরও এখন আর সে মূৰ্ত্তি নাই। তাহার শরীর রক্তে প্লাবিত, সে বাম হস্তে কালার চুলের ঝুঁটি ও দক্ষিণ হস্তে তরবারী ধরিয়া ভয়ঙ্কর বেশে আসিয়া দাঁড়াইল।

কালা। দোহাই ঠাকুর জি, দোহাই ঠাকুর জি।

সন্ন্যাসী। কমবকৎ চিল্লাও ম‍ৎ।

ভীম সর্দ্দার প্রভুর মুখের দিকে চাহিয়া কালাকে ছাড়িয়া দিয়া কাষ্ঠ-পুত্তলিকার ন্যায় হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

সন্ন্যাসী। কেঁও, তোম দেওয়ানা হোগেয়া, কেয়া দেখতে হো? আপনা মনিবকো পছান্তা নেহি।

ভীম সর্দ্দারের তখনও কথা কহিবার শক্তি ছিল না। সে একদৃষ্টে দেওয়ানের মুখপানে চাহিয়া রহিল।

দেওয়ান বলিলেন, “কিরে ভীমে, তুই যে এখানে?”

“আজ্ঞা বলছি” এই মাত্র বলিয়াই ভীমের দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল, তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিল,” সে আর কথা কহিতে পারিল না। সে অনেকক্ষণ পরে গদগদ স্বরে বলিল, “আপনাকে যে আবার দেখতে পাব, এমন আশা ছিল না।”

দেও। এখন খবর কি? তুই কালীপুরে যাসনি?

ভীম। আজ্ঞা আপনি যেই পড়ে গেলেন, আমি আপনার হুকুম মত উর্দ্ধশ্বাসে ছুলেম, কিন্তু খানিকদূরে গিয়ে ভাবলেম, ডাকাতেরা নিশ্চয়ই আমার পিছু নেবে। আর আমি একা, সঙ্গে গহনার বাক্স–আমিও যাব, বাক্সটিও যাবে। যেখানে হোক, একস্থানে লুকাতে হবে, এই সব ভাবতে ভাবতে আর প্রাণপণে দৌড়িতে দৌড়িতে, সামনে এক জায়গায় কতকগুলি বটগাছ দেখতে পেলেম, সেইখানটা খুব অন্ধকার, সেই অন্ধকারে আস্তে আস্তে জলায় নেমে একটা ভাঙ্গা সাঁকোর নীচে গিয়ে লুকিয়ে রইলেম; একটু পরেই শুনতে পেলেম, দুপ দুপ করে দু বেটা ডাকাত তীরের মত ছুটেছে। একজন বলছে, ‘এ বেটা কত দূর গেল?’ আর একজন বলছে ‘যেখানে যাক না কেন, রতন শর্ম্মার কাছে নিস্তার নাই। আর সে যেখানে যাবে, তাও আমি জানি, তুই চলে আয়।’ তারা দুজনে চলে গেলে, আমি সাঁকোর নীচে থেকে বেরিয়ে ভাবলেম, যাঁর নিমক খাই, তাঁর কি দশা হল, আগে একবার দেখা চাই। এই ভেবে বরাবর যেখানে ডাকাতদের সঙ্গে মারামারি হয়েছিল, সেইখানে এসে এই বেটার সঙ্গে দেখা হল।

দেও। অ্যাঁ, বেটা গেল কোথা! পালাল নাকি?

সন্ন্যাসী এতাবৎকালে অগ্নিস্তূপের সংস্কার করিতেছিলেন। সকলকে অন্যমনা দেখিয়া কালা ডাকাইত পালাইবার উদ্যোগ করিতেছিল। সে কিছুদূর যাইতে-না-যাইতে সন্ন্যাসী ক্রুদ্ধভাবে বলিয়া উঠিলেন, “ফিন্ ভাগতে হো বদ্‌মাস, ইধার আও।”

কালা ডাকাইত মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাঁহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সন্ন্যাসী কট্‌ট্ করিয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া কি কথা বলিলেন, তাহা কেহ বুঝিতে পারিল না। পরে তিনি দেওয়ানকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “দেখো বেটা, উস্কা কেয়া হাল – হো গেয়া, আউর এক কদম হিলনেকা তাকৎ নেহি হৈ।”

দেওয়ান, সন্ন্যাসীর এই অদ্ভুত ক্ষমতা দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইলেন এবং তাঁহার প্রতি তাঁহার ভক্তি গাঢ়তর হইল। তিনি সেই দুইজন দস্যুকে তাঁহার নিকটে রাখিয়া ভীম সর্দ্দার সহ প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময়ে বলিয়া গেলেন, “কল্য প্রাতে আসিয়া পুনর্ব্বার শ্রীচরণ দর্শন করিব।”

সন্ন্যাসীর আশ্রম হইতে বিদায় হইয়া গোবিন্দরাম পুনর্ব্বার পূর্ব্বোক্ত বালা-বাঁধ দিয়া চলিলেন। ভীম সর্দ্দারও পুনর্ব্বার প্রভুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। যাইতে যাইতে দেওয়ানজী ভৃত্যুকে জিজ্ঞাসিলেন, “হাঁ রে, থানায় না দিয়া, তুই ও বেটাকে এখানে আনলি কেন?”

ভীম। আজ্ঞা থানা যে এখান হতে অনেক দূর, ততটা রাস্তা কি অতবড় জোয়ান মৰ্দ্দকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া যায়? আলোটা দেখতে পেয়ে ভাবলেম, অবশ্য এখানে মানুষ আছে, কোন-না-কোন একটা উপায় হতে পারবে, তাই এখানে নিয়ে এলেম।

দেওয়ান কোন উত্তর না দিয়া অন্যমনে ভাবিতে ভাবিতে চলিলেন। কিছুদূর গিয়া আপনার লাঠী ভীমকে দিয়া তাহার তরবারীখানি লইয়া বলিলেন, “তুই বরাবর কালীপুরে না গিয়া ভাল করিসনি।”

ভীম। হুজুর, আমি মূর্খ মানুষ, না বুঝে একটা কাজ করে ফেলেছি, আমার কসুর মাপ করবেন। “আচ্ছা চলে আয়,” বলিয়া গোবিন্দরাম পূৰ্ব্বাপেক্ষা দ্রুতপদে চলিতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে উম্মিমালার ন্যায় কতই চিন্তা তাঁহার চিত্ত উদ্বেলিত করিতে লাগিল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “কি ভয়ঙ্কর কাণ্ডই ঘটিয়া গেল। চারি-পাঁচ ঘণ্টা পূর্ব্বে কে জানিত যে, এ প্রকার ঘটনা সকল সংঘটিত হইবে? চারি-পাঁচ ঘণ্টা পূর্ব্বে আমার মনের অবস্থা কিরূপ ছিল, এখন কি হইল? আবার কি ঘটিবে, তাহাই বা কে বলিতে পারে? আমার সঙ্গীদিগের কি দশা হইয়াছে, তাহাও জানি না। মানুষের জ্ঞান অতীব সামান্য, অতীব সঙ্কীর্ণ। এই অসীম বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাপারে সসীম মনুষ্য সম্পূর্ণ অন্ধ। তবে মনুষ্য জ্ঞানের অহঙ্কার করে কেন? মনুষ্য কি বুঝিতে পারে? দেখিতে পায় না বলিয়া চন্দ্রমার অস্তিত্ব অস্বীকার করা অন্ধের যেমন ধৃষ্টতা, আমরা যাহা বুঝিতে পারি না,

তাহা হইতে পারে না বলা আমাদের সেইরূপ প্রগল্ভতা—নাস্তিকতা—দাম্ভিকতার চরম সীমা। লোকে বলে, যোগবলে ব্রহ্মাণ্ডের গূঢ়তত্ত্ব সকল বুঝিতে পারা যায়, জানি না, সে কথা কতদূর সত্য; কিন্তু সন্ন্যাসীর কি আশ্চর্য্য ক্ষমতা! ইনি একস্থানে বসিয়া নানা স্থানের ঘটনা অনায়াসে জানিতে পারিতেছেন। আহা, কেন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম না! জানি না কি হইতেছে! স্ত্রীলোকের পুরী, অভিভাবক কেবল বৃদ্ধ শ্বশুর মহাশয়—তিনি কি করিবেন? না জানি, দস্যুগণ কতই যন্ত্রণা দিতেছে, কতই অবমাননা করিতেছে! উঃ! অসহ্য! (প্রকাশ্যে) ভীমে, আর কতদূর আছে? এখন আমরা কোথায় এসেছি?”

ভীম। আজ্ঞা এই যে ডানকুনি গ্রাম ডাইনে রেখে এলাম।

দেও। তবে ত আমরা এসে পড়েছি, অ্যাঁ?

ভীম। আজ্ঞা, ঐ যে ওপারের রাস্তা দেখা যাচ্ছে।

সুদূর-প্রসারী প্রান্তর ধূ ধূ করিতেছে। প্রান্তরের পশ্চিম সীমায় কৃশাঙ্গী স্বরস্বতী নদী রজতরেখার ন্যায় মৃদুমন্দ গতিতে নীরবে প্রবাহিত হইতেছে। নদীর পশ্চিম পারে বট ও অশ্বত্থ বৃক্ষাবলী সংখ্যাতীত খদ্যোত্মালামণ্ডিত হইয়া রত্নতরুর ন্যায় শোভা পাইতেছে এবং সেই তরুরাজীর পশ্চাদ্ভাগে একটি কাঁচা রাস্তা উত্তর দক্ষিণে চলিয়া গিয়াছে। এই রাস্তার ধারে কালীপুর গ্রাম এবং এই রাস্তাই ভীম সর্দ্দার দেওয়ানকে দেখাইয়া দিল। তাঁহারা যে পথ দিয়া আসিতেছিলেন, সে পথ কালীপুরের রাস্তার সহিত একটি ইষ্টকনির্ম্মিত সেতুর দ্বারা সংযোজিত হইয়াছে।

দেওয়ান ভৃত্যসহ নদী পার হইয়া গ্রামের প্রান্তভাগে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এখানে আসিয়া তাঁহার চিত্ত আরও ব্যাকুল হইয়া উঠিল, তিনি কল্পনায় নানা বিভীষিকা দেখিতে লাগিলেন, তিনি যেন স্ত্রীলোকের আর্তনাদ শুনিতে পাইলেন। বিলম্ব তাঁহার আর সহ্য হইল না। তিনি উন্মত্তের ন্যায় পল্লিমধ্যে প্রবেশ করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *