বসু-বাড়ি – ৭৫

৭৫

জীবনের প্রায় আট বছর কারাবাস বাবার স্বাস্থ্যের খুবই ক্ষতি করে দিয়েছিল। হার্টের অসুখের খবর পেয়ে আমার চিন্তা হল তাঁর শরীর কি এই ধাক্কা সহ্য করতে পারবে! একটা সান্ত্বনা ছিল যে, নতুনকাকাবাবু ডাক্তার সুনীল বসুর মতো হার্ট স্পেশ্যালিস্টের হাতে তিনি থাকবেন। চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হবে না এ-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম। কিন্তু হার্টের অসুখে যে বিশ্রামের দরকার হয় সেই বিশ্রাম বাবা কি নেবেন! শারীরিক বিশ্রাম না হয় জোর করে চাপানো গেল, কিন্তু মানসিক বিশ্রাম তো অসম্ভব! দেশের চিন্তা তো আছেই। ওদিকে আবার সংসার চালানোর ব্যাপারে বাবা তো চিরকালই বেপরোয়া। তার ওপর ‘নেশন’ পত্রিকা চালু করে নিজের উপর খুবই বড় রকমের আর্থিক বোঝা তিনি নিয়েছিলেন। এ-সব কথা আমার মাথায় ক্রমাগতই ঘুরছিল। করিই বা কী? বাবা বেশ পরিষ্কার করে লিখেছিলেন যে, কোনো চিন্তা নেই। তিনি ক্রমে-ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠবেন, আমি যেন তাড়াহুড়ো করে দেশে ফিরে যাবার চিন্তা না করি। বাড়ির কেউই এ-সব ব্যাপারে বাবার কথার ওপর কিছু বলতে পারতেন না। প্রতি চিঠিতেই বাবা আমাকে ডাক্তারি সব রিপোর্ট বিশদভাবে জানাতেন। কোন্‌টা আশাপ্রদ, কোন্টা নয়—সবই জানাতেন। তারই সঙ্গে নানা কাজের নির্দেশ থাকত। 

.

লণ্ডনে মাস-তিনেক থাকার পরে আমি শেফিল্ডের নামকরা শিশু হাসপাতালে কাজ শিখবার সুযোগ পেলাম। লণ্ডনের বিশ্ববিখ্যাত শিশু হাসপাতালে ভর্তি হতে মাস ছয়েক দেরি হবে, সুতরাং সেই সময়টা কাজে লাগাবার জন্য আরও দূরে চলে যেতে হল। বিদেশে ছোট শহরে বা গ্রামে থাকবার একটা লাভ আছে, সেই দেশের মানুষের কাছাকাছি আসা যায়, তাদের মন বোঝা যায়,তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচয় হয়। লণ্ডনের মতো বড় শহরে কেউ কারও দিকে তাকায় না। বছর খানেক বাদে যখন সুইট্‌জারল্যাণ্ড ও ভিয়েনায় পড়তে গেলাম তখন আমার সামনে আবার এক নতুন জগৎ খুলে গেল। সুইট্‌জারল্যাণ্ড আগে দেখেছিলাম ট্যুরিস্ট হিসাবে। পরে বুঝলাম দেশ বেড়াতে আসা এক কথা আর সেই দেশে মানুষের পাশাপাশি থেকে লেখাপড়া করা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার! আমাদের দেশ সম্বন্ধে সেখানকার মানুষের অজ্ঞতা দেখে মন খারাপ হয়ে যেত। মনে হত এবার আমরা স্বাধীন হয়েছি, নিশ্চয়ই আমাদের দেশ সম্বন্ধে বড় রকমের প্রচারে আমরা নামব। আবার দেখে অবাক হতাম যে, সুইসদের মতো ছোট্ট জাতি, যাদের জনসংখ্যা কলকাতার সমান, কেমন সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে নিজেদের গড়ে তুলেছে। পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটি রাজ্য, নানা অসুবিধার মধ্যেও যা কিছু সম্বল আছে তারই সদ্ব্যবহার করে নিজেদের দেশকে কেমন সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধিশালী করেছে। 

আমার কাছে ভিয়েনার আকর্ষণ ছিল অবশ্যই অন্য ধরনের। আমার জীবনের গভীর এক দুঃখের সময়ে আমি সেখানে অতি আপনজন পেয়েছিলাম। এমিলি কাকিমা তো আছেনই, ছোট্ট অনিতা আমাকে তার খেলার সঙ্গী করে নিয়েছিল। হাসপাতালে কাজের সময়টা ছাড়া বাকি সময় আমার তাঁদের সঙ্গেই কাটত। যে কোনো পরিবারে পুরুষের উপস্থিতির বিশেষ এক গুরুত্ব আছে। আমি যেন মাস ছয়েক ঐ অভাব পূর্ণ করেছিলাম। উঁ-মামা বা অনিতার দিদিমার নিজের হাতে রান্না করা অতি উপাদেয় গুলাশ বা স্নিসেল্ বা রকম রকম সুপ, আপেলের পুডিং ইত্যাদি খেয়ে শেষ করতে পারতাম না। 

শেফিল্ডে থাকতেই বাবা জানালেন যে নতুনকাকাবাবু তাঁকে কিছুদিনের জন্য সুইট্‌জারল্যাণ্ডের কোনো এক ভাল ক্লিনিকে চিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য পাঠাতে চান। লস্যানের কাছে গ্লিওঁ বলে একটি মনোরম জায়গায় ভাল একটি ক্লিনিকের সন্ধান পাওয়া গেল। আমি খবরটা পেয়ে আনন্দিতই হলাম। কারণ কলকাতায় বসে বাবার পূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া সম্ভব ছিল বলে আমার মনে হয়নি। আমাকে বাবা জানালেন যে, সুইট্‌জারল্যাণ্ড থেকে ফিরবার আগে তিনি লণ্ডনে আসবেন, মা সঙ্গে থাকবেন। আমাকে বললেন,লগুনের কোনো এক বিখ্যাত হার্ট-স্পেশালিস্টকে দেখাবার ব্যবস্থা করে রাখতে। 

.

১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি ইউরোপে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু বাবা আরও একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। দক্ষিণ কলকাতার বিধানসভার আসনটি শূন্য হয়ে পড়েছিল। বাবা ঐ আসনের জন্য লড়বেন স্থির করে ফেললেন। তিনি তো ১৯৪৮ সাল থেকেই জাতীয়তাবাদ ও সমাজবাদের ভিত্তিতে একটা শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ গড়ে তোলার কাজে মন দিয়েছিলেন। এই নির্বাচনে লড়ে তিনি একটি দৃষ্টান্ত রাখতে চান। বিরোধী পক্ষকে সঙ্ঘবদ্ধ করার পথে একটি বড় পদক্ষেপ নিতে চান। কিন্তু যে সময় নির্বাচন, সে সময় তিনি থাকবেন সুইট্‌জারল্যাণ্ডে। তিনি বললেন সাগরপার থেকেই তিনি তাঁর নির্বাচক-মণ্ডলীর কাছে তাঁর আবেদন রাখবেন, ফলাফল তিনি তাঁদের হাতেই ছেড়ে দেবেন। 

শেফিল্ডে বসে আমি সুইট্‌জারল্যাণ্ড থেকে বাবার চিঠি পাচ্ছি। স্বাস্থ্যের সব খবর জানাচ্ছেন। অন্যদিকে বাড়ি থেকে বাবার নির্বাচন সংক্রান্ত খবরের জন্য ছটফট করছি। সুইট্‌জারল্যাণ্ডে পৌঁছবার পরে বাবা ও মা ভিয়েনা থেকে কাকিমা এমিলি ও অনিতাকে আনিয়ে নিলেন। গ্লিওঁতে তাঁরা সকলে মিলে কয়েক সপ্তাহ খুব আনন্দে কাটিয়েছিলেন। সুইট্‌জারল্যাণ্ডে বাবার স্বাস্থ্যের খানিকটা উন্নতি হল। আমার আশা হল বাবা বোধহয় বিপদ কাটিয়ে উঠলেন। 

‘নেশন’ কাগজ আমার কাছে নিয়মিত আসত যদিও খবরগুলো দিন-কয়েকের পুরনো হত। অবস্থা প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও বাবার অনুগামীরা কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন। প্রচারের কাজে ‘নেশন’-ই হল একমাত্র হাতিয়ার। বাবা ইউরোপ থেকে নির্বাচক-মণ্ডলীর কাছে তাঁর বক্তব্য ও আবেদন রাখলেন। ভোট গোনা হয়ে যাবার কয়েক ঘন্টা বাদেই বাড়ি থেকে আমি টেলিগ্রাম পেলাম—বাবা বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। 

দিন-কয়েক পরেই বাবা ও মা লণ্ডনে আসবেন। আমাকে বাবা সেই কয়েক দিন লণ্ডনে তাঁদের সঙ্গে কাটিয়ে যেতে বললেন। সুইট্‌জারল্যাণ্ড থেকে আমার জন্য একই হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। লণ্ডনের এয়ারপোর্টে বাবাকে দেখে তো ভালই লাগল। নির্বাচনে জয়ের পর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তিনি যেন পা বাড়িয়ে রয়েছেন। মাকেই অপেক্ষাকৃত ক্লান্ত লাগল, কী যেন এক গভীর চিন্তা তার মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাবার জন্য লণ্ডনে নানা ধরনের প্রোগ্রাম করা ছিল। নানা লোকের সঙ্গে দেখাশুনো, সভা, বক্তৃতা ইত্যাদি দিয়ে তাঁর দিনগুলি ভরা ছিল। অনেক সময় এমন হত বাবা যখন বিশেষ কোনো কাজে ব্যস্ত, মা তখন আমার সঙ্গে বসে নানা বিষয়ে কথা বলতেন। পারিবারিক, ব্যক্তিগত, দেশের কথা ও রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে এত খোলাখুলিভাবে কথাবার্তা আগে কখনও হয়নি। মা সেই সময় অনেক ব্যাপারেই বাবার পক্ষ থেকে কথা বলতেন। যেমন উনি বলছিলেন, তোমার ভবিষ্যৎ-জীবনের প্রস্তুতি এইভাবে হওয়া উচিত। বিবাহের ব্যাপারে তোমাকে অনেক দিক বিবেচনা করতে হবে, ইত্যাদি। আমি শেষ পর্যন্ত জনসেবার ক্ষেত্রে ও জনজীবনে প্রবেশ করব সেটা বাবা ও মা যেন ধরেই নিয়েছিলেন। বাবার পরামর্শ ছিল আমি যেন সব সময় সে-সব কথা মনে রেখে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করি। 

যেদিন বাবা ও মাকে এয়ার-টার্মিনালে বিদায় জানালাম সেদিন বাবাকে বেশ সুস্থ ও প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। খবর পেলাম বোম্বাই পৌঁছেই বাবা সফরে বেরিয়ে পড়েছেন। মা লিখলেন, বাবা একটু বাড়াবাড়ি করছেন বলে মনে হয়। আমি যখন আমার চিঠিতে তাঁর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করতাম তিনি প্রতিবারই লিখতেন, কোনো চিন্তা কোরো না, I have many more years to live and work. অপরদিকে এটাও শুনেছি যে, বাড়িতে কেউ বিশ্রামের কথা বললে তিনি বলতেন, বিশ্রাম আবার কী? I am a racing horse, I shall die galloping. 

আগস্ট মাসে ময়দানে অক্টারলোনি মনুমেন্টের তলায় বক্তৃতা করবার সময় বাবার আবার হার্ট অ্যাটাক হল। আমাকে অবশ্য বলা হল যে, ব্যাপারটা গুরুতর নয়; দূরে যারা থাকে তাদের অসুখ-বিসুখের খবর কম করেই বলা হয়। কিছুদিন পরে বাবা নিজেই আমাকে খবরটা জানালেন। তবে বুঝলাম, নতুনকাকাবাবু এবারে চিকিৎসার ব্যাপারে খুবই কড়াকড়ি করছেন। ১৯৪৯-এর শেষে কলকাতায় সংযুক্ত সমাজবাদী সম্মেলন হল, বাবা তাঁর সভাপতি, কিন্তু ভাষণটি নিজে পড়তে পারলেন না। সম্মেলনে দেশের নানা দিক থেকে অনেক প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন এবং সম্মেলনে সংযুক্ত সমাজবাদী সংগঠন বা ইউ. এস. ও. গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যার সভাপতি নির্বাচিত হলেন বাবা। আমি প্রায়ই বাবার চিঠি পাই। তিনি আশার কথা বলেন। এদিকে পূর্ব বাংলায় আবার দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে যাওয়ায় বাবার চিন্তার অবধি ছিল না। বিভক্ত-বাংলার এই হানাহানির রাজনীতির সমাধানের সূত্র খুঁজে বের করা বাবার জীবনের শেষ দিনগুলির প্রধান চিন্তা হয়ে দাঁড়াল! 

অক্টোবরের প্রথমেই আমি লণ্ডনে ফিরে এসে গ্রেট অরমণ্ড স্ট্রিটের বিশ্ব-বিখ্যাত শিশু-হাসপাতালে শিক্ষার্থী হিসাবে যোগ দিলাম। ১৯৫০-এর ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে হাসপাতালে বেরোবার জন্য আমি প্রস্তুত। প্রায় একই সঙ্গে তখন একটি টেলিগ্রাম এল আমার হাতে, অন্য দিকে টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিগ্রামে লেখা : Father passed away after an hours illness. টেলিফোনে কথা বললেন আনন্দবাজারের তারাপদ বসু। তিনি বললেন, “শিশির, তুমি মন খুব শক্ত করো, আমাদের শরৎবাবু আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।” ততক্ষণে ‘টাইমস’ পত্রিকাও এসে গেছে। খবরও ছাপা হয়ে গেছে। 

আমি স্থির হয়ে রইলাম। তারাপদবাবু ও তাঁর স্ত্রী সেই দিনটা আমাকে তাঁদের বাড়িতে ধরে রাখলেন। কলকাতায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এখন কী ঘটছে কে জানে! মা’র খবর জানতে চেয়ে,এবং আমার এখন কী কর্তব্য জানতে চেয়ে বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠালাম। ভাবলাম আমার হয়তো ভাগ্য ভাল যে, বাবাকে আমি কোনোদিন রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায় দেখিনি। তাঁর ডাক এসেছে, তিনি বীরের মতো চলে গেছেন। বসুবাড়ির মধ্যমণির প্রস্থানের সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। ধন ও ঐশ্বর্যে নয়, ত্যাগ ও সেবার মহিমায় উজ্জ্বল এই অধ্যায় প্রত্যক্ষ করার যে সুযোগ আমরা পেয়েছি পৃথিবীতে কজনই বা তা পায়? কটা পরিবারে শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র সমকালে জন্মগ্রহণ করেন? আমরা তাঁদের স্পর্শ ও আশীর্বাদ পেয়ে ধন্য হয়েছি। সেটাই বা ক’জনের ভাগ্যে ঘটে! 

বাবার শেষ কয়েকখানা চিঠি ওলটাতে ওলটাতে কিন্তু মনে হল আমার চিন্তা ভুল। শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র বসুবাড়ির সন্তান কেবল আক্ষরিক অর্থে। আসলে তাঁরা ভারত-সন্তান। কেবল আমরা নই, ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি নর-নারী তাঁদের পরমাত্মীয়। ভারতবাসীর দুঃখকে আপন দুঃখ করে নিয়ে তাঁদের কল্যাণে তাঁরা জীবনদান করে গেলেন। বসুবাড়ির বন্ধন, বসুবাড়ির অভিমান, বসুবাড়ির গণ্ডি অতিক্রম করে তাঁরা চলে গেছেন অমরত্বের সন্ধানে। শরৎ-সুভাষকে ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তার হাতে সমর্পণ করেই বসুবাড়ির প্রকৃত ও চরম সার্থকতা। 

তবু, আমরা যারা রইলাম তাদেরও কিছু আছে। যা দেখেছি, যা শুনেছি তাও কি কম! ইংরেজ কবি চেস্টারটনের ভাষায় বারে বারে বলি : 

It is something to have wept as we have wept, 
It is something to have done as we have done, 
It is something to have watched when all men slept 
And seen the stars which never see the sun. 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *