বসু-বাড়ি – ৭০

৭০

সেই ছাত্রাবস্থায় যে বিলেত গিয়েছিলেন তার পরে বাবা আর ইউরোপ যাননি। সেজন্য অনেকদিন থেকেই ইউরোপ ভাল করে দেখবার তাঁর ইচ্ছা ছিল। জীবনের আট বছর তো জেলেই কেটে গেল। তার উপর আছে রাজনীতির ডামাডোল। সুযোগ-সুবিধা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ভিয়েনা থেকে যখন এক মা ও কন্যার ডাক এল বাবা মনস্থির করে ফেললেন। মা তো সঙ্গে যাবেনই। আমিও সঙ্গে থাকব, ঘোরাঘুরির পরে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যাণ্ডে থেকে যাব। সবদিক চিন্তা করে ছোট দুই বোনকেও সঙ্গে নেওয়া ঠিক হল। আমরা বেশ দল বেঁধেই ইউরোপ পাড়ি দিলাম। খরচ অনেক, তবে বাবার গত এক বছরের রোজগারে কুলিয়ে যাবে মনে হল। 

তখনও জেট এরোপ্লেন চালু হয়নি। সেজন্য বিমানে যাত্রার সময় প্রায় ডবল লাগত। কলকাতা থেকে বোম্বাই হয়ে কায়রোয় কিছুক্ষণ থেমে আমরা রাতের অন্ধকারে রোমে পৌঁছলাম। এরোপ্লেন থেকে নামতেই দেখা গেল সাংবাদিক ও ফোটোগ্রাফারদের বেশ ভিড়। যুদ্ধের পরে রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর দাদা—আর এক রাজনীতিবিদ চন্দ্র বোস—ইউরোপ সফরে এসেছেন এটা বেশ বড় খবর। তাছাড়া যুদ্ধের পরে ইউরোপের রাজনীতি কোন্ দিকে যাচ্ছে বাবাও সে-বিষয়ে খুবই কৌতূহলী, সাংবাদিকদের সঙ্গে এই যোগাযোগ তাঁর কাম্য। দেশের রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর নিজের মতামতও খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করার সুযোগ তিনি কেনই বা নেবেন না? বাবা প্লেন থেকে নামামাত্র ছবি তোলা শুরু হল এবং পরে বাবা যেখানেই যান সাংবাদিকরা ও ফোটোগ্রাফাররা তাঁকে ধাওয়া করেন। 

যুদ্ধের সময় রাঙাকাকাবাবু যে-হোটেলে ছিলেন, আমরা সেই হোটেলেই উঠলাম। বাবা ইউরোপীয় আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং ইউরোপীয় জীবনযাত্রার যা কিছু ভাল, সুস্থ ও আনন্দদায়ক তিনি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। ভোজনরসিক ছিলেন বলে ভাল ইউরোপীয় খাদ্য তিনি খুবই উপভোগ করতেন। কতকগুলি বিধিনিষেধ তিনি কিন্তু মানবেনই। যে-কোনো হোটেলের খাবার-ঘরে ঢুকেই তিনি ঘোষণা করে দিতেন, গো-মাংস ইত্যাদি আমাদের ধারে-কাছে আনবে না। আর পানীয় দেবে বিশুদ্ধ ‘মিনারেল ওয়াটার’। 

ইতালির মতো সুন্দর দেশ তো কমই আছে, তাছাড়া ঐতিহাসিক ও শিল্পকলার নিদর্শনে ইতালির প্রত্যেকটি শহর ঠাসা। যে-কোনো নতুন জায়গায় পৌঁছেই একটি নামকরা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে আলোচনা করে সব কিছু ঘুরে দেখবার একটা সুন্দর পরিকল্পনা বাবা করে ফেলতেন। যতক্ষণ পকেটে কিছু টাকা আছে, দরাজ হাতে খরচ করতে তাঁর আটকাত না। রোম থেকে নেল্স। নেল্স থেকে ছোট্ট সুন্দর দ্বীপ কাপ্রি, তারপর ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলান—একটার পর একটা যেন স্বপ্নের নগরী। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, দেখার শেষও যেন হয় না। তার সঙ্গে আছে ইতালিয়ানদের সরব আনাগোনা, চিৎকার করে ঝগড়াঝাটি ও প্রাণোচ্ছল হাসি। 

সাংবাদিকরাও ছাড়বে না। নানা পত্রিকা থেকে বাবার সঙ্গে ইন্টারভিউয়ের তাগিদ। জানতে চায় ভারতবর্ষের পরিস্থিতিটা কেমন, বাবার মতামত ও ভবিষ্যতের কার্যক্রম কী। বাবা তো স্পষ্টবক্তা, যা বলার জোরের সঙ্গেই বলেন, বলেন দেশের নেতৃত্ব যথেষ্ট বলিষ্ঠ নয়, বলেন ভারতবর্ষের চাই একটা মজবুত ঐক্যবদ্ধ সমাজবাদী সংগঠন। 

সব বাদ দিয়েও আমাদের সামনে ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, ইতিহাসের সন্ধান। যুদ্ধের সময় রাঙাকাকাবাবুকে চিনত-জানত এমন কাকে পাওয়া যায়, কী করে তাঁর সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করা যায়। প্রথমেই খোঁজ করা হল পিয়েত্রো কোয়ারনির। কোয়ারনি ছিলেন ১৯৪১ সালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ইতালির রাষ্ট্রদূত। তাঁর সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর দেখা ও কথাবার্তা হবার পরেই তাঁর ইউরোপ যাবার ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে কথা বলে সেই সময় একটা ভাঁল রিপোর্ট রোমে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা যখন রোমে, তখন কোয়ারনি ইতালির রাষ্ট্রদূত হয়ে প্যারিসে রয়েছেন। অন্য আর দু’একজনকে পাওয়া গেল যাঁরা হয় সেই সময় কাবুলে বা ইতালির পররাষ্ট্র দফতরে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের খুব ভাল লাগল। 

১৯৩৩ সালে রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে এসেছিলেন একটি ইতালীয় জাহাজে এবং প্রথমেই নেমেছিলেন ইতালিতে। যদিও ইতালির পুলিশ ইংরেজ পুলিশের প্ররোচনায় কখনও কখনও তাঁকে বিরক্ত করেছিল, ইতালির সরকার মোটামুটি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। যে-কোনো স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতি সেই দেশের জাতীয় স্বার্থে রচিত হয়। ভাবালুতা বা দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে নয়। মুসোলিনীর নেতৃত্বে সেই সময় ইতালি ভূমধ্যসাগর ও উত্তর আফ্রিকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছিল। ভূমধ্যসাগর ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা—ভারতবর্ষ এবং এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান জলপথ। স্বাভাবিকভাবেই ঐ এলাকায় ইতালি ইংল্যাণ্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। রাঙাকাকাবাবু ঐ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বার্থে ইতালির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছিলেন। ইতালির সরকারও প্রতিদ্বন্দ্বীর শত্রু হিসাবে মুক্তিকামী ভারতবাসীদের সহানুভূতি ও সমর্থন চাইছিলেন। সেই সময় মুসোলিনীর সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর বার-দুয়েক দেখা হয়েছিল এবং ইতালি-ভারত সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্বন্ধে তাঁদের আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। অনেক পরে ১৯৪১ সালে দেশ থেকে অন্তর্ধানের পরে কাবুলে যখন রাঙাকাকাবাবু খুবই অসুবিধায় পড়েছিলেন তখন ইতালির পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে তাঁর পুরনো পরিচয় কাজ দিয়েছিল। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তিরিশের দশকে ইতালিতে ভারতের পক্ষে কিছু কাজ হয়েছিল। মুসোলিনী রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। ইউরোপের প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রদের একটা বড় সম্মেলন ইতালিতে হয়েছিল, মুসোলিনী যার উদ্বোধন করেছিলেন। যুদ্ধের মধ্যে ১৯৪২ সালে রাঙাকাকাবাবুর বই ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগলের ইতালীয় অনুবাদ প্রকাশিত হয়—ইতালির ভারত-বন্ধুদের উদ্যোগে এটা সম্ভব হয়েছিল। 

ইতালি সফর সেরে আমরা যাব সুইট্‌জারল্যাণ্ডে। ইউরোপে ট্রেনে চেপে এক দেশ থেকে আর এক দেশে যেতে বেশ মজা লাগে, যদিও দূরত্ব বেশি নয়। সীমান্ত পেরোবার সময় রক্ষী ও পুলিশের কথাবার্তা, পোশাক-আশাক, আচার-ব্যবহার সব বদলে যায়, তারা ট্রেনের ভিতরে এসে কাগজপত্র দেখে, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, বিদেশী হলে একটু বেশি খুঁটিয়ে দেখে। উত্তর ইতালির যে অঞ্চল দিয়ে আমরা সুইট্‌জারল্যাণ্ড ঢুকলাম সেটি খুবই সুন্দর—লেক, পাহাড় আর লম্বা-লম্বা সুড়ঙ্গ। সুইট্‌জারল্যাণ্ডের ছোট-ছোট গ্রাম ও শহরগুলিও ছবির মতো। 

সুইটজারল্যাণ্ডে আমরা প্রথমেই গিয়ে নামলাম জুরিখে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এ. সি. এন. নাম্বিয়ার। রেল স্টেশনের উল্টো দিকেই একটি হোটেলে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। নাম্বিয়ার প্রায় সারা জীবনই ইউরোপে কাটিয়েছেন। সেই বিশ দশকে যখন বাবা দেশবন্ধুর কাগজে ‘ফরওয়ার্ড’-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর তখন নাম্বিয়ারকে খুঁজে বের করে ঐ কাগজের ইউরোপের প্রতিনিধি করেছিলেন। সেই সময় থেকে অনেকগুলি ভারতীয় কাগজে তিনি ইউরোপীয় রাজনীতি সম্বন্ধে অনেক লিখেছেন। পরে রাঙাকাকাবাবু ও জওহরলাল যখন ইউরোপে যান তখন এই দুজনের সঙ্গে নাম্বিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জার্মান ভাষার উপর তাঁর দখল অসাধারণ। এত সুন্দর করে কথাবার্তা বলেন এবং নানা ছোট বা বড় ঘটনার এত চমৎকার বিবরণ দেন যে, মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। তাঁকে পেয়ে আমরা সকলেই খুব খুশি। যুদ্ধের সময় ইউরোপে আজাদ হিন্দ আন্দোলনে রাঙাকাকাবাবুর পরেই ছিল নাম্বিয়ারের স্থান। ফ্রি ইণ্ডিয়া সেন্টার, ফ্রি ইণ্ডিয়া লিজন বা ফৌজ এবং জার্মান ও ইতালিয়ান সরকারের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর আলাপ-আলোচনা সম্বন্ধে অনেক ভিতরের অজানা খবর নাম্বিয়ার বাবাকে ও আমাদের শোনাতে লাগলেন। 

ছাত্রদের সম্বন্ধে বাবার একটা দুর্বলতা ছিল। বিদেশে যেখানেই যেতেন প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রদের খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে মেলামেশা, খাওয়া-দাওয়া করতেন। জুরিখে বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য বেশ কয়েকজন ভারতীয় ছাত্র ছিলেন। তাঁরা সকলেই এসে পড়লেন। সকলে মিলে হৈ-হৈ করতে করতে আমাদের সুইত্জারল্যাণ্ড সফর বেশ ভালভাবেই শুরু হল। 

জুরিখ সুইট্‌জারল্যাণ্ডের পূব দিকের প্রধান শহর। ঐ অঞ্চলের লোকেরা জার্মান ভাষা বলে। রাজধানী বার্ন-এর এলাকাও জার্মান ভাষাভাষীর। পশ্চিমের সুন্দর শহর জেনিভা অঞ্চলে ফরাসি ভাষা চলে, আর দক্ষিণে চলে ইতালিয়ান। তাছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের আর একটি ভাষাও আছে। দেশটি ছোট হলেও সুইস্রা ছোটবেলা থেকেই দুটি বা তিনটি ভাষা শিখে ফেলে ও বলে। সরকারি কাজকর্মও তিনটি ভাষায় চালানো হয়। আমরা ভারতীয়রা ভাষা ভালই শিখতে পারি। যে সব ভারতীয় ছাত্রর সঙ্গে ইউরোপের নানা দেশে আমাদের আলাপ হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বিদেশী ভাষা বেশ ভালই রপ্ত করে নিয়েছিলেন।

জুরিখ থেকে বার্নে গিয়ে দেশের কনসুলেটে কর্মরত অনেকের সঙ্গে আলাপ হল। নাম্বিয়ার তো ছিলেনই, আর ছিলেন রাষ্ট্রদূত ধীরুভাই দেশাই। সোলি বাটলিওয়ালা, আজাদ হিন্দ রেডিওর বালকৃষ্ণ শৰ্মা, পণ্ডিত ভট্ট প্রমুখ। শর্মার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হতেই চমকে গেলাম। মনে পড়ে গেল যুদ্ধের সময় আজাদ হিন্দ রেডিওতে তাঁর কণ্ঠস্বর কত শুনেছি। নাম্বিয়ার তো তাঁর কাহিনী বলেই চলেছেন, এখন তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন বিনয়ী, স্বল্পভাষী শ্রীশর্মা। ইউরোপে যুদ্ধের সময় রাঙাকাকাবাবুর কাজকর্মের বেশ একটা সম্পূর্ণ ছবি তাঁরা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। তাছাড়া এঁদের কাছ থেকে বাবা আমাদের ভিয়েনার কাকিমা ও অনীতা সম্বন্ধে অনেক খবর পেলেন এবং উদ্‌গ্রীব হয়ে সব শুনলেন। 

জুরিখে বাবার একটা বেশ নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হল। দেশের যুবকদের ‘এয়ার-মাইনডেড’ করার উদ্দেশ্যে এক উৎসাহী ভদ্রলোক গ্লাইডার ওড়ানো দেখাতে নিয়ে গেলেন। সুইটজারল্যাণ্ডের শ্রেষ্ঠ বা চ্যাম্পিয়ন গ্লাইডার পাইলট আমাদের জন্য এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। গ্লাইডার প্লেনগুলি ঠিক এরোপ্লেনের মতোই তৈরি, তবে তার মধ্যে কোনো এঞ্জিন নেই এবং ওজনেও খুব হাল্কা। দড়ি দিয়ে জোরে টেনে এক প্রস্থ দৌড় করিয়ে বাতাসের সাহায্যে গ্লাইডারটিকে আকাশে তুলে দেওয়া হয়। চালক আকাশে খানিকক্ষণ ঘোরাফেরা করে সেটাকে কৌশলে ধীরে ধীরে নামিয়ে নিয়ে আসেন। এরোপ্লেন চালানো শেখাতে গ্লাইডার চালানো খুবই সাহায্য করে, তাছাড়া যুবকদের পক্ষে এটা একটা ভাল স্পোর্ট হতে পারে। বাবার তো সবেতেই উৎসাহ, বললেন তিনিও গ্লাইডারে উড়বেন। বাবাকে প্যারাসুট সমেত লাইফ-বেল্ট পরিয়ে চ্যাম্পিয়ন পাইলট তো বাবাকে নিয়ে আকাশে উঠে গেলেন। আমাদের তো চিন্তাই হচ্ছিল। যাই হোক, বাবার গ্লাইডার ফ্লাইং নির্ঝঞ্ঝাটে সম্পন্ন হল। 

বরফে ঢাকা কয়েকটি পর্বত ভ্রমণের পরে আমরা জেনিভায় পৌঁছলাম। জেনিভায় নানা দ্রষ্টব্য ছাড়াও আমরা রাষ্ট্রসঙ্ঘের দফতর দেখতে গেলাম। বিরাট প্রাসাদটি যুদ্ধের আগে ছিল লিগ অব নেশনস্-এর সদর দফতর। তিরিশের দশকে রাঙাকাকাবাবু ভারতের স্বাধীনতার দাবি পেশ করবার জন্য লিগ অব নেশনস্-এর দরজায় দরজায় ধর্না দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছু ফল হয়নি। বড়-বড় রাষ্ট্রগুলি তাঁদের নিজেদের স্বার্থরক্ষা ও ঝগড়াঝাটি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। 

সুইট্‌জারল্যাণ্ড সফরের শেষ পর্যায়ে আমরা জুরিখে ফিরে এলাম। সেখান থেকে আমরা চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ যাব। 

৭১

সুইট্‌জারল্যাণ্ড থেকে আমাদের চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে যাবার কথা। তিরিশের দশকে রাঙাকাকাবাবু কয়েকবার চেকোস্লোভাকিয়া গিয়েছেন। কার্লসবাদে চিকিৎসার জন্য থেকেছেন। তাছাড়া ঐ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর বেশ অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। সেই সময়কার চেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে রাষ্ট্রপতি বেনেশের সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েকবার আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। ১৯৩৪-এ প্রাগে ভারত-চেক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রাঙাকাকাবাবু ছিলেন অন্যতম। প্রাগের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ভারতপ্রেমিক অধ্যাপক লেসনি তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। খবর পাওয়া গেল যে, অধ্যাপক লেসনি ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরপদে এখনও আছেন। বাবা তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করবার জন্য খুবই উদ্‌গ্রীব ছিলেন। 

জুরিখ থেকে এরোপ্লেনে আমরা প্রাগ পৌঁছলাম। প্রাগ এয়ারপোর্টে আমাদের পাশপোর্ট পরীক্ষা ও জিনিসপত্র তল্লাসি করতে গিয়ে সেখানকার পুলিশ দিশেহারা হয়ে পড়ল। আমাদের অনেকক্ষণ আটকেও রাখল। তিন মহিলার বাক্সে এতগুলো শাড়ি দেখে তারা কেবলই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল এবং বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, এত লম্বা লম্বা-কাপড় এনেছেন কেন, এগুলো দিয়ে কী হবে? 

প্রাগের একটি পুরানো কিন্তু ভাল হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা ছিল। শহরে ঢুকে পথে চোখে পড়ল এখানে-ওখানে বিশাল বিশাল ছবি আর লাল পতাকা ও ফেস্টুনের ছড়াছড়ি। ঐ বছরেরই গোড়ার দিকে কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসেছে। সেজন্য পার্টির প্রধানের মুখ বড় বড় করে শ্লোগান সমেত জনসাধারণকে দেখানো হচ্ছে। ইতালি ও সুইট্‌জারল্যাণ্ডের পর খাওয়া-দাওয়ার দৈন্য ও অব্যবস্থা দেখে আমরা দমে গেলাম। তাছাড়া সাধারণভাবে আমরা লক্ষ করলাম যে, লোকজন বড় একটা হাসে না এবং কথাবার্তাও বেশি বলতে চায় না। এমনিতেই কনকনে ঠাণ্ডা। তার উপর লোকজনের, এমনকী হোটেলের কর্মীদেরও ঠাণ্ডা ব্যবহার! ‘সাইট-সিয়িং’ করতে গিয়েও নজর করলাম, সরকারি গাইডরাও যেন কেমন নিরুৎসাহ, দায়সারা মতন করে নিজের কর্তব্য করে যাচ্ছে। ইতালির গাইডরা ছিল প্রাণোচ্ছল। ঐতিহাসিক সব জায়গা দেখাতে তাদের কী উৎসাহ, তাদের কথাবার্তায় ভাবভঙ্গিতে দর্শকেরা মুগ্ধ। 

তিরিশের দশকে রাঙাকাকাবাবু যখন চেকোস্লোভাকিয়ায় ছিলেন তখন সব দিক দিয়েই তিনি বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন। প্রথমত, ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঐ দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনুভূতি; দ্বিতীয়ত, ও দেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ভারতের ইতিহাস ও কৃষ্টির প্রতি গদ্ধা; তৃতীয়ত, শিল্প ও প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে চেকদের কৃতিত্ব; চতুর্থত, মানুষের সেবায় ও স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য প্রকৃতিকে কাজে লাগানোর সার্থক প্রচেষ্টা—যেমন কার্লসবাদে চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাঙাকাকাবাবু বেশি কাউকে না জানিয়ে প্রাগে গিয়েছিলেন। নাম্বিয়ারকে তিনি বলেছিলেন,ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের চেহারা তো তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। নাৎসিরা অধিকৃত দেশে কী ধরনের আচরণ করে তিনি নিজের চোখে দেখতে চান। দেখে তিনি গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন এবং ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। বলেছিলেন পরদেশগ্রাসী শাসকদের চেহারা একই। চেকোস্লোভাকিয়ার জার্মান অধিকর্তা আমাদের দেশের ইতিহাসে লর্ড ক্লাইভেরই প্রতিরূপ। 

যাই হোক, আগে থেকে যোগাযোগ করে বাবার সঙ্গে আমরা এক সকালে প্রাগের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে উপস্থিত হলাম। প্রোফেসর লেসনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শ্রদ্ধা করবার মতো প্রবীণ, বিদ্বান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভদ্রলোক। বহু বছর আগে শান্তিনিকেতনে তিনি বেশ কিছুদিন কাটিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুরাগী ও বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে জ্ঞানী-গুণী যেসব ব্যক্তিকে শান্তিনিকতনে ডেকে এনেছিলেন জ্ঞান ও কৃষ্টির এক বিশ্বমেলা বা বিশ্বভারতী স্থাপনের জন্য, লেসনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র আমাদের দেশ সম্বন্ধে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলেন। এমনকী মহেঞ্জোদারোয় নতুন কী কী আবিষ্কৃত হল, প্রাচীন লিপির মানে খুঁজে পাওয়া গেছে কিনা—তিনি জানতে চাইলেন। বাবা সব প্রশ্নের জবাব খুঁজেও পাচ্ছিলেন না। তবে প্রোফেসর লেসনিকে আশ্বাস দিলেন যে, দেশে ফেরার পর তাঁকে বিস্তৃতভাবে সব জানাবেন। 

লেসনির কথাবার্তা থেকে বেশ বোঝা গেল রাঙাকাকাবাবুকে কী স্নেহের চোখে তিনি দেখতেন। এর একটা বিশেষ কারণও খুঁজে পাওয়া গেল। চেকোস্লোভাকিয়া অধিকার করার পর জার্মানরা অধ্যাপক লেসনিকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর পরিবারের ধারণা হয়েছিল যে, তাঁকে কোনো উপায়ে মুক্ত করতে না পারলে তিনি বাঁচবেন না। সুভাষচন্দ্র বসু বার্লিনে আছেন খবর পেয়ে লেসনি-পরিবার তাঁর কাছে চিঠি দিলেন। তিনি জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ-বিষয়ে যেন কথাবার্তা বলেন। চিঠি পাঠাবার কিছুদিন পরেই প্রোফেসর লেসনি মুক্তি পান। তাঁর পরিবারের লোকেরা আজও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে একথা স্মরণ করেন। 

হোটেলে এক সন্ধ্যায় আমরা খেতে যাবার তোড়জোড় করছি। এক ভারতীয় ভদ্রলোক এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বাবাকে বললেন, তিনি সাংবাদিক, ১৯৪৬-এ তাঁর তাইওয়ান দ্বীপে যাবার সুযোগ হয়েছিল। তিনি সেখানে রাঞ্জ কাকাবাবু সম্বন্ধে যা-কিছু জানতে পেরেছেন বাবাকে জানাতে চান। আরও বললেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের কাছে তিনি তাঁর রিপোর্ট পেশ করেছেন। সর্দারজি তাঁকে বলেছেন সুযোগ পেলেই তিনি যেন বাবাকে সব কথা জানান। নাম হারীন শাহ। বাবা তাঁকে ডিনারের পর তাঁর ঘরে আসতে বললেন। আমাকে বললেন আমি যেন সেই সময় উপস্থিত থাকি। বেশ অনেকক্ষণ ধরে হারীন শাহ ১৯৪৫-এর আগস্ট মাসে তাইপের বিমান-দুর্ঘটনার খুঁটিনাটি বলে গেলেন। বোঝাই গেল ভদ্রলোক বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন এবং মনে করেন যে তিনি এ-বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, ঐ কাহিনী শুনতে বাবার খুবই কষ্ট হচ্ছিল। মুখ থমথমে ও লাল হয়ে গিয়েছিল। তবে যে-কোনো কারণেই হোক বাবা হারীন শাহকে বিশেষ কোনো প্রশ্ন বা জেরা করেননি। আমিও কোনো প্রশ্ন ভুলিনি। কথা শেষ করে ভদ্রলোক বিদায় নেবার পর বাবা স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি কী আর বলি। একটু ভেবে নিয়ে বললাম, যত সব সাজানো গল্প। আজগুবি কথা। আপনি শুয়ে পড়ন। বাবা সেই রাতে ঘুমিয়েছিলেন কিনা জানি না। আমার মাথাও অনেকক্ষণ ধরে ঝিমঝিম করেছিল। 

প্রাগ থেকে আমরা যাব ভিয়েনায়, বাবা-মার ইউরোপ সফরের প্রধান গন্তব্যস্থান বসুবাড়ির শিরোমণি শরৎচন্দ্রের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সহধর্মিণী ও শিশুকন্যার প্রথম দেখা হবে। আমাদের সকলের মন গভীর আবেগ ও চাপা বেদনায় ভরা। আমাদের প্লেন যখন ভিয়েনায় পৌঁছল তখন বেশ সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কথাই ছিল আমাদের কাকিমা এয়ারপোর্টে আসবেন না। এয়ার টারমিনালে বা এয়ারলাইনের শহরের অফিসে অপেক্ষা করবেন। ভিয়েনায় পৌঁছেই আমাদের সকলের একই চিন্তা—এই প্রথম সাক্ষাৎটি কেমন হবে। আমি তো প্লেন থেকে নামার সময় অন্যমনস্ক হয়ে বাবার দেওয়া নতুন ক্যামেরাটি ফেলে চলে এলাম। বাসে চেপে অন্ধকারের মধ্যে এয়ারপোর্ট থেকে এয়ার টারমিনালে পৌঁছতে যেন অনেকক্ষণ কেটে গেল। এয়ার টারমিনালের হলে ঢুকতেই আশ্চর্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, শান্ত ও স্নিগ্ধ চেহারার ছোটখাটো এক ইউরোপীয় মহিলা ধীর পদক্ষেপে বাবার দিকে এগিয়ে এলেন। পরিচয় করিয়ে দেবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। পরস্পরকে ছবিতে তো দেখাই আছে। প্রথমেই তিনি খুব নম্রতার সঙ্গে একখানি খাম বাবার হাতে দিলেন। তার মধ্যে ছিল ১৯৪৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবাকে লেখা রাঙাকাকাবাবুর মূল চিঠিটি। চিঠিটি একবার দেখে নিয়েই বাবা বুকের পকেটে সেটি রাখলেন। চিঠির প্রতিলিপি বাবা অনেক আগেই পেয়েছিলেন, খুঁটিয়ে পড়বার কোনো প্রয়োজন ছিল না। দুজনেই পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন, তারপর কম কথায় কুশল-বিনিময় হল। বসুবাড়ির দুই বধূ কথা না বলে পরস্পরের হাত ধরে রইলেন। তাঁদের মনের কথা মনেই রয়ে গেল। বাবা অনীতার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, আশা করছিলেন তাকেও সেইদিনই দেখতে পাবেন। শুনলেন সাগরপার থেকে তার আত্মীয়রা আসছেন শুনে সে খুবই উত্তেজিত হয়ে আছে। কাকিমা আমাদের দিকে ঘুরে এসে এমনভাবে কথা বললেন যেন পরিচয় অনেক আগেই হয়ে গেছে। বাবার দিকে ইঙ্গিত করে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ইট্ ইজ্ হি প্লাস টেন ইয়ার্স!’ ততক্ষণে আমার খেয়াল হয়েছে ক্যামেরাটি প্লেনে ফেলে এসেছি। টেলিফোনে এয়ারপোর্টে যোগাযোগ করা হল, কোনো ফল হল না। 

হোটেলে পৌঁছে পরের দিনের প্রোগ্রাম ঠিক হল। হোটেলটি ভিয়েনার কেন্দ্রে। আমাদের যেতে হবে শহরের উত্তর প্রান্তে, যেখানে একটি ছোট ফ্ল্যাটে অনীতা তার মা ও দিদিমার সঙ্গে থাকে। পরের দিন সকালবেলাটা বিশ্রামের জন্য রইল। দুপুরে আমরা সকলে মিলে কাকিমার বাড়িতে যাব! অনীতাকে তিনি প্রস্তুত করে রাখবেন। 

সেই রাতে তাঁকে একলা বাড়ি ফিরতে হবে ভেবে বাবা ব্যস্ত হলেন। যদিও যুদ্ধের পর তিন বছর কেটে গেছে, পথঘাটের নিরাপত্তা সম্বন্ধে নানা কথা তখনও শোনা যেত। ভিয়েনা শহরটিকে চার ভাগ করে চারটি শক্তি আমেরিকা, রাশিয়া, ইংলণ্ড ও ফ্রান্স দখল করে রেখেছে। দখলকারীরাই সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। ভিয়েনাবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অনেক অসুবিধা। তবে এই শান্ত ও শক্ত মহিলাটি তো গত পাঁচ বছর একলাই এক গুরুভার বহন করে এসেছেন। তাঁর পক্ষে একলা বাড়ি ফিরে যাওয়াটা এমন কী বড় কথা! 

৭২

ভিয়েনার অ্যাসটোরিয়া হোটেলে আমার মা এমিলি-কাকিমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসুবাড়ির বধূরূপে বরণ করে নিলেন। বাবার সঙ্গে আলোচনা করেই ব্যাপারটা হয়েছিল। নিজের একটি ভাল বেনারসি শাড়ি তাঁকে উপহার দিলেন এবং নিজের হাত থেকে কয়েক গাছা সোনার চুড়ি খুলে ওঁর হাতে পরিয়ে দিলেন। 

ভিয়েনা পৌঁছবার পরের দিন আমরা সকলে অনিতাকে দেখতে যাব ঠিক ছিল। কাকিমা ঘর-বাড়ি গুছিয়ে নেবার জন্য কিছু সময় নিয়েছিলেন এবং সে-জন্য সকালে অনিতাকে এক প্রতিবেশী বন্ধুর বাড়িতে রেখেছিলেন। আমরা যখন ট্যাক্সি করে কাকিমার ফ্ল্যাটে পৌঁছলাম তখনও অনিতা বাড়ি ফেরেনি। বাবাকে দেখে তো অনিতার দিদিমা কাঁদতে লাগলেন। তিনি ইংরেজি বলেন না। পরে বুঝলাম, বাবার সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর চেহারার সাদৃশ্য দেখে তিনি খুবই অভিভূত হয়েছিলেন এবং অন্তরের ব্যথা চেপে রাখতে পারেননি। কিছুক্ষণ পরে দু-বছরের অনিতা লাফাতে-লাফাতে বাড়ি ফিরে এল। তাকে বলা ছিল যে, সাগরপার থেকে তার জ্যাঠামশাই, জ্যাঠাইমা ও ভাই-বোনেরা এসেছেন। সলজ্জ ভঙ্গিতে হাসিমুখে সে একে-একে সকলের সঙ্গে আলাপ করল। বাবার মুখের দিকে সে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। বাবা যখন তাকে আদর করছিলেন মনে হচ্ছিল, সে যেন জীবনে হঠাৎ নতুন কিছুর স্বাদ পেয়েছে। 

অনিতার মুখ ও হাসির মধ্যে আমরা সকলেই রাঙাকাকাবাবুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম। সে তখনও ইংরেজি বলে না। জার্মান ভাষায় সে ক্রমাগতই নানারকম প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। কাকিমা সে-সব প্রশ্ন করে আমাদের ইংরেজিতে তর্জমা করে দিচ্ছিলেন। আমাদের উত্তরগুলো আবার জার্মান ভাষায় অনিতাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। 

অনিতার দিদিমা ছিলেন ঠিক আমাদের দেশের ঠাকুমা-দিদিমাদেরই মতো অতিথি-বৎসল। ক্রমাগতই আমাদের নানাভাবে আপ্যায়ন করার চেষ্টা, বারে বারেই খাবার ও কফি পরিবেশন। তাঁর হাতের রান্না ছিল চমৎকার এবং সকলকেই খাইয়ে তাঁর কী আনন্দ। আমরা না বুঝলে কী হবে, জার্মান ভাষায় অনর্গল তিনি কিছু না কিছু বলে যাচ্ছিলেন। 

ভিয়েনা ঘুরে দেখবার সময় কাকিমা • আমাদের সঙ্গী। সারাদিন ঘুরে বেড়ানো, এখানে-ওখানে খাওয়া আর কত কথা! ভিয়েনা ছিল রাঙাকাকাবাবুর প্রিয় শহর। তিরিশের দশকে তিনি ভিয়েনায় অনেকদিন কাটিয়েছেন, এখানেই তাঁর অপারেশন হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা হল যে, ভিয়েনায় বসেই তিনি তাঁর বই ‘ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগল’ লিখেছেন। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি একজনকেই নাম করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন—’ফ্রয়েলাইন ই শেঙ্কল’। যুদ্ধের সময়ও তিনি ভিয়েনায় এসেছেন। ১৯৪২-এর ডিসেম্বরে তিনি শেষবার এসেছিলেন, অনিতা তখন নবজাত শিশু। অনিতা খানিকটা বড় হয়ে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেছে, কেন তিনি তাদের ফেলে চলে গেলেন। বড় হয়ে এর উত্তর সে পেয়েছে। 

ঠিক হল, অনিতার জন্মদিনে আমাদের এক গ্রুপ ফোটো তোলা হবে। আরও ঠিক হল যে, ১৯৩৪ সালে যে স্টুডিওতে রাঙাকাকাবাবুর ছবি তোলানো হয়েছিল সেই স্টুডিওতেই আমরা ছবি তোলাব। জায়গাটা খুঁজে পাওয়া গেল এবং আমাদের ইচ্ছাও পূর্ণ হল! দুটি তারিখের আশ্চর্যরকম মিল পাওয়া গেল। রাঙাকাকাবাবু ‘ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগল’ গ্রন্থের ভূমিকায় তারিখ বসিয়েছেন ভিয়েনা ২৯ নভেম্বর। অনিতার জন্ম ভিয়েনায় ২৯ নভেম্বর। 

ভিয়েনায় বসে ঘোরাফেরার মধ্যেও বাবা কাকিমা ও অনিতার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে গভীর ভাবে চিন্তা করছিলেন এবং তারই মধ্যে কাকিমার মনের কথা জেনে নেবার চেষ্টা করছিলেন। মোটামুটিভাবে ঠিক হয়েছিল যে, বাবা তাঁদের দেশে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবেন এবং ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হলে তাঁদের নিয়ে আসবেন। দেশে ফেরার পরে বাবা এ-বিষয়ে কিছুদূর অগ্রসরও হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর অকাল-মৃত্যু সব পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পরে কাকিমাও ভারতে আসার ইচ্ছা ত্যাগ করেছিলেন এবং সম্পূর্ণভাবে স্বাবলম্বী থেকে অনিতাকে বড় করে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। 

বসুবাড়ির এক পুরনো বন্ধু শ্রীমতী হেডি ফুলপ-মিলার ভিয়েনায় বাসিন্দা। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতায় আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন। আমরা সকলে মিলে ভিয়েনায় রাশিয়ান অধিকৃত এলাকায় তাঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁর প্রকাণ্ড বসার ঘরের একাংশ ভারতীয় কায়দায় সাজানো। আমাদের দর্শন ও সঙ্গীতে তাঁর গভীর অনুরাগ। রাঙাকাকাবাবু ও দিলীপকুমার রায় তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। ঐ দুজনের সম্বন্ধে তাঁর কত স্মৃতি, অনেক কথা বলেন কিন্তু কথা ফুরোয় না। ভিয়েনার বিখ্যাত সার্জেন প্রফেসর ডেমেল, যিনি ১৯৩৫-এ রাঙাকাকাবাবুর ওপর অপারেশন করেছিলেন, তাঁকে খুঁজে বের করা হল। তিনি খুব গর্বের সঙ্গে ‘ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগল’-এর একটা কপি আমাদের দেখালেন যেটা রাঙাকাকাবাবু তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। জার্মানির ‘ফ্রি ইণ্ডিয়া লিজন’ বা আজাদ হিন্দ ফৌজের এক প্রাক্তন অফিসার ডাক্তার মদন ভিয়েনায় আমাদের খুব দেখাশুনো করেছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন চক্ষুরোগ-বিশেষজ্ঞ, তাঁর শিক্ষক ও ভিয়েনার সবচেয়ে নামকরা বিশেষজ্ঞ প্রোফেসর পিলাটকে দিয়ে তিনি বাবার চোখ পরীক্ষা করিয়ে দিয়েছিলেন। 

তিরিশের দশকে রাঙাকাকাবাবু ভিয়েনায় ভারত-অস্ট্রিয়া সোসাইটি গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঐ সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। সেই সময়কার রাঙাকাকাবাবুর এক পুরনো বন্ধু অটো ফাটিস বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। যুদ্ধের সময়ও তিনি জার্মান সরকারের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনায় সাহায্য করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে বাবা ভিতরকার কিছু-কিছু খবর সংগ্রহ করেছিলেন। পরে ফালটিসসাহেব রাঙাকাকাবাবু সম্বন্ধে ঐতিহাসিক কিছু দলিলপত্র ও ছবির একটি সংগ্রহ দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানায় দান করেন। 

একদিন সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে দুই বোনের সঙ্গে একটু বেড়াচ্ছি, এমন সময় লম্বাচওড়া এক ইউরোপীয় ভদ্রলোক এগিয়ে এসে হিন্দুস্থানিতে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করে দিলেন। আমাদের পরিচয় পেয়ে তো তিনি আমাদের ছাড়বেন না, হোটেলে এসে বাবার সঙ্গে আলাপ করলেন। তিনি আসলে অস্ট্রিয়ান। নাম ফিশার, কিন্তু দাবি করতেন যে, তিনি ভারতীয়। নাম নিয়েছিলেন রামচন্দ্র শর্মা। এক অদ্ভুত চরিত্র। নানা ভাষার ওপর তাঁর আশ্চর্য দখল, একটার পর একটা ভাষা অনায়াসে বলে যেতে পারেন। তাছাড়া ভারতীয় দর্শন ও শাস্ত্রের প্রতি তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা। তিনি তো আমাদের সঙ্গে লেগেই রইলেন। পরে ভারতে এসে তিনি সন্ন্যাস নেওয়া ঠিক করেন এবং আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এসে মা’র কাছে আশ্রমবাসী হবার আগে গৃহীর শেষ খাওয়া খেয়েছিলেন। ভদ্রলোকের ইতিহাসটি আরও কৌতূহলোদ্দীপক। যুদ্ধের সময় ভারতীয় বলে দাবি করে সব বাধা অতিক্রম করে তিনি ‘ফ্রি ইণ্ডিয়া লিজন’-এ যোগ দেন। ধরা পড়ার পরে তিনি ইংরেজদেরও বেশ বোকা বানিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় না ভারতীয় নন এই সমস্যার সমাধান করতে ইংরেজরা হিমসিম খেয়েছিলেন। 

কয়েকদিন খুব আনন্দে কাটাবার পরে আমাদের ভিয়েনা ছাড়বার দিন এগিয়ে এল। কিন্তু পারিবারিক ক্ষেত্রে এক নতুন যে যোগসূত্র স্থাপিত হল তা চিরকালের হয়ে রইল। দূরদেশের ঐ ছোট্ট বোনটি আমাদের সকলের হৃদয় জয় করে নিল। আমাদের সকলেরই ইচ্ছা অচিরেই যেন আমরা বোনটিকে কাছাকাছি পাই। ঐ আশা মনে ধরে আমরা এক সকালে ভিয়েনা থেকে রেলপথে প্যারিস রওনা হলাম। 

ভিয়েনা ডাক্তারি-শিক্ষার এক পীঠস্থান। রাঙাকাকাবাবু একটা কথা প্রায়ই বলতেন। তিনি বলতেন, ভারতীয় ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত যায়, তাদের একটা ভুল ধারণা আছে যে, বহির্বিশ্ব মানেই নাকি ইংল্যাণ্ড। তিনি চাইতেন, ভারতীয় ছাত্ররা ইউরোপের অন্যান্য দেশে গিয়ে যেন আসল ইউরোপীয় কৃষ্টির স্বাদ নেয়। আমি ঠিক করেছিলাম যে, বিদেশে আমার শিক্ষার অন্তত অর্ধেকটা আমি ইউরোপের কোনো দেশে কাটাব। যখন দেখলাম যে, ভিয়েনায় আমাদের ঘর আছে তখনই ঠিক করলাম ভিয়েনার বিশ্ববিখ্যাত শিশু-হাসপাতালে কিছুদিন আমি শিক্ষাগ্রহণ করবই। বাবা-মা ইংল্যাণ্ডে আমাকে রেখে দেশে ফিরে গেলেন এবং প্রবাসের প্রথম বছরটা আমার সেখানেই কাটল! পরের বছরটা যাতে আমি সুইট্‌জারল্যাণ্ড এবং অস্ট্রিয়ায় শিক্ষানবিশি করতে পারি তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। 

আমার ইচ্ছা পূর্ণ হল ১৯৫০ সালে যখন আমি ভিয়েনা অ্যাকাডেমি অব মেডিসিন-এ ভর্তি হলাম। ছোট্ট অনিতার সঙ্গে আমার একটা চুক্তি হয়েছিল—আমি ইংল্যাণ্ডে বসে জার্মান ভাষা শিখে নেব এবং সে ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত করে নেবে। মোটামুটিভাবে আমি জার্মান শিখতে পেরেছিলাম কিন্তু অনিতার কাছে আমি হেরে গেলাম। কয়েক মাসের মধ্যেই সে আমাকে ইংরেজিতে চিঠি লিখতে আরম্ভ করল। 

৭৩

ভিয়েনা থেকে প্যারিস ট্রেনে চব্বিশ ঘণ্টার পথ। ইউরোপের একটা বিখ্যাত ট্রেন ছিল ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস। যুদ্ধের আগে প্যারিস থেকে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুল পর্যন্ত পাড়ি দিত। এখন ভিয়েনার পর আর যায় না। এক সকালে আমরা ঐ ট্রেনে ভিয়েনা থেকে রওনা হলাম। ভিয়েনাতে আমাদের মালপত্র অসম্ভব রকম বেড়ে গিয়েছিল। শৌখিন সব রকম জিনিসপত্রে বাবার খুব শখ। খবর পেলেন যে ভিয়েনার কোনো এক নবাব-পরিবারের অতি উৎকৃষ্ট চিনামাটির বাসনপত্র বিক্রি হচ্ছে। দেখে পছন্দ হয়ে গেল এবং বাসনের এক বিরাট বহর কিনে ফেললেন। ভিয়েনাতে সেগুলি একসঙ্গে প্যাক করানো সম্ভব হল না। সুতরাং অসংখ্য বাক্সে সেগুলি ভরে নিয়ে আমরা ট্রেনে চাপলাম। পুরো যাত্রাটা আমরা সকলে বাক্স-পরিবৃত হয়ে রইলাম, মাথার ওপরে পায়ের নীচে দু’পাশে কেবলই বাক্স। প্যারিস পৌঁছে বাসনপত্রগুলি জাহাজে করে দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা হল। 

প্যারিস ইউরোপের প্রথম সারির শহরগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে অনেকে মনে করেন—ইতিহাসে, ভাস্কর্যে, শিল্পে, সঙ্গীতে ও সাহিত্যে। ভিয়েনা ও প্যারিসের ঐতিহাসিক মিউজিয়ামগুলি দেখার পরই কলকাতায় ঐ ধরনের মিউজিয়াম গড়ে তোলার স্বপ্ন আমি দেখতে আরম্ভ করি। বিশেষ করে প্যারিসের কাছেই ভাসায়ে নেপোলিয়নের জিনিসপত্রের সংগ্রহশালা দেখে আমি খুবই প্রভাবিত হয়েছিলাম। 

প্যারিসের মতো ঐতিহ্যপূর্ণ শহরে ‘সাইট-সিয়িং’ করতে করতে বেশ ইতিহাস পড়া হয়ে যায়। আমাদেরও তাই হল। তাছাড়া আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অনেক সূত্র ধরে আমরা খোঁজখবর করতে লাগলাম। এমন বর্ষীয়ান দু-চারজনকে পাওয়া গেল যাঁরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে আমাদের বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরে এঁরাই আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। 

ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক রোমা রোলাঁর সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর সুইট্‌জারল্যাণ্ডে দেখা হয় ১৯৩৫ সালে। রোলাঁ ছিলেন সাধক প্রকৃতির লোক এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসে ও দর্শনে ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। তিনি ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবনী লিখেছিলেন। তিরিশের দশকে যে কয়েকজন ইউরোপীয় মনীষীর সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর হৃদ্যতা হয়েছিল তাঁদের একজন ছিলেন রোলাঁ। বাবাও ছিলেন রোলাঁর ভক্ত। মনে আছে, রোলাঁর লেখা খানদুয়েক বই কার্শিয়ঙে অন্তরীণ থাকার সময় তিনি আমাকে পড়িয়েছিলেন। 

খবর পাওয়া গেল রোলাঁর স্ত্রী প্যারিসে আছেন। বাবার সঙ্গে আমরা একদিন তাঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলাম। তিনি বললেন যে, রোলাঁ নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন এবং সেগুলি সযত্নে রাখা হয়েছে, ভাল করে সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হবে। বছর কয়েক বাদে রোমে রোলাঁর ডায়েরি বইয়ের আকারে প্রকাশিত হলে দেখলাম, রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা তিনি খুব সুন্দর করে লিখে রেখেছেন। এক প্রবীণ ইউরোপীয় চিন্তাবিদ ভারতের জাতীয় আন্দোলনের কনিষ্ঠতম নেতাকে কী চোখে দেখেছিলেন সেটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। সুভাষচন্দ্রকে তাঁর মনে হয়েছিল গভীরভাবে চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান—তাঁর বই পড়ে রোলাঁর আগেই এই ধারণা হয়েছিল। রোলাঁর মতে রাঙাকাকাবাবু তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনীতিবিদ যিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ঘটনাপ্রবাহ বিচার করতে পারেন। রাঙাকাকাবাবু তাঁকে খোলাখুলিভাবে বলেছিলেন যে, দরকার হলে তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ নিতে প্রস্তুত আছেন। আরও বলেছিলেন যে, বিশ্বযুদ্ধ ভারতকে স্বাধীনতা অর্জনের ভাল সুযোগ এনে দিতে পারে। রোমা রোলাঁর সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার ভিত্তিতে একটি প্রবন্ধ রাঙাকাকাবাবু ১৯৩৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন। 

আগে কখনও অপেরা দেখিনি। সকলে মিলে প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব মিউজিক-এ গেলাম। পৌঁছতে কিছু দেরি হয়ে গিয়েছিল। অপেরা শুরু হয়ে গিয়েছে। অপেক্ষা করতে হল। ইউরোপীয় সঙ্গীত বা নাচের অনুষ্ঠানে যখন-তখন ঢোকা যায় না। বিরতির জন্য অপেক্ষা করতে হয় যাতে অনুষ্ঠানের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। যখন অনুষ্ঠান চলতে থাকে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করে না। 

আমরা যখন প্যারিসে তখন সেখানে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশন চলছে। রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতা আঁদ্রে ভিশিনস্কি বেশ আসর গরম করে রেখেছেন। তিনি ছিলেন আইনজ্ঞ ও সুবক্তা। বাবা ওঁর বক্তৃতা শুনতে খুবই উৎসুক ছিলেন। দর্শক-টিকিটের ব্যবস্থা হল এবং আমরা সকলে মিলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশনের এক প্রস্থ শুনে এলাম। ভিশিনস্কি রুশ ভাষায় বলেছিলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি তর্জমার ব্যবস্থা ছিল। আমরা ইয়ারফোন লাগিয়ে তাঁর বক্তৃতার ইংরেজি বয়ান শুনলাম। এক নতুন অভিজ্ঞতা হল। 

প্যারিস থেকে আমরা যাব আয়ারল্যাণ্ডের রাজধানী ডাবলিনে। আয়ারল্যাণ্ডের সঙ্গে আমাদের এক বিশেষ সম্পর্ক। তাঁরা আমাদের সংগ্রাম-সাথী। একই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে তাঁরা স্বাধীন হয়েছেন। রাঙাকাকাবাবু ১৯৩৬-এর গোঁড়ায় ঐ দেশে গিয়েছিলেন। ভারত ও আয়ারল্যাণ্ডের মধ্যে নতুন করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। রাঙাকাকাবাবু দুঃখ করে বলতেন, কত ভারতীয় লণ্ডনে যায় কিন্তু ডাবলিনে যায় না। সেখানে গেলে যাঁরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন এমন সব নরনারীকে তাঁরা রক্তমাংসে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। 

.

১৯৩৬-এ রাঙাকাকাবাবু ফ্রান্স থেকেই আয়ারল্যাণ্ড গিয়েছিলেন। আমরাও সেইভাবে গেলাম। জাহাজ থেকে নেমে তিনি প্রথমেই যান কর্ক শহরে। কর্কের মেয়র টেরেন্স ম্যাকসুইনি আমাদের যতীন দাসের মতো ইংরেজদের জেলে অনশন করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। রাঙাকাকাবাবু ম্যাকসুইনির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং শহীদদের পরিবারবর্গের সঙ্গে দেখা করে তাঁর আয়ারল্যাণ্ডের সফর আরম্ভ করেছিলেন। আমাদের কর্কে যাওয়া হয়নি। কারণ, আমরা আকাশপথে গিয়ে সোজা ডাবলিনে নেমেছিলাম। ডাবলিনে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে ডি ভ্যালেরার তিনবার দেখা ও আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। ডি ভ্যালেরা তখন আয়ারল্যাণ্ডের রাষ্ট্রপতি। এক বছর আগেই তিনি রাঙাকাকাবাবুর বই ‘দি ইণ্ডিয়ান স্ট্রাগল’ পড়েছিলেন। অন্য দিকে আয়ারল্যাণ্ডের স্বাধীনতাযুদ্ধের সব কথা ও খবর রাঙাকাকাবাবুর নখদর্পণে ছিল। সুতরাং আগে দেখা না হলেও দু’জনের মধ্যে আত্মিক যোগ ছিল বলা যায়। 

ইণ্ডিয়ান-আইরিশ ইণ্ডিপেণ্ডেস্ লিগ রাঙাকাকাবাবুর সম্মানে এক বিরাট সভার আয়োজন করেছিলেন। সভানেত্রী ছিলেন ম্যাডাম গন্ ম্যাকব্রাইড। ধন্যবাদ দিতে উঠে অ্যালেক্স লিগ সুন্দর এক মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, কবে ডাবলিন শহরের কলকাতার মতো সৌভাগ্য হবে যে, ডাবলিনের মেয়রকে গ্রেট ব্রিটেনে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সেই সময় কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সুভাষচন্দ্রকে ইংল্যাণ্ডে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। 

জানুয়ারির কনকনে শীতের মধ্যে আমরা ডাবলিনে পৌঁছলাম। ইউরোপের অন্যান্য শহরের তুলনায় সেখানকার ঘরবাড়ি একটু পুরনো ধরনের বলে মনে হল, সাধারণভাবে চাকচিক্য কম। তবে লোকজনের ব্যবহার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। 

ডি ভ্যালেরা বাবার সঙ্গে ‘ডয়েল’ বা পার্লামেন্ট হাউসে দেখা করলেন। সঙ্গে আমরাও ছিলাম। অনেক কথা হল। রাঙাকাকাবাবুর কথা ডি ভ্যালেরা গভীর আবেগের সঙ্গে স্মরণ করলেন। আমি যথারীতি ছবিটবি তুললাম। তাঁর সই করা একখানা ছবি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। 

ম্যাডাম গন ম্যাকব্রাইড তাঁর বাড়িতে আমাদের চায়ের নিমন্তন্ন করলেন। আমরা আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐ মহীয়সী মহিলাকে দেখবার জন্য খুবই উদ্‌গ্রীব ছিলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে ছাত্রাবস্থায় প্যারিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ম্যাডাম গন তখন সেখানে নির্বাসনে ছিলেন। ম্যাডান গনকে দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। অনেক বয়স হয়েছে কিন্তু কথাবার্তা খুব পরিষ্কার ও তীক্ষ্ণ, চোখ দুটি উজ্জ্বল ও মুখে হাসি লেগেই আছে। মনে হল দুই বন্ধুদেশের দুই স্বাধীনতাসংগ্রামী-পরিবারের এক মিলন-অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাঁর পরিবারবর্গের মধ্যে ছিলেন শোন ম্যাকব্রাইড যিনি তখন আয়ারল্যাণ্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ম্যাডাম গনের একটি কথা মনে আছে। বলেছিলেন, দেখ, আমরা এই দুই দেশের লোক স্বাধীনভাবে সাধারণ সুখী জীবনযাপন করতে চাই। ধনদৌলতের আতিশয্য চাই না, বিলাসিতাও চাই না, এটাই বড় কথা, নয় কি? 

আয়ারল্যাণ্ডের রাষ্ট্রপতি শোন ও-কেলি বাবাকে রাষ্ট্রপতিভবনে আমন্ত্রণ জানালেন। ঠিক সেই সময়েই বাবা ডাবলিনের প্রবাসী ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের নেমন্তন্ন করে বসে আছেন। অতিথিদের স্বাগত জানাবার জন্য আমি হোটেলে থেকে গেলাম। রাষ্ট্রপতি দর্শন হল না। রাষ্ট্রপতি ও-কেলি ছিলেন এক প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা এবং রাঙাকাকাবাবুর প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল। প্রথমেই বাবাকে বললেন যে, ভারতের বসু-পরিবারের যে কোনো ব্যক্তির জন্য আয়ারল্যাণ্ডের রাষ্ট্রপতি-ভবনের দরজা সব সময়েই খোলা। রাষ্ট্রপতি নিজেই ঘুরে ঘুরে রাষ্ট্রপতি-ভবনটি দেখালেন। তিনি নিজে এক কোণে দুটি ঘর নিয়ে থাকেন, বাড়িটির বড়-বড় ঘরগুলি জুড়ে আছে একটি সংগ্রহশালা, যেখানে আয়ারল্যাণ্ডের স্বাধীনতা-যুদ্ধের বীরদের বড়-বড় ছবি সারি-সারি টাঙানো রয়েছে। 

ডাবলিনের ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আমাদের মিলন-সন্ধ্যাটি বেশ ভালই কাটল। এর পরে আমরা যাব আমাদের শেষ গন্তব্যস্থান লণ্ডনে। সকালে যখন প্লেন ছাড়ল তখন আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার কিন্তু লণ্ডনের ওপরে এসে আমরা ক্রমাগতই ঘুরপাক খেতে লাগলাম। এত ঘন কুয়াশা যে, প্লেন নামতেই পারছিল না। বাইরে এসে দেখি চারিদিক ঘন অন্ধকার ও ঝির-ঝির বৃষ্টি। এই হল লণ্ডন। 

৭৪

লণ্ডনে পৌঁছে দেখলাম বাবার মনের ভাবটা একেবারে বদলে গেছে। যেন বহুদিন পরে পুরনো ও চেনা এক জায়গায় ফিরে এসেছেন। কোথায় কী আছে, কী অবস্থায় আছে, কতটা বদলেছে, জানবার ও দেখবার জন্য কী কৌতূহল। লণ্ডনের উত্তরে হ্যাম্পস্টেড এলাকায় প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে ব্যারিস্টারি পড়বার সময় বাবা থাকতেন। সেই সময় তিনি প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন, কত যে পিকচার পোস্টকার্ড তখন মাকে পাঠিয়েছেন তার হিসাব নেই। একদিন আমাদের সকলকে নিয়ে নিজের পুরনো দিনের সেই বাসস্থান খুঁজতে বেরোলেন। আমরা খুঁজছি তো খুঁজছিই। কিছুতেই ৮৬ সাউথ হিল পার্ক-এর বাড়ি পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত পাড়ার এক ভদ্রলোক আমাদের অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন। বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে বললেন যে, ও, ঐ বাড়িটা তো যুদ্ধের সময় বোমা পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। 

লণ্ডনে আমাদের হোটেলে সব সময়েই ভিড়। সাংবাদিকরা তো আছেনই—ভারতীয় ও বিদেশী, আছেন ছাত্র-ছাত্রীর দল। তার উপরে আছেন প্রবাসী ভারতীয়রা। কেউ ডাক্তার, কেউ আইন-ব্যবসায়ী, কেউ ব্যবসায়ী। এত ভারতীয় ইউরোপের অন্য কোনো দেশে পাওয়া যায় না। তাছাড়া আছে বেশ কতকগুলি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান যেগুলি অনেকদিন ধরে ভারতের স্বাধীনতার সমর্থনে কাজ করে এসেছে। যেমন স্বরাজ হাউস, ইণ্ডিয়া লিগ, ইণ্ডিয়ান ওয়াকার্স অ্যাসোসিয়েশন, ইণ্ডিয়ান মজলিস প্রভৃতি। প্রবাসী ভারতীয় সাংবাদিকদের ছিল ইণ্ডিয়ান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। একটার পর একটা সভা হতে লাগল। একটি বড় সভায় সভাপতিত্ব করলেন প্রবীণ ইংরেজ রাজনীতিবিদ ফেনার ব্রকওয়ে, যিনি সারা জীবন ভারতবর্ষ ও সাম্রাজ্যবাদীদের পদানত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির মুক্তির জন্য লড়েছেন। বাবা তাঁর বক্তৃতায় দেশের ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশদ আলোচনা করলেন। ইণ্ডিয়ান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন একটি ভোজসভার আয়োজন করলেন। ইণ্ডিয়ান ওয়াকার্স অ্যাসোসিয়েশন ও স্বরাজ হাউসও অনুষ্ঠান করলেন। বাবা তখন দেশে একটা ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদল গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছেন। ঐ লক্ষ্য সামনে রেখে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রচার করতে লাগলেন। আমাদের হোটেলেই বিদেশী সাংবাদিকদের একটা বড় কনফারেন্স হল। বাবা প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে নানা প্রশ্নের সোজাসোজা জবাব দিলেন। প্রবাসী ছাত্রছাত্রীরা সবসময়েই বাবাকে ঘিরে থাকত, তিনিও যথাসম্ভব তাদের আপ্যায়ন করতেন। 

সেই সময় লণ্ডনে ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন কৃষ্ণ মেনন। তিনি একদিন আমাদের ইণ্ডিয়া হাউসে নেমন্তন্ন করে খাওয়ালেন। ইউরোপ ভ্রমণের সময় বাবা আমাদের বিদেশী দূতাবাসগুলির, বিশেষ করে লণ্ডনের ইণ্ডিয়া হাউসের খোলাখুলিভাবে তীব্র সমালোচনা করছিলেন। সে জন্য ইণ্ডিয়া হাউসে খাওয়াদাওয়া ও কথাবার্তার সময় আমরা সকলেই যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে ছিলাম। বাবা খবর পেয়েছিলেন যে বিদেশে আমাদের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক কাজকর্মে নানারকম দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে। তিনি দাবি করছিলেন যে, ভারত সরকার যেন ঐ বিষয়ে ভাল করে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিবিধানের ব্যবস্থা নেন। 

লণ্ডনের পাশেই ইসলিংটনের শহরগুলির মেয়র বেশ বড় রকমের একটা সংবর্ধনা-সভার আয়োজন করেছিলেন। প্রবাসী অনেক ভারতীয় ও ভারতবন্ধু ইংরেজরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। লণ্ডনপ্রবাসী এক ভারতীয় ডাক্তার তেজ কিষেন কাউল বাবার লণ্ডনের অনুষ্ঠানসূচী সফল করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। শেষে সাব্যস্ত হয় যে, বাবার নেতৃত্বে ইংল্যাণ্ডে ভারতীয়দের একটা দল সক্রিয়ভাবে কাজ করবে এবং দেশের অগ্রগতির জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করবে। 

নেশন পত্রিকার জন্য ইউরোপে ও আমেরিকায় সংবাদদাতা নিয়োগ করার কাজটা বাবা ইউরোপ ভ্রমণের সময় সেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। ইউরোপ থেকে নাম্বিয়ারসাহেব লিখবেন আগেই ঠিক হয়েছিল। লণ্ডন ও ওয়াশিংটনের দু’জন সংবাদদাতা লণ্ডন ছাড়বার আগেই বাবা ঠিক করে ফেললেন। 

দেশে ফেরার পরে বাবা আমাকে নেশনের ফরেন করেসপনডেন্ট নিযুক্ত করেন। আমার মনে হয়, সাংবাদিকতায় আমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এটা করেছিলেন। এই সূত্রে আমার বিশেষ রকমের একটি অভিজ্ঞতা হয়। বাবারই নির্দেশে আমি একবার প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলনে যাচ্ছি, সঙ্গে আছেন আনন্দবাজারের প্রতিনিধি তারাপদ বসু। ইংলিশ চ্যানেল পার হবার জন্য জাহাজে উঠেছি। দুই ভদ্রলোক জাহাজে উঠে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। কোটের পকেট থেকে তাঁদের পরিচয়পত্র বের করে দেখিয়ে বললেন, তাঁরা স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা দফতর থেকে আসছেন। আমি কোথায় যাচ্ছি, কতদিন থাকব ইত্যাদি জানতে চাইলেন। আমার সঙ্গী ‘তারাপদবাবু ব্যাপারটা ঘটায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম বিলেতে এসে আমি বোধহয় পুলিশের দৃষ্টির বাইরে চলে গেছি। দেখলাম, আসলে তা নয়। 

বাবার দেশে ফেরার দিন এসে পড়ল। লণ্ডনে আমার থাকার ব্যবস্থা নিয়ে বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি ভাবলাম এ-কাজটা তো আমি লণ্ডনের বন্ধুদের সাহায্যেই করতে পারি। বাবা কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি খুঁজতে বেরোলেন। লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্ররা সাধারণ একটি বিশেষ এলাকায় দল বেঁধে থাকতেন এবং জীবনযাত্রার ধারাটা ঠিক দেশের মতো রাখার চেষ্টা করতেন। বাবার কিন্তু মত ছিল — In Rome, do as the Romans do. তিনি বললেন, ইংরেজদের বা নতুন কোনো দেশের সামাজিক জীবনের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ না হলে, তাদের ভাল যা কিছু দেবার আছে তা নিতে না পারলে, বিদেশে গিয়ে কী লাভ? বাবা ঠিক করলেন যে, ভারতীয় কলোনির অনেক দূরে কোনো ভাল ইংরেজ পরিবারের সঙ্গে আমার থাকার ব্যবস্থা করে যাবেন। করলেনও তাই। নিজে ছাত্রজীবনে যে অঞ্চলে ছিলেন তারই কাছাকাছি হ্যাম্পস্টেডে এক বৃদ্ধা ইংরেজ মহিলার হেফাজতে আমাকে রেখে গেলেন। খরচাও বেশি। হাসপাতাল থেকেও দূর, কিন্তু বাবা শুনবেন না। মহিলাটি ছিলেন গোঁড়া ইংরেজ কিন্তু আমাকে ঠিক ঠাকুমার মতো দেখাশুনো করতেন। মধ্যবিত্ত ইংরেজ সমাজের অনেক কিছু ভাল ও মন্দ আমি তাঁর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। 

বাবা মা ও দুই বোনকে নিয়ে প্যারিস, রোম ও কাইরো হয়ে দেশে ফিরলেন। আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় আরম্ভ হল। 

ফেরবার পথে প্যারিসে বাবা ১৯৪১ সালে কাবুলের ইতালীয় দূত কোয়ারোনির কাছ থেকে কিছু পুরনো তথ্য ও দলিল পেলেন। ১৯৪১ সালের মে মাসে বার্লিন থেকে কাবুলে পাঠানো রাঙাকাকাবাবুর একটি গোপন বার্তার কপি কোয়ারোনির কাছে ছিল। বার্তাটিতে বাবার জন্য জরুরি খবর ছিল, কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কিছু জানতে পারেননি। কাবুলে যাঁদের হাতে বার্তাটি পৌঁছেছিল তাঁরা রাঙাকাকাবাবুর নির্দেশগুলি পালন করেছিলেন কি না তাও বাবা জানতে পারেননি। 

আমি বিলেতে থাকার সময় বাবা আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন, তা তিনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন। আমার পড়াশুনোর ব্যাপার ছাড়াও তিনি তাঁর রাজনৈতিক কাজকর্মের কথা জানাতেন এবং নানারকম কাজের ভার দিতেন। বিশেষ বিশেষ লোক বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হত। বাবারই কাজে পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য ও ইংরেজ রাজনীতিবিদের সঙ্গে আমার আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল। বাবা চীনের বিপ্লব সম্বন্ধে খুবই আগ্রহী ছিলেন। সেই সময় মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট দল ক্ষমতা দখলের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সেই দেশের খবরাখবর আমাদের দেশে সরাসরি পাওয়া যেত না। নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি লণ্ডন অফিসের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নেশন পত্রিকার জন্য অন্তর্বিপ্লবের খবরাখবর দেশে নিয়মিতভাবে পাঠাবার আমি ব্যবস্থা করি। 

.

১৯৪৯-এর প্রথম মাস-তিনেক লণ্ডনে থাকবার পরে কাজ শেখার ভাল সুযোগ পাওয়ায় আমি মধ্য ইংল্যাণ্ডের শেফিল্ডে চলে যাই এবং সেখানকার শিশু হাসপাতালে যোগ দিই। সেই সময় মনে হত যেন বসুবাড়ি থেকে আমি অনেক দূরে চলে গেছি। দেশে বা বাড়িতে যা কিছু ঘটছে সবই যেন আবছা-আবছা মনে হত। আমরা জনা-চারেক ভারতীয় ডাক্তার একসঙ্গে পড়াশুনো করতাম। আরও দু-চার জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে আমাদের একটা ছোট গোষ্ঠী। নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়ে আমাদের দিনগুলি মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই কেটে যেত। 

হঠাৎ একদিন খবর পেলাম বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ভাবতে লাগলাম আমার হয়তো বাড়ি ফিরে যাওয়াই উচিত। বাবা কিন্তু বারবার আমাকে জানাতে লাগলেন, আশঙ্কার কোনো কারণ নেই, আমি যেন আমার কাজ শেষ করার আগে দেশে ফেরার কথা চিন্তাও না করি। আমার ইচ্ছে ছিল বছর-চারেক ইউরোপে থাকব, দু-বছর ইংল্যাণ্ড এবং বাকিটা মধ্য ইউরোপের কোনো দেশে। রাঙাকাকাবাবুই তো বলে গিয়েছিলেন, ইংল্যাণ্ড ইউরোপ নয়, আমাদের মধ্য ইউরোপের সভ্যতা ও কৃষ্টির সঙ্গে যোগাযোগ করা একান্ত প্রয়োজন। যাই হোক, ঐ ধরনের ভাবনা আমি সেই মুহূর্তে ত্যাগ করবার জন্য প্রস্তুত হলাম। অন্যদিকে বাবার স্থির বিশ্বাস, তিনি ভাল হয়ে উঠবেন। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়ে লিখলেন— I have many more years to live and work. 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *