বসু-বাড়ি – ২০

২০

জেলে থাকতেই বাবা তখনকার কেন্দ্রীয় বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনের পর তাঁর মুক্তির দাবি করে, অন্ততপক্ষে তাঁর সেন্ট্রাল অ্যাসেমব্লিতে যোগদানের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করিয়ে নেবার জন্য, বিরোধী পক্ষ অনেক শোরগোল করলেন। কিন্তু সরকারের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হল না। বাবার অ্যাসেমব্লির আসনটি খালিই পড়ে রইল। 

এক দুপুরে যখন বাবার মুক্তির আদেশ এল তখন আমি স্কুলে। মনে আছে, খবরটা পেয়ে হেডমাস্টার মশাইয়ের অনুমতি নিয়ে ইস্কুল থেকে বাড়ি সারা পথটা দৌড়ে এসেছিলাম। বাবা জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন দেশের পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। বাংলা দেশে কংগ্রেসের তখন একজন বিশিষ্ট নেতার প্রয়োজন। দুই প্রধান নেতার মধ্যে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত জেলে থাকতেই মারা গেছেন। রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে, কবে ফিরবেন খুবই অনিশ্চিত। বাংলার কংগ্রেসের বেশির ভাগ দল ও উপদল বাবাকেই চাইলেন। 

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সবেমাত্র ভারতের জন্য এক নতুন সংবিধান—গভর্নমেন্ট অব ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৫—পাস করেছে। জাতীয়তাবাদীরা বুঝলেন যে, বড় একটা চ্যালেঞ্জ এগিয়ে আসছে। বিশেষ করে বাংলা দেশের পরিস্থিতিটা ছিল খুবই জটিল। সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের শাসকেরা যে ওষুধের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটা ছিল ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা বলে যে ফরমুলাটি তাঁরা বাংলা দেশের উপর চাপিয়ে দিলেন তার ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ক্রমে আরও তিক্ত হয়ে উঠল এবং হিন্দু ও মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক সংস্থাগুলি আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ভাল করে লড়তে হলে কংগ্রেসে তখন একজন শক্তিমান পুরুষের দরকার ছিল। 

অন্যদিকে বাবা ফিরেছেন খবর বেরোতেই হাইকোর্টে একটা প্রচণ্ড, শোরগোল পড়ে গেল। মক্কেলরা ব্রীফের স্তূপ মাথায় করে উডবার্ন পার্কে ভিড় করলেন। খবরের কাগজে বেরোল, মিঃ বোস ফ্লাডেড উইথ ব্রীফস। 

১৯৩৫-এর শেষে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে প্রথম বিয়ে লাগল। আমার দিদি মীরার সম্বন্ধ মোটামুটি ঠিক করে বাবা সোজা এলগিন রোডের বাড়িতে মাজননীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। বাবাকে দেখেই মাজননী বললেন যে, তিনি সবেমাত্র স্বপ্নে দেখেছেন যে দাদাভাই গায়ের চাদর ও লাঠি নিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করতে দাদাভাই বললেন—অবশ্যই স্বপ্নে—যে তিনি মীরাবাঈয়ের জন্য বর দেখতে যাচ্ছেন। বাবা আশ্চর্য হয়ে মাজননীকে জানালেন, তিনি তো বর দেখেই সোজা তাঁর কাছে এসেছেন। শুনে মাজননী বাবাকে বললেন ঐ সম্বন্ধটাই পাকাপাকি করে ফেলতে। পরে আমাদের বড় ভগ্নীপতিকে অনেকেই ‘স্বপ্নে পাওয়া জামাই’ বলে অভিহিত করতেন। 

বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাবা কিছু আধুনিকতা আনতে চাইলেন। বললেন, ভিয়েন বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়ানোটা সংক্ষেপে করতে হবে। তার বদলে টী-পার্টি হবে। এই প্রস্তাবে আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকে আপত্তি তুললেন—যেন শাস্ত্র অশুদ্ধ হয়ে যাবে! যা-ই হোক, বাবা নিজের মতে অবিচল রইলেন। তবে কার্যত বাবার পাত পেড়ে খাওয়ানো ও টী-পার্টি দুটোই খুব বড় করে হল। টী-পার্টি থেকে বসু-বাড়ির মহিলা-মহলের অনেকে দূরে সরে রইলেন। 

১৯৩৬ সালে বাবার উপর কংগ্রেসের কাজের চাপ ক্রমেই বাড়তে লাগল। রাঙাকাকাবাবুর অনুপস্থিতিতে বাবাই বাংলার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সেই বছরে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশন হবে লখনৌতে—সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। সেই সময় কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থীর রাজনীতি দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে এবং সাধারণভাবে বলা যায় জওহরলাল, রাঙাকাকাবাবু ও বাবা এক পথের যাত্রী। রাঙাকাকাবাবু ঠিক করলেন যে, তিনি লখনৌতে কংগ্রেসে যোগ দেবেন এবং মার্চ-এপ্রিল নাগাদ দেশে ফিরে আসবেন। খবরটা প্রচার হয়ে যাওয়া মাত্র রাঙাকাকাবাবু ভিয়েনার ইংরেজ কূটনৈতিক প্রতিনিধির কাছ থেকে এই চিঠি পেলেন : 

12th March 1936 

I have today received instructions from the Secretary of State for Foreign Affairs to communicate to you a warning that the Government of India have seen in the press statements that you propose to return to India this month and the Government of India desire to make it clear to you that should you do so you cannot expect to remain at liberty. 

J. W. Taylor
His Majesty’s Consul 

যেমন কথা তেমন কাজ। রাঙাকাকাবাবু সরকারের হুমকি উপেক্ষা করে এপ্রিলের গোড়ায় বোম্বাই বন্দরে পৌঁছনো মাত্র তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল। 

কংগ্রেসের সভাপতির কাজ তুলে নেবার পর ১৯৩৬-৩৭ সালে বেশ কয়েকবার পণ্ডিত জওহরলাল কলকাতায় সফরে আসেন। বাবার আমন্ত্রণে তিনি আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে উঠতেন। তিনি একতলার যে ঘরে থাকতেন সেটার নামই হয়ে গিয়েছিল পণ্ডিতজির ঘর—পণ্ডিতজিকা কামরা। তাঁর ব্যক্তিত্বের এক অসাধারণ আকর্ষণ ছিল—আমরা তো তাঁকে দেখবার জন্য তাঁর ঘরের আনাচে-কানাচে ক্রমাগতই ঘোরাফেরা করতাম। তাঁর জীবনযাত্রার ধারাটা ছিল সহজ ও স্বাভাবিক, কিন্তু সব দিক দিয়েই ফিটফাট ও নিয়মমাফিক। তাঁর অতিবিনয়ী ও সদাহাস্যময় সেক্রেটারি উপাধ্যায়জি একটি বিশেষ কাজের জন্য আমাকে প্রায়ই ভোরে পণ্ডিতজির ঘরে নিয়ে যেতেন। বাথরুমে জল গরম করবার গ্যাসের যন্ত্রটি আমাকে চালু করে দিতে হত। কী জানি কেন, পণ্ডিতজি হেসে বলতেন, ও কাজটা বড়ই গোলমেলে, আমি পারি না। সেই সময় প্রায়ই দেখতাম, পণ্ডিতজি মেজেতে একটি চাদর পেতে ব্যায়াম করছেন। 

খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে পণ্ডিতজি খুবই হিসেবি ছিলেন। বিদেশী ও দেশী দুরকম রান্নাই টেবিলে তাঁর জন্য দেওয়া হত। তিনি কিন্তু খুব বেছে অল্প খেতেন, গুরুপাক খাদ্য মোটেই খেতেন না। মনে পড়ে, খাবার পর তাঁকে ফলমিষ্টি দেওয়া হয়েছে। আপেলটা বা সন্দেশটা ছুরি দিয়ে আধখানা করে অর্ধেকটা নিয়ে মুচকি হেসে বাকিটা আমাদের কারুর দিকে ঠেলে দিয়ে বলতেন, ‘উইল ইউ হ্যাভ দি আদার হাফ?’ সারাদিন খাটাখাটুনির পর রাত্রের খাওয়াটা তিনি খুবই হালকা রাখতেন—স্ক্র্যাম্‌লেড ডিম ও কফি। হয়তো বাইরের কাউকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি পদ রান্নাও হয়েছে, সব দেখেশুনে হাসতে হাসতে বাবার দিকে চেয়ে বলতেন, ‘শরৎ বোসের ডিনার ইজ্ এ ন্যুস্যান্স, ইট নেভার এনড্‌স্।’ সিগারেট খেতেন গুনে গুনে। খাবার পর দুটি-একটি। মনে আছে, বাবা আমাকে পণ্ডিতজির জন্য ভাল বিলিতি 

বিলিতি সিগারেট—ব্ল্যাক অ্যাও হোয়াইট কিনতে দিয়েছেন—অতিথি-সৎকারে কোনো বাধা নেই। বহুদিন পরে ১৯৬০-এ দিল্লিতে -প্রণ্ডিতজির সঙ্গে কাজে দেখা করতে গিয়েছি, দেখি একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন। বললাম, আপনি এত সিগারেট খাচ্ছেন কেন। আগে তো খেতেন না! উত্তরে বললেন, শুনেছি সুভাষ তো যুদ্ধের সময় চেন-স্মোকিং করত, তাই না? আমি সায় দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার সিগারেট চলে নাকি?’ আমতা-আমতা করে বললাম, ‘মাঝে মাঝে চলে।’ ‘তাহলে চলুক না একটা—’ বলে আমাকে একটা সিগারেট খাওয়ালেন। আরও বললেন, ‘বোধহয় নানারকম স্ট্রেনের জন্য সিগারেট খাই, সুভাষও বোধহয় তাই করত।’ 

জওহরলালকে দেখবার জন্য উডবার্ন পার্কে কী ভিড়ই না হত! কংগ্রেসীদের ভিড় তো আছেই, তার উপর সব স্তরের সব বয়সের মানুষ ভেঙে পড়ত। তিনি ভিড় সামলাতে ভালই পারতেন, কিন্তু কখনও কখনও ধৈর্য হারাতেন ও রেগে যেতেন। দুটি জিনিস তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। এক, দু’মিনিটের কাজ আছে বলে কুড়ি মিনিট সময় নষ্ট করা। দুই, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা। 

যখন কংগ্রেসের প্রচারে তিনি বেরোতেন, সারাদিনে প্রায়ই আঠারো-বিশটা সভায় বক্তৃতা করতেন। বাবা ও জওহরলালকে এক সঙ্গে বেশ কয়েকটা সভায় বক্তৃতা করতে শুনেছি। পণ্ডিতজির গলায় জোর ছিল কম, মাইক না হলে চলত না। মিটিং করতে যাবার সময় গাড়িতে তাঁর জন্য ফ্লাস্কে ভরে গরম জল দেওয়া হত। বক্তৃতার মধ্যে মধ্যে তিনি জলে চুমুক দিতেন। 

২১

রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে খেতে বসেছি কার্শিয়ঙে আমাদের গিধাপাহাড়ের বাড়িতে। কালু সিং ইউরোপীয় ধাঁচের খাবার দিচ্ছে, প্রথমেই সৃপ। আমরা তো সৃপের বাটিটা উল্টো দিকে কাত করে নিয়ে চামচে করে সৃপ খেতে অভ্যস্ত। রাঙাকাকাবাবু কিন্তু সূপের বাটিটা নিজের দিকে কাত করে খাচ্ছেন। বললেন, “তোমরা বাটিটা উল্টো দিকে কাত করে খাচ্ছ কেন?” ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছি। মুচকি হেসে বললেন, “তোমরা যেমন করে খাচ্ছ সেটা তো ইংরেজি কায়দা, ইউরোপের অন্যান্য দেশে কিন্তু আমি যেমন করে খাচ্ছি তেমনি করে খায়।“ 

আমরা যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, আচার-ব্যবহারে, অভ্যাসে ও রুচিতে, ইংরেজদের অন্ধ অনুসরণ করি, সেটা রাঙাকাকাবাবু সুস্থ ও মুক্ত মনোভাবের পরিচায়ক বলে মনে করতেন না। অনেক দিনের দাসত্বের ফলে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সব ক্ষেত্রে আমরা এই ধরনের মনোভাবের পরিচয় দিই। ছোটখাটো দৃষ্টান্ত দিয়ে রাঙাকাকাবাবু আমাদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন যে, সব বিষয়ে ইংরেজদের অনুকরণের স্পৃহা থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত ইউরোপে থাকার ফলে রাঙাকাকাবাবু মধ্য ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানদের, কৃষ্টি, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার ধরন ইত্যাদির দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। তা ছাড়া মধ্য ইউরোপের ভারতপ্রেমী বিদগ্ধ মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করে তিনি বুঝেছিলেন যে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সমানে-সমানে হতে পারে। কারণ সেখানে প্রভু-প্রজার সম্পর্কের লেশমাত্র নেই। জার্মান পণ্ডিত ও ভারততত্ত্ববিদরা বহুদিন আগে থেকেই আমাদের দেশের প্রাচীন সভ্যতা, ধর্ম, দর্শন ও কৃষ্টির দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অপর পক্ষে ইংরেজরা আমাদের দেশে এসেছিলেন মূলত ব্যবসা করতে এবং শেষ পর্যন্ত রাজা হয়ে বসেছিলেন। দুটোর মধ্যে অনেক ফারাক। 

আমি যে-সময়ের কথা বলছি তখন রাঙাকাকাবাবু কার্শিয়ঙে আমাদের বাড়িতে বন্দী হয়ে রয়েছেন, এবং আমি ও আমার দাদা অমিয়নাথ সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে গরমের ছুটি কাটাচ্ছি। বছর দুয়েক আগে বাবা নিজের বাড়িতে বন্দী-জীবন কাটিয়ে গেছেন। রাঙাকাকাবাবুর ওপরও শর্ত ও বিধিনিষেধ ঠিক একই রকম ছিল। দেখা করা বা কথা বলা কারুর সঙ্গেই চলবে না। পুলিস-পাহারা বেশ কড়া। হিলকার্ট রোডে একমাইল উপর দিকে ও একমাইল নীচের দিকে বেড়াতে পারতেন, পেছন-পেছন বন্দুকধারী পুলিস তাঁকে অনুসরণ করত। আমাদের তো কোনো কাজ নেই, কেবল রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া ও গল্প করা। তবে আমি তখনও পর্যন্ত কথা বলতাম খুব কম, সেজন্য রাঙাকাকাবাবু আমাকে ‘সাইলেন্ট বয়’ আখ্যা দিয়েছিলেন। 

‘সাইলেণ্ট’ হবার যেমন কতকগুলি অসুবিধা আছে, তেমনি সুবিধাও আছে। কথাবার্তা কম বললে পারিবারিক দিক থেকে সামাজিক দিক থেকে খানিকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে হয়। তবে চুপচাপ থেকেও যদি চোখ কান ও মন খুলে রাখা যায়, এবং একাগ্র হয়ে সব-কিছু বিচার করা যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত লাভ বই লোকসান হয় না। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমি তো অনেকদিন খোলাখুলি বাক্যালাপ করতে পারতাম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে আমি এত অকপটে কথাবার্তা বলেছি যে, নিজেই, আশ্চর্য হয়ে গেছি। কথাবার্তা কম বলার আর একটা বড় লাভ হচ্ছে গভীর চিন্তার অবকাশ পাওয়া। অনেক বড় হবার পরেও এবং হাজার কাজের মধ্যেও মহাত্মা গান্ধী সপ্তাহে একদিন মৌন থাকতেন। গান্ধীজি আমাদের বাড়িতে থাকতে দেখেছি তিনি কেমন টুকরো-টুকরো কাগজে কথার জবাব লিখে লিখে দিচ্ছেন—তা প্রশ্নকর্তা যিনিই হোন না কেন। মনে আছে বাড়িতে একদিন চায়ের আসরে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বাবাও আছেন। কেউ বললেন ব্যারিস্টারি করা আমার দ্বারা হবে না, কারণ আমি বড়ই ‘কুনো’, মুখে তো কথাই ফোটে না। বাবা কিন্তু বললেন, ওর আইনব্যবসার ‘গুরুজি’ স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকার ছেলেবেলায় নাকি খুবই লাজুক ছিলেন, এবং কথাবার্তায় পটু ছিলেন না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কত বড় ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। 

গল ব্লাডার অপারেশনের পর বেশ কিছুদিন হজমের দিক থেকে অসুবিধা থাকে। পরে নিজের একই অপারেশনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি সেটা ভাল করে বুঝতে পারি। রাঙাকাকাবাবুকে সেজন্য ১৯৩৬ সালে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে খুব সাবধানে থাকতে হত। কালু সিং খুব সাদাসিধে ইউরোপীয় ধরনের খাবার তৈরি করে দিত। উপায় নেই তো, সে অন্য কথা—কিন্তু আমার মনে হয়, রাঙাকাকাবাবুর নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হত। কারণ, মুখরোচক সুস্বাদু খাবার তিনি খুব উপভোগ করতেন, এবং দেখেছি, সময়-সময় অতিরিক্ত পরিমাণ খেয়ে ফেলতেন। খেয়ে হাঁসফাঁস করতেন আর বলতেন, “ও খাবারগুলো পেটের মধ্যে দমে বসে আছে!” কড়াইশুঁটির কচুরি, শিঙাড়া, চিকেন কাটলেট ইত্যাদি সামনে দেখলে তাঁর মুখে বেশ আনন্দের ভাব ফুটে উঠত। 

১৯৩৭ সালে পুজোর সময় বাবা, রাঙাকাকাবাবু ও আমরা ভাইবোনেরা প্রায় সকলে কার্শিয়ঙে একসঙ্গে ছিলাম। তখন যেন দুই ভাইয়ে খাওয়ার কম্পিটিশন। বাবার মিষ্টি কম খাওয়ার কথা, কিন্তু মিষ্টি তিনি খাবেনই। রাঙাকাকাবাবুর গুরুপাক ভাজা মুখরোচক জিনিস খেলে অসুবিধা হয়, কিন্তু তিনি ছাড়বার পাত্র নন। বাজারের মুখরোচক খাবারও তিনি সুযোগ পেলেই খেতেন। ১৯৩৭-এর এপ্রিলে মুক্তি পাবার পর এলগিন রোডের বাড়িতে তিনি দাদাভাইয়ের ঘরে থাকতেন। সেই ঘরটি বর্তমানে ‘নেতাজী ভবনে’ নেতাজীর ঘর বলে পরিচিত। ঠিক পাশের ঘরেই থাকতেন মাজননী। দুপুরবেলা সামনের রাস্তা দিয়ে ‘হট প্যাটিস’ ফেরি করে যেত। বাড়ির সামনে প্যাটি কিনলে তো মাজননী দেখে ফেলতে পারেন। সুতরাং রাঙাকাকাবাবু পাশের গলিতে ফেরিওয়ালাকে বসিয়ে চুপিসারে প্যাটি কিনিয়ে আনতেন ও ভাইপো-ভাইঝিদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করে খেতেন। 

বন্দী অবস্থায় কার্শিয়ঙে রাঙাকাকাবাবুর সকাল-সন্ধে বেড়ানো চাই। জুন মাস, বর্ষা নেমে গিয়েছে। পাহাড়ের বৃষ্টি কি ছাতা বর্ষাতির বাধা মানে? তা ছাড়া হিলকার্ট রোডে তো নদীর স্রোতের মতো জল বয়ে চলেছে। তাতে কী? বেড়াতে বেরোতেই হবে। আর বেড়াতে বেড়াতে কত গল্প! ছেলেবেলার গল্প, পারিবারিক নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা, নানা লোকের চরিত্র বিশ্লেষণ, দেশের কথা, বিশ্বরাজনীতির কথা ইত্যাদি। খানিকটা দুঃখের সুরে হয়তো বললেন, “জানো, আমি যখন ছোট ছিলাম, প্রায় সকলেই বলত, আরে ওটা একটা বদ্ধ পাগল, জীবনে ওর কিছুই হবে না।” আমি মনে-মনে ভাবতাম, কথাটা তো পুরোপুরি ভুল নয়, পাগলামির তো চূড়ান্ত দেখছি, আর সাধারণ মানুষে যাকে ‘কিছু হওয়া’ বলে তা তো সুভাষচন্দ্রের কিছুই হয়নি। অসাধারণত্ব ও পাগলামির ব্যবধান বোধহয় অল্প‍ই। 

২২

এটা তো সকলেই জানেন যে, প্রথম জীবনে রাঙাকাকাবাবু সাইকোলজি বা মনস্তত্ত্বে খুব আগ্রহী ছিলেন এবং এক সময়ে ভেবেছিলেন এই বিষয়টা নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেবেন কিনা। ১৯৩৬-এ কার্শিয়ঙে পারিবারিক নানা সমস্যা বা পরিবারের বিভিন্ন লোকের বা ছেলেমেয়েদের আচার-ব্যবহার, লেখাপড়া, কেরিয়ার ইত্যাদি নিয়ে কথা উঠত। তাঁর কথাবার্তা থেকে বোঝা যেত যে, তিনি প্রত্যেকটি ব্যক্তির জীবনের ধারা ও আচরণ বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেন। এমন কী আমাদের জেনারেশনের যে-কোনো ছেলে বা মেয়ের স্বভাব-চরিত্রের ও আচরণের বেশ একটা ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারতেন। কার চরিত্রের কোন দিকটা সবল, কোন দিকটা দুর্বল, এসব বিষয়ে তাঁর নিজের একটা পরিষ্কার ধারণা ছিল। নিজের জেনারেশনের লোকেদের সম্বন্ধে তিনি আমাদের সামনে আলোচনা করতেন কম, কিন্তু আমার ধারণা সেক্ষেত্রেও তাঁর মতামত খুব পরিষ্কার ছিল। তিনি তো অন্যদের মতো সংসারে জড়িয়ে পড়েননি। কিন্তু পারিবারিক কোনো সমস্যা বা কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির কথা উঠলে তিনি একটা কথা বারবার আমাদের বলতেন, সংসারে সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে “উদার হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।” তিনি আমাদের বোঝাতে চাইতেন যে, ছোটখাটো, অপ্রিয় বা হিংসাপ্রসূত যা-কিছু আছে সেগুলি উদার মনোভাব নিয়ে উপেক্ষা করতে না পারলে সাংসারিক বা সামাজিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে বাধ্য। 

ইউরোপের নানা দেশে ঘুরে, ভিন্নভিন্ন দেশের নেতৃস্থানীয় লোকেদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তা বলে বিশ্ব-রাজনীতির ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবুর বেশ একটা পরিষ্কার ধারণা হয়ে গিয়েছিল। এ-ব্যাপারে আমাদের অধিকাংশ নেতার অনীহা ও অজ্ঞতা তাঁকে পীড়া দিত। একদিকে তখন তো জাপান ছাড়া এশিয়ার ও আফ্রিকার প্রায় সব দেশই ছিল পরাধীন। অন্য দিকে আমেরিকা ও রাশিয়া ছিল এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলি সম্বন্ধে মোটামুটি ভাবে নিস্পৃহ। সেজন্য ইউরোপীয় রাজনীতি ভাল করে না বুঝলে বিশ্বরাজনীতির রূপ ও গতি বোঝা সম্ভব ছিল না। আমাদের লড়াই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। কোন্ কোন্ নতুন শক্তি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ বা খর্ব করতে পারে, এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে সহায়ক হতে পারে এ-বিষয়ে রাঙাকাকাবাবু গভীরভাবে বিচার-বিবেচনা করেছিলেন। এদিক দিয়ে তাঁর চিন্তাধারা দেশের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের থেকে পৃথক ছিল, ফলে তাঁর কাজের ধারাও অন্য স্রোতে বইত। আদর্শবাদ ও ব্যবহারিক রাজনীতির বেশ একটা সমন্বয় তিনি করতে পেরেছিলেন। আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা তাঁর লেখা ও কর্মজীবন থেকে অনেক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। 

রাঙাকাকাবাবুর কথাবার্তা থেকে মনে হত না যে, তাঁর ছেলেবেলাটা শান্তিপূর্ণ ছিল। ইস্কুল-কলেজ যাওয়া-আসা করা, পরীক্ষা পাস করা, বৃত্তি পাওয়া গতানুগতিক এসব নিশ্চয় ছিল, কিন্তু তাঁর ভিতরে নিজের বিবেকের সঙ্গে ও বাইরে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করতে করতে তিনি বড় হয়েছিলেন। এ-ধরনের অভিজ্ঞতা খুব কম লোকেরই হয়। আমাদের দেশের অন্য অনেক নেতার ক্ষেত্রে দেখেছি, পরিণত বয়সে বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতার ফলে অথবা হঠাৎ বিশেষ কারুর ডাকে সংগ্রামের পথে চলে আসেন। রাঙাকাকাবাবু কিন্তু ছিলেন সত্যই আজীবন সংগ্রামী। এ-কথাটি আমি প্রথম বৃঝি ১৯৩৬ সালে কার্শিয়ঙে আঁকাবাঁকা পথে তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে। 

১৯৩৬-এর শেষের দিকে সরকার রাঙাকাকাবাবুকে কলকাতায় নিয়ে এসে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দেয়। তাঁর শরীরও ভাল যাচ্ছিল না। তাছাড়া শীতের সময় কার্শিয়ঙে থাকাটা খুব সুখেরও নয়। মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন সময়ে কত রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী বা বিপ্লবী যে বন্দী হয়ে থেকেছেন, তার ইয়ত্তা নেই, এর একটা হিসেব নিলে হয়। পরে ১৯৪২-এ আন্দোলনের সময় আমার নিজেরও এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ১৯৩৬-এ আমরা দল বেঁধে সরকারের অনুমতি নিয়ে মেডিকেল কলেজে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। বাবা তখন নতুন সাধারণ নির্বাচনের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। বেশ বোঝা যেত, রাঙাকাকাবাবু বাবার সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য ছটফট করতেন, নানাভাবে বাবার কাছে নির্বাচনের প্রচার সম্বন্ধে বা কংগ্রেসের প্রার্থী নির্বাচন সম্বন্ধে নিজের মতামত পাঠিয়ে দিতেন। 

মাজননীর শরীর তখন ভাল নয়, নিয়মিত মেডিকেল কলেজে গিয়ে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিছুদিন পরে সরকার রাঙাকাকাবাবুকে পুলিস পাহারায় এলগিন রোডের বাড়িতে সন্ধ্যার সময় কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে আসত, আবার ফেরত নিয়ে যেত। তাঁকে দেখবার জন্য সেই সময় বাড়িতে আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের বেশ ভিড় হত। 

১৯৩৬-এ ইউরোপ থেকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এক অতিথি এলেন, রাঙাকাকাবাবুরই আমন্ত্রণে। ভিয়েনার শ্রীমতী হেডি ফুলপ-মিলার। রাঙাকাকাবাবু ভিয়েনাতে থাকার সময় শ্রীমতী ফুলপ-মিলার তাঁকে খুবই দেখাশুনো করেছিলেন। তাছাড়া ভারতবর্ষের দর্শন, কলা ও কৃষ্টির প্রতি তাঁর টান ছিল গভীর। বিশেষ অনুমতি নিয়ে তিনিও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাঙাকাকাবাবুকে দেখতে যেতেন। শ্রীমতী ইউরোপীয় অপেরা সঙ্গীতে পারদর্শিনী ছিলেন এবং কলকাতার রেডিওতে তিনি গানও গেয়েছিলেন। সমঝদারেরা তখন বলেছিলেন, অত উঁচু মানের ইউরোপীয় সঙ্গীত তখনও পর্যন্ত কলকাতার রেডিও স্টেশন থেকে কমই প্রচারিত হয়েছে। আমাদের বাড়িতে অতিথি থাকার ফলে শ্রীমতী ফুলপ-মিলারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাড়ির সব ছেলেমেয়েকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি চিরকাল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং ইউরোপে পরে আমাদের সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। 

১৯৩৭ সালে এপ্রিলে রাঙাকাকাবাবু মুক্তি পেলেন। মুক্তির পর স্বাস্থ্যের জন্য তিনি কিছুদিন ড্যালহাউসি পাহাড়ে ধরমবীর-দম্পতির সঙ্গে কাটিয়ে আসেন। ছাত্রজীবনে, ১৯২০-২১ সালে, ইংল্যাণ্ডে ডাক্তার ও শ্রীমতী ধরমবীরের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর পরিচয় হয়। শ্রীমতী ধরমবীর ছিলেন ইংল্যাণ্ডবাসী রাশিয়ান মহিলা। তাঁর মাতৃসুলভ ব্যবহার ও চরিত্রের মাধুর্যে রাঙাকাকাবাবু যে শুধু গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তাই নয়; দিলীপকুমার রায়ের মুখে শুনেছি, শ্রীমতী ধরমবীরকে দেখার পর ইউরোপীয় মহিলাদের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ও মতামতের পরিবর্তন ঘটে। এর আগে রাঙাকাকাবাবুরই আমন্ত্রণে এক ধরমবীর-কন্যা বেশ কিছুদিন আমাদের সঙ্গে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করেছিলেন। সেই সময় আমরাও শ্রীমতী ধরমবীরকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। 

ড্যালহাউসি থেকে ফিরে রাঙাকাকাবাবু পুরোপুরি আবার দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ১৯৩৭-এর অক্টোবরে কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন হবে। তার আগেই সব ব্যবস্থা করতে পুজোর সময় তিনি কার্শিয়ঙে বাবার সঙ্গে মিলিত হলেন। 

২৩

যেখানে গভীর প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক, সেখানে অনেক সময় অভিমানের মাত্রাটাও বেশি হয়। ১৯৩৭-এ রাঙাকাকাবাবু মুক্তি পাবার আগেই মাজননী মা-র কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, মুক্তির পর রাঙাকাকাবাবু যেন উডবার্ন পার্কে না থেকে এলগিন রোডের বাড়িতে তাঁর কাছে থাকেন। বিধবা হবার পর যে-কোনো মায়ের এ-রকম ইচ্ছা হওয়া স্বাভাবিক। তবে আমার মনে হয় মাজননীর ঐ প্রস্তাবে আমার মা-র মন ঠিক সায় দেয়নি। যাই হোক, শাশুড়ির কথামতো মা রাঙাকাকাবাবুকে মাজননীর ইচ্ছার কথা বলেন এবং সোজাসুজি আরও বলেন যে, তিনি রাঙাকাকাবাবুর পথ আগলাবেন না। কথাটা শুনে রাঙাকাকাবাবুর খুব অভিমান হয় এবং মাকে বেদনায় ভরা একখানা চিঠি লেখেন। এমন কথাও তিনি লিখেছিলেন যে, আমার মা যেন একরকম জোর করেই তাঁর জীবনের এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছেন। আসলে অবশ্য তেমন কিছুই হয়নি, বাবা-মার সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর গভীর প্রীতির সম্পর্কে কোনোদিন কোনো ছেদ পড়েনি। রাঙাকাকাবাবুর সেই চিঠিখানা মা পরে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। 

আগেই তো বলেছি ১৯৩৭-এর পুজোর সময় ড্যালহাউসি থেকে ফিরে রাঙাকাকাবাবু কার্শিয়ঙ-এ আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ছিলেন। দিনকতক পরেই কলকাতায় অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন বসবে। কংগ্রেসের সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল তো আসবেনই, গান্ধীজিও আসবেন। দুজনেই বাবার আমন্ত্রণে আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে থাকবেন। কংগ্রেসের অধিবেশনের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাদি নিয়ে বাবা ও রাঙাকাকাবাবু কার্শিয়ঙ-এ নিজেদের মধ্যে ক্রমাগতই আলোচনা চালাতেন। নানা দিকে অনেক চিঠি লেখালেখি চলত। বাবা ও রাঙাকাকাবাবু একসঙ্গে কার্শিয়ঙ-এ আছেন খবর পেয়ে কিন্তু কার্শিয়ং ও দার্জিলিঙ থেকে অনেক পরিচিত ও অপরিচিত লোকজন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এতে সময় নষ্ট হত, কাজেরও অসুবিধা হত। খুব বাঞ্ছনীয় নয় এমন কেউ আসছেন দেখা গেলেই দুই ভাই ঠিক ছোট শিশুদের মতো খেলার ছলে নিজেদের মধ্যে তর্ক জুড়ে দিতেন। রাঙাকাকাবাবু হয়তো বললেন, ‘এই রে, আবার অমুক আসছে, ঐ যে মেজদার পরম বন্ধু, তোমার কাছেই আসছে। আমি বেড়াতে চললুম, মেজদা, তুমিই তাহলে আদর-আপ্যায়ন করো।’ জবাবে বাবা বললেন, ‘ও মোটেই আমার প্রিয় বন্ধু নয়, ও তোর শাকরেদ, তোর কাছেই আসছে। তুই কথাবার্তা বল্, আমি কাজ করি।’ এধরনের কবির লড়াই চলতে-চলতে অতিথি এসেই পড়তেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাঙাকাকাবাবুকেই সামাল দিতে হত। বেশ ঘটা করে বলতেন, ‘আরে আরে আসুন, বসুন! কতদিন দেখা নেই, জমিয়ে গল্প করা যাক’ ইত্যাদি। আমরা এই ধরনের অভিনয় বেশ উপভোগ করতাম। 

ঐ সময় রাঙাকাকাবাবুর শরীর বেশ সেরে গিয়েছে। কার্শিয়ঙে পৌঁছেই চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন, ‘বলো, কে আমার সঙ্গে ভোরে বেড়াতে বেরোবে।’ ঠাণ্ডার সময়, তার উপর আবার সূর্যোদয়ের আগেই উঠতে হবে। আগের বছরে তাঁর সঙ্গে থাকবার সময় বুঝেছিলাম বাড়ির কোনো-কোনো লোককে তিনি উইক-মাইণ্ডেড-এর পর্যায়ে ফেলতেন। যাতে আমাকে তিনি ঐ দলে না ফেলেন, আমি বোকার মতো রাজি হয়ে গেলাম। বুদ্ধিমানেরা আরাম করে ঘুমোচ্ছে, আর আমি নিজের মান রাখতে গিয়ে কী বিপদেই না পড়লাম! ভোরে তিনিই আমাকে ঘুম থেকে তুললেন! দেখলেন যে, আমি ঠিকমতো জামাকাপড় পরেছি, আর তারপর শুরু হত একটা অসম প্রতিযোগিতা। রাঙাকাকাবাবুর হাঁটার ধরন তখন বদলে গিয়েছে। তখন কি জানি যে, ইনি ভবিষ্যতের আজাদ হিন্দ ফৌজের অধিনায়ক! কেবলই পিছিয়ে পড়ি, আর খানিকটা দৌঁড়ে তাঁকে ধরি। গিধাপাহাড় থেকে মহানদী স্টেশন তিন মাইল। মহানদী স্টেশনে পৌঁছে ভাবছি হয়তো ফেরবার আগে একটু বিশ্রাম নেবেন। কোথায় বিশ্রাম! একেবারে ‘রাইট অ্যাাউট টার্ন’ আর আবার মিলিটারি কায়দায় হাঁটা। হাতের ছাতাটা সোজাসুজি ধরে, হাত পুরোপুরি দুলিয়ে জোর কদমে এগিয়ে যাওয়া! 

জওহরলাল আমাদের বাড়িতে আগেও থেকেছেন। তাঁর জন্য কী ধরনের ব্যবস্থাদি করা দরকার মোটামুটি জানাই আছে। তবে গান্ধীজির জীবনযাত্রা তো একেবারেই অন্য—সেজন্য বাবা, মা ও রাঙাকাকাবাবু খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। একটা কথা অবশ্য আমি তখন জানতাম না—গান্ধীজির সঙ্গে বসু-বাড়ির প্রথম যোগাযোগ অনেক পুরনো। ১৯২৫—২৬ সালে মামলায় বন্দী রাঙাকাকাবাবুকে মাজননীর লেখা একখানা চিঠিতে দেখছি, গান্ধীজি আমাদের কটকের বাড়িতে গিয়েছেন, দাদাভাই মাজননীর কাছে তাঁর নির্বাসিত পুত্রের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। কটকের বাড়িতে গান্ধীজি, একটা সভাও করেছিলেন বলে শুনেছি। যাই হোক, ১৯৩৭-এ উডবার্ন পার্কের বাড়িতে যখন মহাত্মা আসবেন তখন তিনি দেশের অবিসংবাদী নেতা। তাঁর সঙ্গে থাকবেন অন্তত জন-ছয়েক ব্যক্তি। ঠিক হল যে, বাড়ির তিনতলাটা পুরোপুরি তাঁর জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। বেশ বড় ছাদও আছে। সেখানে গান্ধীজি বেড়াতে পারবেন, প্রার্থনাসভাও হতে পারবে। রান্নাবাড়ির একটা অংশও তাঁর জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। 

বড়রা দিনকতক আগেই কলকাতায় চলে এলেন। হাওড়া স্টেশনের ভিড় এড়াবার জন্য গান্ধীজিকে আগের একটি ছোট স্টেশনে নামিয়ে নেওয়া হল এবং উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তোলা হল। আমরা ছোটরা দিনকয়েক পরে এলাম। তখন গান্ধীজি ও জওহরলাল দুজনেই আমাদের বাড়িতে। জওহরলালের বোন বিজয়লক্ষ্মীও উডবার্ন পার্কে উঠলেন, তাঁর জন্য দোতলায় একটি ঘর বিশেষ করে সাজিয়ে দেওয়া হল। জওহরলালের কন্যা ইন্দিরা ও এসেছিলেন, তবে আমাদের বাড়িতে ছিলেন না। ক্ষীণকায় লাজুক মুখচোরা অল্পবয়সী একটি মেয়ে বলে তাঁকে মনে আছে। 

মহাত্মা গান্ধীকে তার আগে তো দেখিনি। বাড়িতে পৌঁছেই উপরতলায় তাঁকে দেখতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। বারান্দায় উঠে দেখি, গান্ধীজির ঘরের সামনেই রাঙাকাকাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘চলো, মহাত্মাজির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, প্রথমেই কিন্তু প্রণাম করবে। ঘরে ঢুকেই দেখলাম ছোট্ট-খাট্টো একটি মানুষ, পুরনো ধরনের চশমা নাকে এঁটে, মেজেতে বিছানায় বসে কী যেন লিখছেন। আমি প্রণাম করতেই চশমার উপর দিয়ে একবার চোখ তুলে চাইলেন, রাঙাকাকাবাবু পরিচয় করিয়ে দিতে মাথাটা একটু নাড়লেন, কিন্তু মুখের ভাবের বিশেষ পরিবর্তন হল না। সরোজিনী নাইডু গান্ধীজিকে একবার মিকি মাউস বলে অভিহিত করেছিলেন। আমি ভাবলাম এই মিকি মাউসটি আমাদের দেশের একচ্ছত্র নেতা। স্বীকার করছি গান্ধীজিকে প্রথম দেখে আমি একটু দমেই গিয়েছিলাম। সেই সময় তিনি নিশ্চয়ই গুরুতর কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলেন এবং আমার মতো কিশোরের দিকে নজর দেওয়ার অবকাশ ছিল না। কিন্তু তার পর দিনের পর দিন নানা অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন কাজের মধ্যে তাঁকে দেখে আমি সত্যিই খুব অভিভূত হয়েছিলাম। এক অতি অসাধারণ ব্যক্তি যে আমাদের দেশের নেতা সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। 

গান্ধীজি ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে বেশ কিছুদিন ছিলেন। সেই সময় কত রকম লোক যে উডবার্ন পার্কে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। অন্য কংগ্রেস-নেতাদের মধ্যে জওহরলাল ছাড়া রাজেন্দ্র প্রসাদ, বল্লভভাই প্যাটেল, সরোজিনী নাইডু ও মৌলানা আজাদকে বেশ মনে আছে। রাজেন্দ্র প্রসাদ সম্বন্ধে আমার ধারণা হয়েছিল যে, তিনি একজন অতি বিনয়ী ভদ্রলোক এবং গান্ধীজির একান্ত অনুগত। ক্রমাগতই হাঁপানিতে ভুগতেন, সেজন্য তিনতলায় ওঠানামা করতে তাঁর বেশ কষ্ট হত। বল্লভভাইয়ের এমন গম্ভীর মেজাজ যে, আমরা কাছে ঘেঁষতে চাইতাম না। তবে তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে কোনো কথা ছিল না। সন্ধ্যায় বেড়াবার সময় গান্ধীজির সঙ্গে প্রায়ই মৌলানা আজাদ থাকতেন। তাঁর চেহারা বেশ আকর্ষণীয় ছিল। সরোজিনী নাইডু খুব কথা বলতেন, ইংরেজি তো নয়, যেন সংগীতের মূর্ছনা। সকলের সঙ্গেই তিনি অন্তরঙ্গ। খেতে খুব ভালবাসতেন এবং খেতেনও, যদিও প্রায়ই বলতেন ডাক্তার রায়ের বারণ আছে। 

২৪

ষাটের দশকের শেষের দিকে একদিন ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরছি, প্রবীণ শিখ ড্রাইভার নানারকম গল্প করতে-করতে বাড়িতে পৌঁছে দিল। গাড়িবারান্দায় থেমেই বলে উঠল, “তুমি শরৎবাবুর বাড়িতে আসবে আগে বলোনি কেন, এ-জায়গাটা আমার খুব চেনা। কতবার কত লোককে এখানে পৌঁছে দিয়েছি।” বিশেষ করে তিরিশ বছর আগেকার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। বলল, “তখন গান্ধীজি এখানে রয়েছেন, আমরা দল বেঁধে এসেছি সন্ধ্যায় তাঁর প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে। ছাদ ভরে গিয়েছে, সেজন্য আমরা ঐ দরজাটার সামনে ধস্তাধস্তি করছি। শেষ পর্যন্ত দরজার বড় কাঁচটা আমাদের চাপে ভেঙে গেল!

কথাটা শুনে আমারও সেই সময়কার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। সন্ধ্যায় প্রার্থনাসভার সময় ভিড় সামলাতে আমাদের হিমসিম খেতে হত। মনে আছে আমি একদিন লোহার কোলাপসিব্‌ব্ল গেট ধরে সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। ছাদে আর জায়গা নেই। গাড়িবারান্দায় যাঁরা আছেন তাঁদের অনেক বোঝাবার চেষ্টা করছি, বলছি, বুঝতেই তো পারছেন এটা পাবলিক প্লেস নয়, বসতবাড়ি, জায়গা কম; আপনারা আর একদিন আসুন। এক ভদ্রলোক আমাকে শাসিয়ে বললেন, “দ্যাখো তোমার যুক্তি আমি মানতে রাজি নই, মহাত্মা গান্ধী ইজ এ পাবলিক ম্যান, হোয়্যারএভার হি স্টেজ বিকামস এ পাবলিক প্লেস। তাঁর প্রার্থনাসভায় যোগ দেবার অধিকার থেকে তুমি আমাদের বঞ্চিত করতে পারো না।” 

সন্ধ্যায় উডবার্ন পার্কের বাড়ির ছাদটা প্রার্থনাসভার সময় ভরে তো যেতই, কত লোক যে আশেপাশে বারান্দায় বা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকত তার হিসেব নেই। তাছাড়া বাড়ির সামনের রাস্তায় বিকেল থেকেই ভিড় জমে থাকত। তারা মাঝে-মাঝে’গান্ধী মহারাজ কি জয়’ ধ্বনি দিত। প্রার্থনাসভা আরম্ভ হবার আগে গান্ধীজি মাঝে-মাঝে ছাদের ধারে এসে তাদের দর্শন দিতেন। তাঁকে দেখা গেলে আরও ঘন-ঘন ও সজোরে ধ্বনি উঠত। 

আমাদের বাড়িতে প্রার্থনাসভায় কেবল যে রামধূন হত তা-ই নয়, অন্য ধরনের অনুষ্ঠানেরও ব্যবস্থা করা হত। সবচেয়ে জমত যখন দিলীপকুমার রায় গান গাইতেন। ভক্তিমূলক ও দেশাত্মবোধক গান তো গাইতেনই। মাঝে-মাঝে ইংরেজিতেও প্রার্থনা-সঙ্গীত গাইতেন। এক সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ ধরে তিনি ‘অ্যাবাউড উইথ মি’ গেয়েছিলেন। কী পবিত্ৰ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। উমা বসুকে তিনিই সঙ্গে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন, যাঁর গান শুনে গান্ধীজি তাঁকে “নাইটিঙ্গেল অব ইণ্ডিয়া” নাম দিয়েছিলেন। 

এই সূত্রে দিলীপবাবুর কথা একটু বলে নিই। গান্ধীজি আমাদের বাড়িতে আসবার কিছু আগে দিলীপকুমার আমাদের সঙ্গে বেশ দিনকতক ছিলেন। গানের আসর ছাড়াও তাঁর প্রাণোচ্ছল কথাবার্তায় সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতেন। ছোটদের সঙ্গে সমানে তাল দিয়ে চলতে পারতেন। দুপুরে তিনি যখন খেতে বসতেন মা তো থাকতেনই, আমরাও আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতাম তাঁর রসিক মনের আস্বাদ পাবার আশায়। একদিন বললেন, তোমাদের একটা পরীক্ষা নেব, শব্দ ঠিকমতো উচ্চারণ করার পরীক্ষা। দু’লাইনের একটা ছড়া ঠিকমতো যে যত তাড়াতাড়ি বলতে পারবে, তার ততই কৃতিত্ব। তিনিও আমাদের সঙ্গে পাল্লা দেবেন। ছড়াটি হল : 

তেলে চুল তাজা 
জলে চুন তাজা 

তাড়াতাড়ি করে বলতে গিয়ে আমাদের তো কথা উল্টোপাল্টা হয়ে যায় কিংবা উচ্চারণে আটকে যায়। দিলীপবাবুই শেষ পর্যন্ত জিতে গেলেন। 

তিনি তো গেরুয়া পরতেন। আমি ভাবতাম গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসী এত হাসিখুশি হন কী করে। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ও সখ্য কারুরই চোখ এড়াত না। যুদ্ধের পর দিলীপবাবুর সঙ্গে বেশ কিছুকাল দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর কাজ খানিকটা এগোবার পর আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি, পুনাতে তাঁর আশ্রমে গিয়ে দেখা করি। তাঁর কাছে রাঙাকাকাবাবুর যা চিঠিপত্র ছিল, সেগুলো তো অসঙ্কোচে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেনই, শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত তিনি রিসার্চ ব্যুরোর কাজে ক্রমাগত আমাদের উৎসাহ ও আশীর্বাদ দিয়ে গেছেন। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর দুটি খুব বড় অনুষ্ঠানে তিনিই প্রধান ছিলেন। বারেবারেই আমাকে বলেছেন, “এটা খুব বড় কাজ, চালিয়ে যেও। দেশ যদি সুভাষকে ভুলে যায় তাহলে দুঃখের আর সীমা থাকবে না।” 

একদিন তো গান্ধীজির জন্য আমাদের ছাদে উড়িষ্যার ছৌ-নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছিল। আর একদিন হল ব্রতচারী নাচ, গুরুসদয় দত্ত নিজে নাচ পরিচালনা করলেন এবং নাচে অংশগ্রহণও করলেন। ঐ দুদিন আমাদের মনে হয়েছিল বুঝিবা আমাদের ছাদ ভেঙে পড়বে। অতগুলো মানুষের দাপাদাপি এবং সঙ্গে-সঙ্গে সমবেতকণ্ঠে গান ও ঢাক-ঢোলের কান-ফাটানো আওয়াজ! 

সকাল-সন্ধ্যায় লাঠি হাতে কারুর কাঁধে ভর দিয়ে এই ছাদেই গান্ধীজি পায়চারি করতেন। গরমের দিনে অতি সাধারণ একটি খাটে শুয়ে ছাদে রাতও কাটিয়েছেন। উঠতেন ভোর চারটেতে। সেজন্য ভোরের প্রার্থনাসভা ও বেড়ানোর খবর আমি জানি না। রাত আটটা নাগাদ শুয়ে পড়তেন। আমি এখনও ভেবে অবাক হই, রাত না জেগে গান্ধীজি এত কাজ কী করে করতেন। তাঁর সারাদিনের প্রোগ্রাম ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলত, কোনও কারণেই তার হেরফের হত না। সন্ধ্যায় তাঁর খাবার সময় ছটা, এক মিনিট আগেও হবে না, এক মিনিট পরেও হলে চলবে না। যদি কোনও বিশেষ অতিথি সেই সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান, তিনি এসে কথা বলতে পারেন, গান্ধীজি কিন্তু খেতে-খেতেই তাঁর কথা শুনবেন। 

গান্ধীজি তাঁর পাশে বেশ কয়েকটি অনুগত শিষ্য-শিষ্যা পেয়েছিলেন। আর পেয়েছিলেন সত্যিই একজন দক্ষ সেক্রেটারি—মহাদেব দেশাই। মহাদেব দেশাই এত কাজের মধ্যে অভাবনীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন। তাঁকে অবশ্য খাটতে হত খুব কিন্তু মুখে সব সময়েই হাসি লেগে থাকত। মহাদেব দেশাই বেশ ভালই বাংলা জানতেন এবং দু-চার ছত্র বাংলা লিখে মাঝে-মাঝে আমাদের দেখাতেন। গান্ধীজিও নাকি সেই সময় বাংলা শিখেছিলেন। মহাদেব দেশাইকে সাহায্য করতেন পিয়ারেলাল। গান্ধীজির দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সুশীলা নায়ার, কানু গান্ধী ও আভা গান্ধী। একবার কস্তুরবাও এসেছিলেন কয়েকদিনের জন্য। তাঁর শান্ত স্নিগ্ধ চেহারা ও ব্যবহারে সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। 

গান্ধীজি যখন আমাদের মধ্যে থাকতেন, সাত-সকালে ঘণ্টা বাজিয়ে হাজির হত একটা ছাগল, সঙ্গে আসত দুটি ছাগ-শিশু। গান্ধীজি যে ছাগলের দুধ খেতেন, সেটা তো সকলেই জানেন। তবে তাঁর খাওয়া-দাওয়ার ধরনটা আমাদের একটু অদ্ভুত ঠেকত। শাকসব্জি সিদ্ধ, দই ও রসুনবাটা ইত্যাদি একটা কাঠের পাত্রে নিজের হাতে মিশিয়ে তিনি একটা জগাখিচুড়ি তৈরি করতেন—খেতে কেমন হত কে জানে! সঙ্গে কিছু ফলমূল থাকত। তিনি কিন্তু বেশ তৃপ্তি করে খেতেন। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সম্বন্ধে তাঁর একান্ত নিজস্ব কিছু মতামত ছিল—পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব বের করেছিলেন বলে তিনি দাবি করতেন। ডাক্তারদের মতামতের তিনি বড় একটা ধার ধারতেন না, তা সেই ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় বা যে-কেউ হোন না কেন। আমাদের রান্নাবাড়িতে পিয়ারেলাল এক বিশেষ দেশী যন্ত্রের সাহায্যে গান্ধীজির জন্য পাঁউরুটি তৈরি করতেন। কিন্তু গান্ধী-মার্কা পাঁউরুটি খেতে খুব ভাল হত বলে আমাদের মনে হত না। সেই সময় কলকাতার বিশেষ কোনও হোটেলের পাউরুটির বেশ নামডাক ছিল। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গান্ধীজিকে সেই পাউরুটি চেখে দেখতে রাজি করানো গেল। খেয়ে তিনি কিন্তু স্বীকার করলেন যে, আমাদের পাঁউরুটিই ভাল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *