৪৫
বারারির পথে যখন ধানবাদ শহরের এক পাশ দিয়ে বেরোচ্ছি, তখন কেমন যেন আশঙ্কা হল, কেউ যদি দেখে ফেলে! তখন তো বেশ আলো ফুটে গেছে! সেজন্য গাড়ির স্পীডটা যতটা পারি বাড়িয়ে দিলাম। দিনের আলো ছিল বলেই বোধহয় বারারির রাস্তা খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি। অন্ধকারের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলতে পারতাম! দূর থেকে যখন দাদার বাড়িটা দেখতে পেলাম, তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সতেরোই জানুয়ারির সারা দিনের প্ল্যানটা কী রকম হবে এবং আমাকে কীভাবে কী করতে হবে, সব কিছু রাঙাকাকাবাবু আমাকে পাখি পড়াবার মতো করে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাঁকে দাদার বাড়িটা কিছু দূর থেকে ভাল করে দেখিয়ে দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেব। আমি একলা গাড়ি চালিয়ে দাদার বাড়িতে উপস্থিত হব। দাদাকে বলব যে, আমি ছদ্মবেশে রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে এসেছি। তিনি কিছুক্ষণ পরে হেঁটে দাদার বাড়িতে হাজির হবেন। এসে বাড়ির বেয়ারাকে বলবেন যে, তিনি দাদার সঙ্গে দেখা করতে চান। দাদাকে বলবেন, তিনি একটি ইন্সিওরেন্স কোম্পানির পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে ব্যবসা-সংক্রান্ত কথা বলতে চান। দাদা উত্তরে বলবেন যে, তাঁকে তো একটু পরেই কারখানায় চলে যেতে হবে, সুতরাং সকালে কথা বলার সময় হবে না। তাতে রাঙাকাকাবাবু বলবেন যে, তিনি অনেক দূর থেকে এসেছেন। সন্ধ্যার আগে ট্রেনও নেই। দাদা যদি অনুগ্রহ করে তাঁকে বাইরের কোনো ঘরে দিনটা কাটাতে দেন, তাহলে তিনি খুব বাধিত হবেন। কথাবার্তা সবই ইংরেজিতে হবে, আশপাশের লোকজন শুনতে পেলে ভালই।
দাদা তারপর তাঁর লোকজনকে হুকুম দেবেন যে, আগন্তুকের থাকার জন্য বাইরের দিকের ঘরে ব্যবস্থা করে দিতে। তারপর তিনি রাঙাকাকাবাবুকে বসবার ঘরে ডেকে নিয়ে আসবেন এবং অন্য লোকজনের সামনে ইংরেজিতে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন। চা খাবার পরে রাঙাকাকাবাবুকে বাইরের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। দাদা যখন দুপুরে খেতে আসবেন তখন শলাপরামর্শ করে সন্ধ্যায় আবার যাত্রার প্ল্যানটা পাকা করে ফেলা হবে।
আমি দাদার বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম দুটি লোক সামনেই রয়েছে, তার মধ্যে একজন ড্রাইভার, সে দাদার গাড়িটা পরিষ্কার করছিল। আমাকে যে তারা একলা আসতে দেখল, তাতে আমি খুশিই হলাম। কফির ফ্লাস্ক আর আমার হাতে ছোট ব্যাগটা নিয়ে সময় নষ্ট না করে বাড়ির ভেতরে চলে গেলাম। ড্রাইভারকে বললাম, গাড়িটা যেন সে গ্যারাজে তুলে দেয়। রাঙাকাকাবাবুর জিনিসপত্র গাড়ির ভেতরেই রইল। আমি সে-বিষয়ে কিছু বলিনি। বেলায় কিন্তু দাদার ড্রাইভার আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, জিনিসগুলি নামিয়ে আনবে কি না। ওদিকে তার দৃষ্টি পড়ায় আমি একটু চিন্তিতই হয়েছিলাম।
ভেতরে গিয়ে দেখলাম, দাদার ঘরের দরজা বন্ধ। খুব জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলাম। দাদা দরজা খুলতে দেরি করাতে আমি অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। আশঙ্কা হচ্ছিল, দাদাকে যা বলার আছে, তা বলার আগেই যদি রাঙাকাকাবাবু পৌঁছে যান তাহলে মুশকিল হবে। যাই হোক, দাদা দরজা খুলতেই আমাকে যা পড়ানো ছিল মুখস্থ বলে গেলাম। দাদা যে খুবই আশ্চর্য হয়ে গেছেন, তা তাঁর মুখের চেহারা থেকেই বোঝা গেল।
একটু পরেই বেয়ারা এসে খবর দিল যে, এক মুসলমান ভদ্রলোক দাদার সঙ্গে দেখা করতে চান। দাদা বারান্দায় বেরিয়ে কথাবাতা বললেন। অবশ্যই যেমন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। আমি বসবার ঘর থেকে তাঁদের কথাবার্তা শুনলাম।
আগন্তুক দিনের বেলাটার জন্য আশ্রয় চাওয়াতে দাদা তাঁকে বসবার ঘরে এসে বসতে বললেন। বেয়ারাকে ডেকে তাঁকে চা দিতে বললেন এবং আমার সঙ্গে ইংরেজিতে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। হাসি যে পাচ্ছিল না তা নয়, তবে নিজেকে আমি সংযত রাখতে পেরেছিলাম। একটু পরেই আমি বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গিয়ে বৌদিদির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম।
বেয়ারাকে বলা হল অতিথিকে প্রাতরাশ বাইরের ঘরে দিতে। ঘরটা কিন্তু শোবার ঘরই ছিল। সারা সকালটা রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ হল না। বেয়ারার কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল অন্তত তার ক্ষেত্রে আমাদের প্ল্যান সফল হয়েছে। সে বলল, তার মনে হচ্ছে ভদ্রলোক উত্তরপ্রদেশের খানদানি মুসলমান। দাদা দুপুরে খেতে এলেন। তারপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর কথাবার্তা হল।
আসানসোল বা ধানবাদ স্টেশন থেকে ট্রেন ধরাটা ঠিক হবে না মনে হল। কারণ, স্টেশনগুলি বড়, লোকজন অনেক। ধানবাদের পরের স্টেশন গোমোকেই রাঙাকাকাবাবু বেছে নিলেন। স্টেশনটা ছোট, তা ছাড়া রাতও বেশি হবে, লোকজন থাকবে না। সমস্যা হল বারারি থেকে গোমো যাবার রাস্তা আমার ভাল জানা নেই। আমি চাইলাম, দাদা আমাদের সঙ্গে থাকুন। কিন্তু অন্য এক সমস্যা দেখা দিল। ওই এলাকায় অত রাতে বৌদিদিকে একলা বাড়িতে ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবু বললেন, বৌদিদিও সঙ্গে যাবেন। বৌদিদিকে প্রস্তুত করবার ভার দাদার ওপর রইল।
আমরা যখন ভেতরে খাওয়া-দাওয়া করছি, রাঙাকাকাবাবু তখন অন্য ঘরে অতিথির মতো রয়েছেন। আমি তো একেবারে দূরে সরে রইলাম, যাতে কেউ না মনে করে যে, আমার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ আছে। খাওয়া-দাওয়া সেরে রাঙাকাকাবাবু বেশ কিছুক্ষণ ঘুমোলেন। তাঁর গভীর নিশ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। আমি গাড়ি বাগিয়ে দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম। ঝরিয়ার বাজারে গিয়ে গাড়িতে পেট্রোল ভরলাম, চাকার হাওয়া-টাওয়া চেক্ করলাম, বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।
শীতের দিন, দাদার কারখানা থেকে ফিরতে-ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। আবার একবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তাঁর পাকাপাকি কথাবার্তা হল।
বাড়ির লোকজনদের বলা হল যে, সন্ধ্যার পরে আমাকে নিয়ে দাদা-বৌদিদি বেড়াতে বেরোবেন, সেজন্য সকাল-সকাল খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া হবে। অতিথিকেও তাঁর ঘরে খাবার দিতে বলা হল। খাওয়া সেরে রাঙাকাকাবাবু আবার পুরো ছদ্মবেশ ধারণ করে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। সেখানে বেশ জোর গলায় ইংরেজিতে দাদাকে ও আমাকে গুডবাই বলে বাড়ি থেকে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরেই ওয়াণ্ডারার গাড়িতে করে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। খানিকটা এগিয়ে রাস্তার ধারে রাঙাকাকাবাবুকে পেলাম এবং তাঁকে গাড়িতে তুলে নিলাম। তারপর দাদার নির্দেশমতো গোমোর দিকে গাড়ি চালিয়ে দিলাম। বেশি দূর নয়, মাইল-তিরিশেক পথ। দিল্লি-কালকা মেল গোমো পৌঁছতে রাত দেড়টা তো হবেই। হাতে সময় অনেক। সকলকে মুখ বন্ধ করে রাখার একান্ত গুরুত্ব সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবু বার বার বললেন। আমাকে কলকাতায় ফিরে গিয়ে যারা ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু জানে, যেমন ইলা, দ্বিজেন ও অরবিন্দ তাদের বিশেষ করে বলতে বললেন, ‘টু কীপ দেয়ার মাউথ শাট্।’ পথে আমরা দুবার দাঁড়ালাম, একবার বনেঘেরা রাস্তার মধ্যে, আর একবার জ্যোৎস্নায় উজ্জ্বল ধানের খেতের ধারে। প্রথমবার গোরুর গাড়ির এক লম্বা সারি আস্তে আস্তে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। বনের মধ্যে নির্জন রাতে গোরুগুলোর গলায় ঝোলানো ঘণ্টার মৃদু আওয়াজের সঙ্গে গাড়িগুলির নীচে টিমটিমে আলো মিলে যেন একটা স্বপ্নের রাজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ধানের খেতের উপর জ্যোৎস্না যেন আছড়ে পড়ছিল। প্রকৃতির ওই স্নিগ্ধ চেহারা আমাকে গভীরভাবে অভিভূত করে ফেলেছিল। ভাবছিলাম, এখন তো সবই খুব শান্ত, পরে কি ঝড় উঠবে!
গোমো স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন ট্রেন আসতে কিছু দেরি আছে। সেখানেও সকলে ঘুমন্ত। স্টেশনের বাইরের চত্বরে গাড়ি রেখে রাঙাকাকাবাবুর তিনটি জিনিস নামিয়ে ফেললাম। পাশেই একটা ঢাকা দালান। অনেক ডাকাডাকি করে একটি কুলি পাওয়া গেল। সে জিনিসগুলি তুলে নিল। কয়েক মুহূর্ত আমরা নিষ্পলকে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম। শেষে রাঙাকাকাবাবু বললেন, “আমি চললাম, তোমরা ফিরে যাও।” তারপর ধীর পদক্ষেপে ওভারব্রিজের দিকে এগোলেন।
আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তিনি তাঁর স্বাভাবিক দৃপ্ত ভঙ্গিতে ওভারব্রিজ পার হয়ে ওপারের সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। পরে মনে হল, বসুবাড়ির রীতি-মতো প্রণাম করতে ভুলে গিয়েছি।
স্টেশনের বাইরে এসে আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। হুশ্-হাশ্ শব্দ করে ট্রেন ছাড়ল। দেখতে পেলাম, দিল্লি-কালকা মেল একটি আলোর মালার মতো চাকার আওয়াজের সঙ্গে তাল রেখে নাচতে নাচতে দৃশ্যের বাইরে চলে গেল।
বারারিতে যখন ফিরলাম তখন রাত তিনটে হবে। ঘুমিয়ে পড়লাম। দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে সকাল নটা নাগাদ কলকাতার দিকে রওনা দিলাম। মনটা তখন একেবারে হালকা হয়ে গেছে। প্রকাণ্ড একটা ভার যেন নেমে গেছে। নিজের মনে এত গান আমি কখনও গাইনি। কেউ তো আর শুনতে পাচ্ছে না, সুতরাং গলা ছেড়েই গাইলাম। মাঝে মাঝে থেমে বাংলার মাঠ, ঘাট, গ্রাম ও ধানের খেত দেখলাম। চুঁচুড়ার কাছাকাছি পুলিশের একটা সমাবেশ দেখে হঠাৎ মনে হল, ওরা হয়তো আমাকে ধরার জন্যই অপেক্ষা করছে! পুলিশেরা কিন্তু ভ্রূক্ষেপও করল না। ওয়াণ্ডারার গাড়িটা কোনোরকম অসুবিধা না ঘটিয়ে বেলা চারটে নাগাদ আমাকে ১ নম্বর উডবার্ন পার্কে ফিরিয়ে আনল। বাড়িতে ঢুকতেই বাবার ড্রাইভার সামসুদ্দিন এগিয়ে এল। তার হাতে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমি তাড়াতাড়ি দোতলায় ওঠে গেলাম।
৪৬
বাড়িতে ফিরেই আমার বাবার সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। দোতলার দালান থেকে এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলাম, বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। সেদিনটা ছিল শনিবার, কোর্ট নেই, সুতরাং অবসর থাকার কথা। মাঝের বড় ঘরে মা ছিলেন, চোখাচোখি হয়ে গেল। তাতেই কাজ হল, বাবা খবর পেয়ে গেলেন। আমি সরে এসে ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই বাবা এসে পড়লেন। বেশ উৎকণ্ঠার সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলেন সব-কিছু ঠিকমতো হয়েছে কি না। আমি বাবাকে মোটামুটি সবটাই সংক্ষেপে বললাম এবং তাঁকে আশ্বস্ত করলাম যে, আমাদের পুরো পরিকল্পনাটাই খুব ভালভাবে কার্যকর করা গেছে। কিন্তু বাবা যখন বললেন যে, তিনি আমার কাছ থেকে কোনো টেলিগ্রাম আশা করেননি, তখন আমি বেশ আশ্চর্য হলাম। তিনি বললেন, আমরা চলে যাবার পর তাঁরও মনে হয়েছিল যে, কাজটা ঠিক হবে না।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন আমি কতটা ক্লান্ত। এতক্ষণ আমার কিছুই মনে হয়নি, কিন্তু বাবা কথাটা তোলার পরেই যেন বুঝতে পারলাম, পা দুটো বেশ ধরে গিয়েছে আর ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সেদিনই দেশবন্ধুর নাতনি মিনুর বিয়ে। বাবা বললেন যে, আমাকে কিন্তু বিয়েবাড়ি যেতেই হবে। আমি অনুপস্থিত থাকলে নানা লোকে নানা প্রশ্ন তুলবে। বাড়ির অন্যেরা আগে চলে যাক। বাবার কিছু কাজ আছে, তিনি খানিকটা পরে যাবেন। তাঁর সঙ্গে আমি যাব। উপরে নিজের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলাম। রাঙাকাকাবাবুর কথা বারে বারে মনে হচ্ছিল, সেজন্য ঘুম হল না। পরে স্নান-টান সেরে বিয়েবাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম।
বাবা কাজ সেরে আমাকে ডাক দিলেন। তাঁর সঙ্গে বড় স্টুডিবেকার গাড়িতে চড়ে বিয়েতে গেলাম। মনে হল যেন অন্য জগতে ছিলাম। আবার মর্তে ফিরে এসেছি। আমার এক সমবয়সী বন্ধু সেখানে আমাকেই রাঙাকাকাবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করে বসলেন। বললাম, তাঁর শরীরটা তো মোটেই ভাল নেই, বেরোচ্ছেন না, জেলে ফিরে যাবার অপেক্ষায় আছেন। ভাল খেয়ে-দেয়ে বাড়িতে ফিরেই শুয়ে পড়লাম। পরের দিন রবিবার মা’র কাছ থেকে দুদিনের রিপোর্ট নিতে হবে।
পরে বাবার ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসের ডায়েরির পাতা উলটে-পালটে দেখছিলাম। দেখলাম ১৫ই থেকে ১৭ই জানুয়ারি পাতাগুলি একেবারে ফাঁকা, কিছুই লেখেননি। ১৮ই জানুয়ারির পাতায় সকালে আইন-ব্যবসায় সংক্রান্ত একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং নীচের দিকে মিনুর বিয়ের কথা লেখা আছে।
মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলেছে কি না। গীতাকে নিয়েই সমস্যা। সে সবদিকে নজর রাখে, বিশেষ করে আমার গতিবিধির উপর। মা বললেন যে, সেদিন রাত্রে বা পরের দিন সারাদিন সে কিছু লক্ষ করেনি। সে ভেবেছিল আমি হয়তো ১৭ই জানুয়ারি খুব সকাল-সকাল মেডিকেল কলেজে চলে গিয়েছি। কিন্তু ১৭ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় গীতা ক্রমাগতই জিজ্ঞাসা করতে থাকে, লালদা (মানে আমি) কেন বাড়ি ফিরছে না। মা তো জানেন যে, আমি প্রায় আরও চব্বিশ ঘণ্টা বাড়ি ফিরব না। গীতাকে মা বললেন যে, রাঙাকাকাবাবুর কোনো কাজে আমি কলকাতার বাইরে গেছি। আমি মাকে বললাম, কেন তিনি রাঙাকাকাবাবুর নাম করতে গেলেন। তিনি উত্তরে কিছু বললেন না। আমি পরে কারণটা বুঝলাম, রাঙাকাকাবাবুর নাম করে বললে গীতা আর কোনো প্রশ্ন তুলবে না।
আর দুজন সম্বন্ধে আমার ভয় ছিল, ডাঁটিদাদা (রবীন্দ্রকুমার ঘোষ) ও মেজদা (গণেশ বা ধীরেন্দ্রনাথ)। এই দুজন প্রায় রোজই সন্ধ্যায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আসতেন। আমরা একসঙ্গে রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনতাম। জার্মানরা তখন তাদের ডুবোজাহাজ থেকে টর্পেডো চালিয়ে ইংরেজদের একটার পর একটা জাহাজ ডোবাচ্ছে। আকাশ থেকেও ইংল্যাণ্ডের উপর বোমা-টোমা ফেলছে। ইংরেজদের নাস্তানাবুদ হতে দেখে আমাদের স্বাভাবিকভাবেই খুব আনন্দ হত। ইংরেজদের কটা জাহাজ ডুবল, জার্মানরা ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে রেডিওতে তা ঘোষণা করত। ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ডাঁটিদা আর মেজদা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতেন। জার্মানদের কোনো বিপর্যয় হলে দুজনেই গম্ভীর মুখ করে বাড়ি ফিরে যেতেন, মোহনবাগান হেরে গেলে যেমন অনেকের হত। যা-ই হোক, আমি মার কাছে শুনে আশ্বস্ত হলাম যে, দুদিন সন্ধ্যায় দুজনের মধ্যে কেউই আসেননি।
বাবা আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে, আগের মতো আমি যেন রোজই এলগিন রোডের বাড়িতে যাতায়াত করি। বাড়িতে ফেরার পরের দিন সন্ধ্যায় এলগিন রোডের বাড়িতে প্রথমেই ইলার সঙ্গে দেখা করলাম। পরে তিনতলার ছাদে দ্বিজেন, অরবিন্দ ও ইলার সঙ্গে কথাবার্তা হল। ওদের জানালাম যে, সবই প্ল্যানমতো হয়েছে এবং রাঙাকাকাবাবু সকলকে বিশেষ করে বলে দিয়েছেন ‘টু কীপ দেয়ার মাউস্ শাট্’। পর পর কয়েকদিন গল্পগুজবের পর ইলা এদিক-ওদিক দেখে আমাকে রাঙাকাকাবাবুর পর্দা-টাঙানো ঘরে ঢুকিয়ে দিত। আমি ভিতরে গিয়ে বেশ একথালা মিষ্টি, ফল ইত্যাদি খেয়ে বেরিয়ে আসতাম। একদিন আমরা ক’জন গাড়িবারান্দার ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। রাঙাকাকাবাবুর খালি ঘরে নিয়মমতো আলো জ্বলছে। মেজদা হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে বলে উঠলেন, কী করে যে মানুষ ঐরকমভাবে একটা ঘরে নিজেকে বন্দী করে রাখতে পারে, তিনি বুঝতে পারেন না। শুনে চমকে উঠলাম। ভাবলাম তিনি কি কিছু সন্দেহ করে কথাটা বললেন, না বিশ্বাস করেই নিজের মনের কথা প্রকাশ করলেন।
সোমবার ২০শে জানুয়ারি আলিপুর কোর্টে রাঙাকাকাবাবুর মামলা উঠবে। সেদিন তাঁর কোর্টে হাজির হবার কথা। রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন যে, আমরা যদি দিন তিন-চার ব্যাপারটা চেপে রাখতে পারি, তাহলে তিনি ঠিক ‘পগার পার’ হয়ে যাবেন। কিন্তু সোমবারের মামলাটা অন্তত সপ্তাহখানেক মুলতবি রাখবার চেষ্টা করতে তিনি বলে গিয়েছিলেন।
হাতে নতুন ডাক্তারি সার্টিফিকেট নেই। এমনিতেই সার্টিফিকেট পেতে অসুবিধা হচ্ছিল। নতুনকাকাবাবু ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে শেষের দিকে বলছিলেন যে, জেলে, যাওয়া তো সুভাষের ডালভাত। সে জেলে যাওয়া এড়াবার জন্য বারবার ডাক্তারি সার্টিফিকেট চাইছে কেন, এটা ভাল দেখায় না। ডাক্তার মণি দে যখনই আসেন, নতুনকাকাবাবুকে সঙ্গে করে নিয়ে রাঙাকাকাবাবুকে দেখতে আসেন। নতুনকাকাবাবু যদি বেঁকে বসেন, তাহলে ডাক্তার দে’র কাছ থেকে সার্টিফিকেট বের করা যাবে না। সুতরাং শেষবার রাঙাকাকাবাবু বিখ্যাত সার্জেন ডাক্তার পঞ্চানন চ্যাটার্জিকে ডাকবেন। ডাক্তার চ্যাটার্জির সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। রাঙাকাকাবাবু ব্যবস্থা করলেন যাতে নতুনকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা না করিয়ে পঞ্চাননবাবুকে সোজা তাঁর ঘরে নিয়ে আসা হয়। রাঙাকাকাবাবুর তো অনেকদিনের সায়াটিকার ব্যথা ছিল। সার্জেনকে আলাদা করে দেখানোতে কোনো অপরাধ নেই। ডাক্তার চ্যাটার্জি রাঙাকাকাবাবুকে পরীক্ষা করে ঠিকমতো সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু, সেই সার্টিফিকেট তো একবার ব্যবহার করা হয়ে গেছে। সুতরাং আমরা ঠিক করলাম, পঞ্চাননবাবুর কাছে গিয়ে শেষবারের মতো ‘রুগি না দেখে আর একটা সার্টিফিকেট যোগাড় করব। আমি যদিও তখন মেডিকেল কলেজে জুনিয়র ছাত্র, পঞ্চাননবাবু আমাকে চিনতেন। সোমবার সকালে ওয়াণ্ডারার গাড়ি চড়ে মেজদা, গণেশ, দ্বিজেন ও আমি বিডন স্ট্রীটে পঞ্চাননবাবুর বাড়ি ছুটলাম। কিন্তু তার আগেই ডাক্তার বেরিয়ে পড়েছেন। তখন আমরা তাঁর খোঁজে মেডিকেল কলেজে এলাম। হাসপাতালে পঞ্চাননবাবুর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি তিনি সেখানেও নেই। এদিকে কোর্টের সময় তো এগিয়ে আসছে। তখন আমরা ঠিক করলাম যে, দেরি না করে আমরা রাঙাকাকাবাবুর কৌঁসুলি দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে যাব। কালীঘাটে তাঁর বাড়ির সামনে আমি কিন্তু গাড়িতেই বসে রইলাম,যেমন মেডিকেল কলেজে অন্যেরা গাড়িতে বসে ছিলেন। দেবব্রতবাবু নাই বা জানলেন যে, ব্যাপারটার সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ আছে। যাই হোক, দ্বিজেন ও মেজদা দেবব্রতবাবুর সঙ্গে কথা বললেন। দেবব্রতবাবু আশ্বাস দিলেন যে, তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন ম্যাজিস্ট্রেটকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটা সপ্তাহ মামলাটা আটকে রাখতে। দেবব্রতবাবুকে বলা হয়েছিল যে, রাঙাকাকাবাবু শেষবারের মতো এক সপ্তাহ সময় চাইছেন, পরের সোমবার তিনি অতি অবশ্য কোর্টে হাজির হবেন। দুপুরেই খবর পাওয়া গেল যে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব রাঙাকাকাবাবুর উকিলের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাগ্যিস সময়টা পাওয়া গিয়েছিল। কারণ, পরে জানতে পেরেছিলাম যে, পেশোয়ার থেকে আফগান সীমান্তের দিকে রওনা হতে রাঙাকাকাবাবুর বেশ কয়েকদিন দেরি হয়ে গিয়েছিল।
পরের দিন-দুয়েক খুব সাবধানে কাটাতে হল। প্রথমত রাঙাকাকাবাবুর নির্জনবাসের ধোঁকাটা ঠিকমতো চালু থাকা চাই। পরের বড় সমস্যা হল, কীভাবে তাঁর অন্তর্ধানের খবরটা ফাঁস করা হবে। আমাদের বরাত ভাল যে, বাইরের কেউ নির্জনবাসের ব্যাপারে অস্বাভাবিক কৌতূহল বা সন্দেহ প্রকাশ করেননি। পুলিশের দিক থেকে তো বিশেষ কোনো ব্যস্ততা লক্ষ করা যায়নি।
বাবা চিন্তা করে মনে মনে একটা পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছিলেন। এ-বিষয়ে সব ঠিকঠাক করার জন্য একদিন দুপুরে বাবা উডবার্ন পার্কের তাঁর শোবার ঘরে দ্বিজেন, অরবিন্দ আর আমাকে ডাকলেন। ঠিক হল, শনিবারের খাবারটা না-খেয়ে ফেলে রাখা হবে। রাঙকাকাবাবু কেন খাবার খাননি, সর্বেশ্বর ঠাকুর নিশ্চয়ই এই নিয়ে শোরগোল তুলবে। তখন অরবিন্দ, দ্বিজেন ও অন্যেরা প্রথমে পর্দার বাইরে থেকে ডাকাডাকি করবে। সাড়া না-পেয়ে পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে ‘আবিষ্কার’ করবে যে, রাঙাকাকাবাবু ঘরে নেই। তারপর শুরু হবে দৌড়দৌড়ি ও খোঁজাখুঁজি। বাবা আমাদের সকলকে নিয়ে অভ্যাসমতো উইক-এড্-এর ছুটি কাটাতে রিষড়ার বাগানবাড়িতে থাকবেন। ‘আবিষ্কার’-এর পর একদল গাড়ি নিয়ে ছুটবে বাবাকে খবর দিতে। অতঃপর বাবা যা করণীয় করবেন।
৪৭
রবিবার, ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৪১। বাবা-মা’র সঙ্গে আমরা সকলে রিষড়ার বাগানবাড়িতে রয়েছি। সেইদিন সকালে রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানের খবর পরিকল্পনামতো প্রচার করে দেওয়া হবে। সকাল থেকে বাবা মা ও আমার উৎকণ্ঠা। বাড়ির অন্য কেউ তো কিছু জানে না। সকলকেই বলা হয়েছে, রবিবারটা রিষড়ায় কাটিয়ে আমরা সোমবার সকালে কলকাতায় ফিরব।
বেলা যত বাড়ছে, আমাদের উৎকণ্ঠাও তত বাড়ছে। বাবা তো উপরের বারান্দায় পায়চারি করছেন। মাঝে মাঝে গঙ্গার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করছেন, আবার ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘বড্ড দেরি হচ্ছে যে, সবকিছু ঠিকমতো হল তো?’ আমি কিছুই মন্তব্য করছি না। আমার চিন্তা, রাঙাকাকাবাবু ইতিমধ্যে ঠিকমতো সীমান্ত পেরোলেন কি না
আমাদের দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল। তখনও কোনো খবর নেই। আমরা খেয়ে নিয়ে যে যার ঘরে চলে গেলাম। বাবা কিন্তু মাঝে মাঝে বারান্দায় বেরিয়ে কান পাতছেন। আমিও উঁকিঝুঁকি মারছি। শেষ পর্যন্ত—তখন প্রায় দুটো বাজে—একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। দেখা গেল গাড়ি থেকে নেমে অরবিন্দ ও মেজদা গণেশ হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির দিকে আসছে। আমি তাদের দূর থেকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। অরবিন্দ এসেই মেজোজ্যাঠাবাবুর খোঁজ করল, খুব জরুরি কাজ! বাবা তাদের নিজের শোবার ঘরে ডেকে নিলেন। সেখানে পরিকল্পনামতো কথাবার্তা হল।
মেজদা আমার ঘরে এসে আমাকে ঠেলাঠেলি আরম্ভ করল। বলতে লাগল, “ওঠ, ওঠ, ভয়ানক খবর। রাঙাকাকাবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না। “
আমি বললাম, “অসময়ে এসে কী-সব যা-তা বলছ, পাওয়া যাচ্ছে না মানে আবার কী!” বলে পাশ ফিরে শুলাম।
সে তখন বলল, “সত্যি বলছি, তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমরা মেজোকাকাবাবুকে বলতে এসেছি।”
আমি চোখ রগড়াতে রগড়াতে অবিশ্বাসের ভান করে পড়ে রইলাম।
বাবা সব শুনে তাদের বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। আর বললেন, সব গোছগাছ করে নিয়ে তিনি শিগগিরই কলকাতায় আসছেন। সকলকে বলা হল, একটা গুরুতর ব্যাপার ঘটে গেছে, সকলকে সেদিনই বাড়ি ফিরতে হবে। ঠিক হল, বাবাকে নিয়ে আমি প্রথমে চলে যাব। সঙ্গে সত্যবাদী ঠাকুরকে নিয়ে যাব, কলকাতায় গিয়ে সকলের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে তো! মা ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে পরে আসবেন।
কিছুক্ষণ পরে আবার সেই ওয়াণ্ডারার গাড়ি চালিয়ে বাবাকে পাশে ও সত্যবাদী ঠাকুরকে পেছনে বসিয়ে আমি কলকাতা রওনা হলাম। সত্যবাদীকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে বাবাকে নিয়ে আমি এলগিন রোডের বাড়িতে পৌঁছলাম। সেখানে তখন খুবই উত্তেজনা। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব একে-একে এসে পড়ছেন। সকলকেই এককথা বলা হচ্ছে। সকালে খাবারটা পড়ে থাকতে দেখে সর্বেশ্বর ঠাকুর শোরগোল তোলে। তারপর বাড়ির অন্যেরা জড়ো হয়ে পর্দার বাইরে থেকে রাঙাকাকাবাবুকে ডাকাডাকি করে। কোনো সাড়া না পেয়ে তারা ভিতরে ঢুকে দেখে যে, ঘর ফাঁকা। তখন দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়, প্রথমেই বাড়ির আনাচেকানাচে, এমন কী চিলের ছাদ পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি চলে। কোথাও কোনো হদিস না পেয়ে বাবাকে রিষড়ায় খবর দিতে একটা গাড়ি ছোটে। অন্য একটা গাড়ি যায় দক্ষিণেশ্বরে।
এলগিন রোডে পৌঁছে বাবা আর-একবার সকলের সামনে ব্যাপারটা গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত স্থির হয়ে বসে শুনলেন। ক্রমেই ভিড় বাড়তে লাগল। যে-কেউ আসেন, কিছু-না-কিছু পরামর্শ দেন। দেখলাম ভিন্ন ভিন্ন লোকের নানারকম ধ্যানধারণা। বাবা চুপ করে বসে যতটা সম্ভব সকলেরই মন রাখবার চেষ্টা করতে লাগলেন। আত্মীয়স্বজন ছাড়া বসুবাড়ির বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এসে পড়লেন, যেমন, আনন্দবাজারের সুরেশচন্দ্র মজুমদার, নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের নৃপেন ঘোষ প্রভৃতি।
বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বাবা উডবার্ন পার্কের বাড়িতে গিয়ে আলোচনা চালাবেন ঠিক করলেন এবং দলবল নিয়ে এ-বাড়িতে চলে এলেন। উডবার্ন পার্কের বাড়িতে নিজের অফিসঘরে বসে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে-বলতে একটার পর একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে লাগলেন। একটা গেল পণ্ডিচেরীতে, একটা গেল আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে ইত্যাদি। একজন বললেন, সুভাষকে হয়তো হাজারিবাগের কিছু দূরে ছিন্নমস্তার মন্দিরে পাওয়া যাবে। আর একজন বললেন, উত্তরভারতের তীর্থস্থানগুলিতে খোঁজ করা হোক। কিন্তু এ-সব জায়গায় খোঁজ করা হবে কী করে?
আমি ইচ্ছা করেই একটু দূর থেকে ব্যাপারস্যাপার লক্ষ করছিলাম। বাবা একবার আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “এঁরা বলছেন কেওড়াতলার শ্মশান ও কালীঘাটের মন্দিরে একটু খুঁজে এলে ভাল হয়, তুমি আর কাউকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে চলে যাও না।” আমি তথাস্তু বলে মেজদা, গণেশ ও তাঁর গোপালমামাকে সঙ্গে নিয়ে রাঙাকাকাবাবুকে খুঁজতে বেরোলাম। কেওড়াতলায় দেশবন্ধুর সমাধিমন্দিরের চারদিকে ঘুরলাম। দেখলাম, বেশ কয়েকটি লোক নেশা করে ঝিমুচ্ছে। কেওড়াতলায় সুবিধা না হওয়ায় কালীঘাটে চলে গেলাম। মন্দিরের চত্বরে কি আর সন্ধ্যায় কারুর হদিস পাওয়া যায়। এদিক-ওদিক দেখে আমিই একটু অধৈর্য হয়ে পড়লাম, বাড়ি ফিরতে চাইলাম।
গোপালমামা বললেন, কাছেই বড় একজন সাধক আছেন। তাঁর কাছে তিনি মাঝে মাঝে আসেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে হয়, কিছু যদি বলতে পারেন। আমরা তিনজনে সরু অন্ধকার একটা গলি দিয়ে সেই সাধুর ডেরায় পৌঁছলাম। দেখলাম সেখানেও একটি কালীমূর্তি রয়েছে। খবর দিতে তিনি বেরিয়ে এলেন এবং ব্যাপারটা কী জিজ্ঞাসা করলেন। গোপালমামা কাঁপা-কাঁপা গলায় ব্যাপারটা বললেন। শুনেই তিনি খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, “তোকে কি আমি আগেই বলিনি যে, সুভাষকে তোরা সংসারে আর রাজনীতিতে আটকে রাখতে পারবিনি! হল তো! সে তোদের মায়া কাটিয়েছে।”
গোপালমামার বিনীত অনুরোধে তিনি বললেন, “মনে হচ্ছে কলকাতার কিছু উত্তরে, এই ধর, চন্দননগরের কাছাকাছি কোনো মন্দিরে সে আছে। রাতে মার পূজার পর আরও জানতে পারব।”
আমি মনে মনে রাঙাকাকাবাবুরই ভাষায় বললাম, ‘আপনি কচু জানেন!’ যাই হোক, আমরা বাড়ি ফিরে রিপোর্ট দিলাম।
রাত বাড়তে লাগল। একে-একে সকলে বাড়ি ফিরলেন। সকলে চলে যাবার পর বাবা সুরেশবাবুকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় বসলেন। খবরের কাগজে পরের দিন সকালে কী লেখা হবে তার আলোচনা করলেন এবং আমার বিশ্বাস একটি খসড়াও তৈরি করলেন। আনন্দবাজার অফিসে একটা টেলিফোন করার পর সুরেশবাবু চলে গেলেন।
দোতলায় আমি বাবার অপেক্ষায় ছিলাম। বাবা যেন একটু ক্লান্ত হয়েই উপরে উঠে এলেন। পরীক্ষার প্রথম দিনটা ভালভাবেই কেটেছে বলে আমাদের মনে হল। তবে পরের দিন সকালে খবরটা প্রচার হয়ে গেলে পুলিশ কীরকম আচরণ করবে, এই চিন্তা নিয়ে আমরা শুতে গেলাম।
পরের দিন কেবল হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড ও আনন্দবাজারে খবরটা বেরোল। কারণ উপর-পড়া হয়ে আমরা কারুকেই খবর দিতে যাইনি। যাঁদের আমাদের বাড়িতে দৈনন্দিন যাতায়াত ছিল, তাঁদেরই খবর দেওয়া হয়েছিল।
২৭শে জানুয়ারি সারাদিন কেবলই টেলিফোন বাজতে লাগল, সন্ধ্যার পর দুই বসুবাড়িতে খুব ভিড়। আমি সকালে মেডিকেল কলেজে গেলাম। দু-একজন সহপাঠী আমার দুইদিনের অনুপস্থিতি লক্ষ করেছিলেন। তাঁদের প্রশ্নের আমি ভাল-ভাল উত্তর দিলাম। অ্যানাটমি বিভাগে ডিসেকশন করার সময় আমার ডেমনস্ট্রেটর ডাক্তার সুবোধ সুররায় কাজ দেখতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন দু-দিন আমি আসিনি কেন। উত্তরে বললাম, বাড়ির কাজে একটু কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছিল। শুনে তিনি বললেন, “পুলিশ রেকর্ড নেই তো!” বলেই তিনি আমার কার্ডে দু-দিনই ‘present’ লিখে দিয়ে চলে গেলেন। আমার শরীরটা ছম্ করে উঠল। আমার এক সহপাঠী কল্যাণীপ্রসাদ গুপ্ত আমাকে বলল, “খবরটা পড়ে মনে হচ্ছে যে, সুভাষবাবুর গোঁফসুদ্ধু ঐ ছবিটা কাগজে ছাপানো তো ভাল হয়নি!” আমি শুনে মনে মনে আঁতকে উঠলেও ভাব দেখালাম যেন আমি কিছুই বুঝিনি।
বাড়ি ফিরে এলগিন রোডের বাড়িতে গেলাম। বিকালের দিকে পুলিশের টনক নড়ল। একদল অফিসার এসে প্রথমে অন্তর্ধানের বৃত্তান্ত শুনলেন, পরে বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরে-ঘুরে পরীক্ষা করতে লাগলেন। আমি গাড়িবারান্দার ছাদে দাঁড়িয়ে তাঁদের কাজকর্ম দেখতে লাগলাম। দেখলাম তাঁদের বিশেষ দৃষ্টি বাড়ির পিছনের দিকে বা পাশের গলির ছোট খিড়কির দিকে, সামনের বড় গেটটা তাঁরা যেন পরীক্ষাই করলেন না।
বাড়ি ফিরে এসে শুনলাম অল্ ইণ্ডিয়া রেডিও সন্ধ্যার খবরে বলেছে যে, সুভাষচন্দ্রকে ঝরিয়ার কাছাকাছি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুনেই বাবা অস্থির হয়ে পড়লেন। দাদাকে বারারিতে টেলিফোন করে ধানবাদে গিয়ে পুলিশের দপ্তরে খোঁজ নিতে বললেন। দাদা খোঁজ নিয়ে জানালেন, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার হ্যাঁ-ও বলবেন না, না-ও বলবেন না। কিছুক্ষণ পরে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের নৃপেনবাবু খবর দিলেন যে, খবরটা ভুল বলে স্বীকৃত হয়েছে।
বাবা আমাকেই বললেন, মাজননীকে গিয়ে বলে আসতে যে, খবরটা ভুল। আমি আবার এলগিন রোডে গিয়ে মাজননীকে বলে এলাম। মাজননী শুনলেন, কিন্তু বিশেষ কিছু মন্তব্য করলেন না। দেখলাম গ্রেপ্তারের খবর শুনে ইলা খুবই কাতর হয়ে পড়েছে। আমি অনেক করে তাকে বোঝালাম যে, খবরটা সত্যি নয়। যখন ইলার সঙ্গে কথা বলছি, তখন রাঙাকাকাবাবুরই রেডিওতে শুনলাম, বার্লিন রেডিও বলছে, ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসু কাল থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
৪৮
আমরা যেমনটি চেয়েছিলাম রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানের খবরটা ঠিক সেভাবেই প্রচার হয়ে গেল। পুলিশকে বিভ্রান্ত করাটাই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সেটা আমরা বেশ ভালভাবেই করতে পেরেছিলাম বলে আমার বিশ্বাস। শত্রুপক্ষ বেশ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল বলে মনে হয়। ১৯শে জানুয়ারি নাকি একটা জাপানি জাহাজ কলকাতা থেকে রওনা হয়েছিল। পরে শুনেছি ইংরেজ পুলিশ সেই জাহাজটিকে ধাওয়া করে চীনের এক বন্দরে নিয়ে এসে খুব খোঁজাখুঁজি করেছিল। তবে এটাও শুনেছি যে, দিল্লির সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোরা এক বড় কর্তা সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়ার গল্পটা মোটেই হজম করেননি। সব সীমান্ত, বন্দর, ইত্যাদিতে তৎক্ষণাৎ সাবধানবাণী পাঠিয়েছিলেন এবং যে-কোনও উপায়ে সুভাষ বসুকে গ্রেপ্তারের হুকুম দিয়েছিলেন। তবে ততদিনে রাঙাকাকাবাবু ‘পগার পার’ হয়ে গেছেন। আর-একটা কথা দিনকতক পরে সুরেশ মজুমদার মহাশয় বাবাকে বলেছিলেন। তিনি দিল্লির কোনও-এক সূত্র থেকে শুনেছিলেন যে, চাঞ্চল্যকর খবরটা কাগজে বের হবার পর মধ্যভারতের ট্রেনের এক টিকেট-চেকারের হঠাৎ মনে হয়, সে যেন সুভাষবাবুকে দেখেছে। সে কথাটা প্রকাশ করায় পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সে রাঙাকাকাবাবুর পোশাক-পরিচ্ছদের যে বর্ণনা দেয়, তার সঙ্গে তাঁর ছদ্মবেশটা বেশ মিলে যায়। বাবা একদিন রাতে আমাকে ডেকে বললেন যে, বর্ণনাটা যে বেশ মিলে যাচ্ছে, রিপোর্টটা তা হলে সত্যি হলেও হতে পারে। আমারও তাই মনে হল এবং উদ্বিগ্নও হলাম।
ঘরে-বাইরে অন্তর্ধান নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ ছিল না। বাড়ির অনেকেই চুপচাপ ছিলেন, বিশেষ করে যাঁরা মনে-মনে বিশ্বাস করতেন যে, রাঙাকাকাবাবু নিশ্চয়ই দেশের মুক্তির সন্ধানে অজানার পথে পাড়ি দিয়েছেন। সুতরাং চুপচাপ থাকাই সমীচীন। মাজননীর মনের কথা ঠিক কখনও ধরতে পারিনি। তাঁর চিন্তার শেষ ছিল না, কিন্তু স্থির ও অবিচল ছিলেন। নতুনকাকাবাবু তো ডাক্তার, তিনি অন্যভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি বললেন, সুভাষ রাজনীতিতে একঘরে হয়ে হতাশার বশবর্তী হয়ে হয়তো বা ভয়ানক কিছু করে বসেছে। সুভাষ লুকিয়ে থাকবে কী করে, তাকে তো দেশের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরাও চেনে, দোকানে মুড়ি খেতে গেলেও তো যে-কেউ তাকে চিনে ফেলবে। কেউ-কেউ আবার সন্ন্যাসী হয়ে যাবার গল্পটাই গ্রহণ করলেন। আমার দিদিমা খুব ধর্মপ্রাণা ছিলেন, তিনি আমাদের সকলকে একদিন জোর গলায় বললেন, তোমাদের তো ধর্মে-টর্মে বিশ্বাসই নেই, কিন্তু বলে দিলাম, তোমাদের রাঙাকাকাবাবু সাধুবাবা হয়েই ফিরবেন। সেই কবে রাঙাকাকাবাবু একবার গুরুর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তার উপর অন্তর্ধানের সময় গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে যাবার গল্প ফেঁদে আমরা রাঙাকাকাবাবু সম্বন্ধে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি করলাম যে, আজও তার মূল্য দিতে হচ্ছে। এখনও অনেকে মনে করেন, তিনি সন্ন্যাসী হয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন।
.
মজার মজার গল্পও বেশ চলছিল। বসুবাড়ির বিশেষ বন্ধু নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র একদিন বললেন যে, তিনি শুনেছেন একদিন সন্ধ্যায় দুজন শিখ ভদ্রলোক রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। পরে তিনজন শিখ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ব্যাপারটা নাকি পরে কোনো চরের মনে পড়ে! মেজদা গণেশ আরও মজার একটা গল্প শুনিয়েছিলেন। একদিন মাঝরাতে নাকি এক দীর্ঘকায় সুদর্শন পুরুষ গঙ্গার ঘাটে এক ঘুমন্ত মাঝিকে উঠিয়ে বলেন তাঁকে মাঝদরিয়ায় নিয়ে যেতে। মোটা টাকার লোভে সে রাজি হয়। গঙ্গায় তখন জোয়ার, নদীর মাঝামাঝি পৌঁছতেই মাঝিটি দেখে এক ডুবোজাহাজ গুমগুম আওয়াজ করে জলের উপর ভেসে উঠল। ভদ্রলোকটি মাঝির হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে লাফিয়ে জাহাজে চলে গেলেন। জাহাজটি আবার গুমগুম শব্দ করে জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন থেকেই রাঙাকাকাবাবু এক প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছেন। আজও কত রকমের রূপকথা তাঁকে নিয়ে শোনা যায়।
বাবা খুবই উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছিলেন। কবে রাঙাকাকাবাবুর খবর পাবেন এই আশায় ছিলেন। প্রায়ই কোনো-না-কোনো সূত্রে কিছু শুনতেন। আমাকে কাজের শেষে তাঁর শোবার ঘরে ডাকতেন। মশারির মধ্যে তাঁর খাটে মুখোমুখি বসে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতাম। দুজনেরই এতে খানিকটা শান্তি হত। একদিন হাইকোর্টে শুনে এলেন যে, ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের আড্ডা ক্যালকাটা ক্লাবে রাঙাকাকাবাবু সম্বন্ধে খুব আলোচনা হচ্ছে। একটা আলোচনায় নাকি কলকাতার পুলিশ কমিশনার যোগ দিয়েছিলেন। পুলিশসাহেব নাকি জোর গলায় বলেছেন, “উই নো দ্যাট শরৎ বোস নোস।” মুসলিম লীগ দলের নেতা ও বাবা-রাঙাকাকাবাবুর বন্ধু ইসপাহানি সাহেব নাকি সেখানে বলেছেন, ‘ইট ইস্ বিলিভড় দ্যাট সুভাষ ইস্ উইথ দি ফকির অব ইপি”, ইত্যাদি ইত্যাদি। একদিন বাবার এক জ্যোতিষী বন্ধ বাবাকে বললেন যে, রাঙাকাকাবাবু এক বিরাট জলাধারের পাশ দিয়ে চলেছেন। আমি তো একটা বিরাট ম্যাপ নিয়ে বাবার সঙ্গে মশারির ভিতরে ঢুকলাম। সোভিয়েট রাশিয়ার বৈকাল লেক হতে পারে বলে আমাদের মনে হল। জ্যোতিষী বন্ধুটি বাবাকে আরও বলেছিলেন যে, বাড়ির একটি ছেলে ব্যাপারটা জানে, তবে সে পর্দার আড়ালে আছে। শুনে বাবা খুব চিন্তিত হয়েছিলেন।
বাবা-মার সঙ্গে বেশি রাত পর্যন্ত তাঁদের ঘরে বসে আমার কথাবার্তা বলা আমার বোন গীতার খুব পছন্দ হত না। সে বোধহয় ভাবত তাকে কেন বাদ দিয়ে আমরা গোপনে কথাবার্তা চালাচ্ছি। যাই হোক, বাবা আমার সম্বন্ধে অতিরিক্ত সাবধানতা বজায় রাখতে চাইতেন। যাতে রাস্তার টিকটিকিরা কোনোরকম সন্দেহ না করে, তিনতলায় রাস্তার দিকের আমার শোবার ঘরে গিয়ে আলো না জ্বালিয়ে আমাকে শুয়ে পড়তে বলতেন, যাতে তারা মনে না করে যে বেশি রাত পর্যন্ত আমি কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছি।
আড়াই মাস অপেক্ষা করার পর খবর এল। ১৯৪১-এর ৩১শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি মা ও গীতার সঙ্গে উডবার্ন পার্কের দোতলার দক্ষিণের বারান্দায় বসে গল্পসল্প করছি। নীচের তলার বেয়ারা ধনু এসে আমার হাতে একটা শিল্প দিল। আমি চিন্তা না করে জোর গলায় পড়ে ফেললাম—’ভগত রাম, আই কাম ফ্রম ফ্রন্টিয়ার’। পড়েই আমার চৈতন্য হল। গীতা তো শুনেইছে, সে হয়তো আমাকে জেরা করবে। মার সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় হতেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। কথাটা ঘোরাবার জন্য বানিয়ে বানিয়ে বললাম, আবার সেই কাশ্মীরি কার্পেটওয়ালাটা জ্বালাতে এসেছে। যাই বিদায় করে আসি। নীচে নেমে দেখলাম উত্তর ভারতীয় এক যুবক এবং এক পাঞ্জাবি মোটাসোটা ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। দুজনেই প্যান্টকোট পরা, যুবকটির টাই নেই, ভদ্রলোকটির আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী এবং কাকে চান। যুবকটি বললেন, তাঁরা সুভাষবাবুর সংবাদ নিয়ে এসেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমার সম্বন্ধে তিনি কী জানেন। তিনি বললেন, সুভাষবাবু আপনাকে এই নামে ডাকেন এবং আপনি মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ছাত্র। সুভাষবাবু বলে দিয়েছেন যে, যদি তাঁরা সোজাসুজি বাবাকে ধরতে না পারেন তাহলে যেন আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁদের পশ্চিমের অফিসঘরে নিয়ে গেলাম। ভগত রাম আমাকে বললেন যে, শিপে তাঁর আসল নামটাই তিনি লিখেছেন, আমি যেন সেটা ছিঁড়ে ফেলি। তারপর তিনি আমাকে জানালেন যে, সেইদিনই রাঙাকাকাবাবুর মস্কো পৌঁছবার কথা। ১৭ই মার্চ কাবুলের জার্মান কনস্যুলেট থেকে তিনি রাঙাকাকাবাবুকে মোটরে করে রুশ সীমান্তের দিকে রওনা হয়ে যেতে দেখেছেন। রাঙাকাকাবাবুর কাছ থেকে বাংলায় লেখা বাবার নামে একখানা চিঠি ও ইংরেজিতে লেখা একটি বাণী এবং একটি প্রবন্ধ নিয়ে এসেছেন। আমি খুব তাড়াতাড়ি লেখাগুলির উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বাবাকে খবর দিতে গেলাম। তখনই বাবা স্নান-টান সেরে নীচে নেমে আসছেন। বাবাকে ফিসফিস করে বললাম, রাঙাকাকাবাবুর খবর এসেছে, আপনি আগে একবার ও-ঘরে আসুন। বাবার কাছে ভগত রাম আবার রাঙাকাকাবাবুর কুশল-সংবাদ দিলেন। বাবা আমাকে লেখাগুলির ভার নিতে বললেন এবং নিজের ঘরে গিয়ে ভাল করে পড়ে দেখতে বললেন। ভগত রাম পরের দিন ভোরে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে বাবার সঙ্গে দেখা করবেন, এই ব্যবস্থা হল। ভগত রামের কথাবার্তা শুনে ও রাঙাকাকাবাবুর হাতের লেখা দেখে আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া হল সেটা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি লেখাগুলি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। চিঠিটি ছিল পেনসিলে লেখা। ইংরেজিতে ‘মেসেজ মাই টু কান্ট্রিমেন’–কালিতে সাধারণ কলম দিয়ে লেখা। প্রবন্ধটি—’ফরওয়ার্ড ব্লক— ইস জাটিফিকেশন’—ছিল পেনসিলে লেখা এবং ছোট মাপের কাগজে পঞ্চাশ পাতার উপর বাবা বেশি রাতে আমাকে ডাকলেন। কাগজগুলি দেখলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন লেখাগুলি রাঙাকাকাবাবুর এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত কি না। আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।
চিঠিতে রাঙাকাকাবাবু জানিয়েছিলেন যে, আর-একটি যাত্রা আরম্ভ করার আগে তিনি লিখছেন, তবে ‘অনেক দেরি হয়ে গেল এই যা দুঃখ’। আরও লিখেছিলেন যে, পত্রবাহক তাঁর অনেক সেবা করেছেন, তাঁকে যেন বাবা প্রয়োজনমতো সাহায্য করেন। মূল চিঠির নীচে তিনি তাঁর ‘কন্যার জন্য’ দু’লাইন লিখেছিলেন। কয়েক মাস পরে ইলা কলকাতায় এলে আমি তাকে গোপনে চিঠিটা দেখিয়েছিলাম।
মেসেজ টু মাই কানট্রিমেন’ লেখাটি বাবা সত্যরঞ্জন বক্সী মহাশয়ের হাতে দিয়েছিলেন। গোপনে সেটা ছাপিয়ে নানা জায়গায় বিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেকেই সেটা পড়ে বাবার কাছে এসে লেখাটা রাঙাকাকাবাবুর বলে তাঁর মনে হয় কি না জিজ্ঞাসা করেছিলেন। বাণীটিতে রাঙাকাকাবাবুর সই ছিল এবং ঠিকানা ছিল ‘সামহোয়ার ইন ইউরোপ, ১৭ই মার্চ ১৯৪১’। কেন তিনি যুদ্ধের মধ্যে দেশত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি দিলেন সেটা তিনি দেশবাসীকে বুঝিয়ে বলেছিলেন। ইংরেজ গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করবার ব্যাপারে তিনি বর্মার ও চীনের বন্ধুদের তাঁর গোপনযাত্রায় সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। মূল বাণীটি এখনও কোথাও আছে কি না জানি না। প্রবন্ধটি অবশ্য নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর সংগ্রহশালায় আছে। ১৯৪২ সালে মা চিঠিটি বিসর্জন দিতে বাধ্য হন, সে পরের কথা।
৪৯
ভগত রামের মারফত রাঙাকাকাবাবুর খবর পাবার কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় বাবা আমাকে নীচে ডেকে পাঠালেন। দেখলাম কালো টুপি পরা এক ভদ্রলোক বাবার সঙ্গে সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পরে জেনেছিলাম যে, ওঁর নাম অসিত মুখার্জি, কলকাতার জাপানি কনসুলেটে কাজ করতেন। বাবা বললেন, কলকাতার জাপানি কনসাল-জেনারেল তাঁর সঙ্গে গোপনে দেখা করতে চান। রিষড়ায় দেখা হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ওই ভদ্রলোক কনসাল জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যার পরে গঙ্গার ধারে আসবেন। আমি সেখান থেকে তাঁকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে রিষড়ায় চলে যাব। বাবা প্রথমে বলেছিলেন, ড্রাইভার গাড়ি চালাবে। এ ধরনের কাজে ড্রাইভারকে সঙ্গে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত মনে করিনি। আমি বললাম,”আমি একলাই ওয়াণ্ডারার গাড়ি চালিয়ে যাব। “
যথাসময়ে আমি গঙ্গার ধারে প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে গাড়ি নিয়ে হাজির হলাম। একটি বড় গাড়ি থেকে এক মধ্যবয়সী জাপানি ভদ্রলোক নেমে এগিয়ে এলেন। অসিতবাবু খানিকটা দূর থেকে আমাকে দেখিয়ে দিলেন। আমি জাপানি ভদ্রলোককে পাশে বসিয়ে স্ট্র্যাণ্ড রোড ধরে সোজা রিষড়ার দিকে গাড়ি চালিয়ে দিলাম। অমায়িক জাপানি ভদ্রলোকটি হাসিমুখে আমার সঙ্গে নানারকম ব্যক্তিগত কথাবার্তা চালালেন।
রিষড়ার বাগানবাড়িতে পৌঁছে নীচের তলায় বাবার ছোট্ট অফিস-ঘরে অতিথিকে বসিয়ে দৌড়ে ওপরে উঠে বাবাকে খবর দিলাম। বাবা তখনই নীচে নেমে এলেন এবং তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হল। জাপানি ভদ্রলোকের নাম ছিল কায়ো ওকাজাকি। রাঙাকাকাবাবু বার্লিন থেকে টোকিও মারফত যে প্রথম বেতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন, সেটি নিয়ে তিনি এসেছিলেন। সেই সঙ্গে জাপানিরা কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে সাহায্য করতে পারে, সে বিষয়েও আলোচনা শুরু হল।
ওকাজাকির সঙ্গে এই আলোচনার পরে সত্যরঞ্জন বক্সী মহাশয়ও যোগ দিয়েছিলেন। আলোচনার জন্য বাবা বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ভাল ম্যাপ সংগ্রহ করেছিলেন। মা’র কাছে শুনেছি যথাসময়ে গোপন পথে বর্মা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের উপায় নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর প্রতিষ্ঠার কিছু পরে ১৯৫৯ সালে আমেরিকা থেকে ওকাজাকি সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি তখন জাপান সরকারের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি পদে ছিলেন।
কিছুদিন পরে ওকাজাকি কলকাতা ছেড়ে চলে যান। তাঁর জায়গায় ওতা বলে এক জাপানি ভদ্রলোক বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে বার্তা বিনিময়ে সাহায্য করতেন। ওতা শাড়ি পরিয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন যাতে আপাতদৃষ্টিতে ওই সব যাতায়াত সামাজিক বলে মনে হয়। বাবা আগেই আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ওকাজাকি মারফত একটি বার্তায় তিনি রাঙাকাকাবাবুকে বলেছেন যে, ‘দি মেডিকেল স্টুডেন্ট ইজ অল রাইট।’
এই সময় বাবা পাঞ্জাবের ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা সর্দার শার্দূল সিংয়ের কাছ থেকে একটা বার্তা পান। সর্দারজি জানিয়েছিলেন যে, বাবুজি মানে রাঙাকাকাবাবু ভবিষ্যতে বাবার কাছে সব গুরুত্বপূর্ণ বাতাই বাংলায় লিখে পাঠাবেন। এ কথাটা আমারও জেনে রাখার প্রয়োজন ছিল, সে কথা পরে বলব।
আমি এ পর্যন্ত এমন সব কথা লিখেছি যার থেকে মনে হতে পারে যে, রিষড়ার বাগানবাড়িটা যেন গোপন কাজকর্মের জন্যই ছিল। তা কিন্তু নয়। বাবা সপ্তাহের শেষে কলকাতা থেকে সরে গিয়ে আমাদের সকলকে নিয়ে রিষড়ায় দু-এক রাত কাটিয়ে খুব আনন্দ ও শান্তি পেতেন। পেশাগত কাজকর্ম ও রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনাও অবশ্য সেখানে চলত। যাঁরাই যেতেন গঙ্গার টাটকা ইলিশমাছ ভাজা ও রিষড়ার বিখ্যাত গজা পেট ভরে না খেয়ে ফিরতেন না। খেতে বসে অতিথিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে বাবা নিজেই অনেক সময় পুরো একটা ইলিশমাছ খেয়ে ফেলতেন। রাঙাকাকাবাবু বার্লিনে পৌঁছবার খবর পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বাবাকে শান্তিনিকেতনে ডেকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ চাইছিলেন বাবাকে বিশ্বভারতীর ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিতে। রাজশেখর বসুকেও একই কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বলে শুনেছি। বাবা ও মা শান্তিনিকেতনে কয়েকটা দিন খুবই আদরযত্নের মধ্যে কাটিয়ে আসেন। বাবাকে সেই সময় কবিগুরু রাঙাকাকাবাবুর খবর জিজ্ঞেস করে বলেন, “আমাকে তুমি বলতে পারো।” উত্তরে বাবা তাঁকে জানান যে, রাঙাকাকাবাবু জার্মানিতে আছেন ও ভাল আছেন।
আমি সম্প্রতি শান্তিনিকেতনে গিয়ে স্বর্গত অনিল চন্দের স্ত্রী রানী চন্দকে এ-সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলাম। শ্রীমতী চন্দ আমাকে জানান যে, একদিন সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথ বাবার সঙ্গে গোপনে কথা বলবেন বলে আশপাশ থেকে সকলকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং অনিলবাবু দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাবা আমাকে বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ এতই আন্তরিকতা, ভালবাসা ও উৎকণ্ঠার সুরে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তাঁকে সত্যি খবরটা না দিয়ে তিনি পারেননি।
রাঙাকাকাবাবু দেশত্যাগ করার পরে বাংলার রাজনীতিতে বাবার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। কংগ্রেস ইতিমধ্যে দুভাগ হয়ে গিয়েছে, একটি হাই কমাণ্ডের অ্যাড হক কংগ্রেস, অন্যটি বাবার নেতৃত্বে কংগ্রেস দল। প্রভাব ও লোকপ্রিয়তার দিক থেকে রাঙাকাকাবাবু ও বাবার নেতৃত্বে আস্থাবান কংগ্রেস দলটি ছিল অনেক এগিয়ে। প্রকৃতপক্ষে সেটাই ছিল বাংলার আসল কংগ্রেস। সেই সময় বাংলায় রাজত্ব করছেন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী নেতা নাজিমুদ্দীন সাহেব। সরকারের বিভেদধর্মী নীতির ফলে এখানে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে অসদ্ভাব ক্রমেই বাড়ছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশের প্রগতির জন্য বাবা ও রাঙাকাকাবাবু কয়েক বছর ধরেই নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দু’বছর আগেই রাঙাকাকাবাবু কলকাতা কর্পোরেশনের মুসলিম লীগের কয়েকজন প্রগতিবাদী নেতার সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িক সদ্ভাব প্রতিষ্ঠার জন্য একটা রফা করতে সমর্থ হন, যেটাকে বলা হত ‘বোস-লীগ প্যাক্ট’। পরে বাবা বৃহত্তর ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আনার কাজে লেগে যান। ফজলুল হক সাহেব মনে মনে উদারপন্থী ও জনদরদী হলেও ঘটনাচক্রে নাজিমুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমেই তাঁদের মধ্যে সংঘাত বাড়তে থাকে। ফজলুল হক সাহেবের নিজের দল ছিল কৃষক-প্রজা পার্টি। ১৯৪১ সালের শেষের দিকে বাবা ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে সমর্থ হন। হক সাহেবের দল বেরিয়ে আসায় নাজিমুদ্দীন সাহেবের দল বিধানসভায় সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়ে ও মন্ত্রিসভার পতন হয়। সেই সময় কলকাতার ইংরেজ সম্প্রদায়ের একটি দল সরকারের মনোনীত সদস্য হিসাবে অ্যাসেমব্লিতে বসতেন। ইংরেজ গভর্নরের সাহায্যে রাজত্ব চালাবার সব ব্যাপারে তাঁরা কলকাঠি নাড়তেন। বাবা ও হক সাহেবের নেতৃত্বে বিধানসভায় প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি গড়ে ওঠায় ইংরেজরা কোণঠাসা হয়ে পড়লেন এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে খুবই শঙ্কিত হলেন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উডবার্ন পার্কের বাড়ি বাংলার রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠল। কত লোকের যে আনাগোনা তার হিসেব নেই। ফজলুল হক সাহেব যে প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটা বাবা শুরু থেকেই বলে দিয়েছিলেন। সকলেই বলতে লাগলেন যে, বাবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন। ফলে, শত্রু-শিবিরে, বিশেষ করে ইংরেজ ও পুলিশ মহলে ত্রাসের সঞ্চার হল। বাবা খবর পেলেন যে, তাঁকে গ্রেফতার করবার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে ইংরেজ গভর্নরের কাছে নতুন মন্ত্রিসভার নাম দেওয়ার সময় হয়ে আসছে। ফজলুল হক সাহেব ও অন্য অনেকে চাইলেন যে, মন্ত্রিসভার প্রথম তালিকায় বাবার নাম থাকে। কিন্তু বাবা আসন্ন গ্রেফতারের খবর পাওয়ায় নিজের নাম প্রথমেই দিতে চাইলেন না। বললেন, “আমার নাম থাকলে গভর্নর খুব সম্ভব টালবাহানা করবে, ফলে নতুন মন্ত্রিসভার গঠনে বিঘ্ন হবে। হয়তো বা পুরো পরিকল্পনাটাই নষ্ট হবে।”
বাবা চাইলেন যে, তাঁর গ্রেফতারের আগেই অথবা সঙ্গে সঙ্গেই ফজলুল হক সাহেব আর দুজন মন্ত্রীর নাম দিয়ে শপথ নিয়ে ফেলুন। তাই হল। প্রায় একই সঙ্গে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিল আর বাবা জেলে গেলেন। বাবার কংগ্রেস দল থেকে শেষ পর্যন্ত দুজন মন্ত্ৰী হলেন।
বাবা মন্ত্রী হবার কথা ওঠাতে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মন্ত্রী তো হবে, ওই মাইনেতে সংসার চলবে কী করে? বাবা কিন্তু এসব ব্যাপারে নির্বিকার ছিলেন। কেউ প্রশ্ন তুললে হেসে আকাশের দিকে হাত তুলে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করে দিতেন। যেন বলতে চাইতেন, ভগবান আছেন, তিনিই দেখবেন। মাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে কথার সোজা জবাব দিতেন না। কেবল মৃদু ও করুণ হাসি মুখে দেখা দিত। বাবা পরে জেল থেকে ব্রিটিশ সরকারকে লিখেছিলেন যে, তাঁর উদ্দেশ্য যে সফল হয়েছে সেটাই বড় কথা, যদিও সাম্প্রদায়িকতার আগুন নেভাতে গিয়ে তাঁর নিজের হাত পুড়েছে।
এগারো ডিসেম্বর বিকেলে এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার জ্যানড্রিন বাবাকে জানিয়ে গেলেন যে, তাঁর গ্রেফতারের আদেশ এসেছে। মা তো তখনই জানতে পারলেন। বড় দুই ছেলের মধ্যে একজন কলকাতার বাইরে,অন্য জন বিলেতে। সুতরাং আমাকে ও গীতাকে বলা হল। আমার দিদি মীরা তখন সন্তানসম্ভবা। বাবা ডাক্তার মণি সরকারকে ডেকে ব্যাপারটা বললেন এবং দিদিকে দেখাশুনোর সব ভার তাঁকে নিতে অনুরোধ করে গেলেন।
সন্ধ্যায় উডবার্ন পার্কের নীচের তলা লোকে ঠাসা। বিধানসভার অনেক সদস্য নতুন মন্ত্রিসভার তালিকার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। বাবার গ্রেফতারের খবর জানিয়ে দেওয়ামাত্র সকলের মুখে একই সঙ্গে চাপা ক্রোধ ও বিষাদের ছবি ফুটে উঠল। মনে আছে, বাবা হাসিমুখে সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন, কিন্তু আর কেউ হাসতে পারলেন না। অতিথিরা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একে একে বিদায় নিলেন। সেই রাতটা বাবা নিজের বাড়িতেই বন্দী হয়ে কাটালেন। পরের দিন সকালে বাবাকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে গেল। বসুবাড়ির ইতিহাসে এক ঘোর দুঃসময়ের সূচনা হল।