বসু-বাড়ি – ৫৫

৫৫

১৯৪৩-এর শেষ, ১৯৪৪-এর শুরু। ক’দিন আগেই মাজননীর মৃত্যু হয়েছে, আমাদের অশৌচ চলছে। এক নির্জন সন্ধ্যায় এক অবাঙালী ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। একেবারে যুবক না হলেও বয়স বেশি নয়। শরীরের গড়ন মোটামুটি ছোটখাটো, রং ফর্সা, মাথার চুল কোঁকড়া। বললেন পূর্ব এশিয়া থেকে গোপনে এসেছেন, সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর নিজের হাতে লেখা চিঠি। রাঙাকাকাবাবু তাঁকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আমার হাতে দিলেন। পড়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। লেখাটা যে রাঙাকাকাবাবুর সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ হল না। সিঙ্গাপুরের ইণ্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্‌ট্স্ লিগের সদর দপ্তরের চিঠির কাগজে লেখা। একেবারে উপরে ছাপানো রয়েছে Faith, Unity, Sacrifice। তার নীচে ইণ্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্‌ট্স্ লিগের ৩ নম্বর চান্সারি লেনের ঠিকানা। তারিখটা রাঙাকাকাবাবুর নিজের হাতে লেখা : শ্রীশ্রীকালীপূজা, ২৯শে অক্টোবর, ১৯৪৩। 

চিঠিটার বয়ান হল : পত্রবাহক বিশেষ জরুরি কাজে দেশে যাচ্ছেন। আমার বন্ধু, সহকর্মী ও সমর্থকেরা তাঁকে সাহায্য করলে আমি বিশেষ বাধিত ও সুখী হব।—শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু। 

চিঠিটা ভাল করে দেখার পর আমি অতিথিকে জিজ্ঞাসা করলাম আমাকে কী করতে হবে। তিনি বললেন নেতাজীর নির্দেশ অনুযায়ী গোপন খবরাখবর সংগ্রহ করার জন্য ও নানারকম ব্যবস্থাদি নেবার জন্য ঠিকমতো যোগাযোগ করে দিতে হবে। তিনি বললেন, তাঁর নাম টি কে রাও; বাড়ি মাদ্রাজে। কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে সাবমেরিনে চেপে ওঁরা ভারতে এসেছেন, নেমেছেন সুদূর কাথিয়াওয়াড় উপকূলে। চারজন চারদিকে চলে গেছেন। প্রারম্ভিক কাজ সমাধা করে ওঁরা কোনো বিশেষ দিনে বেনারসে মিলিত হবেন। নিজের সম্বন্ধে ভদ্রলোক জানালেন যে, তিনি ব্রিটিশ ফৌজে ছিলেন, উত্তর আফ্রিকার বিখ্যাত টোবরুক-এর জার্মান সেনাপতি রোমেলের ফৌজের হাতে বন্দী হন। তারপর ইউরোপে নেতাজীর ডাকে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন। গোপন বৈপ্লবিক নানারকম কার্যকলাপে বিশেষ করে রেডিও যোগাযোগের কাজে বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ১৯৪৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসে নেতাজী ইউরোপ ত্যাগ করার কিছুদিন পরে মেজর এম. জি. স্বামীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল একটি জার্মান ব্লকেড রানার জাহাজে এশিয়া পাড়ি দেন। শত্রুপক্ষের ব্লকেড় ভেদ করে এবং সবরকম আক্রমণ প্রতিহত করে ওঁরা পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছে যান। সিঙ্গাপুরে মেজর স্বামী নেতাজীর নিজস্ব গোপন বিপ্লবী সংগঠনের ভার পান। জার্মানিতে প্রস্তুত একটি আধুনিক রেডিও ট্রান্সমিটার তাঁরা নিয়ে এসেছেন। ঐ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে তাঁরা নেতাজী ও মেজর স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। 

রাও খুব আবেগের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের অনেক কথা বললেন। বিশেষ করে আমাদের স্বাধীন সরকার গঠিত হবার পর থেকে মালয় ও সারা পূর্ব-এশিয়ায় যে বিরাট মুক্তি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে এবং রাঙাকাকাবাবু সব স্তরের ভারতীয়দের মধ্যে যে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছেন তার একটা ছবি তিনি আমার সামনে তুলে ধরলেন। বললেন, নেতাজী যেখানেই যান, হাজার-হাজার মানুষ তাঁর পেছনে ছোটে। রাও সেই প্রথম আমাকে ‘জয় হিন্দ’ বলতে শেখালেন। আমি অবশ্য আগেই রেডিও মারফত অনেক খবরই পেয়ে গেছি। পুলিশের অনুমতি নিয়ে পুজোর সময় বারারিতে দাদার কাছে গিয়েছিলাম। যে-ঘরে মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে রাঙাকাকাবাবুকে চা খাওয়ানো হয়েছিল, সেই ঘরে বসেই ১৯৪৩-এর ২১শে অক্টোবর রাঙাকাকাবাবুর নিজের গলায় আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ শুনেছিলাম। সে এক আশ্চর্য অনুভূতি। এখন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে সবকিছু শুনলাম। 

যোগাযোগের ব্যাপারে রাও কয়েকটি নাম করলেন—সত্যরঞ্জন বক্সী, সুরেশচন্দ্র মজুমদার, সুধীর রায়চৌধুরী ও অতুলচন্দ্র কুমার। প্রথম তিনজনই তখন জেলে, অতুলবাবু বোধহয় মালদায়। সেজন্য তখনই আমি রাওকে কোনো কথা দিতে পারলাম না। একটা দিন বাদ দিয়ে সন্ধ্যার শো-এ মেট্রো সিনেমায় আসতে বললাম। উডবার্ন পার্কের বাড়িতে দেখাশুনো করা মোটেই সমীচীন নয়, আমি তখনও অন্তরীণ, গোয়েন্দাদের নজর খুব কড়া 

সেই রাত্রেই মা’কে চিঠিটা দেখালাম। চিঠিটা যে রাঙাকাকাবাবুর লেখা, সে-বিষয়ে মা’রও কোন সন্দেহ হয়নি। কার সঙ্গে কীভাবে রাওর সঙ্গে যোগাযোগ করে দেওয়া যায়, এ-বিষয়ে মা’র সঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। আমরা জানতাম যে গোপন বৈপ্লবিক কাজে রাঙাকাকাবাবুর একান্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন সত্যরঞ্জন বক্সী। আমরা ছোটরা তাঁকে আমাদের পরিবারের একজন বলেই মনে করতাম। বাবার গ্রেপ্তারের পর তিনিই মা’র কাছে রাঙাকাকাবাবুর খবরাখবর নিয়ে আসতেন। তিনি যখন জেলে, আমি ঠিক করলাম তাঁর ছোট ভাই সুধীররঞ্জন বক্সীর সঙ্গে দেখা করে সাহায্য চাইব। 

পরের দিন সন্ধ্যায় প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে সত্যবাবুর বাড়িতে সুধীরবাবুকে পেয়ে গেলাম। তাঁকে ব্যাপারটা বললাম। সুধীরবাবু সব শুনে বেশ উৎসাহিত হলেন। তখনও বিপ্লবী দল বি. ভি. বা বেঙ্গল ভলান্টিয়ারস-এর কিছু-কিছু সদস্য মুক্ত ছিলেন। সুধীরবাবু তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাঙাকাকাবাবুর পাঠানো বিপ্লবীদের সাহায্যের ব্যবস্থা করবেন স্থির করলেন। সুধীরবাবু কলকাতা করপোরেশনে কাজ করতেন। ঠিক হল যে, আমি রাওকে বলব করপোরেশনে গিয়ে সুধীরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। অফিসে ট্যাক্স সংক্রান্ত কোনো সমস্যা সমাধানের অজুহাতে সুধীরবাবুর সঙ্গে দেখা করলে কেউ সন্দেহ করবে না। আমরা রাওয়ের একটা নাম দিলাম—প্রসাদ। সে সুধীরবাবুর কাছে প্রসাদ বলে পরিচয় দেবে। তারপর যা করবার সুধীরবাবু করবেন। 

পরের দিন সন্ধ্যায় মেডিকেল কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সোশ্যাল। আমি ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি। স্বাগত ভাষণটা আমাকেই দিতে হবে। মেডিকেল কলেজের পথে মেট্রোয় নেমে রাওয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্রটা সমাধা করতে হবে। মেট্রোর সামনে পৌঁছতেই রাওকে দেখতে পেলাম। দুটো টিকিট কেটে রাওকে ইশারা করে ডেকে নিয়ে ভিতরে গেলাম। ছবি আরম্ভ হবার আগে যে কয়েক মিনিট সময় পেলাম তারই মধ্যে রাওকে বুঝিয়ে দিলাম কীভাবে সুধীরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে। নিউজ্ রিল দেখানো হয়ে যাওয়ামাত্র আমি সিনেমা থেকে বেরিয়ে এলাম। মেডিকেল কলেজে সময়মতোই হাজির হয়ে গেলাম। বক্তৃতাও করলাম। 

পরের দিন দুপুর বেলা কলকাতা করপোরেশন থেকে টেলিফোন এল। অন্য দিক থেকে কেউ বললেন, আমি প্রসাদ বলছি, আপনার নির্দেশমতো আমি এখানকার অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছি, তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবার ভার নিয়েছেন। 

রাঙাকাকাবাবুর সেই চিঠিটা আমি আট-নয় মাস নিজের কাছেই রেখেছিলাম। আমি যখন মেডিকেল কলেজে যাতায়াত করতাম, প্রায়ই চিঠিটা আমার পার্সে থাকত, যেটা খুলে আমি ট্রাম-বাসের ভাড়া দিতাম। কাজটা বোধহয় ঠিক করিনি। তবে চিঠিটা বুকের কাছে রেখে কী যে আনন্দ পেতাম বলবার নয়। রাঙাকাকাবাবু আমাকে মনে রেখেছেন, আবার এত বড় একটা কাজের ভার দিয়েছেন, এর চেয়ে বেশি আমি জীবনে আর কী পেতে পারি! ১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে আমার অন্তরীণের আদেশের মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। কী জানি কেন, সরকার সেই সময় আদেশটা বহাল রাখল না। সেই সময় মা ও ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে বাবার সঙ্গে কুনুরের বন্দিশালায় দেখা করতে গেলাম। সঙ্গে নিয়ে গেলাম রাঙাকাকাবাবুর চিঠিটা। ঠিক করেছিলাম যে-কোনো উপায়ে বাবাকে চিঠিটা দেখাব। আমাদের কুটুম্বিতার সূত্রে এক আত্মীয় মিত্তিরমশাই পুলিশ অফিসার ছিলেন, এবং কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা কুনুরের সেই বাড়িতে থাকতেন। তিনি সব সময় বাবার উপর দৃষ্টি রাখতেন আর চিঠি সেন্সর করতেন। বাবার সঙ্গে দেখা করার সময় তিনি আমাদের উপর চোখ রাখতেন আর কান পেতে থাকতেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, মিত্তিরমশাইকে বারেবারে বাথরুম যেতে হত। সেই সুযোগে আমি বাবাকে রাঙাকাকাবাবুর চিঠিটা দেখালাম এবং আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা, আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি, ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছু খবর তাড়াতাড়ি বলে দিলাম। চিঠিটা নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। 

আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে যখন সুধীরবাবু ও আমি বুঝলাম যে, পুলিশ ধীরে ধীরে চারদিক থেকে জাল গুটিয়ে আনছে তখন এক রাত্রে আমি চিঠিটা নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী মহাশয়ের হাতে দিয়ে আসি। তিনি পরে আমাকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি সেটি নষ্ট করে ফেলতে বাধ্য হন। যুদ্ধের পর পি. কে. রায় বলে এক ভদ্রলোক অনুরূপ একটি চিঠি আমার হাতে দেন। রাঙাকাকাবাবুর নির্দেশে তিনি পায়ে হেঁটে সীমান্ত পার হয়ে দেশে আসছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের গতি প্রতিকূল হয়ে পড়ায় সীমান্ত পার হতে পারেননি। চিঠিটি রাঙাকাকাবাবু আমার হাতে দিতে বলেছিলেন। বয়ান ছিল একই, কেবল ঠিকানা ছিল আলাদা। মূল চিঠি নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর সংগ্রহশালায় আছে। 

৫৬

রাঙাকাকাবাবু যখন ১৯৪১ সালে ইউরোপে যান তখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিটা ছিল অন্য রকম। জার্মানি তখন ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ চালাচ্ছে। রাশিয়া নিরপেক্ষ। জাপান ও আমেরিকা লড়াইয়ের আওতার বাইরে। ইতালির সহযোগিতায় জার্মানি ইংরেজদের ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের ঘাঁটিগুলি আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। এই অবস্থায় রাঙাকাকাবাবু জার্মান সরকারের কাছে কতকগুলি প্রস্তাব রাখলেন। তিনি চাইছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের স্বার্থে, যে-কোনো উপায়ে লড়াইটা ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে টেনে আনতে। তিনি জার্মানদের বলেছিলেন যে ইউরোপ থেকে আফগান-ভারত সীমান্তে পৌঁছতে তিন-চারটি পথ বের করা যায়। তবে রাশিয়া বা তুরস্কের কিছু সাহায্য পেলে কাজটা সহজ হয়। রাঙাকাকাবাবুর পরিকল্পনা ছিল তিনি ইউরোপে যে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে তুলবেন, ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ইংরেজবিরোধী সশস্ত্র উপজাতিদের সাহায্যে সেটি ভারতবর্ষে প্রবেশ করবে। তারপর দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের পাঠান ও পাঞ্জাবি বিপ্লবীরা দলে দলে ঐ মুক্তি অভিযানে যোগ দেবেন। 

১৯৪১-এর মাঝামাঝি জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করায় ঐ পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল। সুতরাং রাঙাকাকাবাবু নতুনভাবে চিন্তা করতে শুরু করলেন। দলিলপত্র থেকে দেখতে পাই যে, ১৯৪২ সালের প্রথম থেকেই তিনি ইউরোপ ছেড়ে পূর্ব-এশিয়ায় চলে আসার জন্য ব্যবস্থা নিতে জার্মানিদের চাপ দিচ্ছিলেন। জাপান তখন ভারতের সীমান্তে পৌঁছে গেছে। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা হল, কিন্তু পুরো এক বছর পরে। সিঙ্গাপুরে রাঙাকাকাবাবু পৌঁছলেন ১৯৪৩ সালের জুলাইয়ের প্রথমে। দেরি হলেও তিনি ছাড়বার পাত্র নন। কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ব-এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রাঙাকাকাবাবু একটি গুপ্ত বিপ্লবীদের দল গড়ে তুললেন, যাঁরা গোপনে আগেই দেশে প্রবেশ করবেন ও আজাদ হিন্দ ফৌজের অগ্রগতি সুগম করবেন। এইরকম একটি দলের পক্ষ থেকে ‘টি কে রাও’ রাঙাকাকাবাবুর চিঠি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। 

সুধীররঞ্জন বক্সীর সঙ্গে রাওয়ের যোগাযোগ করে দিয়ে বেশ ভাল ফলই হল। সুধীরবাবু রাওকে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁরা কী-কী ভাবে তাঁদের সাহায্য করতে পারেন। রাও বললেন, প্রথমত, তাঁরা ভারতে ইংরেজ ও আমেরিকান ফৌজ সম্বন্ধে বিস্তৃত খবর চান। যথা, তাদের সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার, বিমান বাহিনীর শক্তি এবং কোথায় এবং কীভাবে তাদের সাজানো হয়েছে। এই সব খবর রাঙাকাকাবাবুকে তাঁরা গোপন ট্রান্সমিটারের সাহায্যে পৌঁছে দেবেন। দ্বিতীয়ত, আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে যাতে বাংলার গেরিলা-বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, দেশের ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায় রাঙাকাকাবাবুর অনুগামী রাজবন্দীদের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছে দিতে হবে এবং তাঁদের মনোবল অটুট রাখতে হবে। 

সুধীরবাবু বি ভি দলের রাতুল রায়চৌধুরী ও ধীরেন সাহারায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ধীরেনবাবু তাঁর দুই সহকর্মী নীরেন রায় ও চঞ্চল মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে ইতিমধ্যেই কলকাতায় বলরাম বসু স্ট্রীটে এক ভাড়াবাড়িতে বসবাস করছিলেন। সুধীরবাবু, রাতুলবাবু ও ধীরেনবাবু নিজেদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চললেন। অন্যদিকে সুধীরবাবু রাওয়ের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সেরে নিলেন। আমি সন্ধ্যার পর মাঝে-মাঝে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে সুধীরবাবুর সঙ্গে দেখা করে খোঁজ-খবর নিতাম। প্রথম মাসচারেক পুলিশ কিছু আঁচ পেয়েছিল বলে আমার মনে হয় না। 

বি ভি-র তিন বন্ধু ঠিক করলেন যে, গেরিলা যুদ্ধের জন্য অস্ত্র আমদানির ব্যবস্থা ঠিকমতো করা দরকার। তাঁরা গোপনে রাঙাকাকাবাবুর পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র নামানোর জন্য সন্দেশখালি ও রায়মঙ্গল বেছে নিলেন। ঐ এলাকার অনেক মাঝির সঙ্গে নৌকা সরবরাহের ব্যবস্থা করলেন। ওপার থেকে আসা বিপ্লবী-যোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখার জন্যও নানা জায়গা ঠিক করে রাখা হল। 

সুধীরবাবু রাও ও তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায় দেখা করতেন। শেষ পর্যন্ত একদিন ১৫নং বলরাম বসু স্ট্রীটে স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। রাও ও তাঁর সাথী ক্রমাগত তাঁদের বাসস্থান পালটাতেন। স্থানীয় কর্মীদের গোপন আস্তানা থেকে মাঝে-মাঝে তাঁরা খবরাখবর সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন এবং রেঙ্গুন থেকে রাঙাকাকাবাবুর কাছ থেকে বার্তাগুলি পৌঁছে দিয়ে যেতেন’। গোপন · সামরিক খবর সংগ্রহের ব্যাপারে এক দুঃসাহসী দেশপ্রেমী মহিলা শান্তিসুধা রায়চৌধুরী বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকান সামরিক দপ্তরে সেক্রেটারির কাজ করতেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর তিনি এনে দিয়েছিলেন এবং সেগুলি রাও রেডিও মারফত রাঙাকাকাবাবুর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাছাড়া ধীরেন সাহারায়, চঞ্চল মজুমদার ও নীরেন রায় বাংলার নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য ঘাঁটির ব্যবস্থা করেছিলেন। 

রাঙাকাকাবাবুর কাছ থেকে বেশ কয়েকটি বার্তা গোপন ট্রান্সমিটার মারফত কলকাতায় পৌঁছেছিল। দুটি সুধীরবাবু আমাকে দেখিয়েছিলেন, আমার বেশ মনে আছে। একটাতে বি ভি-র কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা যেন হঠাৎ আক্রমণাত্মক কিছু না করে বসেন, তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। যশোর, খুলনা ও চট্টগ্রামের কোনো কোনো অঞ্চলে ডুবোজাহাজ পাঠানোর সুবিধা সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে তিনি জানতে চেয়েছিলেন। 

১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ ও জাপানি সৈন্যবাহিনী আমাদের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত আক্রমণ শুরু করল, তখন আমাদের আনন্দের আর সীমা রইল না। খবর পেলাম, সীমান্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় সৈন্যদের জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজের তরফ থেকে আকাশ থেকে প্রচারপত্র ফেলা হচ্ছে। যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর স্থানীয় বিপ্লবীদের আস্তানা সরিয়ে চিৎপুরে শিব ঠাকুর লেনের তিনতলার একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। রাও ও তাঁর সঙ্গী প্রায়ই এই বাড়িতে আসতেন এবং খবর আদান-প্ৰদান করতেন। লড়াই যতই তীব্র হতে লাগল, কাজকর্মও তত বেড়ে গেল। এই সময় রাঙাকাকাবাবু চাইলেন যে, তাঁর দলের রাজবন্দীদের সঙ্গে যেন যোগাযোগ করা হয়। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী নীরেন রায়কে ছদ্মবেশে বক্সা বন্দী-শিবিরে পাঠানো হল। সেখানে সত্য গুপ্ত, জ্যোতিষ জোয়ারদার ও অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে যোগাযোগ হল। ঠিক হল যে, যথাসময়ে ঐ বন্দীরা জেল থেকে উধাও হবেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে মিলিত হবেন। বন্দীদের পালাবার জন্য ঘোড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। 

রেডিও মারফত আমরা খবর পেলাম আজাদ হিন্দ ফৌজ ও জাপানি সেনা কোহিমায় পৌঁছে গেছে এবং ইম্ফল ঘিরে ফেলেছে। আরও নীচের দিকে টামু দিয়েও আজাদি সৈন্য ভারতে ঢুকে পড়েছে। সেই সময় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ও তাঁদের তাঁবেদারদের মনে কী ত্রাসেরই না সঞ্চার হয়েছিল! আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম যে, ইংরেজ সামরিক কর্তৃপক্ষ বাংলা থেকে হঠে গিয়ে বিহারের মাঝামাঝি কোথাও নতুন একটা প্রতিরোধ-ব্যবস্থা প্রস্তুত করার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু আমাদের কী দুর্ভাগ্য। ইম্ফল দখল করার আগেই প্রচণ্ড বর্ষা নামল। জুলাই মাসে রাঙাকাকাবাবু আজাদ হিন্দ ফৌজকে সীমান্ত থেকে ফিরে আসবার নির্দেশ দিলেন। রাও মারফত গোপন-বার্তায় তিনি জানালেন যে, পুজোর সময় আবার আক্রমণ শুরু করা হবে। এর কয়েক দিন পরে রাও ও তাঁর সঙ্গী শিব ঠাকুর লেনে এসে ধীরেন সাহারায় ও চঞ্চল মজুমদারকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের হিন্দুস্থান বিল্ডিংয়ের উলটো দিকে এক গলির ভিতর এক হোটেলের চারতলায় নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে খুব জরুরি কিছু খবর তাঁদের বেতার-যন্ত্রের সাহায্যে রাঙাকাকাবাবুকে পাঠালেন। 

ধীরেনবাবু ও চঞ্চলবাবু ফিরে শিব ঠাকুর লেনের কাছাকাছি এসে দেখলেন, অনেক পুলিশ বাড়িটা ঘিরে রেখেছে। তাঁরা খবর পেলেন যে, নীরেন রায় গ্রেফতার হয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গী গোপাল সেন পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতে করতে চারতলা থেকে রাস্তায় পড়ে গেছেন। ধীরেন ও চঞ্চল সেখান থেকে অদৃশ্য হলেন এবং তৎক্ষণাৎ সুধীর বক্সী ও অন্যান্য সহকর্মীদের সাবধান করে দিলেন। সুধীরবাবু টেলিফোনে আমাকে মেডিকেল কলেজে গোপাল সেন সম্বন্ধে খবর নিতে বললেন। আমি কিছু খবর সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। 

পুলিশের দল শিব ঠাকুর লেনের আস্তানায় যখন উপস্থিত হয় তখন নীরেন ও গোপাল সেখানে ছিলেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাঁরা গোপন কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলতে থাকেন এবং যতক্ষণ পারেন সর্বশক্তি দিয়ে পুলিশকে ঘরের বাইরে ঠেকিয়ে রাখেন। শেষ পর্যন্ত দরজা ভেঙে পুলিশ ঘরে ঢুকে পড়ে। নীরেন গ্রেপ্তার হন, গোপাল সেন পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতে করতে চারতলা থেকে একেবারে নীচে পড়ে যান। তাঁদের উপর নির্দেশ ছিল, কোনো কাগজপত্র যেন পুলিশের হাতে না পড়ে। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে গোপাল সেন বলেছিলেন, “জীবন থাকতে আমি ওদের কিছু নিতে দিই নাই।” 

৫৭

১৯৪৪ সালে বর্ষা নামবার পরে সীমান্তে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিপর্যয় এবং কলকাতার শিবঠাকুর লেনে বিপ্লবীদের গুপ্ত আস্তানায় পুলিশের হানা প্রায় একই সময়ে ঘটল। সুধীর বক্সী আমাকে জানালেন যে, শিবঠাকুর লেনের দুর্ঘটনার পরে টি. কে. রাও ওরফে ‘প্রসাদ’ ও তার সঙ্গীদের বাংলা থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকতে বলা হয়েছে। তাঁরা যে গ্রেফতার এড়াতে পেরেছিলেন সেটা আমি যুদ্ধের পরে জেনেছিলাম। 

কিন্তু প্রশ্ন হল, ইংরেজ গোয়েন্দা দফতর আমাদের এই সব কার্যকলাপের খবর পেল কোন্ সূত্রে? ক্রমেই তারা খুব সজাগ হয়ে উঠল এবং আমাদের গতিবিধির ওপর খুব কড়া নজর রাখতে আরম্ভ করল। সাবমেরিনে চড়ে রাও ও তার সঙ্গীদের ভারতে প্রবেশ ও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের খবর জার্মান পররাষ্ট্র দফতরের পুরনো নথিপত্রের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। ১৯৪৪-এর মে মাসে কাবুল থেকে জার্মান দূত এক গোপন টেলিগ্রামে বার্লিনে জানাচ্ছেন যে, সুভাষ বসুর পাঠানো একটি দল তাঁর নিজের লেখা চিঠি নিয়ে কলকাতায় “শরৎ বসুর ছেলে শিশির”-এর সঙ্গে দেখা করেছে। তাদের মধ্যে একজন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গিয়ে সাহায্যের জন্য খোঁজখবর করেছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, রাওয়ের দলের কেউ উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছেছিল এবং আমাদের পুরনো সহকর্মীদের খুঁজেছিল। 

১৯৪২-এর প্রথম থেকেই পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আমাদের সব ব্যবস্থা ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ পাঞ্জাবের কিরতি কিষান পার্টি, যারা ১৯৪০-৪১ সালে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল এবং ভগত রাম যে পার্টির সদস্য ছিলেন, ১৯৪২ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে মিশে যায় এবং আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে। তারা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করায় আমাদের সঙ্গে তাদের প্রতিপক্ষের সম্পর্ক দাঁড়ায়। এই অবস্থায় অনেক কিছু ঘটবার সম্ভাবনা। বাবা আমাকে বন্দীনিবাস থেকে এক গোপন চিঠিতে ১৯৪২ সালেই জানিয়েছিলেন যে, রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানের খুঁটিনাটি খবর ইংরেজ গোয়েন্দা দফতরে পৌঁছে গেছে। 

১৯৪৪ সালে যখন আমরা রাঙাকাকাবাবুর পাঠানো দলের সঙ্গে কাজ করছি, আমি নিজেই মেডিকেল কলেজের কমনরুমে এক রাজনৈতিক দলের পত্রিকায় পড়েছিলাম যে, সুভাষ বসুর এজেন্টরা দেশে গোপনে প্রবেশ করছে এবং তাদের যেন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পড়ে আমি শিউরে উঠেছিলাম। 

যাই হোক, জুন-জুলাই মাস থেকে নজর করলাম যে, গোয়েন্দারা আমাকে খুব কাছাকাছি থেকে অনুসরণ করছে। আমি বাড়ি থেকে বেরোলেই তারা আমার পেছু নেয়, একজন নয় দুজন। কলেজে যাওয়া, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা তো আছেই। আমি মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় ট্রামে চেপে যখন সুধীরবাবুদের বাড়ি যেতাম তখনও অন্তত জনাদুয়েক টিকটিকি আমার পিছনে পিছনে যেত। আমরা সেই সময়ে বেশ বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের চূড়ান্ত জয় সম্বন্ধে আমরা এতই নিশ্চিত ছিলাম যে, ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কী বিপদ হতে পারে চিন্তা করতাম না। আমি যখন ঘুরে বেড়াতাম প্রায়ই আমার মানিব্যাগে রাঙাকাকাবাবুর চিঠিটা থাকত। 

সরকার যে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের একটা আঁচ পেয়েছিলেন সেটা তাদের কতকগুলি হুকুম থেকেও বোঝা যায়। বাবার চিঠিপত্র বন্দীনিবাসে নিযুক্ত বাঙালী অফিসারটি সে-পর্যন্ত সেন্সর করতেন। হঠাৎ হুকুম হল যে, বাবার সব চিঠিপত্র কলকাতায় সেন্সর হবে—সেন্সর করবেন কট্টর গোয়েন্দা-অফিসার শশধর মজুমদার। আমি যখন ১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারিতে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখনও ‘বডি-সার্চ’-এর হুকুম ছিল না। কিন্তু কয়েক মাস পরে যখন বাড়ির অন্য কেউ-কেউ বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন কর্তৃপক্ষ বললেন যে, প্রত্যেকের বডি-সার্চ করা হবে, এমনকী মহিলাদেরও। বাবা ঐ শর্তে দেখা করতে অস্বীকার করেন। 

শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, আমি বেশিক্ষণ তাদের দৃষ্টির আড়ালে গেলে গোয়েন্দারা অস্থির হয়ে পড়ত। ঐ সময় মেডিকেল কলেজে আমার ‘লেবার ডিউটি’ পড়ল, ইডেন হাসপাতালে দিনকতক থাকতে হল। আমি ভিতরকার ডিউটি-রুমে সত্যিই আছি কি না জানবার জন্য বাইরে থেকে তারা আমার খোঁজ করত বা ডেকে পাঠাত। বাইরে এসে আমি দেখতাম কেউ কোথাও নেই। যখন আমি বুঝলাম যে, আমার গ্রেফতার প্রায় নিশ্চিত, আমি রাঙাকাকাবাবুর চিঠিটা সরিয়ে ফেলা ঠিক করলাম। সুধীরবাবু আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন যে, আমাদের গোপন কার্যকলাপ সম্বন্ধে নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী মহাশয়কে জানিয়ে রাখা হয়েছে। আমি একদিন সন্ধ্যায় নরেনবাবুর বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে চিঠিটা তাঁর হাতে দিয়ে এলাম। 

.

গ্রেফতার অনিবার্য হয়ে আসছে বোঝবার পরে একবার আমি গা-ঢাকা দেবার বা আণ্ডার গ্রাউণ্ড হয়ে যাবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাকে না পেলে পুলিশ আমাদের পরিবারের উপর,বিশেষ করে আমার মা’র উপর, বেশি রকম জুলুম আরম্ভ করবে এই ভেবে ঐ পরিকল্পনা ত্যাগ করি। 

১৯৪৪-এর অক্টোবর। একদিন যথারীতি সকালে মেডিকেল কলেজে যাচ্ছি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে লি রোড ধরে হেঁটে গিয়ে বড় রাস্তায় ট্রাম ধরব। লি রোডে ঢোকামাত্র টের পেলাম দুটি লোক খুব কাছাকাছি থেকেই আমাকে অনুসরণ করছে, ঠিক যেন মিলিটারি কায়দায় মার্চ করে আসছে। ভাবলাম বাড়ি ফিরে যাব কি না। কিন্তু মনে হল যে, এরা আমাকে বাড়ি ফিরতে দেবে না। এগিয়েই চললাম। খানিকটা এগিয়ে দেখি রাস্তার ডান দিকে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে—আমাদের বেশ চেনা, গোয়েন্দা দফতরের ছাই-রঙের ফোর্ড ভি-এইট গাড়ি। আমি কাছাকাছি আসতেই ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা এক পুলিশ অফিসার ধীরে ধীরে রাস্তার ওপার থেকে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন, “শিশিরবাবু, আপনাকে আমাদের সঙ্গে একবার লর্ড সিন্হা রোডে আসতে হবে।” গাড়িতে তুলে নেবার পর বললেন, “কলেজে যাচ্ছিলেন বোধহয়, আমাদের ওখানে বেশি সময় লাগবে না, একটু দেরি হয়ে যাবে আর কি।” ১৪নং লর্ড সিন্হা রোডের পুলিশ দফতরের উত্তরে ছোট-ছোট কয়েকটি ঘর আছে। তার মধ্যে একটাতে আমাকে বসাল। কিছুক্ষণ পরে কতুকগুলি মামুলি ধরনের প্রশ্ন-টশ্ন করল। গ্রেফতারের অর্ডার দিল। তারপর আমাকে আবার গাড়িতে তুলল, ভাবলাম বুঝি জেলে পাঠাচ্ছে। একটা ছোট-খাটো পুলিশের গাড়ি মিছিল করে আমাকে কিন্তু উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এল। আবার বাড়ি সার্চ হবে। এবার সার্চটা হল বেশ উগ্র রকমের। মনে হল, বিশেষ কিছু যেন তারা খুঁজছে। আমাদের রেডিওটা এ. সি.-তে চলত বলে একটা কনভার্টার ছিল। পুলিশের সন্দেহ হল ওটা বোধহয় ট্রান্সমিটার বা ঐ ধরনের কিছু হবে। আমরা যতই বোঝাবার চেষ্টা করি ততই তাদের সন্দেহ বাড়ে। শেষ পর্যন্ত তারা এক সাহেব রেডিও-এঞ্জিনিয়ারকে ধরে নিয়ে এল। তাঁর কথায় তারা আশ্বস্ত হল। কিছু বই কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে ক্ষান্ত হল। রওনা হবার আগে বাড়িতে ভাত খেলাম, একদিকে বসে পুলিশ, অন্যদিকে মা ও ভাইবোনেরা। 

আমাকে আবার লর্ড সিন্হা রোডে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। কড়া পাহারায় সেই ছোট ঘরটিতে বসিয়ে রাখল। বিকেলের দিকে একবার বাইরে নিয়ে গিয়ে সব দিক থেকে আমার ছবি তুলল। সন্ধ্যার পরে একজন অফিসার এসে একটা নতুন অর্ডার জারি করে গেলেন। এই অর্ডারে ভারত-সরকার আমাকে পাঞ্জাব সরকারের হেফাজতে দিলেন। বুঝলাম, আমাকে পাঞ্জাবে চালান দেবে। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেল, কেউ আমাকে নিতে এল না। কিছু অখাদ্য খাবার খেতে দিল। পরে একজন এসে বলে গেল, ঘরে যে টেবিলটা আছে, সেটার উপর আমি শুতে পারি। প্রভুদের কী যে মতলব বুঝলাম না! 

রাত চারটে নাগাদ কড়া নেড়ে আমার ঘুম ভাঙাল। আমাকে বলা হল, রওনা হতে হবে। তৈরি হবার কিছু ছিল না, এক বস্ত্রেই তো আছি, সঙ্গে কোনো বাক্স-প্যাঁটরাও নেই। দেখলাম সামনেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একজন ইউনিফর্ম-পরা অফিসার, দুজন বন্দুকধারী পুলিশ ও কোট-প্যান্ট-পরা এক বাঙালী অফিসার আমাকে নিতে এসেছিলেন। ভাবতে লাগলাম, এই ভোররাতে আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে! মনে হল, হাওড়া স্টেশন থেকে সম্ভবত আমাকে ট্রেনে তুলতে চায় না, বর্ধমান বা আসানসোল কোথাও আমাকে নিয়ে রাখবে। পরের দিন সন্ধ্যায় পাঞ্জাবের ট্রেনে তুলে দেবে। 

.

চৌরঙ্গি দিয়ে বেরিয়ে কিন্তু হাওড়ার দিকে না গিয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউ দিয়ে গাড়ি এগোল। আমি তো মনে করলাম তাহলে একটু ঘুরিয়ে বোধহয় মোটরেই গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অন্ধকার রাতে মেডিকেল কলেজের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। পাঁচমাথার মোড় পেরিয়ে গাড়ি দমদমের রাস্তা ধরল। শেষ পর্যন্ত দমদম এয়ারপোর্টের সাইন-বোর্ড দেখে বুঝলাম, প্রভুদের মতলবটা কী। 

ভাবলাম এরোপ্লেন করে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কেন, এত তাড়াহুড়ো কিসের জন্য? হয়তো তাড়াতাড়ি আমাদের একটা গোপন বিচার করতে চায় এবং সাজা দিতে চায়। সাজাটা যে চরম হতে পারে তাও মনে হল। সুধীর বক্সীর গ্রেফতারের খবর ক’দিন আগেই খবরের কাগজে পড়েছিলাম। পুরো দলটা ধরা পড়ে যায়নি তো! 

আমাকে গাড়িতে বসিয়ে অফিসাররা কী সব ব্যবস্থা করতে এরোড্রোমের অফিসে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে আমাকে একটা সামরিক ডাকোটা বিমানে তোলা হল। সঙ্গে রইলেন বাঙালী অফিসারটি। অন্যান্য সব যাত্রীই ছিলেন ইংরেজ সামরিক অফিসার। তাঁদের জন্য ছিল চেয়ারের ব্যবস্থা, আমাদের জন্য বাকেট সিট। 

এরোপ্লেনে চড়া আমার জীবনে সেই প্রথম, সরকারের খরচাতেই হল। হঠাৎ-হঠাৎ যখন এয়ার পকেটের জন্য বিমানটি নীচে নেমে আসছিল, খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল মাটিতে সবসুদ্ধ পড়েই যাবো নাকি। পথে বিমানটি এলাহাবাদে নামল। নামবার সময় আকাশ থেকে গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম দেখলাম। এলাহাবাদে নেমে আমি এদিক-ওদিক একটু দেখছি। আমার অফিসারটি আমার দিকে এগিয়ে এসে পকেট থেকে হাতকড়া বের করে বিনয়ের সুরেই বললেন, “হুকুম আছে, প্রয়োজন হলেই এটা ব্যবহার করতে।” আগেই তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। নাম জ্যোতি রায়। 

দিল্লির সামরিক বিমানবন্দরে নেমেই দেখতে পেলাম একটা প্রিজন ভ্যান। বন্দুকধারী পুলিশ পাহারায় আবার যাত্রা শুরু হল। লালকেল্লার দরজায় পৌঁছে বিশেষ রকমের একটা অনুভূতি হল। রাঙাকাকাবাবুর কথা মনে হল, যেন কোথা থেকে একটু গৌরবের ছোঁয়া পেলাম। ফোর্টের সামরিক এলাকায় পৌঁছে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে বেশ খানিকটা নেমে গেলাম। মাটির তলায় দালানে দেওয়ান ও গরাদ বসিয়ে সেল বানানো হয়েছে। তার একটায় আমাকে তালাবন্ধ করল। সম্রাট শাহজাহানের অতিথি হলাম। 

৫৮

লালকেল্লার মাটির তলার সেলে ঢুকেই চোখে পড়ল দেওয়ালে কয়লা দিয়ে লেখা চারটি লাইন : 

Stone Walls do not a prison make 
Nor iron bars a cage, 
The mind is its own place 
And can make a heaven of hell. 

পূর্ববর্তী কোনো বন্দীর ঐ লেখা পড়ে মনটা বেশ ভরে গেল। ঘরটি মাপে খুব ছোট ছিল না। তিন দিক দিয়েই বন্ধ, কেবল সামনের দিকে গরাদ দেওয়া দুটি জানালা ও একটি শক্ত লোহার গেট। খুবই অপরিচ্ছন্ন, দেওয়ালগুলি ঝুলে ভর্তি, মেঝেতে পুরু ধুলো। আসবাবের মধ্যে একটি লগবগে খাটিয়া। দালানের অন্যদিকে আর একটি সেল আছে তা আসবার সময় নজর করেছিলাম। 

সেলের ভারপ্রাপ্ত লোকটি আমার সঙ্গে দেখা করে গেল। নাম মহম্মদ নাজির, দেখে পুলিশের লোক বলে মনেই হয় না, পরনে লুঙ্গি আর হাফ শার্ট। সে আমাকে জানাল যে, সকালে একবার আর সন্ধ্যায় একবার সেল থেকে বের করে কলঘরে নিয়ে যাবে। খাবার পৌঁছে দিয়ে যাবে সেলের মধ্যে। আশেপাশে আরও বন্দী আছে কি না আমাকে জানায়নি, প্রথমে বুঝতেও পারিনি। আমাকে পাহারা দেবার জন্য একজন বন্দুকধারী সিপাই দিনরাত আমার সেলের সামনে পায়চারি করত। দিনের বেলায় ডিউটিতে থাকত কুড়ি-বাইশ বছরের এক জাঠ যুবক, খুব হাশিখুশি। তার গ্রামের কথা, বাড়ির কথা আর সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর কথা আমাকে ক্রমাগতই বলবার চেষ্টা করত। ভাষাটা সড়গড় না থাকায় সব কথা ঠিক ধরতে পারতাম না, তবে ওরই মধ্যে বেশ ভাল লাগত ওকে। 

যেদিন পৌঁছলাম সারাদিন খাওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় লালকেল্লার প্রথম ডিনার আমার সামনে রাখা মাত্র বেশ খানিকটা খেয়ে ফেললাম। সারা শরীরটা যেন জ্বলে গেল, ওরকম ঝাল আলু-মটর আমি জীবনে খাইনি। সারা রাত হেঁচকি তুললাম। পরের দিন থেকে সাবধান হয়ে গেলাম। 

দিল্লিতে তখনই ঠাণ্ডা পড়তে আরম্ভ করেছে। আমার গায়ে তো খদ্দরের জামাকাপড় আর হাল্কা একটা আলোয়ান। জেলের মোলায়েম কম্বল গায়ে দিয়ে তো সারা শরীরে লাল-লাল চাকা-চাকা দাগ হয়ে গেল। 

লালকেল্লায় দিন-দশেক ছিলাম। গোয়েন্দা দফতরের কেউ ঐ কদিন মোটেই দেখা দিলেন না। কলকাতাতেই তো আমার উপর হুকুম জারি হয়েছিল যে আমাকে পাঞ্জাব সরকারের হেপাজতে রাখা হবে। সুতরাং বুঝতে পারলাম, যে-কোনো কারণেই হোক লালকেল্লায় আমাকে সাময়িকভাবে রাখা হয়েছে। জীবন অদ্ভুতভাবে গতানুগতিক। দিনে দুবার সেলের বাইরে নিয়ে যায়, তাছাড়া মাটির তলায় ঐ বন্দিশালায় কেবল “বসে বসে শোনা আপন মর্মবাণী”। বাড়ির কথা মনে হয়, মা’র কথা মনে হয়, রাঙাকাকাবাবুর কথা মনে হয়, সহকর্মীদের কার কী হল ভাবি, কিন্তু করবারও তো কিছু নেই। 

বন্দী হিসাবেও তো আমার কতকগুলি অধিকার আছে, যেমন বাড়িতে চিঠি লেখার অধিকার, জীবনযাত্রার জন্য কিছু কাপড়-চোপড় ও জিনিসপত্র পাবার অধিকার ইত্যাদি। মহম্মদ নাজির এসব বিষয়ে কিছু বলতে পারে না। উপরওয়ালারা জানেন, তাঁরা তাকে কিছু জানাননি। 

হঠাৎ একদিন চোখে পড়ে গেল জানলার একধারে কাঠের উপর পেন্সিলে খুব ছোট-ছোট করে এক বন্দী নিজের কথা লিখে গেছে। হংকং-এ ব্রিটিশ ফৌজে কোনো এক ব্যাটেলিয়ানে সে ছিল, নিজের ক্রমিক নম্বরটি সে লিখেছিল। বিদ্রোহের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে কোর্ট-মার্শাল করার জন্য ঐ সেলে রাখা হয়েছিল। ভাবলাম লোকটির শেষ পর্যন্ত কী হল কে জানে! 

অন্য দিকের সেলের বন্দীকে আমার সেলের সামনে দিয়ে স্নানের ঘরে নিয়ে যেতে হত। সেই সময় চোখাচোখি হত। কথা বলবার খুব একটা চেষ্টা আমি করতাম না, যদিও ভদ্রলোকটির যে কথা বলার খুব ইচ্ছা তা বুঝতে পারতাম। কী জানি কেন একদিন বিকালে মহম্মদ নাজির আমাদের দুজনকে একসঙ্গে সেল থেকে বের করল এবং কিছুক্ষণ সেলের বাইরে একসঙ্গে বসতে দিল। বলল, “একলা আর কত থাকবে, একটু কথা-টথা বলে নাও না, কেউ জানতে পারবে না।” প্রথমেই পরস্পরের নাম বিনিময় হল। আমার নামটা শুনে ভদ্রলোক যেন বেশ বিস্মিতই হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে লালকেল্লায় নিয়ে এসেছে কেন, আমি কি কোনো গোপন বিপ্লবাত্মক কাজের সঙ্গে জড়িত। আমি উত্তরে বলেছিলাম, “ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার একটু-আধটু সম্পর্ক আছে।” 

নিজের সম্বন্ধে তিনি জানালেন যে, তিনি পূর্ব-এশিয়া থেকে একটি দলের সঙ্গে সাবমেরিনে করে দেশে এসেছিলেন, আসবার আগে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়েছিল এবং কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা ধরা পড়ে যান। লালকেল্লায় আমাদেরই সেলের উপরে একটি ঘরে তাঁকে তখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁর কথা শুনে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম বলাই বাহুল্য। 

টি. কে. রাওয়ের দলের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হবার কিছুদিন পরে একদিন উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আমার খুড়তুতো দাদা কার্তিক আমাকে বলেন যে, রাঙাকাকাবাবুর পাঠানো একটি দলের লোকেরা এলগিন রোডের বাড়িতে এসেছিল। তাদের সাহায্য করা হচ্ছে এবং কলকাতারই আশেপাশে তারা গোপন কাজকর্ম চালাচ্ছে। আমার মনে হয়েছিল, এলগিন রোডের বাড়ির বেশ কয়েকজন, এমন কী ছোটরাও, ব্যাপারটা জানে। আমি কথাটা চুপচাপ শুনে গিয়েছিলাম, কোনো মন্তব্য করিনি। সুধীর বক্সী মহাশয়কে আমি ব্যাপারটা জানাই এবং খোঁজ করতে বলি আরও একটি দল কলকাতায় কাজ করছে কি না। সুধীরবাবু খবর নিয়ে আমাকে বলেন যে, অন্য দলটির যোগাযোগ ও কাজকর্ম সম্বন্ধে জানা গেছে। তবে ঠিক হয়েছে যে, আমাদের দলটিকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখা হবে এবং আমাদের কাজকর্মের গোপনীয়তা কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন হতে দেওয়া হবে না। এক বছর বাদে মুক্তির পর আমি জানতে পারি যে, যে-ভদ্রলোকটির সঙ্গে আমার লালকেল্লায় ঘটনাচক্রে দেখা হয়েছিল তিনি নাকি গোপন বিচারে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। 

একদিন বিকালে সেলের মধ্যে পায়চারি করছি। দেখি, সিপাই- সান্ত্রী নিয়ে দুজন পুলিশ অফিসার আমার সেলের সামনে হাজির হলেন। অফিসারদের মধ্যে একজন বিরাটকায় শিখ আর একজন কোট-প্যান্ট পরা ছোটখাটো মানুষ। বললেন, তাঁরা আমাকে নিতে এসেছেন। এই প্রথম আমাকে হাতকড়া পড়ানো হল। খুব ভারী লোহার গয়না, দু’হাতে পরিয়ে একসঙ্গে করে চাবি লাগিয়ে দেওয়া হয়। মোটা ভারী চেনটা একটা সিপাই বা অফিসার শক্ত করে ধরে থাকে। আমরা সিঁড়ি বেয়ে মাটির উপরে এলাম। একটি বন্ধ ভ্যানে চাপিয়ে আমাকে এনে ফেলল দিল্লি জংশন স্টেশনে। 

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, দিল্লি স্টেশনে লোক গিজগিজ করছে। যেমন সব সময়েই হয়। আমাকে যখন প্ল্যাটফর্ম দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, যদি কোনোমতে একটা চেনামুখ পাই। অন্তত বাড়িতে যদি খবরটা কেউ পৌঁছে দেয়। কিন্তু চেনা মুখ তো নেই-ই, আমাকে যে এভাবে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে তাতে কারুরই মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বলে মনে হল না। ভেবে দুঃখ হল যে, ওদিকে রাঙাকাকাবাবু সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলে দেশের স্বাধীনতার জন্য পাহাড়ে-জঙ্গলে লড়াই করছেন, স্বাধীন সরকার গঠন করেছেন, আর তাঁর দেশের লোক ছোটখাটো ও তুচ্ছ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। নিজেকে বড়ই একলা মনে হল। যাই হোক, আমাকে পাঞ্জাব মেলের একটি কূপে কামরায় তুলল। দরজার চাবি পড়ে গেল। আমি ভাবলাম হয়তো হাতকড়াটা এবার খুলে দেবে। অফিসারটি আমার অসুবিধাটা যেন উপলব্ধি করলেন, কিন্তু জানিয়ে দিলেন যে, হাতকড়াটা কোনোমতেই খোলা হবে না, হুকুম আছে। বললেন, “আমরা কী করব বলুন, বিপ্লবী বন্দীরা সুবিধা পেলেই আমাদের ফাঁকি দিয়ে উধাও হয়ে যান।” বাথরুমে যাব তাও হাতকড়া খুলবে না, দরজার সামনে একজন সিপাই চেনটা ধরে বসে রইল। 

ঘুমটা ভাগ্যিস আমার ভাল হয়। ঐ অবস্থায়ও খানিকটা ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুমোলেই খানিকটা সোয়াস্তি, ঘুম ভাঙলেই দুঃস্বপ্ন, সে এক অদ্ভুত অবস্থা। সকাল-সকালই ট্রেনটা লাহোরে পৌঁছে গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে দেখলাম এক শিখ পুলিশ অফিসার আমার কামরার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন, “সো দিস ইজ দি ম্যান!” এবার কিন্তু প্রিজন ভ্যানে নয়, একটা টাঙ্গায় আমাকে তোলা হল। আমাকে চালকের পাশে সামনে বসিয়ে হাতকড়াটা ভাল করে মুঠোর মধ্যে নিয়ে সর্দারজি পেছনে বসলেন। কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে! লাহোরের পথের ধুলো উড়িয়ে টাঙ্গার চালক আমাদের লাহোর ফোর্টের ভিতরে একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড় করাল। সর্দারজি কিছুক্ষণের জন্য ভিতরে গেলেন। পরে বুঝলাম রাস্তা পরিষ্কার আছে কি না দেখতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে টাঙ্গা থেকে আমাকে নামিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললেন। একটা বারান্দা পেরিয়ে, একপাশে কতকগুলি ঘর পিছনে ফেলে একটা খোলা ছাদের উপর দিয়ে গিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম। গুণ্ডার মত চেহারার এক পুলিশ অফিসার ইতিমধ্যে আমার ভার নিয়েছেন। বড়সড় একটা চাবি নিয়ে বারো নম্বর সেলের লোহার গেটটা খুললেন। আমাকে ভিতরে নিয়ে হাত কড়াটা খুলে দিলেন। গেটটা বন্ধ হয়ে গেল। ভাবলাম, যাক, শাজাহানের প্রাসাদ থেকে মুক্তি পেয়ে এবার শাহ আকবরের অতিথি হলাম। 

৫৯

লাহোর ফোর্টের বারো নম্বর সেল আমার জন্য ধার্য ছিল। রেড ফোর্টের মাটির তলার ঘরটির চেয়ে অনেক ছোট, বড়জোর দশ ফিট×বারো ফিট হবে। মেজেটা ইট বের করা, কেবলই হোঁচট খাবার ভয়। দুদিকের দেওয়ালের একই অবস্থা, তবে চুন মারা আছে। উত্তর-পূর্ব দিকটা সম্পূর্ণ খোলা, অবশ্যই মোটা গরাদ দেওয়া। গেটটাও বেশ বড় এবং এমনভাবে বাইরে থেকে বন্ধ করা যে কারুর সাধ্যি নেই যে সেটাকে একটু নাড়াতে পারে। ঐ দুই দিক দিয়ে বাইরে থেকে বন্দীর উপর বেশ ভাল নজর রাখা যায়। আসবাবের মধ্যে একটা ছোট মাপের চারপাই বা খাটিয়া, যাতে পা ছড়িয়ে শোয়া সম্ভব নয়। আর আছে—একটা জলের কলসি আর একটি আধা-ভাঙা পিতলের গেলাস। ঘরের এক কোণে অতি প্রাচীন কায়দায় পায়খানার ব্যবস্থা। বুঝলাম বাবার মনে যে আশঙ্কা ১৯৪২ সাল থেকে জেগেছিল তাই শেষপর্যন্ত হয়েছে। কুখ্যাত এই বন্দীশালায় আমাকে এনে ফেলেছে। 

ভাবতে লাগলাম আমাকে নিয়ে এরা কী করবে। যে নাটকীয়ভাবে এরা আমাকে লাহোর দুর্গে এনে ফেলল, নিশ্চয়ই ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়েছে, এবং খুবই গুরুতর কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছিলাম। এরা সম্ভবত আমাদের দলের অনেককেই ধরে ফেলেছে। আমার মনে হয়েছিল এরা খুব সম্ভব লুকিয়ে আমাদের বিচার করবে এবং কঠোর সাজা দেবে। কম করে হলেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তো হবেই, কারুর কারুর ফাঁসিও হতে পারে। বিচারের সময় আসামীর কাঠগড়ায় কাকে কাকে দেখব আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। যদি আসামী হয়েই জীবনের শেষ কথা বলতে হয়, তাহলে কী বলব তাও মনে মনে বিচার 

করতে লাগলাম। 

বারো নম্বর সেলে তালা বন্ধ হবার কিছুক্ষণ পরেই আমাকে প্রথম সম্ভাষণ জানাল একটি কালো বিড়াল। একটি বড় ছাদ আমার সেল থেকে দেখা যেত, তার ধারে এসে স্থির হয়ে বসে বিড়ালটি আমার দিকে চেয়ে রইল। কালো বিড়াল তো আমরা মোটেই শুভ বলে মনে করি না, ইংরেজরা কিন্তু করে। নিজেকে বোঝালাম, ইংরেজেরই তো এখন রাজত্ব, সুতরাং তাদের সংস্কারমতো কালো বিড়ালটিকে শুভ বলে ধরে নেওয়া যাক। একটু পরেই একটি সুশ্রী হরিণ এসে গরাদের বড় জানলা দিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। একটু হাসিই পেল, কেমন যেন চিড়িয়াখানার উলট-পুরাণ। আমি রয়েছি খাঁচার মধ্যে, বাইরে থেকে জন্তু-জানোয়ার আমাকে দেখছে। হরিণটি লাহোর ফোর্টে আমার সাড়ে তিন মাস নিঃসঙ্গ বন্দীদশার সময় প্রায়ই আমার সেলের সামনে ঘোরাঘুরি করত, আমার ভালই লাগত। বন্দুকধারী সান্ত্রী তো রয়েছেই। সে আমার সেলের সামনে পুরোপুরি মিলিটারি কায়দায় পায়চারি করে। রাইট অ্যাবাউট টার্নগুলির প্রত্যেকটি পদ আমি খুঁটিয়ে দেখতাম। যখন দেখলাম কেউই এদিকে মাড়াবে না বলে মনে হচ্ছে, সিপাইয়ের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। জবাব শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। কেবল বলল, “বাত্ করনা মনা হ্যায়।” সাড়ে তিন মাস সে আমার সঙ্গে আর একটি কথাও বলেনি। কেউ তো কোথাও নেই, কিন্তু সান্ত্রীমশাই নিজের চেহারা, ছবি, পোশাক, বন্দুক সম্বন্ধে খুব সজাগ। তার প্যান্টের দু’পকেটে দুটি রুমাল। একটি দিয়ে মুখ মোছে, আর একটি দিয়ে জুতোজোড়া পালিশ করে। ভাবতাম, মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই উলটো-পালটা হয়ে যায়! 

রাতগুলো ছিল বড়ই বিভীষিকাময়। আমার সেলের ছাদ থেকে একটা জোরালো আলো আমার উপর সব সময় ফোকাস করা আছে। বাইরেটা একেবারে অন্ধকার। সব সময়েই মনে হচ্ছে ওরা আমার প্রতিটি ওঠা-বসা, ঘোরা-ফেরা বাইরে থেকে দেখছে, আমি কিন্তু কাউকেই বা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে পায়ের শব্দ কাছে আসছে মনে হয় আর সান্ত্রীমশাই হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন ‘হল্ট’! কিছু একটা বলে আগন্তুক সরে যায়, পায়ের শব্দও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ঐ অবস্থায় কি ঘুমানো যায় নাকি! 

আমি যখন লাহোর ফোর্টে দিন গুনতে আরম্ভ করেছি বাড়িতে তখন তোলপাড় সরকার কিছুতেই জানতে দেবে না আমি কোথায় কী অবস্থায় আছি। বাবাই বোধহয় কেবল বুঝতে পেরেছিলেন আমাকে কোথায় নিয়ে গেছে, তাঁর দক্ষিণ ভারতের বন্দীশালা থেকে লেখা চিঠিপত্র থেকে এটা বোঝা যায়। মা’র তো করুণ অবস্থা। তাঁর একটা চিঠির জবাবে দিল্লি থেকে হোম ডিপার্টমেন্ট সোজা বলে দিল যে আমি কোথায় বন্দী তারা বলবে না, দেখা করতে দেবে না। তবে আমার জন্য জিনিসপত্র পাঠাতে চাইলে দিল্লিতে পাঠিয়ে দিতে পারেন। দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু আমাকে কিছুই দেওয়া হয়নি। আমি সাড়ে তিন মাস এক কাপড়ে ছিলাম, স্নানও করিনি, দাঁত মাজিনি, দাড়ি কামাইনি। 

দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, কেউ আমাকে দেখতেও আসে না। বাইরে থেকে ভিস্তি কলসিতে জল দিয়ে যায়, আর একজন বাইরে থেকে গরাদের নীচে দিয়ে খাবারের থালা ঠেলে দিয়ে যায়, যেমন চিড়িয়াখানায় জানোয়ারদের দেয়। কিন্তু সকলের মুখে কুলুপ আঁটা! সকালের খাবার ইঁটের মতো শক্ত একটা রুটি আর চা। ভাঙা গেলাসে বাইরে থেকে চা ঢেলে দেয়, সামান্য মিষ্টি দেওয়া উষ্ণ জল বই আর কিছু নয়। খাবারের কথা না বলাই ভাল। ঠাণ্ডায় জমা খাদ্য, কোনোরকমে উদরস্থ করা আর কী! 

দিনকতক কাটবার পরে মনে হল দিনক্ষণ ঠিক রাখতে পারছি না। দেওয়ালের এক কোণে নখ দিয়ে দাগ কাটা আরম্ভ করলাম, রোজ একটা করে দাগ, মানে তারিখের হিসেব। 

হঠাৎ একদিন সকালে বেশ ফিটফাট সাহেবি পোশাক-পরা এক অফিসার আর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আমার সেলের সামনে এসে হাজির। যেন কিছুই জানেন না এমন ভান করে কেতাদুরস্ত ইংরেজিতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এখানে এসেছেন কেন. হোয়াই হ্যাভ ইউ কাম হিয়ার? 

আমি বললাম, আমি নিজের ইচ্ছায় আসিনি, আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি বললেন, ঐ একই কথা হল। আরও বললেন, আপনাকেও শিক্ষিত ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে, আপনি আবার গোপনে বিদ্রোহাত্মক কাজকর্ম করছিলেন নাকি! এটা তো ভদ্রলোকের জায়গা নয়, এখানে কেবল খুব মারাত্মক চরিত্রের লোকেদের নিয়ে আসা হয়। যাঁরা অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন, তাঁদের সাধারণ জেলে বা ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়, দল বেঁধে তাঁরা বেশ থাকেন। লাহোর ফোর্ট এক ভয়ঙ্কর জায়গা, এখানে একবার যে এল, সারা জগৎ তাকে ভুলে যায়, আর একবার এখানে এলে এখান থেকে বেরোবার ঠিক-ঠিকানা নেই। এক যুগ কেটে যেতে পারে। 

এই সব কথা বলে আবার ভাল করে আমি কী করি, কোথা থেকে এসেছি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে বললেন, তোমার ইংরেজিটা তো অন্যরকম, কোথা থেকে শিখেছ? বাংলা থেকে যে-সব লোক এখানে আসেন, তাঁদের মধ্যে এম. এ., এম. এস-সি পাশ করা লোকও আছে, কিন্তু তাঁদের ইংরেজি উচ্চারণ তো অন্যরকম। 

আমি বললাম, আপনি কিছুই জানেন না, অনেক-অনেক বাঙালী আছেন যাঁরা আপনার চেয়ে ও আমার চেয়ে অনেক ভাল ইংরেজি বলেন। আমি যেটুকু বলি সেটুকু আমি আমার বাবার কাছে শিখেছি। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, ‘গুড লাক্’ ছাড়া তাঁর আর কিছু বলার নেই। পরে জানলাম অফিসারটির নাম নাজির আহমেদ্ রজভি, লাহোর ফোর্টের ভারপ্রাপ্ত স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ। 

মাস-দুয়েক আমার খবর না পেয়ে মা’র মনে হয়েছিল যে, আমি সম্ভবত বেঁচে নেই। খবরটা সরকার চেপে যাচ্ছে। আক্ষেপের সুরে ভাই-বোনেদের কাছে বলতেন, সত্যি কথাটা বলে দিলেই তো পারে। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আমাকে বলা হল যে, আমি বাড়িতে একটা পোস্টকার্ড লিখতে পারি, তবে ইংরেজিতে লিখতে হবে। পোস্টকার্ড একটি লোক নিয়ে এল, সঙ্গে কালি ও কলম, তার সামনে লিখতে হবে। আমি তো লাহোর ফোর্টের ঠিকানা দিয়ে মাকে দু-চার লাইন লিখলাম। দুদিন পরে আমাকে বলা হল, লাহোর ফোর্টের ঠিকানা দেওয়া চলবে না। ভারত সরকারের অ্যাডিশনাল হোম সেক্রেটারির কেয়ারে আমি আছি, ঐটুকুই লেখা যাবে। তাই লিখলাম। চিঠিটা মা’র হাতে পৌঁছেছিল, কিন্তু তাঁর চিন্তা দূর করতে পারেনি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *