৬৫
জেল থেকে বেরোবার আগের দিন জিনিসপত্র গোছগাছ করতে-করতে ভাবছিলাম, কী জানি, দেশবাসী আমাদের কী ভাবে গ্রহণ করবেন! আপাতদৃষ্টিতে তো রাঙাকাকাবাবুর দুঃসাহসিক মুক্তি-অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। ইংরেজ যুদ্ধে জিতে গেছে, তাঁর নিজের সম্বন্ধেও এক নিদারুণ খবর এসেছে। এই অবস্থায় দেশের মানুষ আমাদের দিকে কি আর ফিরে তাকাবেন?
লায়ালপুর জেলের গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এক বিরাট উদ্বেলিত জনতা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ফুলে ফুলে ছড়াছড়ি, ক্রমাগতই জয়ধ্বনি। ফুল দিয়ে সাজানো এক টাঙ্গায় আমাকে তোলা হল। টাঙ্গা এগিয়ে চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকশো মানুষ দৌড়চ্ছে। পাগলের মতো হয়ে জনতা সমস্বরে ধ্বনি দিচ্ছে—সুভাষচন্দর বোস জিন্দাবাদ’। ‘বোস খানদান জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি। জীবনে এত অপ্রস্তুত ও বিব্রত কখনও হইনি। লায়ালপুরের বিশিষ্ট এক নাগরিকের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেও কেবল লোক আর লোক। ছোটরা এসে আমার অটোগ্রাফ চায়, আমি যত না-না করি, কেউ শুনতে চায় না। আমি উর্দুতে লিখতে পারি দেখে তাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল।
আমাকে বলা হল বিকেলে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে আমাকে বক্তৃতা করতে হবে। আমি যেমন ফুলের মালা আগে পরিনি, জনসভাতেও তেমনি বক্তৃতা করিনি। এক বন্ধুর সাহায্যে রোমান হরফে উর্দুতে বক্তৃতা লিখে ফেললাম। বারবার পড়ে সেটা প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল। লায়ালপুরের মতো ছোট শহরের পক্ষে বেশ বড় সভাই হল।
পরের দিন ভোরে লায়ালপুরের বন্ধুরা আমাকে লাহোরের দূরপাল্লার বাসে তুলে দিলেন। লাহোরে বসুবাড়ির তিন ছেলের মিলিত হবার কথা। সেখান থেকে একসঙ্গে কলকাতায় যাত্রা হবে। দ্বিজেন তো লাহোরেই রয়েছে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য। অরবিন্দ আসবে ক্যাম্পবেলপুর থেকে। কলকাতায় বসুবাড়ির বন্ধু এক পাঞ্জাবি পরিবারের আত্মীয়রা লাহোরে আমাদের দেখাশুনো করার ভার নিলেন। কলকাতা রওনা হতে কয়েকদিন দেরি হল। ট্রেনে রিজার্ভেশন পাওয়া বেশ শক্ত, তা ছাড়া দ্বিজেনের ডাক্তারদের ছাড়পত্র চাই।
এদিকে বাবার মুক্তির খবর কাগজে বেরিয়েছে। তিনি মাদ্রাজ হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
লাহোর থেকে কলকাতা যাত্রায় ট্রেনেও এক নতুন অভিজ্ঞতা হল। প্রত্যেকটি স্টেশনে লোকের ভিড়, রাত্রেও নিস্তার নেই। বারে বারে’সুভাষচন্দর বোস জিন্দাবাদ’, ‘আজাদ হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। প্রবাসী আত্মীয়-স্বজনেরাও বিভিন্ন স্টেশনে এসে আমাদের দেখে গেলেন। দু’রাত ট্রেনে কাটাবার পরে আবার আমরা বাংলার মুখ দেখতে পেলাম। হাওড়া স্টেশনে অনেক লোক, মেডিকেল ছাত্রদের একটা বিরাট দল আমাকে নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করল।
উডবার্ন পার্কের বাড়ি আবার সরগরম। অনেক লোকের যাওয়া-আসা। বাবাকে কিন্তু তখনই পেলাম না। কংগ্রেসের নেতাদের বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি অল-ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে যোগ দিতে বোম্বাই চলে গেছেন। ১৯৩৯-৪০-এর মতভেদ ও বিচ্ছেদ ভুলে গিয়ে কংগ্রেসের নেতারা আবার বাবাকে তাঁদের সঙ্গে চান, ভবিষ্যতে ঐক্যবদ্ধ ভাবে স্বাধীনতা দাবি তোলবার জন্য! বাবা তাঁদের ডাকে সাড়া দিলেন। বোম্বাইয়ে বাবার সংবর্ধনাও হল অভূতপর্ব।
বাবা কলকাতা ফেরার দিন কী বিরাট অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন তার বিবরণ শুনলাম। সাঁতরাগাছি থেকে হাওড়া পর্যন্ত পথ নাকি জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। মোটরে হাওড়া পৌঁছতে বাবার কয়েক ঘন্টা লেগেছিল। হাওড়ার জনসভা ছিল ইতিহাসে লিখে রাখবার মতো একটা ব্যাপার। বাবা মুক্তি পাবার পরই ইংরেজ সরকারের উদ্দেশে এক সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি কোনোরকম দুর্ব্যবহার বরদাস্ত করা হবে না—’নট এ হেয়ার অন দেয়ার হেডস্ মাস্ট বি টাচড্।’ কলকাতায় পৌঁছেই তিনি সংগ্রামের ডাক দিলেন। যৌবনে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তাঁরা যে গান গেয়ে পথে-পথে ঘুরতেন, সেই গান তিনি আবার শোনালেন :
“চলরে চলরে চলরে ও ভাই
জীবনে আহবে চল,
বাজবে যেথা রণভেরী
আসবে প্রাণে বল—”
বললেন রণভেরী সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়েছে, আবার লড়াইয়ের ডাক আসবে।
কদিন পরেই বাবা বোম্বাই থেকে ফিরলেন। বারেবারেই বলতে লাগলেন, শারীরিক ও মানসিক অনেক কষ্ট তো গেছে, আবার মন ও শরীর ঠিক করে নাও। আর একটা কথা প্রায়ই বলতেন বা মাকে দিয়ে বলাতেন, আমি যেন আমার জেলের অভিজ্ঞতা এবং রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানের কাহিনী বিশদভাবে লিখে ফেলি।
রাতারাতি আমরা ‘ফেমাস’ হয়ে যাওয়ায় নানা সভা-সমিতিতে আমাদের ডাক আসতে লাগল। মনে আছে কংগ্রেসের এক বন্ধু মহাত্মা গান্ধীর সভায় বর্ধমানে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য বাবার অনুমতি চাইলেন। ঐ সভায় যাবার অনুমতি দিয়ে বাবা আমাকে আলাদা ডেকে কিছু পরামর্শ দিলেন। বললেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের নিয়ে দেশবাসী যে এত করছেন এটার মূলে রয়েছে ‘সুভাষের reflected glory’। সবটাই সুভাষের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার অভিব্যক্তি। আরও বললেন, এই সব দেখে আমাদের যেন মাথা ঘুরে না যায়। আমার উচিত নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়ে প্রথমে ডাক্তারি পড়া শেষ করা।
বাবা চাইলেন, আমরা সকলে মিলে পুজোর সময় আমাদের কার্শিয়ঙের বাড়িতে দিন-কতক কাটিয়ে আসি। কার্শিয়ঙে। বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথাবার্তা হত। দেখলাম, দীর্ঘ ও কষ্টকর বন্দী-জীবনের পরেও বাবার মানসিক ক্লান্তি বা অবসাদ আসেনি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যুদ্ধের পর এবং বিশেষ করে রাঙাকাকাবাবুর আজাদ হিন্দ আন্দোলনের আঘাতে ব্রিটিশ সরকার আসলে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। সুতরাং আমাদের দৃঢ় থাকতে হবে। নীতিগত কোনো আপোস করবার প্রয়োজন নেই।
রাঙাকাকাবাবু সম্বন্ধে বাবার চিন্তার অবধি ছিল না, তবে সবটা প্রকাশ করতেন না। তিনি নেই—এ-কথা বাবার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। সুভাষ আসবে, সে ফিরে কাজের ভার নিলে তবে আমার ছুটি, এই ধরনের কথা বাবা প্রায়ই বলতেন। বাবার অন্তরের আশা জাগিয়ে রাখতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। বিমান-দুর্ঘটনার কথা উঠলেই বলতাম, ওটা বাজে সাজানো গল্প।
১৯৪৫-এর নভেম্বরে দিল্লির লাল কেল্লায় যখন আজাদ হিন্দ ফৌজের তিন অফিসারের বিচার শুরু হল, সারা দেশ যেন ঝলসে উঠল। জীবনে কয়েকটি বড় গণ-আন্দোলন দেখেছি, কিন্তু সর্বস্তরের সব মানুষ—বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবা, ছাত্র, শিশু, পুরুষ, মহিলা—সকলের মধ্যে এক কথায় সমগ্র জাতির হৃদয়ে এমন আলোড়ন আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। রাঙাকাকাবাবু বিদেশে একটা কথা জোর দিয়ে বলতেন। বলতেন, তিনি যা কিছু করছেন তাঁর দেশবাসীর তাতে পূর্ণ সমর্থন আছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে যে গণ-আন্দোলন হল, তার দ্বারা রাঙাকাকাবাবুর দাবির সত্যতা সম্পূর্ণ ভাবে প্রমাণিত হল। এমনকী, দেশের যে-সব মানুষ সংগ্রামের সময় দেশদ্রোহিতা করেছিলেন, ইংরেজের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন বা যাঁরা চিরকালই ইংরাজের দোসর ছিলেন, তাঁরাও সুবিধা বুঝে কৌশলে এই নতুন আন্দোলনে ভিড়ে গেলেন। দেশের মরা গাঙে আবার বান এল, ভারতবাসী আবার তাঁদের মনোবল ফিরে পেলেন।
আমি জেল থেকে ফেরার আগেই কিছু উৎসাহী ডাক্তার ও মেডিকেল ছাত্র আজাদ হিন্দ ফৌজের আদর্শ ও কীর্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সূচনা করেছিলেন।
ফেরার পর এঁরা আমাকে ডেকে আই. এন. এ. সি-র এক গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিলেন। সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন বাবা। কিছুদিনের মধ্যেই আই. এন. এ. সি. একটি বিরাট শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও পরের বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় আই. এন. এ. সি-র সেবার কাজ সর্বকালের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ইতিমধ্যেই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে আই. এন. এ. রিলিফ কমিটি গঠিত হয়েছিল। বাবার সভাপতিত্বে বাংলার কমিটিই ছিল কাজের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে। বউবাজার স্ট্রিটে কমিটির অফিসটি হয়ে উঠেছিল এক প্রাণমাতানো কর্মযজ্ঞের কেন্দ্র। তাছাড়া কলকাতায় বেশ কয়েকটি আই. এন. এ. ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। পূর্ব-এশিয়া থেকে প্রত্যাগত আই. এন. এ. অফিসার ও সৈনিকদের সেখানে রাখা হত। ঐ সব আজাদি সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে বা সেবা করে আমরা যে কী আনন্দ ও প্রেরণা পেতাম, তা বলবার নয়। সব দেশবাসীর মতো আমরাও কেবলই ভাবতাম, যিনি এই নতুন ইতিহাসের স্রষ্টা তিনি কোথায়?
৬৬
দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচার যতই এগোতে লাগল, পূর্ব এশিয়ায় রাঙাকাকাবাবুর বিরাট কীর্তির কাহিনী ততই ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সারা ভারতে তখন ঘরে-ঘরে নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরগাথাই ছিল আলোচনার প্রধান বিষয়। সকলেরই ইচ্ছা ও চেষ্টা কী করে আমাদের জাতীয় জীবনে নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বাণী ও শিক্ষাকে রূপ দেওয়া যায়। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা সামরিক কায়দায় প্যারেড করতে আরম্ভ করল। নতুন করে দেশসেবায় ব্রতী হতে পাড়ায় পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গড়ে উঠল। সকলের মুখেই জয় হিন্দ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের গান : “কদম কদম বাড়হায়ে যা, খুশি কে গীত গায়ে যা’। অন্যদিকে আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের মুক্তির দাবিতে এক বিরাট গণ-আন্দোলন গড়ে উঠল। কলকাতায় আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়ি স্বাভাবিকভাবেই এইসব কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল। এরই মধ্যে খবর এল কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডিসেম্বরে কলকাতায় হরে। পণ্ডিত জওহরলালকে বাবা আগের মতোই আমাদের বাড়িতে থাকতে আমন্ত্রণ জানালেন। একই সঙ্গে বাড়িতে বিয়ে লাগল, আমার মেজ বোন গীতার বিয়ে ডিসেম্বরেই হবে ঠিক হল। সব মিলে বাড়িতে এক এলাহি কাণ্ড।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশপ্রিয় পার্কে আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে যে বিরাট সভা হল, তার নজির পাওয়া ভার। বাবা ছিলেন সভাপতি, বক্তাদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। জওহরলাল আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে থাকাতে সেখানে দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ও কংগ্রেসকর্মীদের যাওয়া-আসা খুব বেড়ে গেল। গীতার বিয়ের জন্য তো আত্মীয়স্বজন বন্ধুদের দিয়ে বাড়ি ঠাসা।
১৯৪৬-এর জানুয়ারিতে রাঙাকাকাবাবুর জন্মদিনে কলকাতায় এক বিরাট ব্যাপার হল। আই এন এ রিলিফ কমিটির উদ্যোগে এক বিরাট বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা দেশপ্রিয় পার্ক থেকে দেশবন্ধু পার্ক পর্যন্ত পরিক্রমা করল। সদ্যমুক্ত আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার শাহ নাওয়াজ খান ঐ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করায় উদ্দীপনার শেষ ছিল না। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে আমিও সারা পথটা হেঁটেছিলাম।
যুদ্ধের পর ইংরেজরা দুটো বড় ভুল করেছিল। প্রথম ভুল আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার, দ্বিতীয় ভুল দেশে সাধারণ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার কেবল যে দেশের জনসাধারণকে নতুন করে জাগিয়ে তুলল তাই নয়, ব্রিটিশ ফৌজের ভারতীয় সৈনিক ও যে-সব অফিসার পূর্ব এশিয়ায় আজাদি ফৌজের কীর্তিকলাপ স্বচক্ষে দেখে এসেছিলেন তাঁদের অধিকাংশের মধ্যেই এক বিপ্লব ঘটে গেল। লালকেল্লার বিচারের ফলে সেই বিপ্লবের বহ্নি আরও ছড়িয়ে পড়ল। নৌবাহিনীতে ও বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ হল। ভারতের ব্রিটিশ আর্মির অধিনায়ক অকিনলেক নানা সূত্রে খবর নিয়ে জানলেন যে, ভারতীয় অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য প্রায় চলে যেতে বসেছে। আমার বেশ মনে আছে, যুদ্ধ শেষ হবার কিছুদিন পরেই ভারতে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান আর্মির একেবারে উপরতলার অফিসার জেনারেল কারিয়াপ্পা উডবার্ন পার্কের বাড়িতে বাবার সঙ্গে গোপনে আলাপ – আলোচনা করেছিলেন।
১৯৪২-এর আগস্ট বিপ্লবের পর জাতীয়তাবাদীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে ব্রিটিশ সরকার জনগণের মনোবল একেবারে ভেঙে দিয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ দেশে সেই মনোবল ফিরিয়ে দিল। কংগ্রেস আজাদ হিন্দ ফৌজের পক্ষ অবলম্বন করায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আরও জোরদার হল। নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপুল জয় হল। বাংলায় কংগ্রেসের পক্ষে বাবা নির্বাচনযুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেন, কেন্দ্রীয় বিধানসভায় নির্বাচিত হলেন এবং দিল্লির আইনসভায় কংগ্রেস দল তাঁকে নেতা নির্বাচিত করল। বিরোধী দলের নেতা হিসাবে কেন্দ্রীয় আইনসভায় তাঁর বক্তৃতাগুলি স্মরণীয় হয়ে আছে।
১৯৪৬-এর মে মাসে বাবা বসুবাড়ির ইতিহাসে এক সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করলেন। তিনি খবর পেলেন যে, ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়িটি বিক্রি হতে যাচ্ছে। বাবার দৃঢ় মত ছিল যে, ঐতিহাসিক ঐ বাড়িটি রাঙাকাকাবাবুর জীবন ও কর্মের প্রতীক হিসাবে চিরকালের জন্য রক্ষা করতে হবে। কিন্তু সেই সময় বাবার হাতে যথেষ্ট অর্থ ছিল না। তিনি দুই বন্ধুর সাহায্যে বাড়িটি কিনে নিলেন এবং ঘোষণা করলেন যে, বাড়িটির ঐতিহাসিক অংশগুলি যেমন ছিল তেমনই রক্ষা করা হবে এবং বাকি অংশগুলি জনকল্যাণমূলক কাজে লাগানো হবে। বাড়ির পিছনের অংশটি ইতিমধ্যেই হস্তান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সেটিও বাবা ফিরিয়ে নিলেন। বাবা বাড়িটির নাম রাখলেন ‘নেতাজী ভবন’।
নেতাজীর শোবার ঘর ও অফিস যেমন ছিল, তেমনই রাখা হল; আজও তেমনই আছে। বাড়ির বাকি অংশে আই এন এ ক্যাম্প হল। পূর্ব এশিয়া থেকে সদ্য-ফেরা আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ও সৈনিকদের সেখানে রাখা হত। টোকিও ক্যাডেটদের মধ্যে অনেকেই বেশ কয়েক বছর নেতাজী ভবনে থেকে পড়াশুনা বা কাজকর্ম করেছেন। আজ নেতাজী ভবন যে একটি বিরাট জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে, তার মূলে রয়েছে বাবার সেই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন করতে বাবা বেশ বাধা পেয়েছিলেন। যেখানে দেশের স্বার্থ ও নীতির প্রশ্ন সেখানে পারিবারিক বা অন্য ধরনের বাধাবিঘ্ন অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে হয়। বাবা তাই করেছিলেন, তাই ‘নেতাজী ভবন’ দেশের জন্য রেখে যেতে পেরেছিলেন।
১৯৪৬-এর মাঝামাঝি বর্মা থেকে ডাক এল। সেখানে ইংরেজ সরকার কয়েকজন আই এন এ অফিসারকে নানা অভিযোগে বিচার করে সাজা দিতে চাইছিলেন। ঠিক হল, বাবা তাঁদের পক্ষ সমর্থনের জন্য রেঙ্গুন যাবেন। সঙ্গে যাব আমি ও এক পরিবারের বন্ধু। সেই প্রথম পূর্ব এশিয়ায় রাঙাকাকাবাবুর এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় হল। আজাদ হিন্দ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নানা জায়গা আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তা ছাড়া অনেক বিশিষ্ট লোকজনের সঙ্গেও পরিচয় ও কথাবার্তা হল। যুদ্ধকালীন বর্মার নেতা ও রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাম তখনও নিরুদ্দেশ। তাঁর স্ত্রী বাবাকে ও আমাদের তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। অনেক কথাবার্তা হল। যুদ্ধের পর বর্মার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব নিয়েছিলেন জেনারেল আউঙ সাং। আউঙ সাং প্রথমে তাঁদের দলের সদর দপ্তরে বাবাকে সংবর্ধনা দিলেন। আউঙ সাং তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করলেন। পরে তাঁর সঙ্গে বাবার নিভৃতে বেশ কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ হল। আমি দু’জনকার ছবি তুলে নিলাম। শেষে রেঙ্গুনের টাউন হলে আউঙ সাং বাবার জন্য এক বিরাট সংবর্ধনা-সভার আয়োজন করলেন। বাবা যেখানেই যান আউঙ সাং-এর সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী বাবাকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায়। সংবর্ধনা-সভায় আউঙ সাং রাঙাকাকাবাবু সম্বন্ধে বললেন :
I knew him as a sincere friend of Burma and Burmese people…Between him and myself there was complete mutual trust…we did have an understanding in those days that, in any event, and whatever happened, the INA and the BNA should never fight each other. And I am glad to tell you today that both sides did observe that understanding scrupulously……
বাবা যখন আই এন এ-র মামলার কাজে বা বর্মার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত, তখন আমি কয়েকজন কমবয়সী বর্মী রাজনীতিবিদের সঙ্গে আলাপ জমালাম। তার মধ্যে ছিলেন আউঙ সাং-এর সেক্রেটারি আউঙ তান্। যুদ্ধের সময় আউঙ তান্ জাপানে বর্মার দূতাবাসে মিলিটারি অ্যাটাচি ছিলেন। সেই সময় রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। আউঙ তান্ আমাকে বলেন যে, টোকিয়ো সফরের সময় রাঙাকাকাবাবু একখানা চিঠি জাপানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে গোপনে পৌঁছে দেবার জন্য তাঁকে দিয়েছিলেন। আউঙ তান রাস্তায় রাষ্ট্রদূতের গাড়ি থামিয়ে চিঠিটি গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
রেঙ্গুনে রাঙাকাকাবাবুর গুণগ্রাহীরা বাবার হাতে রাঙাকাকাবাবুর ব্যবহার করা জিনিসপত্র, ছবি, ফিল্ম ইত্যাদি বেশ কিছু মূল্যবান সামগ্রী দিয়েছিলেন। সেগুলি নেতাজী মিউজিয়ামে রাখা আছে।
বর্মা থেকে ফিরে শোনা গেল যে, একটি ইন্টারিম্ বা অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বড়লাট ওয়েভেল ঐ সরকারের সভাপতি থাকবেন, তবে ক্ষমতা হস্তান্তরের এটাই যেন হবে প্রথম পদক্ষেপ। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে অধিকাংশের মত হল ঐ সরকারে যোগ দেওয়া। এদিকে জিন্নাসাহেবের নেতৃত্বে মুসলিম লিগ পাকিস্তানের দাবি কিছুতেই তো ছাড়বেই না, বরঞ্চ তারা ক্রমাগতই সুর চড়াতে লাগল। বাংলায় তাদের প্রবক্তা সুরাবর্দিসাহেব তো কেবলই হুমকি দিতে লাগলেন, তাঁরা পাকিস্তান আদায় করে তবে ছাড়বেন। ১৬ই আগস্ট তাঁদের পক্ষ থেকে ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’ আরম্ভ হল। বিকাল হতেই খবর আসতে লাগল, ব্যাপক হারে লুঠতরাজ ও খুনখারাপি আরম্ভ হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে কলকাতায় ও বাংলার জেলায় জেলায় যে হত্যা ও ধ্বংস চলল, তার দৃশ্য মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি।
৬৭
১৯৪৬-এর মাঝামাঝি বাবা বর্মায় জেনারেল আউঙ সাং-এর সঙ্গে কথাবার্তা বলে অনেক আশা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। ১৯৪৫-এর শেষ থেকে ১৯৪৬-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল এক অতি উদ্দীপনাময় সময়। আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিকে কেন্দ্র করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক প্রবল জোয়ার এসেছিল। সেনাবাহিনীও আর ইংরেজদের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে রাজি ছিল না। জনগণের প্রতিনিধিদের পক্ষে ক্ষমতা দখলের এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কী হতে পারে? ওদিকে আউঙ সাং-এর মতো পূর্ব-এশিয়ার নেতাদের কথাবার্তায় বোঝা গেল যে, এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলিও আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়বে। ইতিমধ্যেই ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই নেতা সুকর্ন ও হাতার সঙ্গে আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের যোগাযোগ হয়েছিল। ভিয়েতনামের জনগণ ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালাচ্ছিলেন, ভারতের মুক্তিকামী সব মানুষই তার সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং দেশের ভিতরের ও বাইরের পরিস্থিতি আমাদের অনুকূল ছিল।
আমাদের প্রতিপক্ষ ইংরেজরা কিন্তু ছিল অতি কুশলী ও ধুরন্ধর কূটনীতিবিদ। ১৯৪৬-এর প্রথমেই একটি মিশন পাঠিয়ে দেশের সব দলের সঙ্গে কথাবার্তা বলার প্রস্তাব দিল। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে একটি দল হাজিরও হল। ইংরেজদের সঙ্গে কূটনীতিতে পেরে ওঠা শক্ত যদি আলোচনার লক্ষ্য ও সীমা আগে থেকে বেঁধে না দেওয়া যায়। তা না হলে তারা প্রতিপক্ষকে পদে পদে বেকায়দায় ফেলে দেয়। কথার মারপ্যাঁচে এবং কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও অন্যান্য দলগুলির সঙ্গে আলাদা করে কথাবার্তা চালিয়ে তারা একটি জটিল অবস্থার সৃষ্টি করল। এদিকে জিন্নাসাহেবও কম যান না, তিনি সুবিধা বুঝে পাকিস্তানের দাবিতে অনড় রইলেন।
দাবিটা খুব উঁচু রাখলে শেষ পর্যন্ত অনেকটা পাবারই সম্ভাবনা। ১৯৪৬-এর মাঝামাঝি বেশ বোঝা গেল যে, সব দিক দিয়ে একটা অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আমরা কথার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছি, সংগ্রামের পথ থেকে সরে এসেছি। এই অবস্থায় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাবার মতভেদ শুরু হল। বাবার মতে আমরা কথার লড়াইয়ে ইংরেজ ও জিন্নাসাহেবের কাছে নতি স্বীকার করেছিলাম। তিনি বারবার কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দকে সাবধান করে দিচ্ছিলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য ও নীতি থেকে আমরা যেন কোনোমতেই সরে না যাই। বাবার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট—স্বাধীনতা হবে নিষ্কলুষ, তাতে কোনো খাদ থাকবে না, দেশ’ থাকবে এক ও অখণ্ড; আমাদের জাতীয়তাবাদ হবে শতকরা একশো ভাগ খাঁটি, তাতে জল মেশানো চলবে না; দেশী বা বিদেশী কোনো কায়েমি স্বার্থের কাছে আমরা মাথা নত করব না; আমাদের বিদেশী নীতি হবে পুরোপুরি স্বাধীন—আমরা কোনো বৃহৎ শক্তির তাঁবেদার হব না, বরঞ্চ আমরা এশিয়ার নবজাগ্রত দেশগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করব।
আগস্ট মাসে জানা গেল যে কংগ্রেসের মনোনীত সদস্যদের নিয়ে বড়লাট ওয়েভেল একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করবেন। পণ্ডিত জওহরলাল সহ-সভাপতি হিসাবে ঐ মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব দেবেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বাবাকেও মন্ত্রিসভায় নেবার প্রস্তাব দিলেন। শোনা গেল, বাবাকে নিতে ওয়েভেলের খুব আপত্তি, যদিও বাবা ছিলেন কেন্দ্ৰীয় বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা এবং সরকার গঠন করতে যে কোনো স্বাধীন দেশে তাঁকেই ডাকার কথা। যাই হোক, কংগ্রেসের এ ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব দেখে ওয়েভেল প্রস্তাবটা মেনে নিলেন। সরকার গঠিত হল এবং বাবা তাতে যোগ দিলেন। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় বিধানসভা ও প্রাদেশিক বিধানসভা থেকে সদস্য নিয়ে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য একটি সংসদ গঠিত হয়েছিল এবং বাবা তার অন্যতম সদস্য ছিলেন।
সেপ্টেম্বর মাসে বাবা যখন মন্ত্রী তখন আমি দিনকতক দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে ছিলাম। বাবার দফতর ছিল ওয়ার্কস, মাইনস্ ও পাওয়ার। অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ায় দেশে, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী মহলে, বেশ আশার সঞ্চার হয়েছিল। অনেকেই এটাকে কংগ্রেসের পুরো ক্ষমতায় আসার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে নিয়েছিলেন। যাই হোক, হাতে কাজ পেয়ে বাবা তো উঠে-পড়ে লেগে গেলেন। দিনকতকের মধ্যেই শুনলাম দফতরের নানারকম অন্যায় কার্যকলাপের খবর বাবার গোচরে এসেছে। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য ও দোষীদের খুঁজে বের করার জন্য বাবা তৎপর হলেন। কিন্তু মন্ত্রী তো অল্পদিনই ছিলেন, তাই কাজ সম্পূর্ণ হল না।
এদিকে ১৬ আগস্ট থেকে আরম্ভ করে বেশ কিছুদিন কলকাতা ও বাংলার বিভিন্ন জেলায় যে তাণ্ডবলীলা চলছিল তাতে স্বাভাবিকভাবেই বাবা খুব বিচলিত ছিলেন। কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কত লোক যে মারা গেল! যে-সব পাড়ায় কোনো-এক সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বেশি, সেখানে অন্য সম্প্রদায়ের বাড়িঘর জ্বালিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হল। এই কলকাতাতেই কত মানুষ যে উদ্বাস্তু হলেন তার ইয়ত্তা নেই। অনেক বাজার হাট ধ্বংস বা বন্ধ হয়ে গেল। যানবাহন, বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ সবই বিপর্যস্ত। পাড়ায় পাড়ায় রাতে বা দিনের পর দিন কারফিউ, রাস্তায় রাস্তায় মিলিটারির টহল। বাবা যেমন চাইলেন যে, দাঙ্গায় আহত ও গৃহহারাদের যথাসম্ভব সাহায্য দেওয়া হোক, তেমনই সাম্প্রদায়িক, হিংসাশ্রয়ী শক্তিগুলিকে প্রতিরোধের জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়ি আই. এন. এ. সি-র হেড কোয়ার্টার্স হয়ে দাঁড়াল। শহরের সব উপদ্রুত এলাকায় আই. এন. এ. সি-র কেন্দ্র খোলা হল, তার মধ্যে বেশ কতকগুলিই ছিল ছোটখাটো হাসপাতাল। তাছাড়া বড়-বড় গাড়ি করে দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকা থেকে হাজার হাজার পরিবারকে উদ্ধার করে শান্ত এলাকায় সরিয়ে আনা হল। পাড়ায়-পাড়ায় যুবকদের সঙ্ঘবদ্ধ করে প্রতিরোধ-বাহিনী গড়ে তোলার কাজে বাবা সাহায্য করতে লাগলেন। এ কাজে গোপনে কিছু অস্ত্র সংগ্রহেরও প্রয়োজন হয়েছিল। বাবা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দিকে সঙ্গে নিয়ে শহরের নানা জায়গায় শান্তি মিছিল করলেন। নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসের কী নিদারুণ দৃশ্য কলকাতার পথে পথে সেই সময় দেখেছি তা ভোলবার নয়।
কলকাতায় যা ঘটল তারই প্রতিচ্ছবি দেখা গেল পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকায়—বিশেষ করে নোয়াখালি ও ত্রিপুরায়।
হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ মানুষ প্রাণ হারালেন বা গৃহহারা হলেন। মহাত্মা গান্ধী পূর্ব বাংলা সফর করলেন। বাবাও উপদ্রুত এলাকাগুলিতে ঘুরলেন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। বছরের শেষের দিকে অবস্থার কিছু উন্নতি হলেও দেশের মানুষের মনপ্রাণ বিষিয়ে গেল।
খুনের রাজনীতির প্রথম ফল পেলেন মুসলিম লিগ, কেন্দ্রের অস্থায়ী সরকারে তাঁদের স্থান দেওয়ার প্রস্তাব এল। কী জানি কেন, কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ইংরেজদের এই লড়িয়ে দেবার কূটনীতির শিকার হলেন। মুসলিম লিগের প্রতিনিধিদের জায়গা করে দেবার জন্য মন্ত্রিসভা থেকে বাবাকে এবং জাতীয়তাবাদী মুসলমান এক সদস্যকে সরে যেতে বলা হল। মাত্র ছয় সপ্তাহের মন্ত্রিত্বের পরে বাবা ফিরে এলেন। পরে অনেকে বাবাকে বলেছিলেন, তাঁর পদত্যাগ করা উচিত হয়নি। বাবা বলেছিলেন যে, গান্ধীজির মাধ্যমে প্রস্তাব আসার জন্য তিনি না করতে পারেননি।
বাবা বলেছিলেন যে, ইংরেজ বড়লাটকে মাঝে বসিয়ে মন্ত্রিসভায় একদিকে কংগ্রেস ও অন্য দিকে মুসলিম লিগকে বসানো ছিল দেশ বিভাগের প্রথম পদক্ষেপ। আসলে হলও তাই। সেক্রেটারিয়েটের এক ঘরে পণ্ডিত জওহরলালের নেতৃত্বে আধা-মন্ত্রিসভার বৈঠক বসত, আর অন্য একটি ঘরে মুসলিম লিগের নেতা লিয়াকত আলি খান তাঁর দলবল নিয়ে মিটিং করতেন। লিগ তাঁদের পাকিস্তানের দাবি থেকে একচুলও নড়েননি। দর কষাকষির সুবিধার জন্য বড়লাটের সাহায্যে একটা সুবিধাজনক জায়গা দখল করে নিলেন মাত্র।
.
কলকাতায় ফিরে এসে বাবা দাঙ্গায় বিধ্বস্ত বাংলায় কী করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা যায় সেই চেষ্টা করতে লাগলেন। তাছাড়া দেশ ভাগের বিরুদ্ধে প্রচার আরম্ভ করলেন। বারবার তিনি বলতে লাগলেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করলে সর্বনাশ হবে, কোনো সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং নতুন নতুন সমস্যা দেখা দেবে। তিনি বললেন, সাম্প্রদায়িকতার ওষুধ সাম্প্রদায়িকতা নয়, উদার জাতীয়তাবাদ ও সমাজবাদ। তিনি চাইছিলেন, দেশের সব মূল সমস্যার সমাধান জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করা হোক। উত্তেজনার মধ্যে বা ঝোঁকের মাথায় বা সাময়িক একটা লাভের আশায় নীতি বিসর্জন দিলে শেষ পর্যন্ত ভুগতে হবে। এই ছিল বাবার বিশ্বাস। সেইজন্য ১৯৪৬-এর শেষেও বাংলায় কংগ্রেস দলকে নতুন করে সংগঠিত করবার তিনি ডাক দিয়েছিলেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৪৭ সালের প্রথমে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হল। সাম্প্রদায়িকতার বিষ আরও ছড়িয়ে পড়ল। দ্বিতীয়বার ধাক্কা দিয়ে মুসলিম লিগের আর একটা জয় হল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ধর্মের ভিত্তিতে পাঞ্জাবকে দুই ভাগ করার প্রস্তাব মেনে নিলেন। বাবা এই সিদ্ধান্তে খুবই বিচলিত হলেন। তাঁর মতে ঐ সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল আদর্শ ও লক্ষ্যের পরিপন্থী। তিনি লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে দেশ বিভাগের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে লাগলেন। কিন্তু দেশের আবহাওয়া তখন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক দল ও গোষ্ঠীগুলি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কংগ্রেসি ও জাতীয়তাবাদীদের মধ্যেও অনেকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। পাকিস্তানিদের দাবির পালটা দাবি হিসাবে তাঁরা বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব তুললেন। বাবা কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নন। বাংলাকে এক রেখে বিকল্প কোনো রাজনৈতিক সমাধানের সূত্র বের করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করলেন।
৬৮
এমন লোক এ-জগতে আছেন যাঁদের আদর্শবাদ থেকে টলানো যায় না। ব্যক্তিগত ও জনজীবনে তাঁরা কতকগুলি মূলনীতিতে বিশ্বাস করেন। তাঁরা জীবনে সব কিছু ছাড়তে বা ত্যাগ করতে রাজি, কিন্তু আদর্শ ও নীতি ছাড়তে কোনো অবস্থাতেই প্রস্তুত নন। নীতির প্রতি এই আনুগত্য অনেক দুঃখ ডেকে আনে, ভোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিতই থেকে যান। তাঁরা যেন এ-জগতে এসেছেন কেবল সংগ্রাম করতে। তাঁরা একলা চলেন, এই নিঃসঙ্গতা শান্তভাবে গ্রহণ করেন। চারিদিক থেকে কটু কথা গালমন্দ শুনতে হয়, সে-সব তাঁরা হাসিমুখে হজম করেন। তবে অন্তরে তাঁরা সুখী, কারণ বিশ্বাসে অবিচল থেকে, নীতি আঁকড়ে ধরে, বাস্তব জীবনের সুখ-সুবিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তাঁরা এক নির্মল আনন্দের অধিকারী হন! আদর্শের মাপকাঠিতে যা আমার কর্তব্য তাই আমি করব, তার জন্য যা মূল্য দিতে হয় দেব, আদর্শ ও নীতি নিয়ে কখনও আপোস করব না—এই হল এঁদের কথা। আমার বাবা ছিলেন এই ধাঁচের লোক। রাজনীতি করতে নেমেও তিনি জোর গলায় বারবার বলতেন—He who is morally wrong cannot be politically right, যে নীতির ধার ধারে না, যে চরিত্রহীন, তার রাজনীতি কখনও ঠিক হতে পারে না।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের ভিত্তিতে স্বাধীনতা যখন আসন্ন তখন স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাবা বাংলাকে অবিভক্ত রাখবার একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে হলে খুব খোলা মনেই তা করতে হবে। ঐ প্রস্তাবটি দেওয়ার ফলে বাবা বাস্তবিকই একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন। বন্ধুরা পর হয়ে গিয়েছিলেন, রাজনীতির সহকর্মীরা তাঁকে নির্মমভাবে ত্যাগ করেছিলেন, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অধিকাংশই খোলাখুলিভাবে বা গোপনে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন।
প্রস্তাবটির উদ্দেশ্য কী ছিল? হিন্দু ও মুসলমান দুই জাতি, এদের মধ্যে কখনোই মিল হতে পারে না। সুতরাং দুটি আলাদা রাষ্ট্র চাই, এই ছিল পাকিস্তানপন্থীদের মূল কথা। বাবা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না, ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করার তিনি ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শ, লক্ষ্য ও নীতি চিরকালই ঐ ধৰ্মীয় রাজনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং আমরা জাতীয়তাবাদীরা ঐ মতবাদের বিরোধিতা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। হিন্দু-মুসলমানেরা এই দেশে কয়েক শতক ধরে একত্রে বসবাস করে এমনই মিলেমিশে গিয়েছেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে আমরা কখনোই সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করতে পারব না, বরং সমস্যাগুলি বার বার ফিরে আসবে। সুতরাং, বাবা বললেন, বাংলার হিন্দু-মুসলমানেরা একসঙ্গে হয়ে একটি স্বাধীন সমাজবাদী রাষ্ট্র গড়বেন। ঐ রাষ্ট্রে পার্লামেন্ট নির্বাচিত হবে যৌথ নির্বাচন পদ্ধতিতে। সুতরাং হিন্দু ও মুসলমান যে-কোনো প্রার্থীকে দুই সম্প্রদায়েরই ভোট পেতে হবে। অবিভক্ত বাংলার শাসনতন্ত্র লেখবার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ এক সঙ্গে সমান প্রতিনিধিত্বে একটি সভা গঠন করবেন। যুক্ত বাংলার পার্লামেন্ট ঠিক করবে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী হবে। বাবা বলেননি যে, অবিভক্ত বাংলা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে থাকবে না! তিনি বলেছিলেন যে, আমাদের পার্লামেন্ট এ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
আমি নিজে বাবার মুখে শুনেছি যে, অবিশ্বাসের ও ঘৃণার যে পরিবেশ সৃষ্ট হয়েছে সেজন্য বড় জোর দশ বছর বাংলার স্বাধীন রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকবে। তারপর স্বাভাবিক কারণে ও নিজেরই স্বার্থে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে। বাবা বলেছিলেন যে, ঐ যুগসন্ধির সময় আমাদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত—ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ার পাকিস্তানি মতবাদ অন্তত পূর্ব-ভারতে বানচাল করে দেওয়া। অবিভক্ত বাংলা পুরোপুরি পাকিস্তানে চলে যাবে এই ধারণা ছিল, বাবার মতে অমূলক। কারণ, অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার গঠনতন্ত্রই হবে ভাষার ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত উদ্যোগে ও যুক্ত-ভোটে নির্বাচিত একটি রাষ্ট্র। ঐ রাষ্ট্রে প্রশাসনে ও ফৌজে থাকবে হিন্দু ও মুসলমানের সমান অধিকার।
বাবা মহাত্মা গান্ধীকে বাংলাকে অবিভক্ত রাখার চেষ্টায় বাংলার মুসলিম লিগের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার বিষয়ে ওয়াকিবহাল রেখেছিলেন। গান্ধীজি কয়েকটি বিষয়ে বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন।
সেই সময় আমাদের বাড়িতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির এক সদস্য জর্জ ক্যাটলিন অতিথি ছিলেন। ইতিমধ্যে ইংরেজ সরকার জেনারেল ওয়েভেলকে সরিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে বড়লাট করে পাঠিয়েছে। ক্যাটলিনের হাত দিয়ে বাংলাকে অবিভক্ত রাখার ফরমূলাটি বাবা মাউন্টব্যাটেনের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং অনুরোধ জানিয়েছিলেন যে, বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার পরিকল্পনা যেন কার্যকর না করা হয়। মাউন্টব্যাটেন ছিলেন ধুরন্ধর কূটনীতিবিদ। তিনি বেশ চালাকি করে উত্তর দিয়েছিলেন যে, শেষ মুহূর্তেও যদি কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব ও মুসলিম লিগের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব ঐ ফরমূলা গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি তাঁর পরিকল্পনাটি বদলে দেবেন। যত দূর জানা যায়, কংগ্রেসের সেই সময়কার সর্বভারতীয় নেতৃত্ব যুক্ত স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। জিন্নাসাহেব বাবার কথা ধৈর্যের সঙ্গে শুনেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলার মুসলিম লিগ নেতাদের কোনো নির্দেশ দেননি। মাউন্টব্যাটেন জুন মাসে দুই পক্ষের সম্মতি আদায় করে বেতারে যে পরিকল্পনা প্রচার করলেন তাতে দেখা গেল যে, বাবার সব চেষ্টাই বিফল হয়েছে। তিনি নতুনভাবে তাঁর নিজের কর্মপন্থা ঠিক করবার কাজে মন দিলেন। শেষ জীবনে তাঁর একলা চলার অধ্যায় শুরু হল।
রাজনীতির চরম অস্থিরতার মধ্যেও বাবা সেই সময় গঠনমূলক কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। ১৯৪৭-এর প্রথমে রাজনীতির শিকার হয়ে ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাম্বুলেন্স কোর ভেঙে গেল। কিন্তু ঐ প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু সভ্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, আদর্শবাদী সমাজসেবার কাজটা চালিয়ে যেতেই হবে। বাবার আর্শীবাদ নিয়ে আজাদ হিন্দ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হল। এই প্রতিষ্ঠান দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের সেবা করা ছাড়াও সমাজসেবার ক্ষেত্রে নতুন-নতুন পরিকল্পনার ভিত্তিতে কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। নেতাজী ভবনই হল ঐ প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর। নেতাজী ভবনে আজ পর্যন্ত স্থায়ী ও অর্থপূর্ণ যা কিছু হয়েছে, সবই ঐ সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানের তরুণ ডাক্তার ও অন্যান্য কর্মীদের উদ্যোগে হয়েছে। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোও এঁদের দ্বারাই শুরু হয়েছিল। বাবা একটা কথা গর্বের সঙ্গে বলতেন—আজাদ হিন্দ অ্যাম্বুলেন্সের তরুণ কর্মীরা তাঁকে সামনে রেখে কাজ করে। তাঁর সমর্থন যতটা না হলেই নয় তারা নেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেরাই চালায়, তারা একটি ব্যক্তির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল নয়। তিনি লিখে গেছেন যে, তাঁর আশা, আজাদ হিন্দ সার্ভিস কয়েক দশক ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে মানুষের সেবা করে যাবে। আসলে তাই হয়েছে। শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি কলকাতায় অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়ে চলেছে।
বাবার আশীর্বাদ নিয়ে ও তাঁকে সভাপতি করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আর একটি প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়েছিল—সুভাষ ইনস্টিটিউট অব কালচার। প্রতিষ্ঠানটির জন্য বাবা একটি বড় বাড়িও নিয়েছিলেন এবং কিছুদিন কাজকর্ম বেশ ভালই চলছিল। দুঃখের বিষয়, বাবার মৃত্যুর পরে প্রতিষ্ঠানটি বেশি দিন টেকেনি। ব্যক্তি-বিশেষের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করলে প্রতিষ্ঠানে সুসংবদ্ধ ও কর্মঠ কর্মীর দল গড়ে ওঠে না, তারা স্বাবলম্বী হয় না। ফলে ব্যক্তিটির প্রস্থানের পর প্রতিষ্ঠান ভেঙে যায়। আমাদের দেশে বহু প্রতিষ্ঠানের এই পরিণতি। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আরম্ভ করে কিছুদিনের মধ্যেই অবলুপ্তি। বাবা প্রায়ই এটাকে বলতেন—beginning with a flash and ending in smoke ।
আনন্দের কথা যে, কয়েক বছর পরেই বাবার চিন্তাধারা অনুসরণ করে নেতাজী ভবনে নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর স্থাপনা হয়। বাবার সাবধানবাণী মনে রেখে রিসার্চ ব্যুরোর কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়নি। গত পঁচিশ বছর ধরে কেবল কাজের ভিতর দিয়ে ধাপে ধাপে পুরো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাবা নেতাজী ভবনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজ বহুলাংশে বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭-এর ৪ জুন আমাদের দেশ খণ্ডিত করে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা প্রকাশ করলেন। বাবার প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ হল। তার মতে ঐ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদেরই জয় সূচিত হয়েছিল। তিনি বললেন যে, আমরা আমাদের আদর্শ ও নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছি। তিনি আরও বললেন যে, এমন দিন আসবে যখন কংগ্রেস ঐ সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করবে। যাই হোক, ১৫ আগস্ট এগিয়ে এল। ইংরেজের তদারকিতে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুত হলেন। বাবার পক্ষে তখন কংগ্রেস থেকে সরে আসা ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। নিজের অনুগামীদের নিয়ে নতুন এক দল গঠনের কাজে তিনি মন দিলেন।
১৪ আগস্ট, ১৯৪৭, বাবার কাছে ছিল যেন শোকের দিন। এত বিষণ্ণ তাঁকে আমি কমই দেখেছি। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় দেখলাম আমাদের বাড়ির নীচের তলার দক্ষিণের বাবান্দায় একলা স্থির হয়ে বসে আছেন। কিছুক্ষণ সত্যরঞ্জন বক্সী মহাশয় ছিলেন। তিনিও বাড়ি গেলেন। বাইরে থেকে নানারকম আওয়াজ আসছিল। প্রতিবেশীদের রেডিওতে উৎসবের গানবাজনা ও বক্তৃতাদি চলছে। রাস্তায় অনেক সাধারণ মানুষ খুব শোরগোল করছে। বাবার মনের অবস্থা দেখে আমি রেডিও খুলিনি। ভাবলাম রাস্তায় একটু ঘুরে আসি। বেরিয়ে দেখলাম একটার পর একটা লরি ভর্তি করে দলে দলে মানুষ হিন্দু-মুসলিম এক হো, হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে জাতীয় পতাকা দুলিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করছে। বেশি দূর যেতে মন চাইল না। বাড়ি ফিরে দেখি বাবা আগের মতোই স্থির হয়ে বসে আছেন। শুনেছিলাম আর একজনও বাবারই মতো স্বাধীনতার উৎসব থেকে দূরে ছিলেন—মহাত্মা গান্ধী।
৬৯
১৯৪৭-এর স্বাধীনতার উৎসব খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল। উৎসবের গানবাজনা, বক্তৃতা ইত্যাদি থেমেছে,কি থামেনি, খণ্ডিত পাঞ্জাব ও বাংলায় শুরু হয়ে গেল গণহত্যার এক অভাবনীয় তাণ্ডবলীলা। লক্ষ-লক্ষ লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে পড়লেন আশ্রয়ের আশায়। হিন্দুরা হিন্দুস্থানের দিকে, মুসলমানরা পাকিস্তানের দিকে। পাঞ্জাবেও হত্যা ও লক্ষ-লক্ষ লোককে তাঁদের বাস থেকে উপড়ে ফেলে যে দুই পাঞ্জাবের সৃষ্টি হল তার মধ্যে একটি হল বাস্তবিকপক্ষেই মুসলিম রাজ্য, অন্যটি যদিও ভারতের ভাগে পড়েছিল, সেটি হল হিন্দু ও শিখদের রাজ্য। দুই দিকেই লক্ষ-লক্ষ উদ্বাস্তু। বাবা আগেই বলেছিলেন, বাংলায় কিন্তু ঐ ধরনের পরিবর্তন সম্ভব হবে না, কারণ সারা রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান বহুদিন ধরে এমন নিবিড়ভাবে মিলেমিশে আছে যে, পুরোপুরিভাবে আমাদের সমগ্র জনসংখ্যাকে ভাগ করে ফেলা সম্ভব নয়। যাই হোক, লক্ষ-লক্ষ পরিবার তাঁদের বহুদিনের বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বন্যার স্রোতের মতো আসতে লাগলেন। বেশ কয়েক বছর ধরে এটা চলল।
এই অবস্থায় বাবার অনুগামীদের মধ্যে যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন তাঁদের নিয়ে আগস্টের প্রথমে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি গড়লেন। নতুন দল গড়ার সময় বাবার মূল কথাই ছিল যে, আমাদের দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ ও লক্ষ্যকে জাগিয়ে রাখতে হবে। দেশভাগ ও ইংরাজ সাম্রাজ্যের মধ্যে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নিতে আমরা বাধ্য হয়েছি কিন্তু আমাদের জাতীয় আন্দোলনের মূল ভাবধারাকে আমাদের ছাড়লে চলবে না। তাছাড়া স্বাধীনতার পর দেশ গড়ে তোলার কাজ, আমাদের দরিদ্র জনগণের সার্বিক মঙ্গলের জন্য, আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সমাজবাদী চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে, সেটাকে রূপ দিতে হবে। যে সাম্প্রদায়িকতা ও গোঁড়ামির বিষ আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, সেটাকে দূর করার ব্রত গ্রহণ করতে হবে। সেটা আমরা করতে পারব যদি জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদী শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় এবং দেশের সব সমস্যা জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আমরা আমাদের জাতীয় কর্মসূচী ঠিক করি। তিনি আরও বলেছিলেন যে, কে প্রকৃত বামপন্থী এবং হঠকারী বামপন্থী এটা আমাদের বুঝে নিতে হবে। যাঁরা কেবল নেতাজীর নাম ব্যবহার করেন কিন্তু তাঁর নির্দেশিত পথে চলেন না তাঁদেরও চিনে নিতে হবে।
১৯৪৭-এর প্রথমেই কলকাতায় একটি সম্মেলনে বাবা আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ও সৈনিকদের ডাক দিয়েছিলেন দলবদ্ধভাবে এবং সক্রিয়ভাবে দেশের জনজীবনে প্রবেশ করতে এবং নেতাজীর আদর্শ, মতবাদ ও নীতির ভিত্তিতে কাজ করতে। দেশে যাঁরা যুদ্ধের আগে ও পরে রাঙাকাকাবাবুর অনুগামী ছিলেন তাঁদেরও তিনি ডেকেছিলেন ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাবা কোনো দিক থেকেই ভাল সাড়া পাননি। ফলে বড় রকমের নতুন দল পঠন করতে বাবা পারেননি। আগেকার বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর নেতা ও কর্মিবৃন্দ সুখে-দুঃখে বাবার সঙ্গে সর্বদাই ছিলেন। তাঁদের নিয়েই বাবা কাজ চালিয়ে গেলেন।
বাবার একটা বড় দুঃখ ছিল যে, মহাত্মা গান্ধী দেশভাগের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও যখন কংগ্রেস দেশকে খণ্ডিত করার প্রস্তাব মেনে নিতে চলেছে তখন জোরের সঙ্গে বাধা দিলেন না। সেই সময় গান্ধীজি বাংলায় বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। বাবা তাঁর সঙ্গে তখন প্রায়ই দেখা করতে যেতেন এবং দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন। বাবা গান্ধীজিকে বারবার বলেছিলেন, আজও যদি আপনি আপনার কড়ে আঙুল উঁচিয়ে একবার বলেন যে, দেশভাগ করা চলবে না তাহলেই কাজ হবে। কিন্তু গান্ধীজি উত্তরে বলেন যে, তাঁর আর সে প্রভাব নেই, দেশের নেতৃবৃন্দের উপরেও নেই, দেশের জনসাধারণের উপরেও নেই।
১৯৪৮-এর প্রথমে আমাদের বিদেশনীতি সম্বন্ধে বাবা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথা বলেছিলেন। প্রথমত তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, আমাদের বৃহৎ শক্তি দুটির মধ্যে কারুর সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা উচিত হবে না। আমাদের বিদেশনীতি হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে স্বাধীন বিদেশনীতি রক্ষার জন্য দুটি পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে। এক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক রাষ্ট্রসঙ্ঘ গড়তে হবে। দুই, ভারতকে এক শক্তিশালী সামরিক শক্তিরূপে গড়ে তুলতে হবে। এই সূত্রে মনে পড়ল বাবা স্বাধীনতার আগে থেকেই; বিশেষ করে স্বাধীনতা অর্জনের পর, জোরের সঙ্গে বলতেন, আমাদের দেশের যুবকদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা চাই।
১৯৪৮-এর জানুয়ারির শেষ দিন মহাত্মা গান্ধীর হত্যার খবর যখন রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছিল তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না। বাড়িতে ফিরে দেখলাম, বাবা গান্ধীজির শেষকৃত্যে যোগ দেবার জন্য পরের দিন ভোরের দিল্লির এরোপ্লেনে একটি আসনের জন্য চেষ্টা করছেন। বাবা তো সহজে বিচলিত হতেন না, তবে গভীর বেদনার ছায়া তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিল। কেবলই বলছিলেন, তাঁর শেষ কাজে আমাকে যেতেই হবে। সাংবাদিকরা যখন তাঁকে কিছু বলতে বললেন, বাবা শেক্সপিয়রের ভাষায় বললেন : When comes such another?
১৯৪৭-এর প্রথম থেকেই বাবা দেশের সব সমস্যা সম্বন্ধে তাঁর মতামত নির্ভয়ে এবং খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করছিলেন। তাঁর মতামত দেশের অধিকাংশ নেতা বা দল গ্রহণ করেননি। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বাবাকে লিখেছিলেন, তিনি যেন আবার কংগ্রেসের নেতৃত্বে ফিরে আসেন, যাতে তাঁরা সকলে মিলে দেশের ঐ সঙ্কট সময়ে জটিল সমস্যাগুলির মোকাবিলা করতে পারেন। বাবা রাজি হননি, বলেছিলেন, গভীর নীতিগত পার্থক্য যখন রয়েছে তখন তাঁর পক্ষে বাইরে থাকাই ভাল।
বাবা বুঝতে পারছিলেন যে, তাঁর মতবাদ প্রচারের জন্য একটা পত্রিকা দরকার। পত্রিকা চালানোর ব্যাপারটা কিন্তু বাবার কাছে নতুন কিছু ছিল না। সেই বিশের দশকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন বাবা। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর ঐ পত্রিকা চালিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব বাবাই বহন করেছিলেন। পরে ব্রাজরোষে পড়ে ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকা যখন হঠাৎ বন্ধ করে দিতে হয়, বাবা ও রাঙাকাকাবাবু এক অসাধ্যসাধন করে বসেন। রাতারাতি ‘ফরওয়ার্ড’-এর বদলে ‘লিবার্টি’ পত্রিকা বের হতে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ঐ দুটি পত্রিকার অবদান ভোলবার নয়। কিন্তু পত্রিকা বের করা ও চালিয়ে রাখা—অনেক খরচের ব্যাপার। ‘ফরওয়ার্ড’ ও ‘লিবার্টি’-র ক্ষেত্রে বাবা আর্থিক দিক দিয়ে কোনো কার্পণ্য করেননি। কিন্তু বয়স তখন অনেক কম ছিল এবং টাকা রোজগার করবার সময় ও সুযোগ ছিল বেশি। তবে কাগজ বের করবার সিদ্ধান্ত তিনি যখন একবার নিয়েছেন, তিনি করে তবে ছাড়বেন। অর্থ সাহায্যের জন্য তিনি কোনো কোনো সচ্ছল বন্ধুর কাছে অনুরোধ করলেন। সাড়া আশাপ্রদ হল না। তখন নিজেরই জমিজমা এখানে-সেখানে যা ছিল সেগুলি ব্যবহার করে, তার সঙ্গে নিজের রোজগারের যতটা পারলেন যোগ দিয়ে একটা প্রেসের ব্যবস্থা করলেন। জোর কদমে কাজ এগোল। টাকার যত অভাব ছিল স্বার্থত্যাগী একনিষ্ঠ কর্মীর তত অভাব ছিল না। তাঁদের সকলের মিলিত চেষ্টায় ১৯৪৮-এর ১ সেপ্টেম্বর ‘দি নেশন’ কাগজ বেরোল। বাবা হলেন সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। তাঁর সই করা সম্পাদকীয় প্রথম সংখ্যায় ছাপা হল। সম্পাদক হলেন সত্যরঞ্জন বক্সি। ম্যানেজিং ডিরেক্টর জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ এবং বার্তা সম্পাদক মোহিতকুমার মৈত্র। ‘দি নেশন’ পত্রিকা বেশ একটা আলোড়নের সৃষ্টি করল। বাস্তবিক পক্ষে জনসাধারণের চাহিদা পত্রিকার কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি মেটাতেই পারছিলেন না। বাবা খুবই উৎসাহিত হলেন এবং পত্রিকাটি যাতে খুব উঁচু মানের হয় তার জন্য সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। পরের বছর আমি যখন ডাক্তারিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যাণ্ডে ছিলাম তখন ‘দি নেশন’-এর ফরেন করেসপনডেন্ট হিসাবে সাংবাদিকতায় এবং লেখালেখিতে আমার হাতেখড়ি হয়। বাবারই নির্দেশে প্যারিসে আমি ‘দি নেশন’-এর প্রতিনিধি হিসাবে একটি আন্তর্জাতিক সম্পাদক সম্মেলনে যোগ দিই।
যুদ্ধ শেষ হবার কিছুদিন পরেই বাবার কাছে ভিয়েনা থেকে এক বন্ধুর মারফত একটি চিঠি এসে পৌঁছয়। চিঠিটির সঙ্গে ছিল বাংলায় বাবাকে লেখা রাঙাকাকাবাবুর একখানা চিঠির প্রতিলিপি। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউরোপ থেকে সাবমেরিনে পূর্ব-এশিয়া পাড়ি দেবার পূর্ব-মুহূর্তে রাঙাকাকাবাবু চিঠিটি লিখেছিলেন। চিঠিটিতে রাঙাকাকাবাবু তাঁর সহধর্মিণী ও কন্যা অনীতার কথা তাঁর মেজদাদাকে জানিয়েছিলেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপে গিয়ে কাকিমা ও অনীতার সঙ্গে দেখা করে ভবিষ্যতের জন্য ব্যবস্থাদি করার ইচ্ছা বাবার মনে অনেকদিন থেকেই ছিল। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকেই তিনি মোটামুটি ঠিক করলেন যে যাবেনই। আমার ডাক্তারি পাশ করার পর প্রায় দেড় বছরের শিক্ষানবিশি ঐ বছরেই শেষ হবে। ঠিক হল শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমি সঙ্গে যাব এবং দুই ছোট বোনকেও সঙ্গে নেওয়া হবে।