বসু-বাড়ি – ৫০

৫০

আমার মনে হয় বাবা গোপন ও বৈপ্লবিক কাজকর্মে নিজের সম্বন্ধে বড়ই বেপরোয়া ছিলেন এবং নিজের উপরে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতেন। অথচ রাঙাকাকাবাবুর যাতে কোনো বিপদ না হয়, আমার সম্বন্ধে পুলিশ যাতে কোনোরকম সন্দেহ না করে, তার জন্য তিনি খুবই ব্যস্ত হতেন এবং সবরকম সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিতেন। ভগত রামের অভিজ্ঞতা থেকে এর কিছু আঁচ পাওয়া যায়। ভগত রাম কাবুল থেকে রাঙাকাকাবাবুর খবর নিয়ে কলকাতা আসবার পথে রাঙাকাকাবাবুরই নির্দেশে লাহোরে সর্দার শার্দূল সিং কবিশেরের সঙ্গে দেখা করেন। সর্দারজি রাঙাকাকাবাবুর লেখা দেখেও এমন ভাব দেখান যেন তিনি কিছুই বুঝছেন না বা বিশ্বাস করছেন না এবং ভগত রামকে বিদায় করে দেন। ভগত রাম এতে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। হতে পারে, শার্দূল সিং ইচ্ছা করেই ঐ রকম ব্যবহার করেছিলেন। অচেনা এক লোকের কাছে হয়তো বা কিছুই কবুল করতে চাননি। বাবার কাছে এসে ভগত রাম কিন্তু অন্য ধরনের অভ্যর্থনা পেলেন এবং সবরকম সাহায্য পেলেন। খোলা জায়গায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ও আলোচনা করতে বাবা মোটেই ইতস্তত করলেন না। যদি পুলিশ কোনো আঁচ পেত, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের রাগানে সেই সকালে বাবা ও ভগত রামকে একসঙ্গেই ধরে ফেলতে পারত। জাপানিদের সঙ্গে দেখাশুনোর ব্যাপারেও রাবা বেশ বেপরোয়া ভাব দেখাতেন। নিজের বাড়িতে বারবার তাদের সঙ্গে দেখা না করে ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায় তো করতে পারতেন। গোয়েন্দা দপ্তর নিশ্চয়ই রিষড়ার বাড়ির উপর নজর রাখত, যেমন উডবার্ন পার্ক ও এলগিন রোডের বাড়ির উপর রাখত। বাবা অবশ্য বিশ্বাস করতেন যে, গোপন কথাবার্তা বা কাজকর্ম স্বাভাবিক পরিবেশে করলেই সন্দেহ কম হয়। পরে নানা সূত্র থেকে যা জেনেছি, তার থেকে মনে হয়, বাবার সম্বন্ধে খবরাখবর পুলিশ দপ্তর সোজাসুজি আমাদের তরফ থেকে পায়নি। ঐ সব কাজে সংশ্লিষ্ট অন্যদের অসাবধানতা বা গাফিলতির ফলেই কিছু-কিছু গুরুত্বপূর্ণ অতি গোপনীয় খবর গোয়েন্দাদের হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। বাবার গ্রেপ্তারের কিছু দিন পরে উডবার্ন পার্কে বসে গল্প করতে-করতে আমার খুড়তুতো দাদা রঞ্জিত আমাকে বললেন, ‘মেজোজ্যাঠাবাবু’ সম্বন্ধে একটা খুব গোপন কথা ভারত সরকারের কাছে পৌঁছে গেছে। শীলভদ্র যাজীর কাছে তিনি শুনেছেন যে, ভগত রাম নামে এক ভদ্রলোক রাঙাকাকাবাবুর চিঠি নিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলেন একথা সরকার জানে। সেজদার কথা শুনে আমি আঁতকে উঠেছিলাম, যদিও সে-রকম কোনো ভাব আমি প্রকাশ করিনি। সেজদা বা শীলভদ্রজির তো ভগত রামের নাম জানার কথা নয়! বুঝলাম যে, একটা গুরুতর খবর ফাঁস হয়ে গেছে, খুব সম্ভব আমার নামও পুলিশের খাতায় উঠেছে। যুদ্ধের পরে সত্যরঞ্জন বক্সি মহাশয় আমাকে বলেছিলেন যে, দিল্লির রেড ফোর্টে বন্দী অবস্থায় গোয়েন্দারা তাঁকে একটা চিরকুট দেখিয়েছিল, যেটাতে বাবার সঙ্গে গোপন আলাপ-আলোচনা সম্বন্ধে জাপানিদের একটি বার্তা ইংরেজিতে বড়-বড় অক্ষরে লেখা ছিল। সত্যবাবুর বিশ্বাস, কোনো জাপানি অফিসে হঠাৎ হানা দিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা ঐ বাতাটা পায়। 

বার্লিন থেকে রাঙাকাকাবাবু বাবাকে জাপানিদের মারফত জানিয়েছিলেন যে, জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরকে ভারত ও এশিয়া সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করাটাই তাঁর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রী রিবেনট্রপ নাকি নিজেই রাঙাকাকাবাবুকে বলেছিলেন, “আপনি আমাদের এসব বিষয়ে ‘এডুকেট’ করুন।” রাঙাকাকাবাবুর একমাত্র কাম্য ছিল যুদ্ধ এমনভাবে চলুক যাতে ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের সুবিধা হয় এবং স্বাধীনতার জন্য শেষ সশস্ত্র আঘাত হানবার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। 

১৯৪১ থেকে ১৯৪৫, বাবার কারাবাসের পুরো সময়টা বসুবাড়ির পক্ষে অতি কঠিন পরীক্ষার সময় হয়ে দাঁড়াল। দুঃসময় যখন আসে, জাঁকিয়ে আসে। প্রথমত, আমরা তো দারুণ আর্থিক সঙ্কটে পড়ে গেলাম। প্রায় একই রকম অবস্থা ত্রিশের দশকে বাবার প্রথম কারাবাসের সময় হয়েছিল। মা ও ছেলেমেয়েদের নামে বাবা যেসব ইনস্যুরেন্স পলিসি করেছিলেন, একে-একে সেগুলি জলাঞ্জলি দিতে হল। আমার চোখের সামনে আমার অতি প্রিয় ওয়াণ্ডারার গাড়িটি বিক্রি হয়ে গেল। মা যথাসাধ্য সংসারের খরচ নামিয়ে আনলেন। তবে যুদ্ধের সময় তো, সবকিছুরই দাম ক্রমাগতই বাড়ছে, সামলানোই দায়। আমার এক দাদা তখন বিলেতে। তাঁর খরচ কে জোগাবে? ত্রিশের দশকে একই অবস্থায় যেমন আর-এক বন্ধু এগিয়ে এসেছিলেন, এবার এগিয়ে এলেন বাবার প্রাক্তন শিষ্য ব্যারিস্টার সুধীরঞ্জন দাস। তিনি মাসে-মাসে কোর্ট-ফেরত উডবার্ন পার্কে এসে বিলেতের খরচের জন্য একখানা খাম ধরিয়ে দিয়ে যেতেন। তখন উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমিই তো বড়, মাকে না পেলে ‘মাকে এটা দিও’ বলে আমার হাতেই খামটি তুলে দিতেন। 

তখন সমগ্র বসুবাড়ির উপর সরকারের শ্যেনদৃষ্টি। দিনরাত টিকটিকিরা বাড়ি ঘিরে রেখেছে। যখনই আমরা কোথাও যাই, পেছনে গোয়েন্দা। বাড়ির ছেলেদের মধ্যেও তিনজনকে যুদ্ধের সময় জেলে যেতে হল। এই অবস্থায় আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বেশির ভাগই দূরে সরে গেলেন। দোষ তো দেওয়া যায় না, কে আর অযথা বিপদ ডেকে আনতে চায়। শুনেছি জেল থেকে বাবার চিঠি পেলে কেউ-কেউ এই ভেবে আতঙ্কিত হতেন যে, তাঁরা হয়তো পুলিশের কুনজরে পড়ে গেলেন। গাড়িতে আমাদের বাড়িতে এসে পরে কারও-কারও ভয় হত,এই বুঝি ফটকের গোয়েন্দারা গাড়ির নম্বর নিল। 

বাবাকে নিয়েও আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। কিছুদিন প্রেসিডেন্সি জেলে রাখবার পর হঠাৎ একদিন তাঁকে সুদূর দক্ষিণ ভারতে সরিয়ে নিয়ে গেল। মজার কথা এই যে, শত্রুশিবিরেও অনেক সময় বন্ধু থাকে। একজন লুকিয়ে খবর দিয়ে দিল যে, বাবাকে মাদ্রাজ মেলে চড়িয়ে স্থানান্তরিত করা হবে। উডবার্ন পার্ক থেকে আমরা সকলে মামাবাবুকে সঙ্গে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে ছুটলাম। মুখ্যমন্ত্রী (তখন বলা হত বাংলার প্রধানমন্ত্রী) ফজলুল হক সাহেবও খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত। কড়া পুলিশ-পাহারায় বাবাকে স্টেশনে নিয়ে এল, সশস্ত্র পুলিশের বেষ্টনীর ভিতর দিয়ে বাবাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ট্রেনের কামরায় তুলে সব দরজা-জানালা এঁটে দিল। ফজলুল হক সহ আমরা কেবল চেয়েই রইলাম। প্রথমে বাবাকে নিয়ে গেল ত্রিচিনোপল্লী জেলে। একেবারে নির্জন কারাবাস, সেখানে বাবাকে নিজে রেঁধে খেতে হত। তারপর কিছুদিন রাখল দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের কাছে কুর্গ প্রদেশের মারকারায়। শেষে নিয়ে গেল নীলগিরি পাহাড়ের কুনুরে। চার বছরের এই কঠিন বন্দী-জীবনের ফলে বাবার স্বাস্থ্য ক্রমেই ভেঙে পড়ল, এবং, আমাদের বিশ্বাস, এটাই তাঁর অকালমৃত্যুর প্রধান কারণ। 

সেই সময়ে বাড়িতে অসুখ-বিসুখেরও শেষ ছিল না। মা তো অন্তত দুবার গুরুতরভাবে অসুস্থ হলেন। একবার তো ডাক্তাররা হালই ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবাকে সেই সময় কলকাতায় নিয়ে আসবার সব আবেদন সরকার অগ্রাহ্য করলেন। ১৯৪২-৪৩এ আমি নিজেও বন্দী অবস্থায় টাইফয়েডে মরণাপন্ন হয়েছিলাম। যুদ্ধের মধ্যে বসুবাড়িতে বেশ কয়েকটি মৃত্যুও হল। মেজদা গণেশ, বোন ইলা ও শেষ পর্যন্ত মাজননী একে একে চলে গেলেন। মাজননীর শেষ সময়েও বাবাকে কলকাতায় আনাবার অনেক চেষ্টা হল, সরকার কিন্তু অনড়। প্রথম কারাবাসের সময় বাবা দাদাভাইকে হারিয়েছিলেন, দ্বিতীয়বার হারালেন মাজননীকে। 

১৯৪২-এর প্রথম থেকেই দেশের আকাশে মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে। একদিকে রাঙাকাকাবাবু ইউরোপ থেকে বেতারে প্রচার আরম্ভ করলেন, অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ সরকারের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ধীরে-ধীরে সংগ্রামের পথে এগোলেন। যুদ্ধের ফলে জনসাধারণের দুঃখদুর্দশাও বাড়তে লাগল। ঘরে ও বাইরে যখন এই অবস্থা, তখন আমি মেডিকেল কলেজে খানিকটা উঁচু স্তরে উঠেছি, স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করার অধিকার পেয়েছি। ছোট-ছোট দলে ছাত্রদের ভাগ করে নিয়ে মাস্টারমশাইরা রুগির পাশে নিয়ে গিয়ে আমাদের হাতে-কলমে পড়াতেন। বেশ একটা নতুন অভিজ্ঞতা। বিপদ-বিপর্যয়ের মধ্যেও কিন্তু ডাক্তারি পড়ানোটা বেশ ভালই হত। আমাদের মাস্টারমশাইরা কোনো অজুহাতেই কাজে আলগা দিতেন না, শৃঙ্খলা ছিল শক্ত, ‘ছাত্রদেরও যথাসম্ভব পাল্লা দিয়ে চলতে হত। তবে নিজের সম্বন্ধে বলতে পারি, মনটা যেন সবসময়েই ভারাক্রান্ত হয়ে থাকত। চলতে ফিরতে, ট্রামে বাসে, ক্লাসে বা হাসপাতালে, কত রকমের চিন্তা যে মাথার মধ্যে তোলপাড় করত, সে আর কী বলব! মাস্টারমশাইদের ও ছাত্রবন্ধুদের মধ্যেও কেউ-কেউ যুদ্ধের গতি নিয়ে আলোচনা করতেন। আমি শুনতাম আর ভাবতাম, এঁদের আলোচনাটা তো শখের, আমার কাছে সবটাই কঠোর বাস্তব সত্য। 

১৯৪২-এর ফেব্রুয়ারিতে জাপানিরা সিঙ্গাপুর দখল করবার পর থেকে রেডিওতে নিয়মিত রাঙাকাকাবাবুর বক্তৃতা শোনা যেতে লাগল। রাঙাকাকাবাবু সম্বন্ধেও অনেকে আমাকে নানারকম প্রশ্ন করতেন। অনেকের কাছেই আমি বিষয়টা কাটিয়ে যেতাম। জনকতক বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুর সঙ্গে খোলাখুলিভাবেই আলোচনা করতাম এবং আসন্ন ভীষণ সংগ্রামের কথা বলতাম। এরই মধ্যে মেডিকেল কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে দু’চারজনকে পেলাম যাঁরা সত্যি-সত্যি ভবিষ্যতের লড়াইয়ে শামিল হতে চান। এঁদেরই মাধ্যমে কলেজের বাইরের জনকয়েক ছাত্র ও যুবকের সান্নিধ্যে এলাম, যাঁরা একই পথের পথিক। যদিও প্রস্তুতিপর্ব এইভাবে চলছিল, ১৯৪২-এর প্রথমের দিকে বুঝতে পারিনি যে, বছরের শেষের দিকে আমি এক ভীষণ ঝড়ের মুখে পড়ে যাব। 

৫১

১৯৪২-এর মার্চ মাসের শেষাশেষি মেডিকেল কলেজ থেকে নাইট ডিউটি সেরে সকালে বাসে বাড়ি ফিরছি, দেখি এক সহযাত্রীর হাতের খবরের কাগজে রাঙাকাকাবাবুর ছবি। কাছ ঘেঁষে খবরটা পড়ে নিলাম। খবরে বলছে রাঙাকাকাবাবু নাকি জাপানের উপকূলে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। যদিও খবরটা পড়ে কিছুক্ষণের জন্য বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম, একটু চিন্তা করেই বুঝলাম, খবরটা বাজে। সেই সময় রাঙাকাকাবাবু আজাদ হিন্দ্ রেডিও থেকে প্রায় রোজই বক্তৃতা করছিলেন। আমি জানি, আজাদ হিন্দ রেডিও ইউরোপে, খুব সম্ভব জার্মানিতেই। আর ভূগোলের জ্ঞান এবং তখনকার যুদ্ধের পরিস্থিতি থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, সেই সময় ইউরোপ থেকে হঠাৎ এরোপ্লেনে করে জাপানে পৌঁছনো সম্ভব নয়। বাস থেকে নেমে এলগিন রোডের বাড়ির সামনে দিয়ে না গিয়ে উডবার্ন পার্কে পৌঁছলাম। মা যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। দেখলাম নিজের ঘরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে জল। আমি তো খুব জোরের সঙ্গে মাকে বুঝিয়ে বললাম, খবরটা কোনোমতেই সত্যি হতে পারে না। 

মাজননীকে কী করে বোঝানো যায় সে-বিষয়ে আমরা চিন্তা করতে লাগলাম। অনেকেই বললেন, আপাতত খবরটা চেপে রাখা যাক, ভুল বলে প্রমাণিত হওয়ার পরে বললেই হবে। কিন্তু এলগিন রোডের বাড়িতে গিয়ে শুনি সর্বেশ্বর ঠাকুর খবরটা বাজারে শুনে এসে বাড়ি ফিরেই মাজননীকে বলে দিয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, মাজননী শুনেই বলেছেন যে, তিনি খবরটা বিশ্বাস করেন না। তবু আমার মনে হল যে, তাঁর মনে যাতে কোনো দ্বিধা না থাকে, রাঙাকাকাবাবুর বেতার-বক্তৃতা সন্ধ্যায় তাঁকে শোনালে হয়। সন্ধ্যায় মাজননীকে আর ছোটপিসিমা কনকলতাকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে নিয়ে এলাম। মা ও তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে বসিয়ে আজাদ হিন্দ্ রেডিও ধরলাম। গলা খুব ভাল শোনা যাচ্ছিল না, আওয়াজ হচ্ছিল। যাই হোক, সকলকার মন শান্ত হল। ইতিমধ্যে মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য কোনো কোনো নেতা মাজননীর কাছে শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। পরে গান্ধীজি মাজননীকে অভিনন্দন জানিয়ে আর একটা তার পাঠালেন। 

শুনেছিলাম, ১৯৪১-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস থেকেই নাকি আজাদ হিন্দ রেডিও চালু হয়েছিল। তবে আমি অনেকদিন ওই রেডিও ধরতে পারিনি। ১৯৪২-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ এশিয়ার ইংরেজদের তথাকথিত অজেয় দুর্গ সিঙ্গাপুরের পতন হল। তার পরেই রাঙাকাকাবাবু নিয়মিত বেতার বক্তৃতা আরম্ভ করেন। তবে আজাদ হিন্দ রেডিও খুব শক্তিশালী ছিল না, সব সময়, বিশেষ করে আবহাওয়া খারাপ থাকলে, ভাল শোনা যেত না। 

সিঙ্গাপুরের পতনের পর রাঙাকাকাবাবুর প্রথম ঐতিহাসিক বক্তৃতা সারা জগৎকে শোনাবার জন্য বার্লিন রেডিও ভাল ব্যবস্থা করল। বার্লিন থেকে প্রচার করা হল যে, এক অজানা রেডিও স্টেশন থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তৃতা শোনা গেছে। বার্লিন রেডিও সেটি রেকর্ড করে নিয়েছে। রেকর্ড-করা বক্তৃতাটি বার্লিন থেকে পুনঃপ্রচার করবে। ফলে, আমরা সকলে জোরদার বার্লিন রেডিও মারফত রাঙাকাকাবাবুর সেই বক্তৃতা বেশ ভালভাবে শুনতে পেলাম। 

সেকালে ঘরে-ঘরে বিদেশী স্টেশন ধরবার মতো রেডিও ছিল না। রাঙাকাকাবাবুর কণ্ঠস্বর বেতারে শোনা যাচ্ছে জানাজানি হবার পরে অনেকেই রেডিও শোনার জন্য নানা জায়গায় জড় হতেন। কিন্তু পাছে পুলিশ জেনে ফেলে এই ভেবে অনেকেই ব্যাপারটা নিয়ে অতিরিক্ত লুকোচুরি করতেন। উডবার্ন পার্কের বাড়িতে কিন্তু আমরা দরজা-জানলা খুলে রেখেই তাঁর বক্তৃতা শুনতাম। আমরা তো আগে থেকেই ইংরেজ সরকারের কুনজরে পড়ে আছি, বেশি আর কী হবে! 

জাপানের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিন পরে স্থানীয় মিলিটারি কর্তৃপক্ষ উডবার্ন পার্কের বাড়ির উপর নজর দিলেন। নোটিসে জারি হল যে, তাঁরা বাড়িটা মিলিটারি হাসপাতাল করবার জন্য নিয়ে নেবেন। মা তো মহা ফাঁপরে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত বাড়ি-ছাড়া করবে নাকি! বাংলার মন্ত্রিসভায় তখন সন্তোষকুমার বসু বাবারই মনোনীত সদস্য। সন্তোষবাবু ফোর্ট উইলিয়ামে হাঁটাহাঁটি করে কোনোরকমে বাড়ি-দখলটা ঠেকালেন। 

এদিকে যতই দিন যাচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক সংকট ততই বাড়ছে। আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৪২ সালটি খুবই স্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। ওই বছরে মহাত্মা গান্ধী ইংরেজ সরকারের কপটতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আপসের নীতি ছেড়ে দিয়ে সংগ্রামের পথে এলেন। অনেকের বিশ্বাস রাঙাকাকাবাবুর দুঃসাহসিক দেশত্যাগ ও বেতার প্রচার গান্ধীজিকে বেশ খানিকটা প্রভাবিত করেছিল। এপ্রিল মাসে তিনি কংগ্রেসের সর্বোচ্চ কমিটির কাছে একটা প্রস্তাবের খসড়া পেশ করেছিলেন। যেটা পড়ে দেখলে বোঝা যায় যে, ১৯৪২-এর গান্ধীজি ও রাঙাকাকাবাবু নীতিগতভাবে খুবই কাছাকাছি এসেছিলেন। গান্ধীজি যে ওই বছরের মধ্যেই চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক দেবেন তার আভাস আমরা নানা দিক থেকেই পাচ্ছিলাম। মেডিকেল কলেজের জনাকয়েক ছাত্র মিলে আমরা আসন্ন লড়াইয়ে আমাদের কর্তব্য সম্বন্ধে আলোচনা আরম্ভ করি। আমাদের আশা ছিল যে, ভিতরের সংগ্রামের সঙ্গে যথাসময়ে রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্বে বাইরের সংগ্রাম যুক্ত হবে। আমাদের গোপন জল্পনা-কল্পনায় ছিলেন কালিদাস বসু, শচীন চৌধুরী প্রমুখ। মেডিকেল কলেজের বাইরের জনাকয়েক বিপ্লবী যুবকও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ‘লীগ অব রেভল্যুশনারি ইয়ুথ’ নাম দিয়ে ১৯৪২-৪৩ সালে সাইক্লোস্টাইল-করা এক ইস্তাহার গোপনে বের করা হত। ভিতরের ও বাইরের সংগ্রামকে যুক্ত করার পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমি ওই ইস্তাহারে কয়েকটি লেখা লিখেছিলাম। মেডিকেল কলেজের পিছনের দিকে এজরা হাসপাতালে আমাদের গোপন বৈঠক হত। 

১৯৪২-এর ৮ আগস্ট গান্ধীজি বোম্বাইয়ে কংগ্রেসের এক ঐতিহাসিক অধিবেশনে তাঁর ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিলেন। খবর পেয়েই রাঙাকাকাবাবু ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে দেশবাসীকে মহাত্মাজির ডাকে সাড়া দিয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বললেন। এই ভাষণটি আমি লিখে নিয়েছিলাম, পরে গোপনে প্রচার করার উদ্দেশ্যে। ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব পাশ হওয়া মাত্র ব্রিটিশ সরকার সারা দেশ জুড়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করলেন। জেলে যাবার আগে গান্ধীজি ডাক দিয়ে গেলেন, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’! দেশের প্রায় সব জাতীয়তাবাদী নেতাই কারারুদ্ধ হলেন, অনেকেই আবার গা-ঢাকা দিলেন। সংগ্রামী দলগুলি বেআইনি ঘোষিত হল। যে বিদ্রোহের আগুন বোম্বাইয়ে প্রজ্বলিত হল, ধীরে ধীরে তা দেশের সব দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিদ্রোহের ঢেউ কলকাতায় পৌঁছতে তিন-চার দিন লাগল। 

১৩ অগাস্ট সকালে মেডিকেল কলেজে পৌঁছেই চারদিকে একটা চাপা উত্তেজনার আভাস পেলাম। মামাবাড়িতে দুপুরের খাওয়া খেয়ে কলেজে ফিরে দেখি, কলেজ-প্রাঙ্গণে ছাত্ররা দলবদ্ধভাবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছে—বিশেষ করে বিহারের সরকারি তাণ্ডব নিয়ে। খবর এল যে, কলকাতার ছাত্রসমাজ সেইদিনই বিকেলে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে আইন অমান্য করে প্রতিবাদ-সভা করবে। ঠিক হল যে, মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাও এক মিছিল বের করবে, তবে আমাদের পরিক্রমাটা হবে ছোট। কলেজ স্ট্রীট দিয়ে বেরিয়ে হ্যারিসন রোড দিয়ে ঘুরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের গেট দিয়ে আমরা আবার কলেজে ফিরে আসব। মিছিলটা বেশ বড়ই ছিল। চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের উপর কলেজের গেটের সামনে এসে একটা প্রশ্ন উঠল। আমরা কি কলেজে ফিরে যাব, না সকলের লক্ষ্য ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করব? আমরা যারা মিছিলের সামনের দিকে ছিলাম, বললাম, পথেই যখন নেমেছি, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে যাবার চেষ্টা করাই আমাদের কর্তব্য। মিশন রো’র মাঝামাঝি পৌঁছে দেখি একদল লাঠিধারী ও সশস্ত্র পুলিশ আমাদের পথ আগলে আছে। দূরে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে বন্দুকধারী অনেক· সৈন্য। মাঝে মাঝে গুলির আওয়াজ আসছে। এক পুলিশ অফিসার আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, আমাদের মিছিল বেআইনি, তিন মিনিটের মধ্যে আমরা যদি সরে না যাই, ওরা যা করার তা করবে। আমরা তো ইচ্ছা করেই নানা কথা বলে কয়েক মিনিট কাটিয়ে দিলাম। এখন স্বীকার করতে পারি, আমরা কেউ-কেউ চাইছিলাম যে, পুলিশ আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যেন মেডিকেল কলেজের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। আমার সঙ্গে মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন রবি রায়, সমীর সেন, ইসমাইল ইব্রাহিম, অতুলেন্দু সেন, কুলভূষণ সেনগুপ্ত প্রমুখ। অফিসারের ‘চার্জ’ অর্ডার শোনামাত্র প্রচণ্ড লাঠি-চার্জ আরম্ভ হল। লালটুপি পরা বিহারি পুলিশ তাদের লম্বা-লম্বা লাঠি মাটিতে ঠুকে ঠুকে সহানুভূতির সুরে বলতে লাগল : বাবুজি, আপলোগ কিউ নহি চলে যাতে, চলা যাইয়ে, চলা যাইয়ে। অন্যদিকে হেলমেট-পরা সার্জেন্টরা মোটা-মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে মারধর শুরু করে দিল। 

মিছিল ছত্রভঙ্গ হবার পরে আমরা দু’একজন পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে কার কোথায় কতটা লেগেছে দেখছিলাম, যাকে বলে ‘লিকিং আওয়ার উণ্ডস্’। হঠাৎ একটি লোক আমার পাশ থেকে একটা ঢিল ছুঁড়ে দিল। তৎক্ষণাৎ তিনজন সার্জেন্ট দৌড়ে এসে আমাকে ঘিরে ফেলে দ্বিতীয় দফায় প্রহার আরম্ভ করল। শেষ মারটা পড়ল মাথায়, চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। যখন একটু সংবিৎ ফিরে পেলাম, দেখি আমার সহপাঠী নারায়ণকুমার চন্দ্র আমাকে ধরে আছে। তার কাঁধে ভর দিয়ে কলেজে ফিরে এলাম। ইমারজেন্সিতে ডিউটি অফিসার ডাক্তার ইব্রাহিম আমাকে পরীক্ষা করেই ভেতরের ঘরে শুইয়ে দিলেন। আমার বমি হতে আরম্ভ করল। একটু পরেই পুলিশ এসে ইমারজেন্সিতে কোনো আহত বিক্ষোভকারী এসেছে কি না খোঁজ নিতে এল। খবরটা শুনেই ডাক্তার ইব্রাহিম আমাকে আরও ভেতরে তাঁর নিজের ঘরে সরিয়ে ফেললেন। 

রাত প্রায় ন’টা হবে, শহরের পরিস্থিতি খানিকটা শান্ত হবার পরে বসুবাড়ির বিশেষ বন্ধু প্রভাসচন্দ্র বসুর গাড়িতে করে আমি বাড়ি ফিরলাম। মা ও বাড়ির অন্য সবাই সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, আর আমি অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে ওপরে উঠছি। এই দৃশ্যটি বেশ মনে আছে আমার। 

৫২

পুলিশের হাতে মারধর খেয়ে আমি তো আহত সৈনিকের মতো দিনকতক বাড়িতে শয্যাশায়ী। খবরটা যে কেবল তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ল তাই নয়, গুজব রটে গেল যে, আমি মারা গেছি। ব্যাপারটা ঘটবার পরের দিন আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে কেউ-কেউ ভয়ে ভয়ে বাড়িতে টেলিফোন করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খবর নিতে লাগলেন কথাটা সত্যি কি না। পরে বর্ধমানের এক বন্ধু জানালেন যে, সেখানে আমার জন্য শোকসভাও হয়ে গেছে। যাঁরা আমাকে বাড়িতে দেখতে আসছিলেন তাঁদের কাছ থেকে আমি খবরাখবর নিচ্ছিলাম। বাংলার ও বাংলার বাইরে নানা জায়গায় জনসাধারণ কী বীরত্বের সঙ্গে বিদেশী সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন সে-সব শুনে আমরা খুবই গর্বিত হচ্ছিলাম। 

পরে, ১৯৪৩ সালে, যখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন বাবা বললেন যে, মাদ্রাজের এক খবরের কাগজে তিনি কলকাতায় মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উপর পুলিশের হামলার বিষয় পড়েছিলেন। পড়েই তাঁর মনে হয়েছিল এবং তিনি তাঁর জেলের সাথী, লালা শঙ্করলালকে বলেছিলেন যে, তাঁর ধারণা আমি নিশ্চয়ই ঐ সংঘর্ষের মধ্যে ছিলাম। তাঁর বিশ্বাস ছিল তাঁর ছেলে এরকম কোনো ব্যাপারে পিছিয়ে থাকবে না বা নিজের গা বাঁচাবার চেষ্টা করবে না। বাবার কথা শুনে আমি মনে খুব বল পেয়েছিলাম। 

অন্য দিকে রাঙাকাকাবাবু বোম্বাই কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব পাশ হওয়ার ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত দৃপ্ত বেতারভাষণে তাঁর দেশবাসীকে গান্ধীজির ডাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান। পরে গান্ধীজির উদ্দেশে এক বেতার-ভাষণে রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন, তিনি যখন শুনলেন, মহাত্মাজি স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত গণ-সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন তখনই তাঁর মনে হল যে, জগতের কাছে, সমগ্র মানবসমাজের কাছে ভারতের মুক্তিসংগ্রামীদের সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর আগেই সিঙ্গাপুর পতনের পর তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে রাঙাকাকাবাবু সেই সময়কার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও আমাদের জাতীয় কর্তব্য সম্বন্ধে পরিষ্কার করে বলেছিলেন। তাঁর মূল কথা ছিল যে, ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। বহুদিনের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন জাতি হিসাবে জগৎসভায় আসন নেবার এক অপূর্ব সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। ঐ সন্ধিক্ষণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শত্রুরা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মিত্র, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মিত্ররা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের শত্রু। ঐ সঙ্কট-মুহূর্তে কেউ কেউ নিজেদের সুবিধাবাদী-নীতি ও ভারুতা ঢাকবার জন্য চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার দোহাই দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা ভারতবর্ষের যথার্থ প্রতিনিধি নন। দেশের আপামর জনসাধারণ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে চান এবং শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। তিনি ডাক দিয়ে বলেছিলেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার লগ্ন আসন্ন। ভারতের মুক্তি সমগ্র মানব-সমাজের মুক্তির পথ সুগম করবে। 

সেই বিপদের দিনে রাঙাকাকাবাবুর কণ্ঠ ও উদাত্ত আহ্বান আমাদের মনে বল দিত ও আশার সঞ্চার করত। তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য আমরা কান পেতে থাকতাম। কীভাবে ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, কী কী উপায়ে শত্রুপক্ষকে বিপদে ফেলা যায় ইত্যাদি নিয়ে তিনি নিয়মিত আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে বক্তৃতা করতেন। অন্য দিকে জাপানে ও পূর্ব এশিয়ার নানা দেশ, ইন্দো-চীন, মালয়, শ্যাম, বর্মা থেকে প্রবাসী মুক্তিসংগ্রামী ভারতীয়রাও রেডিও মারফত প্রচার আরম্ভ করেছিলেন। বেশ কয়েকবার জাপন ও সিঙ্গাপুর থেকে রাসবিহারী বসুর বক্তৃতা শুনেছি মনে আছে। বাইরের রেডিও শুনে বেশ বোঝা যেত যে, প্রবাসী ভারতীয়রা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশ নেবার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চালাচ্ছেন। 

দিন-দশেক বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে আগস্ট মাসের শেষাশেষি আমি আবার মেডিকেল কলেজে যাওয়া-আসা শুরু করলাম। চারিদিকে তখন খুব উত্তেজনা। দেখলাম ছাত্রমহলে বিদ্রোহ জাগিয়ে রাখবার নানা রকম পরিকল্পনা চলছে। মেডিকেল কলেজের ইংরাজ সুপারিনটেনডেন্টের সঙ্গে ছাত্রদের মাঝে-মাঝে সংঘর্ষ হত। ছাত্ররা মেডিকেল কলেজের বড় থামওয়ালা বাড়ির ছাদে জোর করে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর চেষ্টা করায় সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের সঙ্গে বড় রকমের ঝগড়া হয়। গোয়েন্দাদের কার্যকলাপও সঙ্গে-সঙ্গে বেড়ে যেতে থাকে এবং কলেজের মধ্যে টিকটিকিদের আনাগোনা খুবই নজরে পড়তে থাকে। 

আমাদের মধ্যে যারা গোপন প্রস্তুতির কাজে বিশ্বাসী ছিলাম, ক্লাসের পরে সন্ধ্যায় বৈঠক করতাম। আমি রেডিও মারফত যে-সব খবর পেতাম, অন্যদের জানাতাম। সরকারি যোগাযোগ-ব্যবস্থা যথাসময়ে কী উপায়ে নষ্ট করে দেওয়া যায়, এ-সব নিয়ে আলোচনা হত। বিস্ফোরক পদার্থ সংগ্রহের ব্যবস্থাও কেউ-কেউ করেছিলেন এবং পরীক্ষামূলকভাবে এখানে-সেখানে সেগুলি ব্যবহারও করা হয়েছিল। আমরা বড় স্বপ্ন দেখতাম। যেমন, উপযুক্ত সময়ে রাইটার্স বিল্ডিংটা ডাইনামাইট দিয়ে আমরা উড়িয়ে দেব, এই ধরনের প্রায় অসম্ভব প্ল্যান নিয়েও আমাদের মধ্যে আলোচনা হত। 

সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। নিজের শরীরটা বিশেষ ভাল নেই। ক’দিন থেকেই গায়ে জ্বর-জ্বর লাগছে। একদিন ভোররাতে শুয়ে শুয়ে মনে হল বাড়ির চারিদিকে যেন হাঁটাচলার আওয়াজ পাচ্ছি। একটু ফর্সা হতে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি লালপাগড়িতে ছেয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি মাকে খবর দিলাম। বোঝাই গেল বাড়ি সার্চ হবে। কাবুল থেকে বাবাকে লেখা রাঙাকাকাবাবুর চিঠিটা তখনও মা’র কাছে আছে। আরও কিছু কাগজপত্র ছিল যেগুলি পুলিশের হাতে না পড়াই ভাল। মা তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে রাঙাকাকাবাবুর চিঠি ও অন্য কিছু কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলে বিসর্জন দিলেন। একটু পরেই নীচের তলা থেকে খবর এল যে, পুলিশ এসেছে, ডাকাডাকি করছে। ১৯৩২-এ বাবাকে যখন প্রথমবার গ্রেপ্তার করে সেই সময় খানাতল্লাশিটা মূলত নীচের তলায় হয়েছিল। এবার দেখা গেল তাদের নজর উপর তলার দিকে এবং আমিই যেন তাদের লক্ষ্য। আমার বই, কাগজপত্র বেশ কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করল। কয়েকটি বই ও পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করল। রাঙাকাকাবাবুর ৯ আগস্টের বেতার-ভাষণ কপি করে টাইপ করে আমার টেবিলে রেখেছিলাম, পরে প্রচার করার উদ্দেশ্যে। খুব ভাগ্যের কথা যে, ঐ কাগজটির উপর তাদের নজর পড়ল না। সার্চ শেষ করে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার আমাকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা দেখাল। আমি তো অনেকদিন থেকেই মনে মনে গ্রেপ্তারের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। নিজের ভাগ্যে কী আছে তা নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন হইনি। তবে মা’র মনের অবস্থা অনুমান করে বিচলিত হতাম। অবশ্য জানতাম যে, তাঁর সহ্যশক্তি অসীম, ঠিক চালিয়ে যাবেন। বিদায় নেবার সময় কিছুক্ষণ তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম, একটু হাসলাম। মা কিন্তু হাসতে চেষ্টা করেও পারলেন না, ঠোঁট চেপে রইলেন; চোখে জল এল, কিন্তু পড়ল না। এই অবস্থায় মা’কে আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। 

প্রথমে তারা লর্ড সিন্হা রোডের গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে গিয়ে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখল। কিছু বাদে প্রশ্নও করল। দুপুরের পর আমাকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে গিয়ে হাজির করল। জেল অফিসে কিছু কথাবার্তার পর আমাকে ‘বড়াহ্-হাজত’-এ নিয়ে গেল। লম্বা একটা ব্যারাক, দেখি সেখানে অনেক বন্দী রয়েছেন। আমাকে দেখেই এগিয়ে এলেন সুরেশচন্দ্র মজুমদার, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। “এ কী, তুমিও এলে!” বলে সুরেশবাবু আমি কোথায় কীভাবে থাকব এ নিয়ে বিতর্ক আরম্ভ করে দিলেন। একটু পরেই কিন্তু সুরেশবাবু আবিষ্কার করলেন যে, আমার গায়ে বেশ জ্বর। চেহারাটাও যে ভাল দেখাচ্ছিল, তা নয়। অবস্থাটা বুঝে বন্দীরা সকলে মিলে দাবি জানালেন যে, আমাকে হসপিটাল ওয়ার্ডে রাখতে হবে। জেলারকে ডেকে পাঠানো হল। জেল কর্তৃপক্ষ রাজি হয়ে গেলেন, আমি হসপিটাল ওয়ার্ডের দোতলায় এককোণে জায়গা পেলাম। 

জেল হাসপাতালের অভিজ্ঞতা ভোলবার নয়। প্রথম কয়েকদিন একটু-আধটু ওঠাউঠি করতে পারতাম। দু’দিন পরে মা’র সঙ্গে জেল অফিসে একটা ইন্টারভিউও হল। মা’কে জানালাম আমার জ্বর ও মাথাব্যথা বাড়ছে, উঠে আবার দেখা করতে আসতে পারব কি না জানি না, তিনি যেন মন্ত্রিসভায় বাবার মনোনীত সদস্যদের জানান ও ব্যবস্থা নিতে বলেন। 

হসপিটাল ওয়ার্ডে বেশ কয়েকজন কমবয়সী উৎসাহী বন্দী ছিলেন। আমার প্রচণ্ড মাথাধরার মধ্যেও তাঁরা আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা চালাতেন। জেলের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তারটি মাঝে-মাঝে ঘুরে যেতেন। হসপিটাল ওয়ার্ডের কর্তা আসলে ছিলেন একজন পুরনো কয়েদী। আসলে হাতুড়ে হলেও বছরের পর বছর জেলের রোগীদের ওষুধপত্র দিতে দিতে আধা-ডাক্তার বনে গিয়েছিলেন। যাই হোক, প্রকৃতির নিয়মে আমার রোগ ক্রমে-ক্রমেই বাড়তে লাগল এবং আমি শেষ পর্যন্ত একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম। 

সুদূর দক্ষিণ ভারতে বন্দী বাবা আমার গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। বাবা ও মা তো গোপন কথাগুলি জানতেন। সেজন্য তাঁদের চিন্তার অবধি ছিল না। তবে আমি কারারুদ্ধ হবার পরে চিঠিতে আমাকে আশীর্বাদ জানিয়ে বাবা আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, আমি কারাযন্ত্রণা ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে সহ্য করব। 

৫৩

মৃত্যুর খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ালে সত্যিই মৃত্যুকে ভয় হয় না, মনটা কেমন যেন উদাস ও শান্ত হয়ে যায়। প্রেসিডেন্সি জেলের হসপিটাল ওয়ার্ডে বিছানায় টাইফয়েড জ্বরে মারাত্মক দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার মনের ভাব সেইরকমই হয়েছিল। জেলের ডাক্তার মাঝে-মাঝে এসে কী যে দেখে যান বুঝি না। ভারপ্রাপ্ত কয়েদি ওয়ার্ডার এটা-ওটা ওষুধপত্র দেন, আমি খেয়েও নিই। কিন্তু ধুম-জ্বর ও মাথার যন্ত্রণা কিছুতেই কমে না। রোজ সন্ধ্যায় লক-আপের আগে লোহার ডাণ্ডা দিয়ে ব্যারাকের গরাদগুলো ঠুকে-ঠুকে ‘বার-টেস্টিং’ করে, মানে দেখে গরাদগুলো সব ঠিক আছে কি না। আমার মাথার ঠিক উপরেই একটা বড় গরাদের জানালা। ‘বার-টেস্টিং’-এর সময় সে কী বিকট আওয়াজ। মনে হয়, মাথায় যেন কেউ লাঠি মারছে। বললাম, “ওটা বন্ধ করা যায় না?” উত্তর হল, “ওটা করতেই হবে, নিয়ম!” 

একদিন হাফ-ডাক্তার ওয়ার্ডারবাবুর মনে হল আমাকে কড়া জোলাপ দেওয়া দরকার, সুতরাং পুরো মাত্রায় ‘সাইডলিস্‌’ পাউডার খাইয়ে দিলেন। দিয়েছেন যখন, খেয়েই নিলাম, যদিও সম্প্রতিই আমাদের কলেজে পড়ানো হয়েছে যে, টাইফয়েড সন্দেহ হলে, কড়া জোলাপ দেওয়া মানা। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছি বুঝতে পারছি। জেলর বা ডেপুটি জেলর এলেই আমি বলি যে, মন্ত্রী সন্তোষকুমার বসুকে যেন অনুরোধ করা হয় আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। আমার সত্যিই মনে হয়েছিল যে, জেলের হাসপাতালে থাকলে আমার বাঁচবার আশা নেই। বাড়ি থেকেও এ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা হচ্ছিল, আমি পরে জেনেছিলাম। যাই হোক; শেষ পর্যন্ত একদিন আমাকে জানানো হল আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল ডাক্তার উমাপ্রসন্ন বসু আমাকে পরীক্ষা করতে আসবেন। কানাঘুষা শুনলাম, হোম ডিপার্টমেন্টের সাহেবরা নিশ্চিন্ত হতে চান যে, আমার সত্যিই খুব অসুখ, ভান করছি না। প্রিন্সিপাল সাহেব এসে তো আমাকে খুব ভাল করে পরীক্ষা করলেন। আমি ক্ষীণস্বরে একবার তাঁকে বললাম যে, আপনারাই তো পড়িয়েছেন টাইফয়েডের দ্বিতীয় সপ্তাহে গায়ে র‍্যাশ হয়, আমারও হয়েছে দেখছি, তাহলে কি আমার টাইফয়েড হয়েছে? তিনি মাস্টারসুলভ বকুনির সুরে বললেন, “তোমার টাইফয়েড হয়েছে কি হয়নি, তা নিয়ে তোমার মাথাব্যথার দরকার নেই, সেটা আমরা দেখব। তুমি যেমন-যেমন বলে যাচ্ছি ওষুধপত্র খাও। তারপর আমি দেখছি কী উপায় করা যায়।” 

দু-তিনদিন পরে ডেপুটি-জেলর এসে জানালেন, আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবার হুকুম এসেছে। আমার তখন আর ওঠবার শক্তি নেই।স্ট্রেচারে করে জেল থেকে আমাকে বের করে নিয়ে এসে একটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে বন্দুকধারী দুই সিপাই আমার পাশে বসল। মনে মনে হাসলাম, এ একেবারে তাসের দেশ, নিয়মের ব্যতিক্রম হবার উপায় নেই। 

মেডিকেল কলেজের এমার্জেন্সি রুমে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ ফেলে রাখল। আমি ডিউটি-অফিসারকে বারে বারে বলবার চেষ্টা করলাম যে, বন্দী হলেও আমি যখন এ-কলেজের ছাত্র, আমাকে যেন ডাক্তার মণি দে-র ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার দে আমাদের পরিবারের বহুদিনের বন্ধু ও ডাক্তার, তার উপর আমাদের মেডিসিনের অধ্যাপক। তাঁর উপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস। শুনলাম উপরওয়ালার হুকুম, তা হবে না, ডাক্তার ওয়াহেদের অধীনে আমাকে ভর্তি করা হবে। ডাক্তার ওয়াহেদও আমাদের শিক্ষক, তবে আলাপ-পরিচয় কম। যাই হোক, ডাক্তার ওয়াহেদ খুব যত্নের সঙ্গে আমার দেখাশুনা করেছিলেন। তাঁর নিজের অধিকার প্রয়োগ করে ডাক্তার দে’-কে ডেকে আমাকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়েছিলেন। আমাকে বলেওছিলেন, ডাক্তার দে’র সঙ্গে পরামর্শ করেই আমি তোমার চিকিৎসা করছি। মেডিকেল কলেজে বেশ কিছুদিন আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মা ও নিকট-আত্মীয়স্বজনেরা আমাকে একবার করে দেখে যাবার অনুমতি পেয়েছিলেন। আমার ক্যাবিনের সামনে দিনরাত একটা লালপাগড়ি বসে থাকত ও মাঝে-মাঝে উঁকি-ঝুঁকি মারত। ঘোরের মধ্যেও আমি যুদ্ধের গতি ও রাঙাকাকাবাবুর কার্যকলাপ সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতাম। সেই সময় স্টালিনগ্রাডে জার্মান ও রাশিয়ানদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য এমন মরণপণ লড়াই আর হয়েছে কি না সন্দেহ। মনে আছে আমি গীতাকে প্রায় রোজই জিজ্ঞাসা করতাম, আজ কোন সেকটরে লড়াই হচ্ছে, কোন এলাকা.কার হাতে গেল ইত্যাদি। রাঙাকাকাবাবুর বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে কি না, তিনি কী বলছেন ইত্যাদিও জিজ্ঞাসা করতাম। পরে শুনেছি ওরই মধ্যে দু’তিনদিন আমার অবস্থা এমনই সঙ্কটাপন্ন হয়েছিল যে, বাড়িতে বলে দেওয়া হয়েছিল কখন কী হয় বলা যায় না, সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে। মা ও ছোটরা তখন কলেজ স্কোয়ারে মামার বাড়িতে এসে আছেন। মা তো দেখবার সময় চুপচাপ বসে থাকতেন, আর মামিমা পূজোর ফুলটুল প্রায়ই আমার বালিশের তলায় গুঁজে দিয়ে যেতেন। 

.

দক্ষিণ ভারতের বন্দিশালা থেকে বাবার কাছ থেকে গোপন-বার্তা মাঝে-মাঝে মা’র হাতে এসে পৌঁছত। বাবা ও রাঙাকাকাবাবু এ-সব ব্যাপারে বেশ পটু ছিলেন। সাদা কাগজে টাইপ করা বা বড় অক্ষরে লেখা বার্তাগুলি কোনো লোকের মারফত আসত অথবা ভিন্ন-ভিন্ন জায়গা থেকে ডাকে আসত। আমার অবস্থা বুঝে মা আমাকে মাঝে-মাঝে গোপন খবর কিছু-কিছু জানিয়ে যেতেন। একবার তো টাইপ করা একটা কাগজ রাত্রে পড়ে রাখার জন্য আমাকে দিয়ে গেলেন, আমি সেটা বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখলাম। ১৯৪২-এর নভেম্বরের ঐ গোপন চিঠিতে বাবা অনেক চাঞ্চল্যকর কথা লিখেছিলেন। রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধান ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে ইংরাজ সরকার কীভাবে খবর সংগ্রহ করছিল, দলের লোকদের লাহোর কোর্ট বা দিল্লির রেড ফোর্টে ধরে নিয়ে গিয়ে কী সব কাণ্ডকারখানা করেছিল, কী কী তারা জানতে পেরেছে ইত্যাদি অনেক কথা জানিয়েছিলেন। বাবার খবরের সূত্রটা সম্ভবত ছিলেন লালা শঙ্করলাল, যাঁকে পাঞ্জাবের জেলে কিছুদিন রেখে পরে ইংরাজ সরকার বাবার সহবন্দী করে দক্ষিণে পাঠিয়ে দিয়েছিল। শঙ্করলাল দিল্লির একজন বিশিষ্ট প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ছিলেন। পরে তিনি রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানের কিছুদিন আগে তিনি গোপনে নাম ভাঁড়িয়ে জাপান গিয়েছিলেন। বাবার ঐ বার্তায় মিঞা আকবর শাহ ও অন্যান্য কয়েকজনের উল্লেখ ছিল। বাবা জানিয়েছিলেন যে, ইংরাজ সরকার রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানে আমার ভূমিকার কথা জানে। সুতরাং আমার টাইফয়েড হওয়াটা হয়তো ‘ব্লেসিং ইন ডিসগাইস্’ অথবা মন্দের ভাল হয়েছে। নয়তো খুব সম্ভব ওরা আমাকে লাহোরে চালান করে দিত। 

.

ডাক্তাররা যখন বললেন আমি বিপন্মুক্ত, তখন যেন পুনর্জন্মের পরে আবার উঠে বসতে শিখলাম। সরকার ঠিক করলেন যে, আমাকে গৃহবন্দী করা হবে। উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আমি ফিরে গেলাম। হুকুম হল যে, সরকারের অনুমতি ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারব না। তখন অবশ্য আমার ঘোরাফেরার অবস্থা ছিল না। তাহলেও গোয়েন্দা-বিভাগের একজন ইন্সপেকটর উডবার্ন পার্কে নিয়মিত এসে দেখে যেতেন যে, আমি সশরীরে সেখানে আছি। অন্তরীণের যে হুকুমটা আমার উপর ১৯৪৩-এর জানুয়ারিতে জারি করা হল, তার মেয়াদ ছিল এক বছর। 

জাপানি ফৌজ তখন বর্মার সীমান্তে দাঁড়িয়ে। ১৯৪২ সালেই কলকাতা, পূর্ব ভারতের অন্য কয়েকটি জায়গা ও সিংহলে ছোটখাটো বিমান-আক্রমণ হয়েছিল। ১৯৪২-এর ডিসেম্বরের শেষে এক সন্ধ্যায় কলকাতায় জাপানিরা কয়েকটা বোমা ফেলল। বিমান-আক্রমণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে প্রত্যেক বাড়ির নীচের তলায় একটা ঘর আশ্রয় নেবার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখবার আদেশ জারি হয়েছিল। অসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার লোকজনেরা বাড়িতে এসে একটা ঘর বেছে দিয়ে যেতেন। ঘরের কোনো খোলা দিক থাকলে সেদিকটায় একটা দেওয়াল তুলতে হত, এগুলোকে বলা হত ‘ব্যা-ওয়াল,’ বোমার টুকরো আটকাবে। তা ছাড়া হাতের কাছে বালির বস্তা, দু-চার বালতি জল, কিছু শুকনো খাবার-দাবার আশ্রয়-ঘরটির মধ্যে বা কাছেই রাখা থাকত। কাঁচের জানালার উপর কাপড় সেঁটে দেওয়া হত, ভাঙা উড়ন্ত কাঁচ থেকে বাঁচবার জন্য। ব্ল্যাক-আউটের জন্য বাড়ির সব আলোতে কালো কাগজের ঢাকা লাগানো থাকত। মাঠে-ঘাটে ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছিল, যাতে বিমান-আক্রমণের সময় কেউ বাইরে থাকলে আশ্রয় নিতে পারেন। 

.

১৯৪২-এর ডিসেম্বরে বড়দিনের রাতে আসন্ন বিমান আক্রমণের সাইরেন বাজল। আমরা সকলে নীচে নেমে আশ্রয়-ঘরে জড় হলাম। আমি তখনও পুরোপুরি সুস্থ হইনি, কষ্ট করেই নামলাম। পাশেই উডবার্ন পার্কে সাউথ ক্লাব। ক্লাবের বেয়ারা, মালি সকলে আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিল। হঠাৎ খুব কাছাকাছিই যেন বেশ জোরে একটা বোমা পড়ার আওয়াজ হল। ক্লাবের এক বেয়ারা হাততালি দিয়ে আনন্দে বলে উঠল, ঠিক মেরেছে, জাপানিরা তো জানে আজ বড়দিনে সাহেব-মেমেরা ফিরপোতে নাচগান করছে, ফিরপো উড়িয়ে দিয়েছে। বোমাটা অবশ্য ফিরপোতে পড়েনি। আসল কথাটা হল যে, খয়ের খাঁর দল আর কতকগুলি সুবিধাবাদী হঠকারী রাজনীতিজ্ঞ ছাড়া দেশের অধিকাংশ সাধারণ লোক চাইছিল যে, যুদ্ধে যেন ইংরাজদের হার হয়। 

রাঙাকাকাবাবু জার্মানি থেকে তাঁর বেতার-বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, দেশের নানা জায়গায়, বিশেষ করে কলকাতায় বোমা ফেলতে হচ্ছে বলে তিনি ব্যথিত। কলকাতার কথা বলতে গিয়ে তিনি এই শহরের ও শহরবাসীদের প্রতি তাঁর অন্তরের টানের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, কলকাতাতেই তাঁর কর্মজীবনের বেশির ভাগটা কেটেছে, কলকাতার সব অলিগলিই তাঁর পরিচিত। তবে আমাদের শত্রু কলকাতায় ও অন্য নানা জায়গায় সমরসম্ভার গড়ে তুলছে বলে বোমা ফেলতে হতে পারে। আসলে কিন্তু জাপানিরা কলকাতার উপর বেশি বোমা ফেলেনি। আমরা চাইছিলাম যে, কলকাতা ও পূর্ব ভারতের সব সামরিক ঘাঁটির উপর যেন জোর আক্রমণ হয়। যুদ্ধ ঘনিয়ে উঠলেই বিপ্লবাত্মক কাজের সুবিধা। পরে শুনেছি রাঙাকাকাবাবুই নাকি জাপানিদের বলেছিলেন মানবিকতার খাতিরে কলকাতার উপর বেশি বোমাটোমা যেন না ফেলা হয়। যে কারণেই হোক, আমাদের দেশে বোমাবর্ষণ খুব কমই হয়েছিল। কিন্তু বোমার ভয়ে ১৯৪২-৪৩ সালে হাজার-হাজার লোক তল্পিতল্পা গুটিয়ে পশ্চিমে পালিয়ে গিয়েছিলেন। 

৫৪

১৯৪৩ সালের মার্চ মাস। রেডিওতে বার্লিন থেকে রাঙাকাকাবাবুর বক্তৃতা শুনে কেমন যেন খটকা লাগল। মনে হল যেন পুরানো কোনো রেকর্ড করা বক্তৃতা শুনছি। রাঙাকাকাবাবু প্রতিবার বক্তৃতার প্রথমে যুদ্ধ-পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতেন। তারপর ভারতবর্ষের ভিতরকার আলোচনা করে নিজের মন্তব্য পেশ করতেন, এবং শেষে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য তিনি কী করছেন তার একটা আভাস দিয়ে বিদায় নিতেন। যে বক্তৃতাটা শুনলাম তাতে কোনো নতুন কথা নেই, জানুয়ারি মাসের পরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার উল্লেখ নেই। হঠাৎ আমার মনে হল, রাঙাকাকাবাবু ইউরোপ ছেড়ে এশিয়ার পথে পাড়ি দিয়েছেন। আমি সেই রাতেই মাকে ও গীতাকে আমার অনুমানের কথা বললাম। আমি অবশ্য তখন মনে করেছিলাম যে, রাঙাকাকাবাবু খুব সম্ভবত তুরস্ক ও সোভিয়েট সাইবেরিয়ার মধ্য দিয়ে জাপান যাচ্ছেন। তখনও রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে খোলাখুলি কোনো ঝগড়া নেই। সাবমেরিনে এতটা পথ যাত্রার কথা কী করেই বা মনে আসবে? 

১৯৪৩-এর ২৬ জানুয়ারি আমাদের স্বাধীনতা-দিবসে রাঙাকাকাবাবু বার্লিনে এক বিরাট অনুষ্ঠানে তাঁর ইউরোপ-প্রবাসের শেষ বক্তৃতা দেন। পুরো অনুষ্ঠানটি বার্লিন রেডিও প্রচার করেছিল, এবং আমরা শুনেছিলাম। মূল বক্তৃতাটি তিনি জার্মান ভাষায় দিয়েছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি বয়ানটা আমাদের জন্য প্রচার করেছিলেন। সেই সময়কার ইউরোপের কূটনীতিকরা তো সভায় উপস্থিত ছিলেনই, পশ্চিম-এশিয়ার স্বাধীনতা-সংগ্রামী কয়েকজন বিশিষ্ট নেতাও সভায় যোগ দিয়েছিলেন। ঐ সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বাজানো হয়েছিল, বাজিয়েছিলেন বার্লিনের রেডিও অর্কেস্ট্রা। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের এত ভাল অর্কেস্ট্রা আমি আর শুনেছি বলে মনে পড়ে না। 

১৯৪৩ সাল যতই এগোতে লাগল, দেশের অবস্থা ততই সঙ্কটাপন্ন হতে লাগল। ইংরেজ সরকার জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধে খুবই বিব্রত, সে-জন্য জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের উপর খড়্গহস্ত। একদিকে যুদ্ধের স্বার্থে চলছে নির্মম জনগণের শোষণ, অন্য দিকে কংগ্রেস নেতা ও হাজার হাজার কর্মী জেলে। জাতীয়তাবাদী বামপন্থী—রাঙাকাকাবাবুর অনুগামীদের মধ্যে যাঁরা বাইরে ছিলেন এবং কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির যে-সব নেতা ও কর্মীরা আত্মগোপন করেছিলেন তাঁরা বিপ্লবাত্মক কাজকর্ম চালাচ্ছিলেন। বাংলাদেশে রাঙাকাকাবাবুর একান্ত বিপ্লবী দল বি ভি বা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলেই একে-একে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। সরকারি গোয়েন্দাদের তো সর্বক্ষণ ঐ-সব দল ও লোকদের উপর সজাগ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বুঝতেই পারতাম আমাদের পিছনে সবসময়েই পুলিশ। এরই মধ্যে এই বাংলাদেশে এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটল। শত্রুর হাতে যাতে কিছু না পড়ে এই অজুহাতে ইংরেজ সরকার বাংলাদেশের মুখের গ্রাসও কেড়ে নিল। আমরা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়লাম। আমাদের কাছে আজও সেই সময়কার কলকাতার পথঘাটের দৃশ্য দুঃস্বপ্নের মতো। বাংলার পল্লীগ্রাম থেকে হাজার-হাজার লক্ষ লক্ষ কঙ্কালসার নারী, পুরুষ ও শিশু কলকাতার রাস্তায়-রাস্তায় এক বাটি ফেনের জন্য আর্তনাদ করে বেড়াচ্ছে। তাদের আকুল ডাক রাত্রের অন্ধকার ভেদ করে ক্রমাগতই কানে আসে, ঘুম হয় না। রাস্তায় কত যে মৃতদেহ দেখেছি তার হিসেব নেই। দেশপ্রেমী, সংগ্রামী সব মানুষ তখন বিদেশী সরকারের অত্যাচারে কোণঠাসা। সব দেখে ক্ষোভ ও চাপা ক্রোধে মন ভরে যেত, ভাবতাম আরও কত লোক তো দেশে রয়েছে, কেবল লঙ্গরখানা না খুলে তাঁরা আরও তো কিছু করতে পারেন। জগতের গণতন্ত্র রক্ষায় ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এত লোক তো গলাবাজি করছিলেন, ঘরে বসে ঘুষি পাকিয়ে জাপানের বিরুদ্ধে বিক্রম দেখাচ্ছিলেন, কিন্তু কই, বাংলার অনশনক্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ মানুষকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে কেউ ডাক দেননি। বিপ্লবের কথা দূরে থাক, সেই সময় এঁরা কেউ ঐ বর্বরোচিত গণহত্যার প্রতিবাদে একদিনের জন্যও ধর্মঘট বা হরতাল ডাকেনি। আমাদের মনে হত বিবেকানন্দ,দেশবন্ধু,সুভাষচন্দ্রের দেশটা ক্রীতদাসে ভরে গেল কী করে? যে দিকে চেয়ে দেখি, কেবলই ক্রীতদাস! অবশ্য তাদের জামার রঙ ভিন্ন ভিন্ন, কারুর সাদা, কারুর সবুজ, কারুর লাল। 

সব দুঃখ ও ক্রোধ ছাপিয়ে উঠত একটা আশা—রাঙাকাকাবাবু—আসবেন। তিনি তো বলেই দিয়েছেন আসবেন, খালি হাতে আসবেন না, বিজয়-খড়গ হাতে নিয়ে আসবেন, রক্তের বন্যা বেয়ে আসবেন। ক্রীতদাসের দেশ আবার বীরের দেশে পরিণত হবে। 

পারিবারিক দিক থেকেও ১৯৪৩ সালটা ছিল শোকের বছর। বছরটার মাঝামাঝি ইলার মৃত্যু হল, শেষের দিকে বিদায় নিলেন মাজননী। আগের বছরের গোড়াতেই একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। জ্যাঠাবাবু সতীশচন্দ্রের বড় ছেলে গণেশ, আমাদের মেজদা, হঠাৎ মারাত্মক রকমের মস্তিষ্কের অসুখে মারা গেলেন। ছোট ছেলে দ্বিজেন. তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী। মেজদার মৃতদেহের পাশে জ্যাঠাবাবু নিশ্চল হয়ে বসে আছেন, সে দৃশ্য দেখা যায় না। ‘কলকাতায় তখন বড়দের মধ্যে বিশেষ কেউ নেই। আমি তখনও পুরোপুরি সুস্থ হইনি। মেজদার শেষকৃত্য করবার জন্য ছোট ভাই দ্বিজেনকে চাই। আমিই দৌড়োদৌড়ি আরম্ভ করলাম। বাবারই হাতে গড়া মন্ত্রিসভা তখন রয়েছে। সন্তোষবাবু কলকাতায় নেই, বাবার মনোনীত অন্য মন্ত্রী-মহাশয় বিশেষ গা করলেন না। ফজলুল হক সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি পুলিশ সাহেবদের বললেন, বড় ভাইয়ের সৎকার করবার জন্য ছোটভাইকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ছুটি দেওয়া হোক। তারা তো কিছুতেই রাজি হয় না। বলে, এর দায়িত্ব তারা নিতে পারবে না, ভারত-সরকারকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। ফজলুল হক সাহেবকে দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে টেলিফোন করলাম। তিনি আমাকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে তাঁর ঘরে আসতে বললেন। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আমার সেই প্রথম প্রবেশ। গেটে বলা ছিল, সেজন্য ভিতরে যেতে অসুবিধা হল না। আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে শ্যামাপ্রসাদবাবু দিল্লিতে হোম সেক্রেটারি রিচার্ড টটেনহ্যামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চাইলেন! কথাবার্তা থেকে বুঝতেই পারছি, সাহেব রাজি হচ্ছেন না। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদবাবু ছাড়বার পাত্র নন। শুনে খুব ভাল লাগল যখন শ্যামাপ্রসাদবাবু জোরের সঙ্গে বললেন, এটা করতেই হবে, ‘দিস্ হ্যাস টু বি ডান!’ শেষ পর্যন্ত টটেনহ্যাম নিমরাজি হল, শ্যামাপ্রসাদবাবু আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। সারাদিন টানাপোড়েনের পরে বিকেলে পুলিশ-পাহারায় জেল থেকে বেরিয়ে এসে দ্বিজেন বড় ভাইয়ের শেষ কাজ করে আবার জেলে ফিরে গেল। শ্যামাপ্রসাদবাবুর সঙ্গে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর রাজনীতির ক্ষেত্রে মূলগত পার্থক্য ছিল, তাঁদের পথ ছিল ভিন্ন, কিন্তু আমাদের পারিবারিক ঐ বিপর্যয়ের সময় তাঁর দৃঢ়তা দেখে আমি বেশ অভিভূত হয়েছিলাম। 

আগেই বলেছি সেই সময় আমাদের আশার বাণী আসত বেতারে, রাঙাকাকাবাবুর কণ্ঠে। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আচমকা টোকিও রেডিও ঘোষণা করল যে, সুভাষচন্দ্ৰ বসু জাপানে পৌঁছে গেছেন। খবরটা শুনে আমরা সকলে উল্লসিত হয়ে উঠলাম। সারা রাত রেডিও শুনলাম। টোকিও রেডিওতে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ধরে এটাই ছিল প্রধান খবর। রাঙাকাকাবাবুর প্রত্যেকটি কথা ও ভঙ্গি, তাঁর চেহারার বিবরণ, তাঁর সংগ্রামের কাহিনী, এমন-কী তাঁর পোশাকের খুঁটিনাটি, টোকিও রেডিওর প্রোগ্রামে ভরে রইল। দিন দুয়েক পরেই রাঙাকাকাবাবু টোকিও রেডিও থেকে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় বক্তৃতা করলেন। সারা পূর্ব-এশিয়ার ভারতীয়দের ডাক দিলেন আসন্ন চূড়ান্ত সংগ্রামে শামিল হতে। আমাদেরও আশা হল বছরের শেষের দিকে স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হবে। কিছু দিনের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবু সিঙ্গাপুরে এসে নামলেন। তারপর থেকে প্রতিদিনই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, সাইগন, রেঙ্গুন, টোকিও, বাটাভিয়া প্রভৃতি রেডিও মারফত আমরা নতুন-নতুন খবর পেতে লাগলাম। সিঙ্গাপুরে ১৯৪৩-এর ৫ জুলাই আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম বড় প্যারেডে রাঙাকাকাবাবু যে বক্তৃতা দেন সেটা এখনও কানে বাজে। তখন শুনে মনে হয়েছিল, তিনি কত এগিয়ে গেছেন, দেশে আমরা কত পেছিয়ে পড়ে আছি। 

ইলার মৃত্যুর খবর রাঙাকাকাবাবু পেয়েছিলেন কি না জানি না। মাজননীর মৃত্যুর খবর তাঁর কাছে পৌঁছেছিল জানি, কলকাতা থেকেই এক গোপনবার্তার মাধ্যমে। দেশে ফেরার পরে দেবনাথ দাস বলেছিলেন, একদিন যথারীতি কাজকর্মের পরে অনেক রাত পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবু গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বসেছিলেন। হয়তো এমনিতে কারুকে কিছু বলতেনও না। দেবনাথবাবু বলে ফেলেন, “আজ আপনাকে বড়ই ক্লান্ত দেখাচ্ছে, শুয়ে পড়ুন।” উত্তরে রাঙাকাকাবাবু বললেন, “না, আমি ক্লান্ত নই, আজ খবর পেয়েছি আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।” 

১৯৪৩ সালের শেষের দিকে মাজননীর শরীর ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। নতুনকাকাবাবু ডাক্তার সুনীল বসু যখন বুঝলেন যে, তাঁকে বাঁচানো যাবে না তখন শেষ দেখার জন্য বাবাকে নজরবন্দী হিসাবে কলকাতায় আনবার চেষ্টা শুরু হয়। মাজননী বাবাকে একবার দেখবার জন্য আকুল হয়েছিলেন। বাঙালী ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করবে না বলে সাহেব ডাক্তার ডেনহ্যাম হোয়াইট-এর রিপোর্ট ভারত-সরকারকে পাঠানো হয়। কিন্তু হোম ডিপার্টমেণ্ট কিছুতেই বাবাকে কলকাতায় নিয়ে আসতে রাজি হয় না। বাবা জেলে থাকতে আমার মাও একবার ১৯৪৪-এ মরণাপন্ন হয়েছিলেন। বাবার নিজেরই মনে হয়েছিল, মা’র সঙ্গে হয়তো তাঁর আর দেখা হবে না। তখনও কিন্তু ইংরেজ সরকারের মন টলেনি। মা কোনো ক্রমে রক্ষা পেয়ে যান, কিন্তু মাজননীকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। মাজননীর মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা কয়েকটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর মা’র কথা তিনি ইংরেজ কবি শেলির ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন— 

“জীবনে তাঁকে আশাহীন সীমাহীন দুঃখ সহ্য করতে হয়েছে; 
মৃত্যু বা নিশার চাইতেও ঘনান্ধকার অন্যায় তিনি ক্ষমা করেছেন;
যে শক্তিকে মনে হয়েছে দুর্জয়, তা তিনি তুচ্ছ করেছেন; 
ভালবেসেছেন সয়েছেন; 
এবং তা তিনি জীবনান্ত পর্যন্ত করেছেন নম্রতা, ধর্মপরায়ণতা, জ্ঞান ও সহ্যশক্তির সঙ্গে।” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *